শঙ্খ ঘোষ এর কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

যমুনাবতী

নিভন্ত এই চুল্লীতে মা

একটু আগুন দে

আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি

বাঁচার আনন্দে।

নোটন নোটন পায়রাগুলি

খাঁচাতে বন্দী

দু’এক মুঠো ভাত পেলে তা

ওড়াতে মন দি’।

হায় তোকে ভাত দিই কী করে যে ভাত দিই হায়

হায় তোকে ভাত দেব কী দিয়ে যে ভাত দেব হায়

নিভন্ত এই চুল্লী তবে

একটু আগুন দে –

হাড়ের শিরায় শিখার মাতন

মরার আনন্দে।

দু’পারে দুই রুই কাৎলার

মারণী ফন্দী

বাঁচার আশায় হাত-হাতিয়ার

মৃত্যুতে মন দি’।

বর্গী না টর্গী না, যমকে কে সামলায়!

ধার-চকচকে থাবা দেখছ না হামলায়?

যাস্ নে ও-হামলায়, যাস্ নে।।

কান্না কন্যার মায়ের ধমনীতে আকুল ঢেউ তোলে, জ্বলে না-

মায়ের কান্নায় মেয়ের রক্তের উষ্ণ হাহাকার মরে না-

চলল মেয়ে রণে চলল।

বাজে না ডম্বরু, অস্ত্র ঝন্ ঝন্ করে না, জানল না কেউ তা

চলল মেয়ে রণে চলল।

পেশীর দৃঢ় ব্যথা, মুঠোর দৃঢ় কথা, চোখের দৃঢ় জ্বালা সঙ্গে

চলল মেয়ে রণে চলল।

নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল

মৃত্যুরই গান গা-

মায়ের চোখে বাপের চোখে

দু-তিনটে গঙ্গা।

দূর্বাতে তার রক্ত লেগে

সহস্র সঙ্গী

জাগে ধক্ ধক্, যজ্ঞে ঢালে

সহস্র মণ ঘি।

যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে

যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে

বিষের টোপর নিয়ে।

যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে

দিয়েছে পথ, গিয়ে।

নিভন্ত এই চুল্লীতে বোন আগুন ফলেছে।

বাবুমশাই

সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা!

বেঁচে ছিলাম ব’লেই সবার কিনেছিলাম মাথা

আর তাছাড়া ভাই

আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে

নতুন সমাজ, চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে

যাবে খোল-নলিচা

যাবে খোল-নলিচা পালটে, বিচার করবে নিচু জনে’

-কিন্তু সেদিন খুব কাছে নয় জানেন সেটা মনে

মিত্র বাবুমশয়

মিত্র বাবুমশয় বিষয়-আশয় বাড়িয়ে যান তাই

মাঝেমধ্যে ভাবেন তাদের নুন আনতে পান্তাই

নিত্য ফুরোয় যাদের

নিত্য ফুরোয় যাদের সাধ-আহ্লাদের শেষ তলানিটুকু

চিরটা কাল রাখবে তাদের পায়ের তলার কুকুর

সেটা হয় না বাবা

সেটা হয় না বাবা’ বলেই থাবা বাড়ান যতেক বাবু

কার ভাগে কী কম প’ড়ে যায় ভাবতে থাকেন ভাবুক

অমনি্ দু’চোখ বেয়ে

অমনি্ দু’চোখ বেয়ে অলপ্পেয়ে ঝরে জলের ধারা

বলেন বাবু ‘হা, বিপ্লবের সব মাটি সাহারা’

কুমীর কাঁদতে থাকে

কুমীর কাঁদতে থাকে ‘আয় আমাকে নামা নামা ব’লে

কিন্তু বাপু আর যাব না চরাতে-জঙ্গলে

আমরা ঢের বুঝেছি

আমরা ঢের বুঝেছি খেঁদীপেচী নামের এসব আদর

সামনে গেলেই ভরবে মুখে, প্রাণ ভ’রে তাই সাধো

তুমি সে-বন্ধু না

তুমি সে-বন্ধু না, যে ধুপধুনা জ্বলে হাজার চোখে

দেখতে পাবে তাকে, সে কি যেমন তেমন লোকে

তাই সব অমাত্য

তাই। সব অমাত্য পাত্রমিত্র এই বিলাপে খুশী

শুঁড়িখানাই কেবল সত্য, আর তো সবই ভূষি

ছি ছি হায় বেচারা’

ছি ছি হায় বেচারা? শুনুন যাঁরা মস্ত পরিত্রাতা

এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা

হেঁটে দেখতে শিখুন

হেঁটে দেখতে শিখুন ঝরছে কী খুন দিনের রাতের মাথায়

আরেকটা কলকাতায় সাহেব আরেকটা কলকাতায়

সাহেব বাবুমশয়।

সবিনয় নিবেদন

আমি তো আমার শপথ রেখেছি

অক্ষরে অক্ষরে

যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন

দিয়েছি নরক করে।

দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল

অন্যে কবে না কথা

বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে

সেটাই স্বাভাবিকতা ।

গুলির জন্য সমস্ত রাত

সমস্ত দিন খোলা

বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই

শান্তি শৃঙ্খলা ।

যে মরে মরুক, অথবা জীবন

কেটে যাক শোক করে—

আমি আজ জয়ী, সবার জীবন

দিয়েছি নরক করে ।

মহা নিমগাছ

ঈশানে নৈঋতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে

মাটির উপর মুখ রেখে

সে এখন শুয়ে আছে শেষ রাতের খোলা প্রান্তরে

আর কেউ নেই

শুধু তার পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ তারা

হাতের ডানায় লেগে আছে ঘাসের সবুজ, বুকে ভেজা মাটি এইটুকু ছাতা

যেন কোনো কোমলতা ছিল না কোথাও কোনোখানে

তারপর

আকাশ আর পৃথিবীর ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসে ভোর

এসে দেখে :

যেখানে সে পা দুখানি রেখেছে, সেখানে

কাল বিকেলের শেষ ঝড়ে

পড়ে আছে কুরে খাওয়া সনাতন মহা নিমগাছ ।

বিশ্বাস

আমার বিশ্বাস আছে আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।

আগুন কখনো তাই সততায় ডাকে না আমাকে।

যত দূরে যাই দেখি তোমার মুখর মুদ্রাগুলি

ঘরের শিয়রে, পথে, জাদুঘরে, জলের প্রবাহে।

তোমার হৃদয় কোনো অর্থবতা জেনেছে কি আজ?

নিঃস্বতায় মুছে গেছে হৃদয়ের কালাকাল সীমা?

জাগো, জেগে ওঠো, জাগো, অন্ধকার জাগরণে জাগো—

আমাদের পৃথিবীতে কখনো ফেরে না হিরোশিমা।

তোমার বিশ্বাস নেই তোমাকে বিশ্বাস করি আমি?

এই ঘূর্ণিচরাচরে আমার সমস্ত রাত্রি ঘিরে

মুনিয়ার ডানা সব ঝরে গেছে আণবী ছটায়—

তোমাকেই খুঁজি তবু শরীরেরও ভিতরে শরীরে।

ভবিতব্য

আগুন লেগেছে শূন্যে, আমোদে মেতেছে তটভূমি ।

হাড়পোড়া শব্দগন্ধ জড়িয়েছে গভীর আশ্লেষে

ঘুমন্ত মনেরও বোধ । মনে হয় একদিন তুমি

জলাধার হয়ে তবু দাঁড়াবে আমারই সামনে এসে ।

কতজনে জানতে চায় বেঁচে আছি আজও কি তেমনই —

অথবা কীভাবে আজও তোমাকেই ভেবেছি প্রবাহ !

তোমার সঞ্চয় তবে মিথ্যে থেকে মিথ্যে হয়ে এল ?

আমারও প্রতীক্ষা তবে শেষ থেকে হয়ে এল শেষ ?

আগুন ছড়ায় আরও, কোথাও কিছুই নেই বাকি

পুড়ে যায় চক্ষুতারা, পুড়ে যায় দূরে বনস্থলী —

তবুও কীভাবে আজও তোমাকেই ভবিতব্য ভাবি !

যে-কথা কারোরই কাছে বলা যায় না — কীভাবে তা বলি !

ত্রিতাল

তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু

শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া

তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু

বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া

পাতালমুখ হঠাত্ খুলে গেলে

দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া

তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই

শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।

শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে

তোমারই ঐ টুকরো-করা-শরীর

দু:সময়ে তখন তুমি জানো

হলকা নয়, জীবন বোনে জরি।

তোমার কোনো ধর্ম নেই তখন

প্রহরজোড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা-

মদ খেয়ে তো মাতাল হত সবাই

কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল !

সঙ্গিনী

হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়

সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়

এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে

সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয় |

পায়ের ভিতর মাতাল, আমার পায়ের নিচে

মাতাল, এই মদের কাছে সবাই ঋণী ––

ঝলমলে ঘোর দুপুরবেলাও সঙ্গে থাকে

হাঁ-করা ওই গঙ্গাতীরের চণ্ডালিনী |

সেই সনাতন ভরসাহীন অশ্রুহীনা

তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না ?

তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়

তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয় |

বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে

বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে

তোমার ধানের মুখে ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট

তুমি চোখ বন্ধ করো, আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি

যেন কোন্ তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস

সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে

মুহূর্ত এখানে এসে হঠাত্ পেয়েছে তার মানে

নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি

আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান

মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে

এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে ।

পালক

সবকিছু মুছে নেওয়া এই রাত্রি তোমার সমান।

সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি পড়ে। কখনো-কখনো

কাছে দূরে জ্বলে ওঠে ফসফরাস। কিছুরই কোথাও

ক্ষান্তি নেই। প্রবাহ চলেছে শুধু তোমারই মতন

একা একা, তোমারই মতন এত বিকারবিহীন।

যখনই তোমার কথা ভাবি তবু, সমস্ত আঘাত

পালকের মতো এসে বুকের ওপরে হাত রাখে

যদিও জানি যে তুমি কোনোদিনই চাওনি আমাকে।

জন্মদিন

তোমার জন্মদিনে কী আর দেব এই কথাটুকু ছাড়া

আবার আমাদের দেখা হবে কখনো

দেখা হবে তুলসীতলায় দেখা হবে বাঁশের সাঁকোয়

দেখা হবে সুপুরি বনের কিনারে

আমরা ঘুরে বেড়াবো শহরের ভাঙা অ্যাসফল্টে অ্যাসফল্টে

গনগনে দুপুরে কিংবা অবিশ্বাসের রাতে

কিন্তু আমাদের ঘিরে থাকবে অদৃশ্য কত সুতনুকা হাওয়া

ওই তুলসী কিংবা সাঁকোর কিংবা সুপুরির

হাত তুলে নিয়ে বলব, এই তো, এইরকমই, শুধু

দু-একটা ব্যথা বাকি রয়ে গেল আজও

যাবার সময় হলে চোখের চাওয়ায় ভিজিয়ে নেবো চোখ

বুকের ওপর ছুঁয়ে যাবো আঙুলের একটি পালক

যেন আমাদের সামনে কোথাও কোনো অপঘাত নেই আর

মৃত্যু নেই দিগন্ত অবধি

তোমার জন্মদিনে কী আর দেবো শুধু এই কথাটুকু ছাড়া যে

কাল থেকে রোজই আমার জন্মদিন।

আড়ালে

দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার

কোমলতাগুলি হারালে-

তোমাকে বকব, ভীষণ বকব

আড়ালে ।

যখন যা চাই তখুনি তা চাই ।

তা যদি না হবে তাহলে বাঁচাই

মিথ্যে, আমার সকল আশায়

নিয়মেরা যদি নিয়ম শাসায়

দগ্ধ হাওয়ার কৃপণ আঙুলে-

তাহলে শুকনো জীবনের মূলে

বিশ্বাস নেই, সে জীবন ছাই!

মেঘের কোমল করুণ দুপুর

সূর্যে আঙুল বাড়ালে-

তোমাকে বকব, ভীষণ বকব

আড়ালে ।।

তুমি আর নেই সে তুমি

তুমি বললে মানবতা

আমি বললে পাপ

বন্ধ করে দিয়েছে দেশ

সমস্ত তার ঝাঁপ

তুমি বললে হিটলারিও

জনপ্রেমে ভরা

আমি বললে গজদন্ত

তুমি বললে ছড়া ।

তুমি বললে বাঁচার দাবি

আমি বললে ছুতো

হামলে কেন এল সবাই

দিব্বি খেত শুত ।

হোক না জীবন শুকনো খরা

বন্ধ্যা বা নিষ্ফলা ।

আমি বললে সেপাই দিয়ে

উপড়ে নেবে গলা ।

তুমি বললে দণ্ডকে নয়

আপন ভূমিই চাই

আমি বললে ভণ্ড, কেবল

লোক খ্যাপাবার চাঁই ।

চোখের সামনে ধুঁকলে মানুষ

উড়িয়ে দেবে টিয়া

তুমি বললে বিপ্লব, আর

আমি প্রতিক্রিয়া ।

খাল

ভাঙা নৌকো পড়ে আছে খালের কিনারভরা

এখন সন্ধ্যার শত নাম;

তুমি আমি মুখোমুখি নই আর।

অবসাদ দিয়েছিলে মনে পড়ে, শুধু মনে পড়ে না কখন

অপরের হাত ধরে চলে গেছ নদীর জোয়ারে।

চারিদিকে সব জল ঠিক আছে নীরবতাময়।

মাঝে-মাঝে যেন কোনো হঠাৎ শুশুক

ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে যায় ব্যবহৃত সময়ের টান—

আমি যার নাম জানি সে কি জানে আমার হৃদয়?

খাল থেকে ছোটো খাল

আরো ছোটো ছোটো সব খালের ভিতরে

কিছু আর মুখোমুখি নয়

আড়ালে অদৃশ্য জালে ঢাকা আছে বীজাণুর কাল—

এখন নদীর দিকে ভালোবাসা প্রতিহত হয়।

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

… তোমার জন্যে গলির কোণে

ভাবি আমার মুখ দেখাব

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

একটা দুটো সহজ কথা

….বলব ভাবি চোখের আড়ে

জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে

বিজ্ঞাপনে,রংবাহারে।

কে কাকে ঠিক কেমন দেখে

…. বুঝতে পারা শক্ত খুবই

হা রে আমার বাড়িয়ে বলা

হা রে আমার জন্ম ভূমি।

বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া

…. তোমার সাথে ওতপ্রত

নিয়ন আলোয় পণ্য হলো

যা কিছু আজ ব্যাক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে

…. রইলো পড়ে গলির কোণে

ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু

ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।

চুপ করো, শব্দহীন হও

এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও

মাতাল

আরো একটু মাতাল করে দাও। 
নইলে এই বিশ্বসংসার
সহজে ও যে সইতে পারবে না !

এখনো যে ও যুবক আছে প্রভু !
এবার তবে প্রৌঢ় করে দাও—
নইলে এই বিশ্বসংসার
সহজে ওকে বইতে পারবে না।

মন্তব্য: