শামীম কবীরঃ বুকের ভেতর মৃত্যুর দেয়াশলাই কাঠি নিয়ে গত শতাব্দীর পোশাক পরা সন্তু

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

পাবলো শাহি

নব্বই দশকের প্রতিভাবান অকাল প্রয়াত কবি শামীম কবীর। স্বল্প পরিষদের এই কাব্যজীবনে চব্বিশ, রোগশয্যার আলোবাদ্য, মনে হচ্ছে রেল, কোথায় দেবো রাজস্ব এবং গদ্য, ডায়েরীর মধ্যেও তাঁর অসীম কাব্যময়তার অধিবিদ্যা লুকায়িত। আর এই কাব্যগুলো জন্ম দিতে সে বুকের ভিতর ঝমিয়ে ছিল মৃত্যুর দেশলাই কাঠি। একটা শিল্পত ফায়ার বক্স তাই তাঁর কবিতাকে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ। তাঁর কবিতার অসাধারণ চিত্রকল্প, দার্শনিক জিজ্ঞাসা, নন্দনের ডালে চড়া সৌন্দর্য যেন এই সবকিছুকে বৃত্ত করে আছে দু’টি বিষয় এক. মৃত্যুচিন্তা দুই. লিবিডো ভাবনা।

সে আসলে মৃত্যুই চেয়েছিল। চায়ের বাক্সের ভেতর কিম্বা মশলা-ঘরে। চেয়েছিল পরম প্রার্থীতের মতোই। আয়োজন ছিল বিশাল। একটা ম্যান সাইজ আরশি, একটা হিট রেডিয়েশন গান, আইসরু দেয়ালের ঘের, শাদা ছাদ, ফ্যান, ট্রে-তে অমোঘ আপেল, প্যাড, ইকোনো এবং তালাচাবি।০১

এই সব তাঁর কবিতার ব্যাকরণ সূত্র হয়ে বার বার ফিরে এসেছে। জীবনেরর দরোজা পার হবার জন্য এভাবেই পথ চলা

মৃত্যু যেখানে অপর, ধ্বসে পড়া খিলানের খলশব্দ শুনতে যেখানে হয় প্রাণ পেতে, অবশেষে সেখানেই যাত্রা শেষ তার! যে যাত্রার জন্যে সঙ্গী হয় ভেতোমদ, সেকোবিষ,পকেট ভর্তি চারদিক থেকে পুড়ে আসা কিছু পোষা স্মৃতি আর খণ্ডিত নীলিমার রূমাল। পরে সেটিকে দেখা যাবে ময়ুরপঙ্খী ও চতুর্থ’র ভূমিকায় অভিনয় করছে। সে যাচ্ছে, অবধারিত, পেছনে না তাকাবার গান গাইতে গাইতে। পথিমধ্যে একটা ব্রীজ সে পেয়েছিলো বটে, একমুখী, যা গাঁথা হয়েছিল বিস্ময়ের বিচি গুণে গুণে। চলতে চলতে একবার শুধু কোনোমতে উচ্চারণ; বন্ধুরা আমি মরতে যাচ্ছি, ভেতরে আমার তিনটি রূমাল, এবং এইটি চতুর্থ খানি।০২

এরকম কবিতার ঘোর লাগা চরণ নির্মাণ করে বেঁচে রইলেন শামীম কবীর। শব্দ তরঙ্গের মাথায় বসে এ যেন নটরাজ শিবের ভূজঙ্গ লেখা। তার ভিতরে রয়েছে তাঁর স্বপ্ন আর ভেঙে পড়া আকাক্সক্ষা, বেদনাগুলি। আলগোছে তাই তার শব্দ বান উন্মাদ লোহার শলাকা হয়ে বিদ্ধ করে আমাদের চোখ, রক্তাক্ত করে হৃদয়ের গহীন বন্দর। আমরা মুগ্ধ হয় বুনোহাঁস শিকারীর মতো তাঁর শব্দ শিকার দেখে। নন্দনের ডালে ফুটে ওঠে তাঁর অজস্র কর্দম ক্লেদজ ফুল।

(i)

সারাক্ষণ হতে চাই গানের বাকশো

… … … … … … … … … …

তার দিকে যে উড়ুক্কু সিঁড়িটাকে আলগোছে পান

ক’রেছি এবং ভুলে গেছি

তাতে গোলাগহ্বর ছিল…

মা’র সঙ্গে বাক্যলাপ/চব্বিশ

(ii)

আর একবার ঘুরে পেছনে তাকাবো

        কি তাকাবো না

            ভেবে

সমস্ত ভাঙা টুকরো-গুছিয়ে কুড়িয়ে আবার

আমাকে জোড়া লাগালাম

কিন্তু হাত কই

ঐ/ঐ

(iii)

ডাকঘরে পোস্টকার্ড বিক্রেতা

যে কোন দিন পোস্টকার্ড কেনেনি

সে জবাবগুলি জানতো

কিন্তু লাখ লাখ পোস্টকার্ডে লেখা 

ভুল বহু উত্তরের ভারে ভরে গ্যালো

ধা না নিক্ষেপকের পকেট…

ধাঁ ধাঁ/রোগশয্যার আলোবাদ্য

(iv)

গত শতাব্দীর পোশাক পরা লেকটির কাছে কী আশা করতে পারি?

ওর কাছে শোনবার মতোন নতুন কী বা থাকতে পারে? আমার

সন্দেহ হয় লোকটার হয়তো বয়স বেশি নয়। পুরোনো পোশাক

পরে বয়স বাড়াতে চেয়েছে।

দর্শন/গদ্য ডায়েরী চিত্রকলা

(v)

জ্ঞান হ’লো প্রতারণা প্রিয়

তাই জ্ঞানগুলোকে প্রথমে কাঁচি দিয়ে ছেঁটে

আর ক্ষুর দিয়ে চেঁছে নামালেই

সেই একটা পরিস্কার সাধুসন্তু মার্কা চোয়াল পাওয়া সম্ভব

আতপ চাঁদ/কোথায় দেবো রাজস্ব

(vi)

বৃষ্টি হয়ে গেলে খুব ইস্টিশন ইস্টিশন ঘ্রাণ

আর সোনার বিস্কুট

ত্যাগ করে চ’লে যাও সর্ষের ভিতরে

… … … … … … … … … …

তুমি সর্ষের ভিতরে ব’সে চক্মকাও

উপশহর-৩/মনে হচ্ছে যাচ্ছে রেল

শামীম কবীর পরাবস্তবতার ঘোর লাগা বাস্তবতা দিয়ে কবিতা নির্মাণ করেন। ফলে, ‘সারাক্ষণ হতে চাই গানের বাকশো’, ‘সমস্ত ভাঙা টুকরো গুছিয়ে কুড়িয়ে আবার/আমাকে জোড়া লাগালাম/কিন্তু আমার হাত কই’, ‘যে কোন দিন পোস্টকার্ড কেনেনি/সে জবাবগুলি জানতো’, ‘আমার সন্দেহ হয় লোকটার বয়স হয়তো বেশি নয়।/পুরোনো পোশাক পরে বয়স বাড়াতে চেয়েছে।’, ‘জ্ঞানগুলোকে … … …ক্ষুর দিয়ে চেঁছে নামালেই/সেই একটি পরিস্কার সাধুসন্তু মার্কা চোয়াল পাওয়া সম্ভব’, ‘তুমি সর্ষের ভিতরে বসে চকমকাও’, এই শব্দমালা তাঁর কবিতার বাণী হয়ে ওঠে। যেন শব্দেরা ঘুমঘোর কেঁপে জেগে ওঠে। এক বিপুল বাস্তবতায় কবি দেখতে পান কিম্ভূতকিমাকার ধ্বনিগুঞ্জনমালা। তাঁর মগজে গজিয়ে ওঠে ‘উভলিঙ্গ লাল জামা’ আর তিনি শুনতে পান বর্ণের ‘শোকবিদ্যা’ যেখানে ভেসে ওঠে ‘রোগশয্যার অলোবাদ্য’ আর শব্দে শব্দে ‘পতঙ্গ রহস্য’ খুঁজতে খুঁজতে কবি পৌঁছে যান ‘ঘুম’, ‘স্বপ্ন’, ‘মল’, ‘গর্ত’, ‘ড্রেন’, ‘যোনি’, ‘বীর্য’, ‘লাশ’, ‘দারিদ্রতা ও রাজনীতি’ পার হয়ে ‘ডাক্তারের ঘরে’। কবির জানালায় থাকে শব্দেরা চুলচেরা চোখ ও সভ্যতা নিয়ে। তারপরও ‘মানুষের সমান আয়না’য় ভর করে কবি দেখনে ‘উড়ন্ত শিং এর খেলা’- এর ‘নাভি’তে তিনি পেযে যান ‘বিষাদের বঙ্গানুবাদ’। ফলে, ‘ফ্যাগোসাইটোসিস’ তাঁকে আক্রান্ত ও অতিক্রান্ত করে। ফলে, নিরন্তর অনন্তর কাল ধরে তিনি দেখেন ‘করাত দিয়ে পা কাটবার দৃশ্য’ কাজেই তিনি ঢুকে পড়েন ‘ঈশ্বরের খামারবাড়ি’তে। আর তখনই কবি ‘শামুক’ হয়ে ওঠেন অবশেষে তাঁর পরিণতি ‘ম্যানসাইজ আরশি কিংবা আত্মহত্যা বিষয়ে গল্প’ রচনার মধ্য দিয়ে। পরাবাস্তবতার বাস্তবতায় তাঁর এই পরিক্রমার দুটি প্রধানতম অনুষঙ্গ একটি ‘মৃত্যুচিন্তা’ আর অন্যটি ‘লিবিডো’ ভাবনা নিয়ে।

(i)

সর্বনাশ ধ্বংস হবে এখনি পৃথিবী

আর তার উভলিঙ্গ লাল জামা ওড়ে

… … … … … … … … … …

এইভাবে বেসে বসি

ভালোবেসে আমি তাকে পরের সপ্তায়

উভলিঙ্গ লাল জামা পরিয়েছি

সযত্নে ক’রেছি খুন

একবারে রক্তপাত নেই

… … … … … … …

তোমার পেছনে থাকে আমার লিঙ্গের সমতল

উভলিঙ্গ লাল জামা/চব্বিশ

(ii)

আপেলের দোকানে যখন আপেল খাই

তখন মনে পড়ে সে আমাকে কতো কথা বলে মনে পড়ে

ডাক্তারের ঘর/রোগশয্যায় আলোবাদ্য

(iii)

হরিণীরা চামড়া প’রে

আর অতি কথা যাহা

হিজড়ে কোনো হরিণী দেখিনা

জলপানি ও ঋষ্য শৃঙ্গের গল্প/ঐ

(iv)

মেয়েদের ফ্রক ওড়ে দুদিকের ঘাসের শাথায়

যে সব মেয়েরা বুনো

পোড়ালো মাটির স্তন

ঘোড়ামুখি উচ্চারণে ব্যাঙ

কেবল জ্বালায় ঘাসে গড়াগড়ি খায়

কেটে কুটে গাছে গেছো ঠ্যাং

এই সব দ্যাখে আর

    চোখ মেরে ছুটে বলে ছেলে

কালোমাটির হাঁড়ি/ঐ

(v)

স্তনের পশম দেখে দমহারা দেবর বালক

উচাটন দহ্নের ঢিল ছোঁড়ে বৈকালের ঐদিকে

শ্বেতসার/মনে হচ্ছে যাচ্ছে রেল

(vi)

সে এক একান্ন ঘরে বসবাস করে

খায় দায় এক সঙ্গে

মাকে বলে ‘মাথা’ আর বাপকে ‘বাবুই’

… … … … … … … … … … …

যদি তা’না জানি তবে ‘বাবুই’ এর ‘মাথা’ থেকে

বাসা থেমে মুছে যাবে সঙ্গমের স্মৃতি

আর

সে আমার-ই বান্ধবীকে করে

বায়েজীদ মাহবুব/কোথায় দেবো রাজস্ব

শামীম কবীরের ‘লিবিডো’ ভাবনা তাঁরই মতো মৃত্যুর ঘোরলাগা শান্ত কবরের হাতছানিতে ভরা। তাই তাঁর ভাবনায় চড়ে বসে ‘উভলিঙ্গ লাল জামা’ আপেলের দোকানে আপেল খেতে গিয়ে ‘তার’ বলা কথা মনে পড়ে। কবি আশ্চর্য অনুবীক্ষণের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করেন হিজড়ে কোন হরিণী, না দেখার সংবাদ। তারপরও তিনি দেখেন বুনো, মাটির স্তনওয়ালা, ঘোড়ামুখি মেয়েদের চোখ মারে ছেলে; আর ‘স্তনের পশম দেখে দমহারা হয় দেবর বালক’,এরপর ‘বাবুই এর মাথা থেকে/ বাসা থেকে’ এই সব স্মৃতিগন্ধ রমণের স্মৃতি বয়ে আনেন কবি।

(i)

জ্ঞানী কবরের স্কন্ধে চ’ড়ে এলাম

ছোট ছোট অট্টহাস্য মাখা ধূলা ঘাস এ বাতাস

এখানের এই নাম অন্যপুর নিহিত রেখেছে

মা’র সঙ্গে কাব্যলাপ/চব্বিশ

(ii)

সবচেয়ে মৃত্যু বেশি যার হাতে

তাকে আমি ক্রয় করে ক্রনিক ম্যানিয়া

        শেখাবোই

স্রোত ও শামুকাসন/রোগশয্যার আলোবাদ্য

(iii)

এবং তা ঘটে যাবে অচিরেই

মশলা ঘরের মধ্যে লাশ হয়ে থাকা অন্ততর

কী যে মজাদার

মশলা-ঘরে মৃত্যু ভালো/ঐ

(iv)

এক দুই তিন বারো ত্যারো বিশ গুণে

বহুৎ তারের খেলা শুনেটুনে

একতারা স্ববাদনী ঠুং   

… … … … … … 

হ’তে পারতো ‘নকরোচ’ বা ‘লানি র‌্যাট’ দিয়েও, কিন্তু

সর্বকিছু চ’ষে শেষে, শুধু পারদকেই, সবচেয়ে

সৎসাক্ষী মনে হ’য়েছে আমার,

… … … … … … … … …

সেই মোতাবেক উপকরণ মাত্রই ২ ম্যান সাইজ আরশি

একটা, দ্বিতীয়ত একটা হিড রেডিয়েশন গান, পাওয়া

গ্যাছে দুটোই এবং এই আইসব্লু দেয়ালের ঘের,

শাদা ছাদ, ফ্যান, ট্রেতে অমোঘ আপেল, প্যাড,

ইকোনো এবং তালাচাবি

… … … … … … … 

শেষ সিগারেটের লম্বা শেষ টান নিয়ে…

গোল গোল, অজস্র রিং বানাতে বানাতে

তার ধূম্রাবেশ আবছা হ’য়ে মিলিযে যেতেছে

ইতিহাসে; কিয়ৎ অতীত, কিছু অনির্দিষ্ট

ভবিষ্যৎ পার ক’রে, কাটিয়ে, এখন এই সে…

ম্যানসাইজ আরশি কিংবা আত্মহত্যা বিষয়ে গল্প/গদ্য ডায়েরী চিত্রকলা

‘মৃত্যু চিন্তা’ কে কবি শামীম কবীর যেন এক অলৌকিক ভ্রমণে পরিণত করেছিলেন। ফলে, এক ধোঁয়াটেঘোর সেই অসীম রূপান্তরের দিকে ধাবিত শূন্যে হয়েছে আর তাঁর কবিতার গন্তব্য ক্রমশ অতিগাগনিক বায়ু শেকল ছিঁড়ে বিপন্ন বিস্ময়ে পরিণত।

বসে বসে তর্জনীর ঝড় দেখতে দেখতে গত জীবনের কথা ভাবতে চাইতো সে, বলতো: এই একবছর আগের শামীম কবীর কেমন ছিলাম তাও মনে পড়ে না। কথাটা তখন স্টান্ট মনে হতো। ওর প্রস্থানের পর এখন অনেক কিছুই স্বচ্ছ হয়ে পড়েছে ক্রমে। ক্রমে আলো আসিতেছে। বিচিত্র রশ্মির ধ্যান। চব্বিশেই কেন এমন ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে sadness ছাড়া জীবনের Profoundity আসে না। কিন্তু গভীরতার কথা ভাবতে গিয়ে গভীরে তলিয়ে যাবার ইচ্ছায় পেয়ে বসল ওকে। অথচ স্বপ্নের পায়ে ধরে রহস্যটি শুনবার ও শোনাবার কথা ছিল তার। মুগ্ধ হয়ে রহস্যমুক্তির কথা ভাবতে ভাবতে, ঘুম পাড়ার যন্ত্রটা ঠিক করে নিতে নিতে যেনোবা নিজেকে শোনালো- এতে তো আমার কোন হাত নেই।  এতে, মানে মৃত্যুতে! আমরাও ভাবলাম, আরে তাইতো তাইতো, এ-তো ঈশ্বরের ব্যাপার, সে কেবল নিমিত্ত। ওর sickness কে সে ক্ষেত্রে Cosmic Event-ই বলতে হচ্ছে। বস্তুত: মৃত্যু বলে কিছু নেই, ওটা হচ্ছে বিরাম রেখা। আমরা যখন শামীম কবীরকে পড়বো তখন কি সে আমাদের স্বরেয় প্রক্ষেপে জীবিত নয়? বরং অতিজীবিত। তাহলে মৃত্যু কোথায়? কে-ইবা জীবিত আর কে-ই বা… … …। পৃথিবীর বায়ুকে ‘একটি’ ধরলে, এই সার্বিক বায়ু শেকল ছিঁড়ে গিয়ে সে কিছুকাল দম নিচ্ছে মাত্র। অথবা, পা-হারা অবস্থায় মৃত্যুর অবধি শুধু খাড়া। ঠিক কোন বিপন্নবোধে আক্রান্ত এক যুবা যে তার অদৃষ্ট ও টেবিল হারিয়ে ফেলেছে, সে গুলিয়ে ফেলতে চায় ফড়িং ও গ্লাইডারের পার্থক্য- আমরা জানি না। আমাদের সময়ে এটাকে বিপন্ন বিস্ময় বলে চিহ্নিত করারও উপায় নেই। তার চাইতে বেশি কিছু এটা। কেননা সম্মিলিত চা-য়ের ভাবনার পর কেউ যখন বলছে- কিভাবে আমরা যাবো, এমন সুসময়। সুসময়ে এমন যাবার কথা ক্যানো মনে আসে যে যাওয়ার ফিরে আসা নেই।০৩

এরকম নিজেকে হত্যা, আর হত্যার পর কান্নাটাও আছে তাঁর কবিতা জুড়ে। এই সব ভাবনা আর ধ্বনিমালা দিয়ে শামীম কবীর আমাদেরকে সময়ের অমোয ক্লীবতার দিকে ঠেলে দেয়। ফলে, জ্ঞানী কবরের স্কন্ধে চড়ে তিনি ফেরের’ যে দেশের ‘ধূলা ঘাম’ ও ‘বাতাসে’, ‘ ছোট ছোট অট্টহাস্য শাখা’ তে। সেকারণে তিনি মৃত্যুকে ‘ক্রয় করে ক্রনিক ম্যানিয়া’ শেখাতে চান, আর মশলা ঘরের মধ্যে লাশ হয়ে অনন্তর থাকতে মজাপান। আর শেষে তিনি আত্মমৃত্যুর আয়োজন করেন ‘নকরোচ’, ‘ল্যানির‌্যাট’ না পেয়ে পারদ দিয়েই। মৃত্যুর সময়ে আয়োজনে থাকবে- ম্যান সাইজ ফ্লিন্ট কাঁচের আয়না, হিট রেজিয়েশন গান, ভয়েস রেকর্ডার, আইসব্ল ু দেয়ালের ঘের, শাদা ছাদ, ফ্যান, ট্রেতে অমোঘ আপেল, প্যাড, ইকোনো, তালাচাবি। (তাঁর এই কবিতার সাজানো মৃত্যুর বাগানের খোঁজ তিনি মৃত্যুর সময় পুরোপুরি পান নি- পেয়েছিলেন, সন্ধ্যার ফাঁকা বাড়ি, ফ্যান, টুল আর নিজের শাদা চাদরটা।)

মাত্র ২৪বৎসর বয়সে একটা সম্পন্ন কবির সমস্ত উৎকর্ষতার ভাষা বিনির্মাণ করেছিলেন তিনি। তাঁর শব্দ গুলো তায় ধ্বনির নাচবিশ্ব তৈরি করে আমাদের মগজে, আর আছড়ে পিছড়ে পরে অনুভূতির অবগাহনে। যখন দেখি তিন বলেন- ‘হায়। হায় দেবদারু। হায় হাসি। যে হাসি ভারমিলিয়ন। যে হাসি প্রকারন্তরে কান্নার অধিক। ‘শিশুদের কান্নার ডিম সেদ্ধ হবে যে কান্নায়।’ ‘একদিন তাঁর মনে হয়েছিল, আজ পুত্রশোকে ছেয়ে যাক সমস্ত আকাশ। আকাশ; তায় আবার সমস্ত, তবে কি আকাশ অনেক: নিচে, উদগাতা অর্থাৎ তার মা, যিনি সেবিকা ও শ্বেতরোগী, তার জন্য নির্ধারিত হতে দেখি ঐ বাক্যটিই কেবল মহা শূন্যাকাশের অজস্র বোতামঘরে যিনি অবিরাম রোদন জমাবেন। সেতার মিশ্রিত ফোলা বাতাসে তখন থেকেই শুর হলো পাখি ও প্রজাপতির দীর্ঘশ্বাস। আর আমরা মেঘের অপেরা দেখতে দেখতে শুনি মৃদু শাফ্ট-এর সুর। সুর শেষ হলে দেখি এন্টেনা উড়ছে আকাশে। কিন্তু আশ্চর্য না হয়ে কে পারে, এন্টেনার পরে এলো টিভি, সেও উড়তে এসেছে ঐ দ্যাখ্যো, উড়ছে, টিভি, বেচারা। আর এদের দেখাদেখি মাটির কলস ‘জল দাও জল দাও’ এর বদলে চাইছে এই ব্যাপক ঘুড়িদিবসে যেন তার পাখা দেন প্রভু। এমনই করুন, এমনই সুন্দর। এসেছিলো শীত হতে ফল। গন্ধম? অনেক ব্যবহ্নত পৃথিবীর। এক অনুপম অপরাহ্নে তাই দ্যাখা গেল গন্ধম হয়ে যাচ্ছে আপেল। নির্বাচিত নারীর কেনা আপেল। শামীম নয়, শামীম কবীরের ছায়ার ছায়াটি হাতে নেয়, আর দ্যাখে ওটি টুকটুকে এক দ্বিধা, বোটাশূন্য। ঐ লোভে সে ছোটে এক লাফে একবার ওপাড়ে পার হয়, এপাশে কিছু পরেই, মাঝখানে খুঁদে পানা ভর্তিপুকুর। বা বল যায় পুকুর প্রহসন। আকাশের একধার নীল চুইয়ে নামে যেখানে কড়াইয়ে। ০৪

এই ধরণের প্রকরণমালা শামীম কবীরকে নব্বই দশক শধু নয়, বাংলা কবিতার প্রতি নন্দনের বরপুত্র আখ্যা দেয়। তাঁর তাবৎ কবিতা জুড়ে শরীরের ধ্বনি ব্যঞ্জনায় খণ্ড খণ্ড জিজ্ঞাসার মালা। এই জিজ্ঞাসার গুপ্ত রসায়ন তাঁকে পৌঁছে দেয় কবিতার অধিজগতে। ফলে, শামীম কবীরের কবিতাগুলি সহজ ভাবে উপস্থাপিত হলেও এক পর্যয়ে বোধের কাছে ধোয়াটে হয়ে ওঠে। সংগত শব্দ ব্যাবহারে তাঁর অনাগ্র তাখে ভিন্ন আর দূরূহ করে তোলে কিন্তু তাঁর কবিতা শেষ পর্যন্ত দুর্বোধ্য নয়- ফলে তাঁর শ্বাসাঘাতে পোড়ে বক্ষ, অনুভূতির বোঝ কাঁধে তোলা ঘাড়।

‘শহরে প্রচার করি উভলিঙ্গ খেলা’, ‘কে আছো ভিতর: কাটাপাখির গহŸর’, ‘বাক্স ভেদ ক’রে আছে চশমা বিক্রেতার রাগী চোখ’ তাই হত্যায় বেশি বেশি ফর্সা হয়ে ওঠে সে। তিনি দেখতে পান মোটা মোটা থামের পাশে অন্ধকার ধ্বনিমালা। তাই কবি ‘বাইশ খণ্ড ধ্যান মেলে’ বসেন, আর ঘোষণা দেন ‘মাছেদের তৃষ্ণা নেই’ উড়–ক্কু মাছই সবচেয়ে তৃষ্ণার্থ পাখি’, ‘এইসব অবলোকন করতে করতে কবি আলাদা হয়ে ওঠেন।

উহ্যত, ‘এমনকি আমার বন্ধু বলতে ও কেউ নেই/ কেউ মদ্য সঙ্গি কেউ জ্যোৎস্না দ্যাখার সঙ্গি’ ফলে তাঁর কবিতা দার্শনিক এক অর্ন্তমুখিতা ঘোর তৈরি করে।

‘মা তো আমার বন্ধুই এবং মা আমার উদ্গাতা, মা বল­ “১ থেকে ২ এর দূরত্ব কতো?”

আমি জানতাম যে 1, বল্লাম “অবশ্যই 1”

মা তখন হেসে বল­ “ও তোর বাপ”

শুনে আমার বেশ ভালোই নাগলো, বল্লাম “ তো আমার কি করার আছে?”

 মা বল­ “তুই তো স্বাধীন”

আমি তৎক্ষণাৎ পড়ে গেলাম চিন্তার মধ্যে, 1+1= 2 হয় সে তো

জানিই, আমি আরম্ভ করলাম 1 থেকে, তারপর

1.999 ক’রে ক’রে 2-এ তো যেতে পারছি না

মার সাথে বাক্যলাপ শেষে, এবার সেই বাপ বল­ “শুরু কর 0 থেকেই”

তারপর আবার বল­ “য্যামন 0 মানে আকাশ”

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ব্রীজ বানাচ্ছি, আর ভাবছি যে  0.9999…

একমুখী ব্রীজ/গদ্য, ডায়েরী, চিত্রকলা

এরকম অনেক অসাধরণ শামীম কবীরের নন্দন যা প্রচলিত ন্যায় গ্রন্থ ঠেলে আমাদের মনে স্থান করে নেয়। কবিতার ধ্বনি মালার এই দাহপত্র তাই শামীম কবীরকে আলাদা করে দেয়। লিবিডো, মৃত্যুচিন্তা এবং ন্যায়গ্রন্থ ঠেলে, ফেলার যে প্রবণতা তিনি চিন্তার মধ্যে ধারণ করতে চেয়ে ছিলেন, তা তার কবিতায় উঠে এসেছে- নির্মাণ করেছে নন্দনের ডালে ব্রহ্মঅনুভববিদ্যালয়। আর শামীম কবীরকে তা নিয়ে গেছে চেনা রুচির উর্ধ্বে। তাই ‘মৃত্যুতে থাকে চূড়ান্ত মাজা’ তাকে চিনতে তিনি চলে গেছেন অন্যতর জীবনে। কবিতা ইতিহাসের সুড়ঙ্গ বেয়ে আমার নিশ্চয় সেই স্বাদ পেয়ে যাবো? আর বুঝে নেবো শামীম কবীরের ‘My aim is to go aimless’ এর গল্প।

১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৭

হদিস

০১.    মজনু শাহ্, ভূমিকা, শামীম কবীর সমগ্র, দ্রষ্টব্য, বৈশাখ ১৪০৪, ঢাকা পৃষ্ঠা-৯০।

০২.    প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-০৯।

০৩.    প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১০।

০৪.    প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯-১০।

মন্তব্য: