জরা এবং মৃত্যুর মাঝখানে আবুল হাসান! । জিললুর রহমান

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

জিললুর রহমান

হা সুখী মানুষ, তোমরাই শুধু জানলে না 
অসুখ কত ভালো, কতো চিরহরিৎ বৃক্ষের মতো শ্যামল 
কত পরোপকারী, কত সুন্দর
… … … 
বেঁচে থাকতে হলে তবু মাঝে মাঝে জ্বরের, জ্বরের প্রদাহ চাই
চাই আবার জোয়ারের মতো সাতিশয় কুলু কুলু শুশ্রূষা
[অসুখ: পৃথক পালঙ্ক, ১৯৭৫]

এমন উচ্চারণ কেবল একজন কবিই করতে পারেন, যিনি খুব অল্প বয়সে অসুখের যন্ত্রণায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। কবির বন্ধুর ভাষ্যে ‘একটুখানি আয়ুষ্মতী ঘুম চেয়েছিলেন’—আবুল হাসানের অকালমৃত্যুর পূর্বে বিনিদ্র রাত্রিগুলো এভাবেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল। তারপর সেই কালঘুম তাঁকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিল, নিয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে—রয়ে গেল শুধু থোকা থোকা দুঃখের মতো অসামান্য টলটলে সব কবিতা। আর সতীর্থদের বেদনামাখানো স্মৃতি এবং একখানি সুরাইয়া খানম মিথ। এতটুকু অনেকেই জানেন। হয়তো আবুল হাসান নামের জন্মকথাও কারও কারও অজানা নয়। ঔৎসুক্যও কম নয় আরও গভীরে এবং আরও বিস্তারিত জানার।

একদিন শরীরের ভেতরে, খোদ হৃৎপিণ্ডের অভ্যন্তরে ক্রমশ বেড়ে ওঠা রোগকে আবুল হাসান তুলনা করেছিলেন ঝিনুকের ভেতরে বেড়ে ওঠা মুক্তার সাথে। মুক্তা যত বেড়ে উঠতে থাকে, ঝিনুকের অভ্যন্তরে তত বেশি করে বেদনা সঞ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু তবু সে মুক্তা ফলায়। এ কথা রোগী আবুল হাসানের ক্ষেত্রে তো সত্য বটেই, কবি আবুল হাসানের ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত সত্য। বস্তুতপক্ষে সকল কবিই বুকের ভেতরে বেদনার চাষ করে মুক্তা ফলায়—

ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!
[ঝিনুক নীরবে সহো: পৃথক পালঙ্ক, ১৯৭৫] 

জরা এবং মৃত্যু জগতের প্রাচীনতম সমস্যা। অতএব, এসব অনুষঙ্গে লেখালেখিও বহু প্রাচীন যুগ থেকেই হয়ে এসেছে। জরা ও মৃত্যু থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে স্বয়ং সিদ্ধার্থ তাঁর রাজপুরীর আয়েশ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর পথে ও প্রান্তরে—‘বধূ শুয়েছিলো পাশে, শিশুটিও ছিলো’, তবু সে কোন পিপাসা তাকে বের করে আনে ঘর থেকে এক অসম্ভবের সন্ধানে। আবার অন্যদিকে কালে-কালান্তরে মহাকাব্যিক আবহে মানুষের বিশ্বাসের ভেতরে অমোঘ মৃত্যু মহিমান্বিত হয়ে স্বর্গ-নরকের পথে চিন্তাকে ধাবিত করেছে। কিন্তু আমাদের কবি আবুল হাসান খুব অল্প বয়সেই তাঁর মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। আর তা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর চেতনা ধাবিত হয়নি কোনো আধ্যাত্মিকতার দিকে। বরং কঠিন নির্মোহ এক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মৃত্যু ও জরা তথা অসুস্থতাকে রোমান্টিক আবহে মহিমান্বিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ভানু সিংহের পদাবলীতে মরণকে ‘শ্যাম সমান’ বলেছেন, ‘মৃত্যু অমৃত করে দান’ বলে মৃত্যুকে একটা আধ্যাত্মিকতায় উপনীত করেন। রবীন্দ্রনাথের তেমন আধ্যাত্মিক রোমান্টিকতা আবুল হাসানের না থাকলেও ‘অসুখ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহংকার’ উচ্চারণে একধরনের রোমান্টিকতা আমরা ঠিকই দেখতে পাই। রবি ঠাকুরের গানে আমরা পাই ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’। কিংবা ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ‘মৃত্যু’ কবিতাটির কথা, যেখানে তিনি মৃত্যুকে ভালোবেসে বলেছেন—

মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে।
সংসারে বিদায় দিতে, আঁখি ছলছলি
জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি
দুই ভুজে।
 
            ওরে মূঢ়, জীবন সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এত আপনার
জনম-মুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে,
তোমার ইচ্ছার পূর্বে? মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিবি আবার
মুহূর্তে চেনার মতো। জীবন আমার
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়।…

মৃত্যুকে এতটা গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেরেছেন; কারণ, তাঁর জীবনে সেই তারুণ্য থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত একের পর এক মৃত্যু এসে হানা দিয়ে গেছে। তার ওপর তিনি আত্মস্থ করেছিলেন উপনিষদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের চিন্তা, যা সংক্ষেপে বললে ‘এই জগত সেই মৃত্যুহীন শাশ্বত সত্তার আনন্দ সম্মিলনের মহাপ্রকাশ’। তাই রবি ঠাকুরের মৃত্যুচিন্তা অনায়াসেই আধ্যাত্মিকতায় পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের এই রোমান্টিসিজমের পেছনে আরও বড় কারণ হয়তো এই যে, মৃত্যু তাঁর নিকটজনদের একে একে নিয়ে গেলেও, নিজে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় বছরের পর বছর দিন গোনেননি। একই রকম রোমান্টিকতায় আক্রান্ত ছিলেন মহাসাগরের ওপারের কবি এমিলি ডিকিনসন। এমিলির মৃত্যুচিন্তা রবি ঠাকুরের সাথে সমমাত্রায় অগ্রসরমাণ বলা চলে। কিন্তু আবুল হাসান শৈশব থেকেই বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভারে ভুগেছিলেন। আর আমরা তো জানি, এই রোগটা জয়েন্টকে ফুটা করে দেয় এবং হৃৎপিণ্ডে কামড় বসায়। কালক্রমে ১৯৭০ সালে এসে আবুল হাসানের হৃৎপিণ্ড সংকোচন ও সম্প্রসারণে অক্ষমতার মতো জটিল পরিস্থিতিতে [কার্ডিওমায়োপ্যাথি] পর্যবসিত হয়। তাই গৌতম বুদ্ধের মতো নয়, বরং মুক্তা ফলানো ঝিনুকের মতো তিনি জরাকে উপলব্ধি করেন, এবং এই কঠিন বাস্তবতায় টের পান, এখানে নির্বাণের কোনো বন্দোবস্ত নেই। রবি ঠাকুরের মতো নয়, বরং নিজের শরীরে বেড়ে ওঠা রোগের বিস্তারের সাথে সাথে হিম শীতল মৃত্যুর এগিয়ে আসা তিনি টের পাচ্ছিলেন। তার পরেও অনেকটা স্বভাবকবির ধরনে রচনা করেছেন একের পর এক রোমান্টিক কবিতা। কিন্তু তাঁর ভেতরের বস্তুবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ আমরা টের পাই ‘জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন’ কবিতায় যখন বলিষ্ঠ স্বরে উচ্চারণ করেন—

মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না,

আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে 
আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন 
কী লাভ যুদ্ধ কোরে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন? 
আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকা তো আপনাদের 
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর…

মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলো না!
পৃথিবীতে তবু আমার মতোন কেউ রাত জেগে 
নুলো ভিখিরির গান, দারিদ্র্যের এত অভিমান দেখলো না!

আমাদের জীবনের অর্ধেক সময় তো আমরা 
সঙ্গমে আর সন্তান উৎপাদনে শেষ কোরে দিলাম,
সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুন তো 
আমরা আমাদের কাছে বোলতে পেরেছি,

ভালো আছি, খুব ভালো আছি? 
[জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন: রাজা যায় রাজা আসে, ১৯৭২] 

সত্তরের সেই মহা ঝঞ্ঝাটময় কালের অনুভূতি আজকের প্রেক্ষাপটেও সম্পূর্ণ বাস্তব মনে হয়। মানুষের হানাহানি এখনো থামেনি, আর জাতিসংঘ তার অসারতা প্রমাণ করেছে ঢের আগেই—আফগানিস্তান বা ইরাকে মার্কিন আক্রমণের খতিয়ান ঘাঁটলেই তা টের পাওয়া যায়। আবুল হাসান তাঁর আরেকটি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত কবিতায় শৈশব স্মৃতিকে উসকে দিতে দিতে উচ্চারণ করেন, ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’। মূলত তিনি ছিলেন হাহাকার ও নস্টালজিয়া উসকে দেওয়া রোমান্টিক কবি। আবার সমাজমনস্ক নম্রস্বরের প্রতিবাদী কবিও বটে। যুগের কারণেও ঘটতে পারে, তবে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতায় তিনি নিপতিত হননি সামনে ঘোর মৃত্যুকে হাতে নিয়ে জীবনযাপনের এমন যন্ত্রণার মধ্যেও। বরং ‘ফেরার আগে’ কবিতায় দেখা যায় প্রত্যক্ষ আঘাত—‘সাইকেল ছিল যেদিন ওরা মানুষ মারলো মানুষ মারলো অপকৃষ্ট/ সেদিন স্বর্গ ধর্ম ভাঙ্গা লাথি মেরে ঈশ্বরমূলে’।

সত্তরের সেই মহা ঝঞ্ঝাটময় কালের অনুভূতি আজকের প্রেক্ষাপটেও সম্পূর্ণ বাস্তব মনে হয়। মানুষের হানাহানি এখনো থামেনি, আর জাতিসংঘ তার অসারতা প্রমাণ করেছে ঢের আগেই—আফগানিস্তান বা ইরাকে মার্কিন আক্রমণের খতিয়ান ঘাঁটলেই তা টের পাওয়া যায়। আবুল হাসান তাঁর আরেকটি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত কবিতায় শৈশব স্মৃতিকে উসকে দিতে দিতে উচ্চারণ করেন, ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’।

তিন কবি বন্ধু, বাঁ খেকে সাবদার সিদ্দিকী, আবুল ও মুহম্মদ ‍নূরুল হুদা © ছবি সংগ্রহ: আবুল হাসানের ফেসবুক গ্রুপ থেকে

আবুল হাসানের ‘অসহ্য সুন্দর’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই কবি কোন এক মৃত সুন্দরীর গোর দেওয়ার দৃশ্য অবলোকন করছেন এবং মৃত সুন্দরীর রূপে কবি মুগ্ধতা প্রকাশ করছেন।

যখোন একটি মৃত সুন্দরীকে গোর দেওয়া হোল 
হায় ভগবান, যখন সুন্দরী মৃত!
একটি একাকী চুল দেখলাম মুখে এসে নিয়েছে আশ্রয়
ক্লান্ত ভুরু, কাঁধের দুদিকে হাত যেন দুটি দুঃখের প্রতীক!
… … … 
তখোন মৃত্যুকে কী যে কোমল সুন্দর লাগছিলো!

কবিতাটির এই প্রথম অংশের সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় এমিলি ডিকিনসনের কবিতার সাথে। আমরা জানি, এমিলি ডিকিনসনও তাঁর অতি আপন বন্ধুর মৃত্যুতে কাতর হয়েছিলেন। তিনি কাতর হয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের একের পর এক মৃত্যুর কারণে; কিন্তু মুগ্ধতাও প্রকাশ করেছিলেন—

As by the dead we love to sit 
Becomes so wondrous dear—
As for the lost we grapple 
Tho’ all the rest are here

In broken mathematics
We estimate our prize
Vast—in its fading ratio
To our penurious eyes!
[As by the dead we love to sit: Emily Dickinson]

কিন্তু আবুল হাসান এমিলি ডিকিনসনের কাছ থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন যখন কবিতাটির শেষাংশে জানা যায় সুন্দরীর গর্ভে ছিল একটি ভ্রূণ, যা আর শিশু হয়ে উঠতে পারল না—

কিন্তু হায় একটি অসহ্য দৃশ্য ঘটে গেল হঠাৎ তখোনই 
যখোন জানলাম আমি গর্ভে তার অসমাপ্ত একটি ভ্রূণ শিশু হতে পারল না!
                                একটি সুন্দর ভ্রূণ! 
[অসহ্য সুন্দর: যে তুমি হরণ করো, ১৯৭৪]

অসুস্থতার কাব্যিক প্রকাশ আমরা লক্ষ করি ‘এখন পারি না’ কবিতায়। কীভাবে অসুখ তার সামর্থ্যকে কাবু করেছে, তা টের পাওয়া যায়, সাথে সাথে তাঁর উচ্ছ্বল যৌবন কেমন রঙিন ছিল, তা-ও স্পষ্ট হয়। কিন্তু কোথাও উল্লেখ থাকে না তাঁর রোগের। শুধু তা-ই নয়, এখানে তিনি এক জায়গায় অনুভূতি ব্যক্ত করেন যে, দুঃখের চেয়ে সুখ আরও বেশি দুঃখময়।

এখন পারি না, কিন্তু এক সময় পারতাম! 
আমারও এক সময় খুব প্রিয় ছিল 
নারী, মদ, জুয়া ও রেসের ঘোড়া! 

আমিও গ্রহণ করে দেখেছি দুঃখকে 
দেখেছি দুঃখের জ্বালা যতদূর না যেতে পারে 
তারও চেয়ে বহুদূর যায় যারা সুখী!

দেখেছি দুঃখের চেয়ে সুখ আরও বেশী দুঃখময়! 
[এখন পারি না: যে তুমি হরণ করো, ১৯৭৪]

আবুল হাসানের আরেকটি অত্যন্ত রোমান্টিক কবিতা ‘সেই মানবীয় কণ্ঠ’, অনেকের মতে গভীর প্রেমের কবিতা বাস্তব অর্থে হাহাকারের কবিতা। যেমন রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কেউ তাঁর কবিতা কৌতূহল ভরে পাঠ করবেন কি না, ঠিক তেমন করে না হলেও মৃত্যু অমোঘ নিয়তি জানা একজন তরুণ কবি নিশ্চিত হয়ে যান যে, কেউ তাঁকে মনেও রাখবে না। কেউ জানবে না কেন তিনি সংসারী না হয়ে সন্ন্যাসী হলেন, কেন কোনো দিন কোনো নারীকে মাতৃত্বের কথা না বলে নির্জনতার কথা বলেছেন? তাঁর ধারণা, ঝরে যাওয়া প্রিয়তম পাতাগুলির মতোন তিনিও ঝরে গেলে কেউ আর মনেও রাখবে না। কিন্তু আমরা আজও যে তাঁকে মনে রেখেছি সে কেবল তাঁর রেখে যাওয়া অসামান্য কবিতার সম্বলের কারণে।

প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না 
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম—কেন আমি 
সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী 
হয়েছি হিরণ দাহ, হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন!

আমি এ আঁধার স্পর্শ করে কেন তাকে বলেছি হৃদয়,
তৃষ্ণায় তাড়িত তবু কেন তাকে বলেছি ভিক্ষুক
আমি এ জলের পাত্রে জল চাই না, বিষ চাই, বিষও তো পানীয়!
[সেই মানবীর কণ্ঠ: যে তুমি হরণ করো, ১৯৭৪] 

এই তীব্র নিরাময় অযোগ্য অসুখ কবির আরও অনেক কবিতায় ছায়া ফেলেছে। তবে শিল্পিত আড়াল কবিতার ভাষাকে করেছে মোহময়, দৃশ্যকল্পগুলো হয়েছে বর্ণময়। কোথাও তিনি বলছেন, ‘শূন্য হোক, পূণ্য হোক খাঁ-খাঁয় ভরপুর হোক সব কিছু/ দুঃখ যেন দেখতে পায় আমি সুখে আছি’। আবার কখনো তিনি আবিষ্কার করছেন, ‘মৃত্যু তার কালো শুঁড় দিয়ে সব টেনে তুলছে/ জীবনের পালটে যাওয়া বয়সের পাথরগুলোকে’। ‘যে তুমি হরণ করো’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটির শেষ কবিতায় আমরা এক কবির ভাসমান মৃতদেহ দেখতে পাই, জলে ভাসমান কবির লাশ—পদ্মা তাকে ঠুকরে ঠুকরে খায়, যেন তারই অশ্রু তারই অক্ষমতা। এই মৃত্যু দেখে ফেলে মাছরাঙা পাখি এবং জলের ঘূর্ণি, যেন জেলের দু’হাতের জালে আটকা চকচকে রূপোলী ইলিশ মৃত্যু। এখানে একটা মারাত্মক উচ্চারণ স্তম্ভিত করে দেয় শেষের চরণগুলোয়—

কবি যতবার কাঁদে এদেশেও অনাচার, মৃত্যু আর রক্তারক্তি বাধে! 
কবির মৃত্যু নিয়ে আজ দেখো ঐখানে লোফালুফি চলে
ঐ তো পদ্মায় ওরা কবির ভাসন্ত মরা দেহ নিয়ে 
        খেলছে, খেলছে!
[কবির ভাসমান মৃতদেহ: যে তুমি হরণ করো, ১৯৭৪] 

কিন্তু পরের কাব্যগ্রন্থের সূচনাতেই কবি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভঙ্গিতে মৃত্যুকে উপস্থাপন করেন। তিনি এখানে প্রেমিক রূপ ধারণ করে দাবি করেন—প্রেমিকের মৃত্যু নেই। এখানে তিনি বিভিন্ন চিত্রকল্পে কখনো মৃত্যুর মুখে হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস, কখনো কর্ডোভার পথের বেদুইন বলে দাবি করেন, আবার কখনোবা হারানো পারের ঘাটে জেলে ডিঙিতে জালে তোলা কুচো মাছের কাঁচালী সৌরভের মধ্যে কিংবা নদীর নির্মল ব্রিজে বিশুদ্ধির বিরল উত্থানের মধ্যে কবি নিজেকে দেখতে পান। শত অসুস্থতা সত্ত্বেও কবির এই প্রতীতি স্থির হয় যে কবির আত্মাকে কেউ দীর্ণ করতে পারবে না, মারতে পারবে না। তাঁর এই বিশ্বাস এই প্রতীতি আমরা ‘রাজা যায় রাজা আসে’ গ্রন্থেও লক্ষ করি—

আমি যেন আবহমান 
থাকবো বসে ঠুকরে খাব সূর্যলতা, 
গাছের শেকড়, অন্ধকারের জল
আমি যেন আবহমান
আবহমান আমিই কল্লোল…
[আবহমান: রাজা যায় রাজা আসে, ১৯৭২]

আজ বাংলা কবিতার পাঠকমাত্রেই জানেন, কবি আবুল হাসান মৃত্যু দিয়েই মৃত্যুকে জয় করেছেন। ষাটের দশকে বাংলা কবিতা ভরে উঠেছিল কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোয়। তাঁদের মধ্যে জন কিটসের মতো ক্ষণজন্মা ছিলেন আবুল হাসান। জনশ্রুতি রয়েছে, গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে আসা এই তরুণ শুধু কবি হওয়ার জন্যই ঢাকায় এসেছিলেন। তাই উদ্ভ্রান্তের মতো লিখে গিয়েছেন একের পর এক সব স্বপ্নগ্রস্ত কবিতা। প্রথম কবিতা প্রকাশের সময় পিতৃপ্রদত্ত নাম ‘আবুল হোসেন’ বলবৎ রাখলেও শিগগিরই তা ‘আবুল হাসান’ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, প্রবীণ কবি আবুল হোসেনের সাথে নামের টক্কর না লাগাই ছিল এর কারণ। কিন্তু সমালোচকেরা বলেন, নামের স্মার্টনেস আসার সাথে সাথে কবিতায়ও স্মার্টনেস এসে ভর করেছিল। তাই কবি আবুল হাসান নিজেকে, কিংবা বলা যায়, নিজের নামকে পাঠকের কাছে কবিতার মাধ্যমে বিশেষভাবে তুলে ধরেন— ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র মায়াবী করুণ’।

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলাদেশের [তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের] বাঙালি কবিদের কবিতায় প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল লিভারপুলের কবিদের কবিতা। তাঁদের ভঙ্গিতে কবি নির্মলেন্দু গুণ ও রফিক আজাদ বেশ কিছু জনপ্রিয় কবিতা রচনা করেছিলেন। এমনকি শামসুর রাহমানও কিছুটা পরিশীলিত অর্থে কিয়ৎকালের জন্য লিভারপুল কবিকুলের প্রভাবান্বিত ছিলেন। সেকালের ‘ভালবাসা তুমি’, ‘ভালবাসা মানে’, কিংবা ‘স্বাধীনতা তুমি’ শীর্ষক কবিতাগুলোর দিকে দৃকপাত করলেই বিষয়টা বোধগম্য হবে। সেদিক থেকে আবুল হাসান ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বরের, ভিন্ন আঙ্গিকের ও ভিন্ন ভাষার কবি। তিনি তাই নিজেই তৈরি করে নেন ভাবীকালের পাঠক, আর এভাবেই তিনি থেকে যান পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকের হৃদয়ের গভীরে, মৃত্যু তাঁকে কখনোই মারতে পারেনি।

[প্রথম প্রকাশ: তর্ক বাংলা ডট কম]

মন্তব্য: