মাজহারুল হক লিপু

’কি দোস্ত সন্ধ্যাতো পার হইয়া গেল,অহনো বাড়ি যাও নাই?’-কথাগুলো বলতে বলতে ইদ্রিস আলী বাদশা মিয়ার চায়ের স্টলে প্রবেশ করে। ইদ্রিস কথাগুলো কেন বলল তা বুঝতে কষ্ট হয়না বাদশা মিযার। লজ্জায় কেমন লাল হয়ে যায় মুখটা। এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে না বললেও পারত সে। 

’ক্যান? নয়টা-দশটার আগে কোনদিন দোকান বন্ধ করছি?’-লাজুক স্বরে জবাব দেয় বাদশা।

হাল ছাড়েনা ইদ্রিস। হাসতে হাসতে বলতে থাকে – ’না মানে সারাদিনতো বিশ্রাম হয়নাই।’

এবার আর কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে চা বানাতে থাকে বাদশা। সত্যি কথাই বলেছে ইদ্রিস। গত তিনটা রাত একটুও ঘুমায়নি সে। মনিরার সাতে গল্প করতে করতে কখন যে রাতগুলো কেটে যায় বুঝতেই পারেনো সে। সত্যিই ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে এখন।

মাত্র তিনদিন আগে মনিরার সাথে বিয়ে হয়েছে বাদশা মিয়ার। দেখতে খুব সুন্দরি না হলেও চেহরারার মধ্যে একটা মায়াবী ভাব আছে তার। মনিরার চোখের দিকে তাকালে বাদশার কাছে মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর আর কি হতে পারে পৃথিবীতে। বাদশার শ্বশুর বাড়ির অবস্থাও খুব খারাপ নয়। নিজের যা জমি আছে তা দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়না তার। মনিরাকে অনায়াসেই একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারত তার বাবা। শুধুমাত্র ইদ্রিস আলীর চেষ্টাতেই তারে সাথে বিয়ে হলো মনিরার। নিজের একটা ঘরও নেই তার। সেই ছোট বেলায় কাজের খোঁজে রতনপুরে এসে চায়ের দোকানে কাজ নেয়া তারপর অনেক পরিশ্রমের ফল এই নিজের চায়ের দোকান। নদীটার ঐ পাড়ে করিম মিয়ার বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে সে। এরকম একটা ছেলের সাথে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায়? ইদ্রিস আলীর ফুপুর দিক দিয়ে কেমন যেন আত্মী য় হয় মনিরার বাবা। ইদ্রিস তার ফুপুকে কাজে লাগিয়ে অনেক কষ্টে এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। ইদ্রিস সত্যিই তার বড় ভালো বন্ধু। শুধু রসিকতা একটু বেশি করে এই যা।

’দোস্ত দুইটা চা দ্যাও এইদিকে’-ইদ্রিসের কণ্ঠ শুনে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসে বাদশা। চেয়ে দেখে সে মামুন সাহেবের সাথে খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে। মামুন সাহেব লোকটাকে ইদানিং রতনপুর বাজারে খুব দেখা যায়। একটা মটর সাইকেলে করে প্রায়ই আসে। সে নাকি এলাকার গরিব মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করে। দরিদ্র,জীবনযাত্রা এরকম কি সব শব্দ ব্যবহার করে ভালো বোঝেনা বাদশা। রাতে দোকান বন্ধ করার পর হাঁটতে হাঁটতে ইদ্রিসের কাছে মামুন সাহেব সম্পর্কে জিঞ্জাসা করে সে।

’উনি হইল ফিল্ড ওয়ার্কার। গ্রামের মানুষের উন্নতি চায় । প্রয়োজনে টাকাও ধার দেয়’-কথাগুলো বলেই হঠাৎ থামে ইদ্রিস। ততক্ষণে তারা ব্রিজঘাটে চলে এসেছে। প্রতিদিনই প্রায় বাদশাকে ব্রিজ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায় সে। ইদ্রিস চলে যাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদীটাকে দেখে বাদশা মিয়া। আজও দাঁড়াল অনেকক্ষণ।

ঘরে ফিরেই দেখে মনিরা খাবার নিয়ে বসে আছে। খেতে খেতে অনেক গল্প করে ওরা। আজ সারাদিন কেমন কাটল, কী করল সেসব । দুপুরে নাকি খুব একা একা লাগে তাই মনিরা আজ গিয়েছিল বাড়িওয়ালার ঘরে। বাড়িওয়ালী চাচীর সাথে অনেক গল্প করেছে সে। চাচী নাকি তার মোবাইলে মনিরার ছবিও তুলেছে। ’কি সুন্দর মোবাইল, গান শোনা যায় আবার দ্যাখাও যায়। চাচীতো সারাদিনই মোবাইলে গান শোনে।’-মনিরার কথাগুলো শুনেেত শুনতে একটা ভাবনা খেলা করে বাদশা মিয়ার মাথায়। বউটা সারা দিন একা থাকে ঘরে। নিশ্চয় ওরকম একটা মোবাইল কিনে দিলে খুব খুশি হবে সে। সারাদিন গান শুনবে,বাপের বাড়িতে কথা বলবে। মাঝেমধ্যে বাদশা মিয়াও ময়েনের ফোনের দোকান থেকে ফোন করে খবর নেবে তার।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই করিম চাচার কাছ থেকে চাচীর মোবাইলের দাম জেনে নেয় বাদশা। দামটা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় তার।আটহাজার পাঁচশ। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা তার আনন্দে ভরে ওঠে মামুন সাহেবের কথা ভেবে। আজই কখা বলবে তার সাথে। আট হাজার টাকা যদি ধার নেওয়া যায ধীরে ধীরে শোধ করে দিতে পারবে সে। বিকালেই কথা হয় তার সাথে। টাকার প্রয়োজন শুনে মামুন সাহেব যেন বেশ খুশিই হলো। প্রতি সপ্তাহে চারশ টাকা করে মোট ছয়মাস কিস্তিতে শোধ করতে হবে টাকাটা। সপ্তাহে চারশ টাকা দেওয়া বাদশার জন্য একটু কঠিন তারপরও মাত্রতো ছয় মাস। মনিরার জন্য এটুকুও কি করতে পারবেনা সে ।  সন্ধ্যার মধ্যে টাকা নিয়ে হাজির হয মামুন সাহেব। একগাদা কাগজপত্রে সই করিয়ে নিযে ষোলটা পাঁচশ টাকার নোট বাদশার হাতে ধরিয়ে দেয় সে। একটু পরেই ইদ্রিস এলে বাদশা বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলতে থাকে-’দোস্ত কাইল আমার লগে একটু শহরে যাইবা? মনিরার লাইগা একটা মোবাইল কিনতে হইব।’

’টাকার খুব গরম মনে হয?’ ইদ্রিস বেণ্চ বসতে বসতে বলে।

’না, মামুন সাহেবের থন লোন নিছি। কিস্তিতে শোধ করতে হইব।’- বাদশা কথাগুলো খুব উচ্ছ্বাসের সাথে বললেও ইদ্রিসের চেহারায় কেমন যেন চিন্তার ছাপ পড়ে।

পরেরদিন খুব সকালে বাদশা মিয়ার সাথে শহরে য়েতে আপত্তি করেনি ইদ্রিস। রাতে ব্রিজ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েও যায় । তবে আজ আর বাদশা মিয়া ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে নদী দেথেনা। প্রায দৌঁড়ে গিযে ঘরের বাইরে থেকে ডাকতে থাকে মনিরাকে। মোবাইলটা হাতে দিতেই থমকে যায় মনিরা। অবাক হযে বলতে থাকে-’কার মোবাইল?’

’তোমার জন্য আনছি।’

’এত টাকা কই পাইলা?’

’সে তেমার জানতে হইবনা । দ্যাও তোমার একটা ছবি তুলি।’-বলতে বলতে বাদশা নানান ভাবে মনিরার ছবি তুলতে থাকে

দুপুরের দিকে চায়ের দোকানে খুব একটা মানুষ আসেনা। এরকম সময়ে বাদশা মিয়ার খুবই ঘুম পায়।আজও ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। পোষ্টঅফিসের পিওন হারেস উদ্দিন শরীরে একটা ঝাকুনি দিতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। এই এক ঝামেলা । এইদোকানে যারা চা খেতে আসে তাদের সবার চিঠি বাদশার কাছে দিযে যায় হারেস। ঘুমঘুম চোখে চিঠিটা ক্যাশ বাক্সে রেকে আবার ঝিমুতে শুরু করে বাদশা। তিনমাস আগে টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল তার। প্রায় একমাস বিছানা থেকে উঠতেই পারেনি। এখনো সেই দূর্বলতা কাটেনি তার। ঐ সময় মনিরার বাবা প্রতিদিন বাজার নিয়ে না আসলে না খেয়েই মরতে হত তার। ইদ্রিসও কম করেনি। মহিম ডাক্তারকে বাড়িতে নিয়ে আসা,ওষুধ কেনা ,তিনবেলা খোঁজখবর নেযা সব কিছুই করত সে। আর মনিরা তো ছিলই। জ্বরের সময় মনিরা কপালে হাত রাখলে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করত সেসময়। সাতমাস বিযে হয়েছে তাদের। মনিরাকে একটা মোবাইল ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি সে। অথচ এসব নিয়ে কোন অভিযোগ নেই তার। তারপরও এত অভাব  ভালো লাগছেনা তার। গত তিনমাসে একটাও কিস্তি জমা দেওয়া হয়নি। মামুন সাহেব খুব কড়া কথা শুনিয়ে গেল সেদিন।

চারপাশে রোদের তেজ কমতে শুরু করেছ। ধীরে ধীরে বাজারে মানুষ আসতে শুরু করেছ একজন দুজন করে। বাদশা মিয়া এক মগ পানি নিয়ে দোকানের পিছনে গিযে চোখেমুখে ঝাপটা দিতে থাকে। 

শালার বিয়ে উপলক্ষে শ্বশুর বাড়ি গিযেছিল ইদ্রিস । আটদিন পর আজ ফিরে এসেই হন্তদন্ত হয়ে বাদশার দোকানে  ঢুকেই বলতে লাগল-’দোস্ত,আগের সপ্তাহে তোমার নামে কোন চিঠি আইছে? মামুন সাহেবের কাছে হুনলাম তোমারে নাকি ট্যাকা শোধ করার জন্য সাতদিনের নোটিশ দিছে কিন্তু তুমি কোন জবাব দ্যাও নাই। ’ বাদশার মনে পড়ল ক্যাশবাক্সের চিঠিটার কথা। কাউকেই দেখানো হয়নি। বাক্স থেকে চিঠিটা বের করে ইদ্রিসের হাতে দেয় সে। এক ঝটকায় খামটা ছিড়ে পড়তে থাকে ইদ্রিস। ’দোস্ত, তুমি কিস্তির ট্যাকা দ্যাওনা কদ্দিন? প্রশ্নটা করার সময় খুব চিন্তিত মনে হয় ইদ্রিসকে।

‘শেষ তিনমাসেরডা দেওয়া হয়নাই’-মাথাটা নিচু করে বলে বাদশা।’

‘সেই ট্যাকা অহন সুদে আসলে কত হইছে জান?’ ইদ্রিস উত্তেজিত হয়ে বলে।

‘কত?’

‘বয়ালি­শ হাজার ।’

বাদশার বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভুতি কাজ করে। অনেক্ষণ কোন কথা বলতে পারেনা। ইদ্রিস তাকে বোঝাতে থাকে কিভাবে চক্রবৃদ্ধিহারে টাকাটা বিয়ালি­শ হাজার হলো। বাদশার মাথায় কিছুই ঢোকেনা।

পরদিন সকালেই ঝণের টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগে থানা থেকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় বাদশাকে। খবরটা শুনেই ইদ্রিস ছুটে যায মনিরার কাছে।সব কিছু শুনেও খুব শান্ত থাকে মনিরা । মনিরার সহনশীলতা দেখে অবাক হয় ইদ্রিস। মনিরা শুধু অস্ফুট স্বরে বলে-’অহন কি হইব ভাই?’

’কি হইব আর ,যত তাড়াতাড়ি ট্যাকা শোধ করা যাইব তত তাড়াতাড়ি ছাড়া পাইব সে। আমি সব মিইল্যা পনের হাজার ট্যাকা দিতে পারুম,তার বেশিতো নাই। তবু দেহি কি করা যায়।’

’কাইলকা আমাপরে এট্রু বাবার বাড়িতে লইয়া যাইবেন?’

দুইদিনের মধ্যে বাবার বাড়ি থেকে ত্রিশ হাজার টাকা জোগার করে এনে ইদ্রিসের হাতে দেয় মনিরা। রাতেই মামুন সাহেবের হাতে টাকা গুলো দিযে মামলা তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করে সে।

পরদিন জেল হাজত থেকে বের হয়ে ইদ্রিসের সাথে ঘরে পৌছায় বাদশা।তখন সন্ধ্যা প্রায় লেগে এসেছে। গোঁধুলির অলোয় মনিরার মুখটাও অদ্ভুত সুন্দর লাগে বাদশার কাছে। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে তারা। তিনজনের সেকি আড্ডা। রাতে বাদশার সাথে ইদ্রিসকে জোর করে খেতে বসায় মনিরা।

‘কি দারুণ জোছনা আইজ। চলনা ইদ্রিস ভাইরে ব্রিজ পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া আসি’-মনিরা বলামাত্রই রাজি হয়ে যায় বাদশা। ব্রিজের ওপার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে ইদ্রিসকে। ফেরার সময় ব্রিজের মাঝখানে এসে হঠাৎ দাড়িয়ে পড়ে মনিরা।তারপর রেলিং ধরে ঝুকে পানির উপর চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখতে থাকে। হঠাৎ কোমর থেকে মোবাইলটা বের করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পানিতে। একটি বিন্দুকে ঘিরে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ে ঢেউ। কেঁপে ওঠে চাঁদের আলোর প্রতিচ্ছবিও। ’এইডা কি করলা?’- বাদশার এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে মনিরা।  মোবাইল লাগবনা শুধু তুমি আমার পাশে থাইকো।’ আকাশের চাঁদ ছাড়া এ দৃশ্য আর কেউ দেখেনি।

মন্তব্য: