মহাদেব সাহার কাব্যভাষায় ‘প্রেম’

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সাগর জামান

মহাদেব সাহা ষাটের দশকে, কবিতায় নানামাত্রিক আবেদনের স্ফুরণ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আবিভূর্ত হন। কবিতাকে একটি নতুন রূপে আলাদা অবয়বে আকীর্ণ করেন। ষাটের দশকের কবিতায় একটি স্বতন্ত্র জীবনবোধ লক্ষ্য করা যায়। মহাদেব সাহা এই বোধে পুরোপুরি আক্রান্ত।  উপযুক্ত বিষয় উপজীব্য হয় তার কবিতায়। প্রেম, দ্রোহ, সমাজ-সচেতনতা বিচিত্র জীবনবোধ আবেগ বিহলতা তার কবিতায় প্রতিভঅষিত হয়। তার কবিতা কখনও প্রতিবাদমুখর। আবার কখনও লাজুক লাবণ্যে প্রেমময়। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ভাঙ্গাগড়ার চিত্র নানা বক্তব্যে বর্ণিত হয় মহাদেব সাহার কবিতায়। প্রেমের অভিব্যক্তি তেমনি তিনি ফুটিয়ে তোলেন সুনিপুণ হাতে। প্রেমের উচ্ছাস বিষাদ তার কবিতায় লক্ষণীয়। অন্যরকম এক প্রেমানুভূতিতে মহাদেব সাহার কবিতা সন্ধ্রার মসৃণ মখমল আলোর মতো সোন্দর্যময়। মহাদেব সাহা প্রেমের কবিতায় অনন্য। প্রেমের আকাংখা, আনন্দ কিংবা শোকের অর্জন তার কবিতায় লীন হয়েছে। উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে।

কেন ভালবাসি, কেন কষ্ট পাই

তুমিও যেমন জানো আমি তাই।

তবু ভালবাসি, তবু ভেজে চোখ

এভাবেই বেঁচে থাকা, এভাবেই শোক।

মহাদেব সাহা প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে সফল পদচারণা করেন। তিনি তার ভীন্নতর প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে আবেগময় প্রেম বিহলতার অবতাড়না করেন দক্ষতার সাথে। তিনি কবিতায় যুক্ত করেন আনন্দ-বেদনার মিশ্ররূপ। এই বিরূপ যান্ত্রিক সমাজ থেকে প্রেমের অনন্য অনুভূতি যখন হারিয়ে যাচ্ছে তখন মহাদেব সাহার কবিতা প্রেমানুভুতিকে জাগরুক করে। ষাটের দশকের এই প্রধান কবি মহাদেব সাহা ১৯৪৪ সালের ৫ই আগস্ট সিরাজগঞ্জ পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার উলে­খযোগ্য গ্রন্থ- এই গৃহ এই সন্ন্যান, মানব এসেছি কাছে, কী সুন্দর অন্ধ, লাজুক লিরিক, ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস, আমি ছিন্নভীন্ন প্রভৃতি। 

প্রেমের অমোঘতা তার চিরন্তন অনুভূতি মানব মানবীর ব্যাকুলতার কথা মহাদেব সাহা তার কবিতায় সন্নিবেশিত করেন শিল্পসমেত। শিল্পের অপুর্ব রূপায়ন তিনি তার প্রেমের অদ্ভূত উপলব্ধির প্রকাশের মাধ্যমে ঘটান। প্রেমের নানা দর্শন মহাদেব সাহার কবিতায় দেখা যায়।  প্রেমবোধ প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। মানুষকে প্রত্যয়ী করে। প্রেমশূন্য মানুষ কখনও সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে পারে না। কারণ প্রেম মানুষকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করে। ভালবাসা একটি তীব্র অঙ্গীকার হিসেবে চিহ্নিত। এই অঙ্গীকারের তীব্রতা ভালবাসার গন্ডী থেকৈ বেরিয়ে আসে। মানুষকে যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ করে। যে কোন লড়াই সংগ্রামে মানুষের গৌরবময় অর্জনের সঙ্গে থাকে তার আদি প্রেমের অনন্যবোধ। প্রেম মানুষকে চলমান রাখে। প্রেম শক্তির উৎস। প্রেমের নানা প্রকাশ মহাদেব সাহা তার কবিতায় ব্যক্ত করেন। 

আমি নিরিবিলি একলা বকুল

তাতে কার ক্ষতি সামান্য ফুল

যদি ঝরে যায়

ভালবেসে তবু এই উপহার

ঝরা বকুলের ঝরা সংসার

যেন রেখে যাই।

প্রেমের কবিতার গুণগত উত্তরনের ক্ষেত্রে মহাদেব সাহা তার কবিতার দিগন্তকে উন্মুক্ত করেন। প্রেমের বহুমাত্রিকতা তার কবিতায় একীভূত হয়। স্বপ্ন অঙ্গীকার, অভিমান, উদ্দেশ্য প্রভৃতি মিলিত কথায় তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়। দুরন্ত আবেগের উচ্ছাস তিনি ভালবাসার আতিশয্যে কবিতাবদ্ধ করেন। প্রেমের পরিণতি এবং পরিণতিহীনতার মধ্য প্রেমের স্মৃতি আনন্দ বেদনার অভিজ্ঞতা ভালবাসার খুনসুটিমাখা বিগত মুখ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় আগামীর পথে। মানুষের বিচিত্র কর্মমগ্নতার মধ্যে স্মৃতি জেগে ওঠে। মানুষ নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়। প্রেমের মুখ মনে পড়ে। স্মৃতিতে বেঁচে থাকে ভালবাসার প্রিয মুখ। এরকম পরম সত্যবদ্ধ দশৃন মহাদেব সাহা কবিতায় উপস্থাপন করেন। 

অবশেষে সবই ঝরে যায়

সময়ের হলুদ হাওয়ায়

স্মৃতিমাত্র লিখে রাখে নাম

সেইখানে আমিও ছিলাম।

মহাদেব সাহা অবাধ ভালবাসায় ভেসে বেড়ান সর্বত্র। সব কবিরাই তাদের ভালবাসার বিশালতায় বিমুগ্ধ থাকেন। তাদের ভালবাসা মুক্ত প্রবাহে অবমুক্ত করেন বিলিয়ে দেন প্রেমের অপুর্ব শিহরণে। মহাদেব সাহা প্রেমের কবিতাকে তার কাব্যচর্চায় প্রাধান্য দিযেছেন। বাংলা কবিতায় বিভিন্ন দশকের প্রধান এবং অপ্রধান সব কবিরাই প্রেমের কবিতায় মনোযোগী থেকেছেন। মহাদেব সাহা ততার ব্যতিক্রম নয়। 

তার প্রেম প্রবণতা তার কবিতাকে শিল্পসুষমায় উজ্জ্বল করে তোলে। তিনি নিরন্তর প্রেম বন্দনায় ব্রতী হন। তিনি ভালবাসার বর্ণিল পথে এগিয়ে যান। তার ভালকাসা উজার করে বাণীবদ্ধ করেন। তিনি উচ্চারণ করেন-

কবির কি আছে আর 

ভালবাসা ছাড়া

সমস্ত উজার করে 

হাতে একতারা।

মানব-মানবীর প্রেমলীলা বহুভাবে আমাদের সাহিত্যে রুপায়িত হয়েছে। মহাদেব সাহা তার কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে এই বিষয়টির নানাদিক তত্ত¡মুলক লেখনী দিয়ে প্রকাশ করেছেন নানাভাবে। প্রেমের অপূর্বভাব তিনি সুন্দরভাবে তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রেমের ভাব মানুষকে স্পশৃ করবে এটাই নিয়তি- নিয়তির অমোঘতা রুখতে পারার সাধ্য কারো নেই। মানুষের অস্তিত্ব জুড়ে প্রেমের খেলা চলমান থঅকে। মানুষ প্রেমের প্রবলতায় কখনো কখনো দিশেহারা, নিয়ন্ত্রিনহীন হয়ে পড়ে। ভালবাসা স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। মানুষ জয়ী হয়। স্বীকৃতি মেলে সাফল্য আসে। আবার ব্যর্থতার প্রকটতায় হতাশা আগ্রাসী রূপ নেয়। সে পৃথিবীর সব ফুল হত্যা করে। ছিঁড়ে ফেলে। দুঃসময় নিয়ে আসে। মহাদেব সাহা এ ধরনের সব অনুষঙ্গকে কবিতায় যুক্ত করেছেন। 

খুব বেশী চাই না কিছুই

নিজের যেটুকু আছে ভুই

তুমি তাতে স্নিগ্ধ জল

ফুটবে কি ব্যথিত কমল। 

মহাদেব সাহার কবিতার ভুবন বহুমাত্রিকতার প্রশস্ত। তার কবিতায় বিষয় বৈচিত্রের দিক লক্ষ্যণীয়। সব বিষয় আশয়ে তার মনোযোগ অভীন্ন। তিনি অন্যান্য বিষয়ের মতো প্রেমলীলা বিষয়ক কবিতা রচনায় দক্ষতা ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। যা অনুধাবন করা খুব সহজে সম্ভব। মহাদেব সাহাও প্রেমের কবিতায় আনন্দকে বিজয়ী করেছেন। 

তার কাছে অশ্রু ও বেদনা অসহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। প্রেমের লক্ষ্য আনন্দ অর্জন। বেদনা নয়। এরকম পরম সত্য তিনি ব্যক্ত করেছেন তার কবিতায়। তার প্রেমে দুরন্ত কাব্যোচ্ছাস লক্ষ্য করা যায়। আনন্দ ও বিষাদের পাশাপাশি তিন বিচ্ছে পরিণতিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে-

তুমি দিয়ে শুরু একটি বাক্য

শেষ তার তুমিহীন

একেই আমরা বলেছিতো প্রেম

বিচ্ছেদ চিরদিন।

মহাদেব সাহার অনন্য কাব্যগ্রন্থ ‘লাজুক লিরিক একটি ভিন্নধারার কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এ গ্রন্থের কাব্যভঅষায় প্রেম নীরিক্ষন নবতর রূপে সংযোযিত হয়েছে। লাজুক লরিকে র প্রেমভাষার মধ্যে রয়েছে শিল্প শক্তির, ভালবাসার শিহরণ আর প্রেমময় আবেগের নিবিড় অবস্থান। এই মহামিলন মহাদেব সাহা সফলভাবে করেছেন লাজুক লিরিক গ্রন্থে। মহাদেব সাহা প্রেমকে একান্ত অনুষঙ্গ হিসেবে অবলম্বন করেন। প্রেমর বোধকে তিনি নন্দনতাত্ত্বিকতায় আর শল্পগুণের মাধ্যমে পৌছে দিয়েছেন প্রেমিকি প্রেমিকার প্রেমবদ্ধ হৃদয়ের গহীনে। প্রেমের জয়গাথা তিনি নির্মাণ করেছেন অনন্ত প্রেমের উজ্জ্বল বিশ্বাসে। এটুকু মহাদেব সাহার শ্রেষ্ঠ সাফল্য।  

মন্তব্য: