কঠিন চীবর দান : কৃচ্ছ্রসাধনার উৎসব

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

অনুপম হীরা মণ্ডল

১. ভূমিকা

বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিটি নিয়ম-রীতিই শুদ্ধচারী হওয়ার শিক্ষা দেয়। এমনি একটি শুদ্ধচারী ব্রত হলাে কঠিন চীবর দানােৎসব। চীবর অর্থ বস্ত্র। গৃহী বৌদ্ধগণ তাদের ধর্মগুরু তথা ভিক্ষুদের দান উৎসবের মাধ্যমে ব্স্ত্র দান করেন। নানা রীতি-নীতি আর ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে

উৎসব পালন করা হয়। গৃহীগণ নিজেদের নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার সাক্ষর রাখেন এই উৎসবের মধ্য দিয়ে। এটি যেমন তাদের দানশীল মানসিকতার প্রমাণ রাখে তেমনি এর সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি জড়িত। বৌদ্ধ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, একজন বৌদ্ধ গৃহী শতবর্ষ ধরে যতাে দান করেন তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ দান হলাে চীবর দান। একইভাবে তারা বিশ্বাস করে যে, এই বিশ্বে যতাে প্রকার দান আছে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ দান চীবর দান। একখানি চীবর দানের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনাে দান অপেক্ষা ষোলগুণ পূণ্য অর্জিত হয়। এমনকি সমগ্র পৃথিবীর সকল দান একত্র করলেও চীবর দানের সমান হবে না। এটি কেবল বৌদ্ধদের পুরাণের বর্ণনা নয় বৌদ্ধরা মনে-প্রাণে এই বিশ্বাস স্থাপন করে চীবর দান উৎসব পালন করে।

২. কঠির চীবর দানােৎসবের উদ্ভব

বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সব সময় কৃচ্ছ্র সাধনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। ব্যক্তিগত বিষয়-বৈভবের দিকে তাদের আগ্রহ কম। অধিকাংশ ভিক্ষুগণ ভিক্ষুসংঘে ধর্ম প্রচার ও কল্যাণ চিন্তার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। ভিক্ষুদের দেখা যায় তাঁরা বুদ্ধেত্বলাভের বাসনায় প্রতিনিয়ত ত্যাগ ও সংযমের শিক্ষা করেন। ত্যাগ ও সংযমের এই শিক্ষা শুরু হয় বুদ্ধদের কাল থেকেই। তাঁরা যেমন খাদ্যে সংযম রক্ষা করেন তেমনি পােশাকেরও সংযমী হতে দেখা যায়। বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ এমন কোনাে পােশাক পরিধান করেন না যা দ্বারা তাদের মনে বৈরাগ্য নষ্ট হয়। তারা হলুদ কিংবা গেরুয়া পােশাক পরিধান করেন। এই পােশাক হলাে বাস্তব জগৎ ও জীবনের সকল লােভ ও লালসা থেকে দূরে থাকার পােশাক। এই পােশাক যারা পরিধান করেন তারা সকল প্রকার মােহ ও বৈষয়িক ভাবনা থেকে দূরে অবস্থান করেন। প্রাচীনকাল থেকে বৌদ্ধভিক্ষুগণ তাদের পরিধেয় বস্ত্র পরিধানের ক্ষেত্রে এই সব নিয়ম পালন করে আসছেন। তারা কোনাে প্রকার বাণিজ্যিক পােশাকের উপর নির্ভর করেন না। বাহারী কিংবা বহুরূপী পােশাক পরিধান করা থেকে তারা বিরত থাকেন। কারণ তাতে মনে কামনার উদ্রেগ হয়। সেই কামনা থেকে বৈষয়িক ভাবনা আসে। আবার বৈষয়িক ভাবনা থেকে দুঃখের সূত্রপাত ঘটে। এই দুঃখ জীবনের কল্যাণ থেকে ভিক্ষুদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে তাই বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘে এই রীতি প্রচলিত আছে।

পাচানিকালে বৌদ্ধভিক্ষুগণ ক্রয় করে কোনাে পােশাক পরতেন না। এমনকি কোনাে দ্রব্য বিনিময় করেও তারা পরিধেয় বস্ত্র সংগ্রহ করতেন না। কারণ এভাবে বস্ত্র সংগ্রহের তাদের কোনাে নিয়ম নেই। তারা অন্যের দান করা বস্ত্র পরিধান করতেন অথবা পাংসুকুলিক চীবর পরিধান করতাে। পাংসুকুলিক চীবর অর্থাৎ শ্মশানে বা অন্য কোথায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা বস্ত্র। এই সব বস্ত্র পরিধান করাতে ভিক্ষুগণ অনেক সময় অনেক দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতেন। কারণ কখনাে কখনাে সংক্রামক ব্যাধি আক্রান্ত ব্যক্তিদের পােশাকও ভিক্ষুগণ কুড়িয়ে নিয়ে পরিধান করতেন। এইসব রােগাক্রান্ত ব্যক্তির পােশাক পরিধান করাতে তারাও অনেক পীড়ায় ভুগতেন। এছাড়া এই বস্ত্রগুলাে অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুব নােংরা থাকতাে যা তাদের বিভিন্ন প্রকার অসুখের কারণ হয়ে দাড়াতাে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেছে এই সব পােশাক পরিধান করাতে ভিক্ষুদের স্বাস্থ্যহানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতাে প্রচুর। 

যারা অন্যের দুঃখ মােচন করবে তাদের এভাবে রােগাক্রান্ত হওয়াটা ছিল দুঃখজনক। তাই বুদ্ধদেব তাদের চীবর অর্থাৎ নতুন বা পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করার বিধান দেন। গৌতম বুদ্ধ যখন রাজগৃহে বর্ষাবাস করেন তখন তিনি ভিক্ষুদের বস্ত্র পরিধান সম্পর্কিত এই বিধান দেন। তিনি বলেন যে, গৃহীগণ ভিক্ষুদের এই বস্ত্র দান করবে। সেই থেকে গৃহীদের দানের মধ্য দিয়ে কঠিন চীবর দানােৎসব পালিত হয়ে আসছে।

বুদ্ধদেব ভিক্ষুদের দানকৃত বস্ত্ৰ পরিধান করতে বলেছেন। তবে সকল ভিক্ষুই এই বস্ত্রের অধিকারী হওয়ার যােগ্য নয়। বৌদ্ধরীতি অনুযায়ী ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস সমাপ্ত করতে হয়। যারা এই বর্ষাবাস সমাপ্ত করেন তারাই কেবল দান করা এই বস্ত্র পরিধান করতে পারেন। তবে বস্ত্রের রঙ সম্পর্কেও বুদ্ধের সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। ভিক্ষুদের দান করা বস্ত্রের রঙ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বৃক্ষর মূল, ছাল, বাকল, শুকনাে পাতা, ফুল ও ফলের রঙ অনুযায়ী ষড় রঙই ভিক্ষুদের জন্য উপযুক্ত। তবে ভিক্ষুদের জন্য হলুদ ও গেরুয়া রঙের পােশাক পরতে দেখা যায়। এই রঙের বস্ত্ৰ তারা লাল ফুলের রঙ থেকে পেয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বৌদ্ধদের বিশ্বাস ভিক্ষুদের পােশাকের এই রঙটি এসেছে লাল ফুলের পাপড়ি থেকে। এ রঙটি গৃহী বৌদ্ধগণ পরিধান করেন না। গৃহীদের বস্ত্রে অজস্র রঙ থাকতে পারে। তবে ভিক্ষুদের এই বৈচিত্র্যহীন বস্ত্র পরিধান করার রীতি প্রচলিত। 

কেবল বৌদ্ধভিক্ষুদের রােগ-শােক থেকে মুক্ত করতে কঠিন চীবর দানের উদ্ভব ঘটেনি। এটি গার্হস্থ্য বৌদ্ধদের ভিক্ষুদের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। যারা গৃহকর্ম করে দিনযাপন করে তারা তাদের ভিক্ষুদের প্রতি নিজেদের শ্রদ্ধা প্রকাশ করার একটি মাধ্যম তৈরি হয়। বরাবর বৌদ্ধ সমাজে ধর্ম প্রচারকদের ভক্তি জানাতে দেখা যায়। বস্ত্রদান বৌদ্ধ সমাজের এই ভক্তি প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম। এটি কেবল নিছক ভক্তি প্রকাশের বিষয়ও নয়। নীতি এবং কৃচ্ছ্রতা সাধনের শিক্ষার বিষয়ও। দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েরই নীতি শিক্ষার সুযােগ ঘটে। দাতা কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে বস্ত্র বয়ন করে দান করেন। একই সঙ্গে গ্রহীতাকেও কঠিন সাধনায় সফল হওয়ার পরই দান গ্রহণ করার সুযােগ গ্রহণ করতে হয়। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে কৃচ্ছ্রতা সাধনের যে মন্ত্র উচ্চারিত হয় কঠিন চীবরদানের মধ্য দিয়ে তা আরাে বেশি স্পষ্ট হয়।

৩. কঠিন চীবর দানের নিয়ম

কঠিন চীবর দান যে একটি পূণ্যকর্ম তা প্রতিটি বৌদ্ধ স্বীকার করে। লােকশ্রুতি থেকে শুরু করে বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থে চীবর দানকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বৌদ্ধপুরাণ ও শাস্ত্রী কাহিনীতে চীবর দানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর পূণ্য কেবল এক জীবনে হবার নয়। বলা হয়ে থাকে যিনি চীবন দান করবেন তিনি জন্ম-জন্মান্তরে এই পুণ্য ভোগ করতে পারবেন। তবে ইচ্ছা অনুযায়ী কিংবা খুশি মতাে চীবর দান করা যায় না। এর সঙ্গে যেমন ধর্মীয় বিশ্বাস জড়িত তেমনি কিছু ক্রিয়া-করণ যুক্ত। একটি উৎসবমুখর পরিবেশে চীবর দান করা হয়। তবে এই চীবর বা বস্ত্ৰ বয়ন করার কিছু কঠিন নিয়ম রয়েছে। অত্যন্ত কষ্টসাধ্যকর্ম বলে এই উৎসবের সঙ্গে কঠিন শব্দটি যুক্ত হয়েছে। যাদিন বন্ত্ৰ দান করা হয়। যেদিন বস্ত্র দান করা হয় সেদিন সূর্য উদয় হওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী দিন সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত দাতার সময় নির্ধারিত। এই সময়ের মধ্যে যিনি বস্ত্ৰ বয়ন করবেন তাঁকে সুতাকাটা, কাপড় বয়ন করা, কাপড় কাটা, সেলাই করা, রঙ করা, ধৌত করা এবং শােকানাের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কর্ম। তাই একে কঠিন চীবর দান বলা হয়েছে। এছাড়া আরাে অনেক কর্ম রয়েছে। যা যিনি দান করেন তাকে যেমন পালন করতে হয় তেমনি একজন বৌদ্ধভিক্ষু যিনি এই বস্ত্ৰ গ্রহণ করবেন তাকেও পালন করতে হয়।

যে কোনো সময় চীবর দান করা যায় না। এই উৎসবকে বলা যেতে পারে ঋতুভিত্তিক উৎসব। কারণ একটি বিশেষ সময় কেবল এই উৎসব পালন করার রীতি প্রচলিত। সময়টি হলো প্রবরণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে কার্তিকী পূর্ণিমার পূর্ব পর্যন্ত। এই একমাস কেবল কঠিন চীবর দান উৎসব পালন করা যায়। তবে প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে কেবল বছরে একবার এই উৎসব পালন করার রীতি আছে।

বৌদ্ধসংঘ থেকে ধর্মানুসারীদের যে সব নীতি শিক্ষা দেওয়া হয় তার অনেকখানি ঘােষিত হয় কঠিন চীবর দানােৎসবের সময়। এটি কেবল পূণ্যলাভের আশায় বৌদ্ধ সম্প্রদায় পালন করে না। তারা তাদের ধর্ম প্রচারক বা ধর্মীয় গুরুদের ভক্তি জানানাের জন্যও পালন করে। এর মধ্য দিয়ে গৃহী যেমন গুরুর প্রতি ভক্তি নিবেদন করতে পারে তেমনি গুরুও তার কৃচ্ছ্র সাধনের প্রমাণ রাখতে পারেন। গুরু নিজেই অত্মস্থ করেন তিনি কতােখানি দান গ্রহণ করার যােগ্য হয়ে উঠেছেন। একই সঙ্গে দাতা তার নিষ্ঠা আর শ্রমকে সঙ্গী করে ভিক্ষুর প্রতি তার অর্ঘ্য নিবেদন করার সুযােগ পায়। দাতাও সুযােগ পায় তার ধর্ম ও ধর্মীয় গুরুদের প্রতি নিষ্ঠা পােষণ করার। বৌদ্ধদের মধ্যে উৎসবটি পালন করতে কোনাে উৎসাহের কমতি লক্ষ্য করা যায় না। উৎসব উপলক্ষে তারা স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে। একই সঙ্গে আত্মীয় বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়দের বৌদ্ধ সংঘের উৎসবের নিমন্ত্রণ জানানাে হয়। কন্যাকে নায়াের আনা হয়। উৎসবের দিন উৎসবস্থলে গ্রামের সকল নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে উৎসবে যােগদান করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধর্মালােচনা শ্রবণ করে এবং নবীনদের চীবর দানের ক্রিয়া-কৃত্য সম্পর্কে অবহিত করে। এর মাধ্যমে নবীনও উপযুক্ত একজন দাতা হয়ে ওঠার তালিম পায়।

৪. উপসংহার

বাংলাদেশের প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে কঠিন চীবর দানােৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব এখন কেবল বৌদ্ধদের উৎসআ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যখন এই উৎসব পালন করা হয় তখন অনেক পর্যটক উৎসবটি দেখতে যায়। কেবল দেশের পর্যটক নয় অন্যান্য দেশের পর্যটকরাও উৎসবে যােগদান করে। বর্তমানে পৃথিবীর যেখানে যেখানে বৌদ্ধ সম্প্রদায় আছে সেখানেই এই উৎসব পালিত হয়। চীন, জাপান, ভারত, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে এই উৎসব পালন হওয়ার কথা জানা যায়। এটি যে এখন একটি সর্বজনীন উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছে তা উৎসবে আগত দর্শনার্থী তথা পর্যটকদের দেখলে বােঝা যায়।

তথ্যসূত্র ও টীকা

সিরাজুল ইসলাম সম্পা, বাংলা পিডিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকাঃ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সােসাইটি, ২০১১)

পৃ. ২৯১-২৯২।

তদেব, পৃ. ২৯২।

তদেব।

মন্তব্য: