পদ্মাবতী

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

নাজিব ওয়াদুদ

পিটালুর ছোবড়া দাঁতন ফেলে দিয়ে চারপাশটা একবার দেখল আমেনা। মৃদু বাতাস দিচ্ছে এখন। ভোরের শীতল পরশ শরীরে আদরভেজা আবেশ জাগায়। কাঁখের কলসিটা পায়ের কাছে রাখে। দু’হাতে চুল আউলা-ঝাউলা করে মাথায় বাতাস লাগায়। শাড়িটা খুলে পরে। সারা রাতের গুমোট গরমে ঘিনঘিনে ঘামে ভেজা গোটা শরীর। গায়ের ত্বক তো নয়, যেন সুনীল চামারের বাড়িতে শুকাতে দেওয়া লবনমাখানো চামড়া। ফাঁকা মাঠের শীতল বাতাসে ঘর্মাক্ত দেহখানা জুড়িয়ে যায়। ভোরের এই স্নিগ্ধ ও শান্ত নির্জনতায় কেমন এক পবিত্র আবেশে তার মন-প্রাণ ভরে ওঠে।

গাছে গাছে পাখিদের প্রভাতী শোরগোল নিস্তব্ধ-প্রায়। ভোরের গান শেষে এখন তারা দিনের কাজ শুরু করবে। তার আগে শেষ বিশ্রামটুকু সেরে নিচ্ছে। এরপর সারাদিন ধরে চলবে জীবনের যতো আয়োজন।

গাছের পাতায় বাতাসের শিহরণ লালচে সূর্যালোকে ঝলকে ঝলকে ওঠে।   

গ্রাম থেকে নদীর পাড় বেশি দূরে নয়। মাঝে ছোট্ট এক ফালি মাঠের ফারাক। আমেনাদের পুকুর পাড়ে আকাশছোঁয়া তালগাছ। তার নিচে দাঁড়িয়ে এদিকটায় তাকালে এই ছায়া-ছায়া ভোরে তাকে স্পষ্ট দেখা যাবে। চিনতেও খুব কষ্ট হবে না। কিন্তু নদীর পানি আরো দূরে। বেশ দূরে। এবার চর পড়েছে নদীর ওপাড় ঘেঁষে, এপারেই মূল স্রোত। তবু পোয়া মাইলটাক্ বালুর চর ভেঙ্গে তবে পৌঁছতে হবে সেখানে।

কলসিটা কাঁখে নিয়ে চরে নামল আমেনা।

শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করছে বিশাল পদ্মার উদোম বুক। ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে, কেবল ধূ-ধূ বালুচর। বালুর সমুদ্রে দৃষ্টি হারিয়ে যায়। তার শেষ খুঁজে না পেয়ে নজর ফিরে আসে পায়ের কাছে। তখন চোখ দুটো সরু করে সামনে তাকালে পোয়া মাইলটাক্ দূরে দেখা যায় শাদা ফিতার মতো সরু এক চিলতে চিকচিকে রুপোলি ধারা। সেটাই পদ্মা নদী। শুকিয়ে শুকিয়ে এমনই শীর্ণ।

খচখচে বালুর ওপর পাতলা পলিমাটির আস্তরণ। আমেনার পায়ের নিচে শুকনো পাতার মতো মুচমুচ শব্দ করে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায় পলির চাদর। 

চর পেরিয়ে গাঙের কিনারায় পৌঁছল আমেনা। পানিতে পা ডুবিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকল। কাঁচের মতো স্বচ্ছ, ঝকঝকে, পরিষ্কার পানি। আর কী শীতল! 

নদীর তলায় লাল শাদা কালো নানান রঙের বড় বড় বালুকণা। পায়ের প্রায়-দেখা-যায়-না এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রোমগুলো ভাসতে থাকে মৃদু স্রোতের টানে। সুড়সুড়ি লাগে। পানির নিচে উদোম পা দু’টোকে ভীষণ ফর্শা দেখায়। চকচক করে। রুপোলি ইলিশের পেটের মতো ঝিলিক মারে। পানির আয়নায় নিজের মুখখানা দেখার চেষ্টা করে আমেনা। কিন্তু পারে না। ছোট ছোট ঢেউ তার প্রতিবিম্বকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে দেয় না। ভেঙ্গে ভেঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নিরুদ্দেশে। হঠাৎ চমকে ওঠে সে। সত্যিই সে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে না তো! 

শিগগিরই তার ঘোর কাটে। তখন দু’হাতে ভর দিয়ে পাছা টেনে টেনে আরো একটু গভীরে নামে। পানি তার বুক ছুঁই-ছুঁই করছে। শরীরটা বার কয়েক শিউরে শিউরে ওঠে কী এক শীতল তৃপ্তিকর আবেশে। মুখে গলায় দু’হাত ভরে পানি ছিটায়। রাতের গুমোট গরমে আধসেদ্ধ-প্রায় দেহখানা রস-রঙ ফিরে পেয়ে পুঁই ডাঁটার মতো সতেজ হয়ে ওঠে।

আকাশে এতটুকু মেঘ কি মলিনতার দাগ নেই। নীল কাঁচের মসৃণ ছই যেন ঢেকে রেখেছে পৃথিবীটাকে। সামনে নদীর ওপারে ধূ-ধূ বালুর চর। উঁচু-নিচু টিলার মতো এবড়োখেবড়ো। এলোপাতাড়ি। ডাইনে-বাঁয়ে সরু নদীটা একটা গিরিপথের মতো হারিয়ে গেছে দুই চরের মাঝখানে। বুক শূন্য করা একটা ভিজে দীর্ঘশ্বাস সকালের পাতলা শুকনো বাতাসকে আর্দ্র করে তোলে। দু’হাতে আঁজলা ভরে পানি তুলে মুখে ঝাপটা মারে আমেনা। কয়েকবার। তারপর ডুব দেয়। দমভর ডুবে থাকে। পানির শীতল স্পর্শ তাকে আপ্লুত করে রাখে। একটু সাঁতারও কাটে। খানিক পর তীরে ওঠে। কলসিটা টেনে নিয়ে আবার পানিতে নামে। ভালো করে ঘষে-মেজে ওপরের পানি সরিয়ে ভরে নেয় কলসিটা। রেখে আসে ওপরে। আরো একটুক্ষণ পানিতে থেকে শেষ ডুবটা দিয়ে তবে ওঠে সে। 

পরিষ্কার আলোয় সব কিছু স্পষ্ট এখন। দূরে গাছ-গাছালির আড়ালে গ্রামগুলো জেগে উঠেছে। বউ-ঝিরা কলসি কাঁখে গাঙের পথ ধরেছে।

পুকুরের পাড় বেয়ে বাইরের আঙিনায় এসে পৌঁছল আমেনা। গোয়ালে গাইগরুটা তখনো ওঠেনি। শুয়ে শুয়েই জাবর কাটছে। পুকুরের ওপাড়ে তালগাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে তফেজ হাজী। তাকে ইশারায় কিছু বলল সে। তারপর খেজুরপাতার বেড়ার মাঝখান দিয়ে সোজা বাড়িতে ঢুকল। মুরগিগুলো ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল, বুড়িটা তার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কঁক্-কঁক্ করে বেড়াচ্ছে উঠোনময়। বারান্দার কাঁথিতে কলসি রেখে আগে কাপড় ছাড়ে সে। তারপর শিকেয় রাখা হাঁড়ি থেকে এক মুঠ চালের খুদ নিয়ে উঠোনে ছড়িয়ে দেয়। খুঁটে খুঁটে খায় মুরগিগুলো।

তখন হাজী সাহেব বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বদনা নিয়ে কলসি থেকে পানি ঢালল। গামছা পাকিয়ে সামনে পেছনে চুল ঝুলিয়ে সপাং-সপাং করে চুল ঝাড়ছিল আমেনা। পানি ঢালার শব্দ পেয়ে তাকাল সেদিকে। বলল, পানি কম কইরি খরচ কইরেন দাদা। তার উত্তরে কিছু বলল হাজী, কিন্তু মুখভর্তি পেস্টের ফেনায় তা স্পষ্ট হলো না। সেজন্যে তখন তখনই সম্পূর্ণ করল না কথা। তার বদলে পিচ করে উঠোনে একমুখ ফেনা ফেলে জিভটাকে ছাড়াল। বলল, দ্যাশ্ কি মরুভূমি হয় গেছে নাকি? পানির এ্যাতোই অভাব? একরাশ বিরক্তি ফুটে উঠল বাড়িওলীর মুখে-চোখে। হাজীর নজরে পড়ল সেটা। হাতের বদনা কাত করে পানি ঢেলে ফেনা ধুয়ে ফেলল সে। 

আমেনা বলল, গাঙ থেকি পানি টাইনি আইন্তে হয়। আপনের না হয় চাকর-বাকর আছে, বুইঝ্তে পারেন না। আমার জান বারায়ে যায়। 

পানি আনার এই কাজটা ক্রমেই নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খুবই বাজে কাজ। মানে হাজী সাহেব। গ্রামের কোনও টিউবওয়েলেই পানি ওঠে না। পুকুর-ডোবাও সব শুকনো। পানির বদনা নিয়ে উঠোনের পুব কোণে কুমড়োর মাচানের নিচে গিয়ে মুখ ধুতে লাগল সে।

ঘরে ঢুকল আমেনা। এক তাড়া নোট এনে হাজীর হাতে ধরিয়ে দিলো। -দেরি হইলো বুইলি কিছু মুনে কইরেন না দাদা। 

টাকা গুনে নিয়ে হাজী বলল, ব্যবসা তাহিলে ভালুই চইল্ছে, নাকি? 

Ñএডি কি ব্যবসা হইলো, বুলেন দাদা? আমিও বুঝি। কিন্তুক্ কী কর্ইবো! প্যাটের দায়। মান্ষের কথা শুইনলে তো প্যাট্ চলে না। 

-মান্ষের কথাত্ কান দিবিনি তাহিলেই হোইলো। কথাতে কি চিড়ি ভিজে?

লোকটাকে মান্য করে আমেনা। বিপদে-আপদে সাহায্য করে। 

রাত নেমেছে অনেক আগে। জোছনা ফুটেছে আকাশে। দিনের মতো ধব-ধব করছে পৃথিবী। ভাত-তরকারি বেড়ে ঘরে নিয়ে আসে আমেনা। রান্নাঘরের ঝাঁপ লাগিয়ে দেয়। ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে। বাতিটার সলতে নামিয়ে তার তেজ কমায়। আলাদা করে রাখা বাটিটা কোছার নিচে নেয়। তারপর বাইরে বেরোয়। ঘরের দরোজায় তালা লাগিয়ে উঠোনে নামে সে।

পাড়া ভেঙ্গে হোসেনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল আমেনা। খোলা উঠোন। এক কোণে বাতাবি লেবুর গাছ। অন্য কোণে একটা মাত্র মাটির ঘর। তার কোল ঘেঁষে একটা চালার নিচে উনুন। খেজুর পাতার বেড়া দিয়ে দু’দিকে ঘেরা। রান্নাঘর সেটা। বাড়ির পেছনে তরি-তরকারির বাগান। উঠোনের প্রায় সামনে, ডান পাশ ঘেঁষে একটা আমের গাছ। উঠোনময় আবছা অন্ধকার। 

হোসেনের ঘরের বারান্দা বেশ উঁচু। ধাপি বেয়ে ওঠে আমেনা। দরজা ভেড়ানো। ভেতরে হারিকেনের আলো। শিকল নাড়ল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলল হোসেন। যেন তৈরী হয়েই ছিল সে। হাতে লম্বা সলতের বাতি। উৎসুক চোখ। -আইসো। 

বেশ বড় ঘর। পুব-পশ্চিমে লম্বা। ছোট ছোট ছয়টা জানালা। তার সব কয়টা খোলা। পুবের দেয়াল ঘেঁষে একটা চৌকি। ওপরে বাঁশের তাক। তাতে কয়েকটা পোঁটলা। এক পাশে কিছু হাঁড়ি-কুড়ি। পশ্চিম কোণে কী সব এলোমেলো পড়ে রয়েছে। তারই পাশে ভাত-তরকারির হাঁড়ি, থালা-বাসন। সেদিকে তাকিয়ে আমেনা বলল, খাওয়া-দাওয়া হয় গেছে নাকি? 

-না। ক্যান্ ? 

আঁচলের আড়াল থেকে বাটিটা বের করল আমেনা। হোসেনের চোখে-মুখে বিস্ময়ের ঘোর। সে একবার বাটির দিকে, আরেকবার আমেনার দিকে তাকায়। -কী?

-তরকারি।

-তরকারি ক্যান্? 

-তুমি এ্যাতো উপকার করো আমার। আমি তো কিছু দিতে পারিনি কুনুদিন! দুঃখ ঝরে তার কণ্ঠ থেকে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ফুঁড়ে।

-কী যে বুলো ভাবি। 

তারপর দরকারি কথা সেরে নেয় ওরা।

হোসেন ফেন্সিডিল সাপ্লাইয়ের কাজ করে। ভাল আয় তাতে। আমেনাকেও কাজে লাগিয়েছে। সব বুঝিয়ে দেয় সে। -তুমি পার্ইবে। কিন্তুক্ সাবধান ভাবি। কেউ যেন্ জাইন্তে না পারে।

সে ঝুঁকি তো আছেই, জানে আমেনা। মাথা নাড়ে সে। অপমান, জেল, সব ঝুঁকি মেনে নিয়েই মাঠে নেমেছে। পেটের দায় যে! 

ঘর-বাড়ি যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনই রয়েছে। গরুটা গোয়ালে শুয়ে জাবর কাটছে। মুরগীর খোঁয়াড়টা একবার দেখে নিল আমেনা। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকল। 

বাতিটা জ্বলছিল টিমটিম করে। তার সলতেটা একটু উসকে দিল। ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। কেরোসিন বাতির লালচে-কালচে আলো। ইটের ঘর। ঝাড়-পোঁছ করা। ঝকঝকে তকতকে। আর ছিমছাম। খোলামেলা বড়-সড় ঘর। মাথার ওপরে টিনের খাড়া চালা। তার নিচে আলকাতরা-লেপা বাঁশের চাতাল। মাটির মেঝে। কাঁঠাল কাঠের চৌকি। টিনের বাক্সটা আগে থেকেই ছিল। স্টিলের আলমারিটা বেচে দিয়েছে কিছুদিন আগে। আলনা ভরা কাপড়-চোপড়। বেশ পরিপাটি করে গোছানো। কিছু দিন আগেও এই ঘরে ছিল আরো কতো তৈজসপত্র। একে একে সেসব বিকিয়ে গেছে।   

চৌকিতে তোষকের ওপর পাতা চাদরটা ঝেড়ে নেয় আমেনা। বালিশ দ’ুটো তার ওপর সাজিয়ে রাখে। আলনার কাপড়গুলো অনর্থক আবার নেড়ে-চেড়ে গোছায়। ঘুমোতে যাবার সময় এখনও হয়নি, অথচ কিছু করারও নেই। হাতে অঢেল সময়। খুচরো এমন সব কাজ যা না করলেও চলে সেগুলোই করল সে। তারপর সত্যি-সত্যিই করার মতো আর কোনও কাজ থাকে না। তখন বিছানায় পা ঝুলিয়ে তালপাখার বাতাস খায়। খুব গরম। দক্ষিণের জানালা খুলে দিল। খাটের ওপর পা তুলে বসল। নদীর দিক থেকে ঝিরিঝিরি দখনে বাতাস উঠে আসছে। তার শীতল পরশে শরীর মন কেমন অসাড় হয়ে ওঠে। কাত হয়ে খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে শোয় আমেনা। বিষণœতা গ্রাস করে তাকে। চোখ বুঁজে বিছানায় পড়ে থাকে। খানিকক্ষণ পর কী মনে করে উঠে পড়ে। দরজা খুলে বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। শাদা জোছনায় পৃথিবীটা ধুয়ে যাচ্ছে। দিনের নিদারুণ দাবদাহে ঝলসে গেছে পৃথিবীর দেহ। এখন দুধের মতো তরল জোছনা আর নদী থেকে উঠে আসা শীতল বাতাসের কোমল পরশ মলমের মতো প্রশান্তি এনে দেয়। গাঢ় তৃপ্তিতে পৃথিবী যেন সুষুপ্তিমগ্ন। বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ তা-ই দেখে আমেনা। তারপর আবার ঘরে ঢোকে। দরজা ভিড়িয়ে দেয়। বিছানায় বসে। ঘরেও এক ধরনের স্তব্ধতা জমাট বেঁধেছে। প্রত্যেকটা বস্তুই যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। জেগে আছে কেবল বাতিটা। উসকানো শিখা লকলক করে জ্বলছে। মৃদু বাতাসে কখনও কখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শিখা। আর একটানা মৃদু পুড়পুড় শব্দ। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন বাতিটার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় আমেনা। সলতের পুড়পুড় শব্দ তার বুকের মধ্যে বাজতে তাকে। 

জষ্টি মাস যায় যায়, তবু এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। মাঝে মাঝে দু’এক ফালি কালো মেঘ ভেসে আসে পদ্মার ওপর দিয়ে। কিন্তু নদী পার হয়ে গাঁয়ের আকাশে পৌঁছতে পারে না। কী এক জাদুমন্ত্রে বকের মতো শাদা হয়ে উঠে যায় উঁচুতে। তারপর ভাসতে ভাসতে নিরুদ্দেশ। 

রোদ তো নয়, গনগনে আগুন। বাতাস যেন ইটের জ্বলন্ত ভাটা থেকে বেরিয়ে আসে। গা-মুখ ঝলসে যায় তার তাতানো ঝাপটায়। একটা আমের বাগানে ছায়ার নিচে দাঁড়ায় আমেনা। 

বেলপুকুরিয়া রেল স্টেশনে মাল পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরছে সে। 

আমগাছের পাতা রোদে পুড়ে কালচে চিমসে হয়ে গেছে। এবার আমের মুকুল হয়েছিল প্রচুর। গুটিও ধরেছিল ভালো। কিন্তু রসের অভাবে কাঁচা কড়ালি শুকিয়ে হলদে হয়ে ঝরে গেল। এখন যে কয়টা আম টিকে আছে তা-ও বোঁটা শুকিয়ে খসে পড়ছে একটা-দু’টো করে। কচি কাঁঠালের বয়স বাড়ে, ধড় বাড়ে না। বামুন মানুষের মতো।

পদ্মার বুকে ঘূর্ণি ঝড় উঠেছে। ওঠে রোজ দুপুরেই। সেই ঘূর্ণিতে মণকে-মণ বালু উঠে যায় আকাশে। দেখে মনে হয় মেঘ জমেছে। কিন্তু সে পানির নয়, বালুর মেঘ, -ধেয়ে আসে ওপরে, লোকালয়ে, ফসলের ক্ষেতে। ঘর-বাড়ি, জমি-জিরেত, সবখানে, খচখচে বালু জমে।

পুকুর-ডোবা খাদ-খন্দক শুকিয়ে খটখটে। মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। টাঙ্গন গ্রামের সবচেয়ে বড় ও গভীর যে পুকুর, লোকে বলে সোনা দীঘি, তাতে এখন হাঁটু পানি। ঘোলা, লালচে পানি দুর্গন্ধ ছড়ায়। গ্রামে একটা ক‚য়াও নেই যেখানে এতটুকু পানি আছে। কোনও টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। থাকবে কেমন করে! গাঙে পানি নেই যে। গাঙের বুক শুকিয়ে গেলে তার পাড়েও পানির টান পড়ে। 

গত বছর বৈশাখে বৃষ্টি হয়েছিল মাত্র দু’বার। কিন্তু বর্ষণ ছিল ভারি। সেই বৃষ্টিতেই মাটির অন্তর ভিজে গিয়েছিল। ঐ বৃষ্টিতেই জমিতে জো ধরেছিল। লোকে ধান-পাটের বীজ ছিটিয়েছিল। এবার এক কাঠা জমি বুনতে পারেনি কেউ। মাটি দেখলে মনে হয় ঘর্ষণ লেগে ফস্ করে আগুন জ্বলে উঠবে।

টাঙ্গন গ্রামটা বেশ বড়। আটটা পাড়া নিয়ে গ্রাম। একেকটা পাড়াই ছোট-খাট গ্রামের মতো। প্রত্যেক পাড়ার আলাদা সমাজ, আলাদা কারবার। প্রকৃত গ্রামটা ছিল আরও বড়। এ গ্রামের অনেকটাই এখন পদ্মার গর্ভে। নদীর ভাঙ্গনে জমি-জিরেত হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে কতো পরিবার। সে হিসেব কেউ রাখে না। এ গ্রামের লোকজন সে কারণে বেশির ভাগই গরিব-গুর্বো, মজুর-জেলে। অধিকাংশেরই জমি-জমার পরিমাণ নগণ্য। তার ওপর নির্ভর করে সংসার চলে না। কেউ পরের জমিতে কাজ করে। কেউ নদীতে মাছ ধরে খায়। কয়েক বছর থেকে সে ধারাও পাল্টে যাচ্ছে। বলতে গেলে গোটা শুকনো মওসুমে গ্রামে কোনও কাজ থাকে না। নদীতেও মাছ হয় না। অনেকেই এখন নিত্য দিন বানেশ্বর বাজার, কাটাখালি হাট, এমনকি রাজশাহী শহরে যায় মুটে-মজুরি করতে। রোজ ভোরে বাড়ি ছাড়ে ওরা। গ্রাম পেরিয়ে যখন নামে পাড়ার বা মাঠের রাস্তায়, কিংবা তারও পরে গ্রাম পেরিয়ে পাকা সড়কে, তখন আপনা-আপনিই একেকটা দলে বাঁধা পড়ে যায় ওরা। যারা সাইকেলে যায় তারাও তখন মিছিলের মতো একজনের পেছনে আরেকজন লাইন দেয়। আর যারা হেঁটে যায় তারা কাপাসিয়া কিংবা কাটাখালি হাটে গিয়ে বাস ধরে।

মুশকিল হয়েছে তাদের যাদের করে-কর্মে খাওয়ার মতো কিছু জমি-জমা এখনও অবশিষ্ট আছে। আগে এ গ্রামে আউশ ধান, পাট, চৈতালী ফসল হতো প্রচুর। আইউব খানের আমলে বসেছিল রিভার-পাম্প। সেচ দিয়ে বোরো ও আমন মওসুমে উচ্চ ফলনশীল ধান হচ্ছিল অঢেল। হরিয়ানে বিহারী নাসিম খানের সুগার মিল চালু হলো সে সময়ই। আখের চাষ হয়ে উঠল আরও অর্থকরী। কিন্তু পদ্মার ভাঙ্গনে গ্রামের দক্ষিণ অংশের মাঠ ছোট হতে থাকল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে ভাঙ্গন আরো করাল হয়ে উঠল। তারপর ভারত ফারাক্কার বাঁধ চালু করল। বর্ষায় নদীর ভাঙ্গন আরো বেড়ে গেল। রিভার-পাম্প তুলে দিতে হলো। আর শুকনো মওসুম এলেই নদীটা মরে যেতে থাকল। নদীর সাথে পাল­া দিয়ে শুকোতে লাগল পুকুর-দীঘি, খাদ-খন্দক, মাঠ-ঘাট, সব কিছু। বৃষ্টিপাতও কমে যাচ্ছে। শুধু এ গ্রাম নয়, পদ্মার তীর ঘেঁষে যত গ্রাম রয়েছে, পুবে, পশ্চিমে, উত্তরে মাইল দুই পর্যন্ত, সবখানেই এই পরিস্থিতি। এসব এলাকার জমি এখন মরুভূমির মতো বিরান হয়ে যাচ্ছে। চৈতালী, আউশ, কিছুই আর ভালো হয় না। কৃষিকাজ উঠে যাচ্ছে এসব গ্রাম থেকে। বদলে যাচ্ছে মানুষের পেশা, জীবনযাপনের অবলম্বন ও উপায়। যারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না তারা পড়েছে চরম দুর্গতির মধ্যে। এই দুর্যোগ থেকে বাঁচতে অনেকেই এখন পৈতৃক ভিটে-মাটি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে অন্যত্র কোথাও। অন্ততঃ আট-দশটা পরিবার গ্রাম ছেড়েছে গত কয়েক বছরে।

আমেনার বাপ জব্বার মুনশীই প্রথম গ্রাম ছাড়ে। সে ঊণনব্বই সালের কথা। নাটোরের উত্তর-পুবে সিংড়া থানার খুবজিপুর গ্রাম। আমেনার নানার দেশ সেটা। সেখানে গিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছে সে। 

কারও নিষেধ শোনেনি মুনশী। যেদিন গ্রাম ছাড়ে সেদিন তার বাড়িতে সে কী ভিড় মানুষের! মানুষ মরলে, কিংবা বিয়ে-শাদি হলে এ রকম জমায়েত হয় লোকের বাড়িতে। সে রকম কিছু ছিল না সেদিন। বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে লোকে কখনও বিভুঁয়ে যায়? মুনশীর গলা ধরে পাড়া-প্রতিবেশির সেকি কান্না!

আমেনাও অনেক কেঁদেছিল। পাড়াতেই বিয়ে হয়েছিল বলে বাপ-মা ছাড়ার ব্যাথা এতদিন অনুভব করেনি সে। কিন্তু শোনেনি তার বাপ। সে-ও সয়ে গিয়েছিল। কারণ তার স্বামী ছিল। লোকটা ভালই রেখেছিল তাকে। বানেশ্বরের হাটে একটা দোকান ছিল তার। পরে জেনেছিল সেটা একটা সাইনবোর্ড ছিল মাত্র। আসলে স্মাগলিং করত লোকটা। তবে সেটা এতটাই ছোটখাট এবং মওসুমী যে লোকে টের পেত না। তার চাহিদাও ছিল কম। কিন্তু সেই লোকটাও একদিন হারিয়ে গেল। কেউ বলে বিএসএফ বা বিডিআর-এর গুলিতে মারা গেছে। লাশ ভেসে গেছে গাঙে। কেউ বলে বহরমপুরে নতুন ঘর বেঁধেছে। কোনো কথাই বিশ্বাস হয় না তার। লোকটার চাওয়া-পাওয়ার জেদ ছিল না। কিন্তু তার প্রতি, তার দেহটার প্রতি তার টান ছিল। সেটা বুঝতে পারত আমেনা। আর সে-ও যে তাকে এতোটা ভালবাসত তা-ই কি আগে বুঝেছে কখনো? মাঝে মাঝে ভাবে, এটা কি ভালোবাসা? না নির্ভরতা? লোকটাকে হারিয়ে সে অসহায় হয়ে পড়েছে। ঝড়-বৃষ্টির তুফানের মধ্যে সে যেন ছিল একটা বিশাল ঝাকড়া বটগাছ। দালান ঘরের ছাদ। সেই আশ্রয় হারিয়ে এখন সে দিশেহারা।

হোসেন সুলতানের সাগরেদের মতো। ব্যবসার সঙ্গী। অন্য পাড়ার ছেলে। আসত মাঝে মাঝে। এখন ঘন ঘন আসে। সে-ও যায় তার কাছে। এ নিয়ে পাড়ার লোকেদের কথার শেষ নেই। -বিহা কর্ইলেই তো ঝামেলা চুইকি যায়?   

-কী কইরি কর্ইবে? সুলতান যদিল্ ফিইরি আসে?

এ গবেষণা শেষ হয় না।

নিজেও ভাবে আমেনা। এভাবে কি চলে? কতদিন চলবে? দিন যেভাবেই হোক চলে যায়। রাত এলেই ভূত ভর করে তার দেহে। সে ভূতের কতো যে বায়না! ঘরের খিল এঁটে, শরীরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে, সারা রাত লড়াই করে সে ভূতের সঙ্গে। লড়তে লড়তে এতটাই ধ্বস্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে ভোরের জন্যে অপেক্ষা সয় না। পাড়ার মসজিদে ফজরের আজান পড়ে। তখন ঘরের খিল খোলে সে। আর কী আশ্চর্য! খোলা বাতাসের ঝাপটায় ভূত ছুটে যায়। অবসন্ন হয়ে বারান্দার মেঝেয় বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কলসি কাঁখে বেরিয়ে যায়। গাঙের পানিতে গা না ধুলে তার দেহের জ্বালা মেটে না। 

সেদিন ফজরের আজান পড়তে না পড়তেই দরজায় টোকা পড়ল। কখনো কখনো এভাবে শেষ রাতে ফিরতো সুলতান। ধড়মড় করে উঠল আমেনা। ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। -কুণ্ঠে ছিলে তুমি? এ্যাতো দিন কুণ্ঠে ছিলে? ঝাঁপিয়ে পড়ে সে পুরুষটার ওপর। তাল সামলাতে পারে না তারা। মেঝেয় গড়াগড়ি খায়। চুমুতে-কামড়ে পুরুষটাকে নাস্তানাবুদ করে ফেলে আমেনা। পুরুষটাও সাড়া দেয়। একতাল সেদ্ধ ময়দার মতো নরম ও উষ্ণ নারীদেহটাকে ডলে-পিষে যেন রুটির ‘লেউ’ বানিয়ে ফেলে। তারপর তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বিছানায় যায়। 

যখন ভূত ছাড়ে তখন জানালা গলে আসা ফিকে আলোয় ঘরটা আবছা দৃশ্যমান। পরস্পরকে ছেড়ে ওঠে ওরা। ফুঁপিয়ে কাঁদে আমেনা। -এ তুমি কী কর্ইলে হুসেন? তুমি আমার এ সব্বোনাশ ক্যান্ কর্ইলে?

-কী কইরি যে হয়া গ্যালো! ঐ অবস্থাত্ তুমাক্ দেইখি আমি ঠিক থাইক্তে পারিনি। বিশ্বাস করো।

-কিন্তুক্ আমার যে মহা সব্বোনাশ হয়া গ্যালো হুসেন!

-তুমি ভাইবো না। আমি তুমাক্ বিহা কর্ইবো। তুমাক্ আমি ঠগাবো না। জবান দিচ্ছি। আমি তুমাক্ ভালবাস্পো। আমি সুলতানের মুতন না। শালা কঞ্জুষের ব্যাটা কঞ্জুষ! তুমার কী কদর কর্ইতো বুলো? তুমার রূপ, তুমার যৈবন, কিসের দাম উই দিইছে? 

এ কথা মিথ্যে নয়। মানে আমেনা। দেহটা ছাড়া আর কিছু বুঝতো না লোকটা। একটা চাবি দেওয়া যন্ত্র ছিল সে। স্বামীর অবহেলায়, উদাসীনতায়, কতদিন মনে মনে কেঁদেছে।

হোসেনকে কথায় পেয়েছে। যেন অনেকদিনের বদ্ধ দূয়ার খুলে গেছে এক ধাক্কায়। এখন কথার প্লাবন শুরু হয়েছে। -তুমার দিক্ তাকায়ে আমার জান ফাইটি যাইতো। শালা বান্দরের গলাত্ সুনার মালা গো! খালি মুনে হোইতো, তুমার মুতন বো পাইলে আমি রাজরাণী বানায়ে রাখ্তু। আর মুনে হোইতো, শালাক্ যমে ল্যায় না ক্যান্! তুমি দুশ্চিন্তা কইরো না ডাল্লিং, তুমাক্ আমি অর চায়ে অনেক বেশি ভালবাস্পো। তুমার কুনু কষ্ট রাখ্ফো না। হ্যাঁ, কসম আল্লার! আবেগে তাকে বুকে টেনে নেয় হোসেন। বাধা দেয় না আমেনা। কিন্তু কেমন যেন আগ্রহও পায় না। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবে সে। অথচ এখন তার সেই বোধও হচ্ছে না।  

আমেনার গালে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে হোসেন বলল, বিডিআরের এক মেজর আইসিছে। শালা জব্বর খতরনাক লোক। অডার দিইছে দেখলেই গুলি! বডার তো বডার, মান্ষের বাড়িত্ বাড়িত্ও বুলে ছার্চ কর্ইছে। এ্যাখুন কদিন গা ঢাইকি থাইক্তে হবে। বুলা তো যায় না।

উঠলো সে। দরোজার কাছে গিয়ে কী মনে হলো, ঘুরে দাঁড়াল। বলল, সাঞ্জের পর আইসো। কথা আছে। 

বুক ঢিপ-ঢিপ করে আমেনার। সুলতানের কথা মনে পড়ে। সেদিনও লোকটা এ রকম ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, বডারের অবস্থা ভালো না। কুন্ শার্লা এক ক্যাপ্টেন আইসিছে। খুব বুলে ট্যাঁঠা! 

-বডারে নাহয় যায়ো না আইজ্।

কথা কম বলত সুলতান। কোনও উত্তর করেনি সে। তারপর কী হয়েছিল কে জানে! কেউ কিছু বলতে পারে না। তার প্রিয় সাগরেদ হোসেনও না। অথচ তার জানা উচিত ছিল। লোকে বলে, সুলতান আর হোসেনের ছিল এক পেট, এক দিল। তারা এ-ও বলে, এ রকম হয়। মানুষ যত কাছেরই হোক, তার মধ্যেই একটা অনতিক্রম্য ফারাক থেকেই যায়। তা নাহলে একেকটা মানুষ আলাদা হবে কী করে! এখন হোসেন চলে যাওয়ার পর এসব চিন্তা তার মাথায় আসছে। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে সে। তবু, এর মধ্যেই, গাঙের উদ্দেশে বের হলো আমেনা।

আজ সূর্যটা বড্ড ক্লান্ত যেন। আকাশের সুনীল সমুদ্রে সাঁতার কেটে পেরে ওঠে না। হয়তো গরম আঁচ ছড়াতে ছড়াতে সে নিজেও জীর্ণ-শীর্ণ, অবসন্ন। সন্ধ্যেটা নামলো যেন আরো দেরিতে। আর তার লালিমা যে কাটতেই চায় না। চাঁদটাও আজ পথ ভুলে অন্য কোনও দিকে চলে গেছে কিনা কে জানে! তার কোনও খবর নেই। সেজে-গুঁজে বসে আছে আমেনা। পরিপাটি শাড়ি পড়েছে। সিঁথি কেটেছে। কপালে টিপ পরেছে। মুখে প্রসাধন করেছে। একটু সেন্টও লাগিয়েছে। আর সারাটা বিকেল ধরে রেঁধেছে। হোসেনের পছন্দ সে জানে। একা মানুষ, যখন-তখন এসে খেতে চাইতো। খাইয়ে খাইয়ে তার পছন্দ-অপছন্দ জানা হয়ে গেছে। চালের আটার রুটি, ঝাল বেশি দিয়ে মুরগীর গোশ্ত, আর কড়া মিষ্টির পায়েস। 

এশার আজানের পর বেরুলো আমেনা।  

ফকফকে জোছনায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। তামাম প্রকৃতি যেন বুকে হাত গুটিয়ে চুপ করে ভিজছে জোছনার বৃষ্টিতে। কখনও এক-আধটু ঝিরঝিরে বাতাস দেয়-কি-দেয় না। পাড়ার রাস্তা এড়িয়ে মাঠের পথ ধরলো আমেনা। পথে দু’টো শেয়াল পিছু নিয়েছিল। হয়তো গোশ্তের মশলাদার গন্ধে তাদের জিভ চটকাচ্ছিল। কিন্তু কাছে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। পেছন দিক দিয়ে হোসেনের বাড়ির সামনে গিয়ে উঠল আমেনা। 

বারান্দায় পাটি ফেলে বসে ছিল হোসেন। হারিকেন জ্বলছিল। তার টিমটিমে আলোয় উঠোনময় ছায়া-ছায়া রহস্য। আমেনাকে দেখে এগিয়ে গেল সে। হাত ধরে তুলে আনল ওপরে। তারপর ঘরে।  

-আর ইট্টুক দেরি কইরি আইস্তে নাহয়? কে না কে দেখফে, তারপর কী না কী রটাবে!

Ñলিজের ভয়ই যখুন কাইটি গেল্ছে তখুন মান্ষেক্ আর ভয় কিসের, বুলো? আর তুমি তো মরদ মানুষ।

এ কথার মানে বুঝতে পারে না হোসেন। সে একটু হাসে কেবল।

খাবার বাড়ল আমেনা। এটা-সেটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করল হোসেন। 

-জানো আমেনা…

কথাটা কানে লাগে। তার নাম ধরে কখনও, কোনও দিন, তাকে ডাকেনি হোসেন। চোখ তুলে তাকালো আমেনা। মাথায় ঘোমটা ছিল বলে তার চোখ দেখা যাচ্ছে না। হোসেন বলে চলেছেÑ তুমার লেগি আমার মুন পুইড়্তো। দেখতে না, এই-সেই বাহানাত্ খালি তুমার কাছে যাতু?

সেটা কখনও অনুভব করেনি আমেনা। পাড়ার ছেলে। প্রায় সমবয়সী। সুলতানের সঙ্গে ব্যবসা করে। সব মিলিয়ে সম্পর্ক সহজ ছিল সব সময়। 

-আসলে তুমাক্ ভালোবাস্তু আমি। তুমি যে কী ছাই বুইঝ্তে পারতে না! ক্যান্ বুলো তো? 

-মুখ ফুইটি তো বুলোনি কুনুদিন?

-মুখে বুইল্বো ক্যান্? একটা জুয়ান মানুষের চোখের ভাষা তুমি বুইঝ্তে পারতে না?   

-তখুন অতো কি আর তুমার চোখের দিক্ তাকাতু? 

-আমি পাগল হয়া গেল্ছুনু বুইঝ্লে?

গোশ্ত-রুটি বেড়ে সামনে এগিয়ে দেয় আমেনা। -এ্যাখুন কথা রাইখি খাও তো।

চেটে-পুটে সবটুকু খেয়ে নেয় হোসেন। একবার আমেনার মুখেও তুলে ধরেছিলো। খায়নি সে। 

বাসনগুলো ধুয়ে গুছিয়ে নিল আমেনা।

তারপর কী মনে হতে বলল, আচ্ছা, এডি কি তুমি ফেইলি আইসিছেলে? বলে কোমর থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে এগিয়ে ধরল।

-আরে হ্যাঁ, তাইতো! একটু যেন বোকার মতো হাসল হোসেন।

-এ্যামুন বোকার মুতন কাম মানুষ করে? অনেকগিলিন ট্যাকাও আছে দেখছি! একবার মুনে হোইলো তুমার ভায়েরই হবে। এ রকুম একটা ছিল অর। তারপর মুনে করনু অরডা কোত্থেকি আইস্পে? ঐডি তো অর সাথেই গেল্ছে। তখুন তুমার কথা মুনে হোইলো। ঠিক তুমারই হবে। দেইখি ল্যাও, একটা ট্যাকাও কিন্তুক্ আমি লিইনি। পরে যেন্ আবার অপবাদ দিও না।

হাসল হোসেন। Ñআরে না। কী যে বুলো!

কোনও উত্তর না দিয়ে উঠল আমেনা। 

-থাক্পে না?

-আইজ্ না। 

কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে হোসেন বলল, আইস্পো শ্যাষ্ রাইতে?

যেতে যেতে, যেন ছেনালি করছে এমন ভঙিতে, আমেনা বলল, পার্ইলে আইসো!

গায়ের কাপড় আলগা করে দেয় আমেনা। পদ্মা নদীর পানি একান্ত আপন জনের মতো সারা দেহে আদরের পরশ জাগিয়ে রাখে। যেন চারদিক থেকে বাহুবেষ্টনে জাপটে নেয় তাকে। নিজের শরীরে নিজেই হাত বুলাতে গিয়ে তৃপ্তির আবেশে তার চোখ বুঁজে আসে।

শরীরের ময়লা তুলতে শুরু করল সে। বারংবার ডলন-পেষণে এক-আধটু ময়লা ওঠে কি ওঠে না, শাদা ত্বকে লাল লাল ছোপ জেগে ওঠে। ডলতে ডলতে নাভির একটু নিচে গিয়ে আঙ্গুলগুলো আপনা-আপনি বারবার আবর্তন করতে থাকে। এক সময় তার অজান্তেই হাতটা থেমে যায় সেখানে। পেটের কমনীয় উজ্জ্বলতার ওপর সেখানে একটা বাদামী রঙের কাটা দাগ। সুলতানের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন। এক সময় সম্বিত ফেরে তার, তখন ঘাড় নামিয়ে চোখ ফেরায় সেই দাগের দিকে।

সূর্যটা ততক্ষণে মাথা তুলে হাসছে। শাদা আলোয় গোটা পৃথিবী ঝকমক করছে। নদীর স্রোতে আলোকরশ্মিগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি জলকণায়। বাতাসের কোমল চুম্বনে চিকচিক করছে তাদের মুখ।

ময়লা তুলতে ভুলে যায় আমেনা। ক্ষতচিহ্নটায় হাত বুলাতে থাকে। অভিমানী সোহাগ চকচক করে তার চোখে-মুখে। পরক্ষণেই কী এক অপমানবোধে, যন্ত্রণায়, কাতর হয়ে পড়ে। হিংস্র ক্ষিপ্র হাতে ঘর্ষণের পর ঘর্ষণ দিতে থাকে। যেন ডলে, ঘষে, তুলে ফেলতে চায় দাগটাকে। অবোধ এক ভালোলাগার কাছে হেরে যাওয়ার যে অপমান তার চিহ্ন পরিস্ফুট তার আদলে। চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপতে থাকে। অশ্র“ টলমল করে দু’চোখে। তার দৃষ্টির সামনে উঁচ-ুনিচু বিশাল চর কেঁপে কেঁপে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে থাকে। যেন এক প্রলয় চুরমার করে ফেলছে সব কিছু। বায়োস্কোপের শাদা পর্দার মতো তার চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায় সব দৃশ্য। শুধু ভাসতে থাকে ঝাপসা ধোঁয়া। সে ধোঁয়াও এক সময় কেটে যায়। তার দৃষ্টির সামনে তখন কালো পাহাড়ের মতো উঁচু নদীর অপর পাড়টি আবার ফিরে আসে। দৃষ্টিগোচর হয় তার চোখের অশ্র“ধারার মতোই সরু ক্ষীণস্রোতা নদী। তার চোখের অশ্র“ উষ্ণ। আর নদীর পানি শীতল। এইটুকু যা তফাৎ!

পানিতে ঝাঁপ দেয় আমেনা। হাত-পা ছোঁড়ে এলোপাতাড়ি। যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে। যেন এই ভালোলাগা, এই অপমান, লজ্জা ও যন্ত্রণার জন্যে দায়ী এই নদীটাই। নখ দিয়ে খামচে দিচ্ছে তার মুখ। কিল আর লাথি মেরে নাস্তানাবুদ করছে তাকে। কিন্তু এক সময় সে নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন এক বুক পানিতে শরীর ডুবিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়।

কী বিশাল এই গাঙ! এই পদ্মা নদী। ভরা বর্ষায় এ কূল থেকে ও কূল নজরে আসে না। আর কী-ই না পরিণতি তার এই শুকনো মওসুমে! শুধু চর আর চর। চরে চরে বন্দী হয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে অনাহারী কুকুরের মতো। আমেনার মনে হয়, তার জীবনটাও এই গাঙের মতো বালির চড়ায় আটকে গেছে। এই চড়া ভেঙ্গে উতরে চলার শক্তি তার আর কোনও দিনই হয়তো হবে না। হঠাৎ দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে তার নরম বুক। বুকের মধ্যে একটা বরফ-শীতল কঠিন দলা ক্রমেই বড় হতে থাকে। তার বুক ঢিপ-ঢিপ করছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তারপর সে-ও এক সময় মিইয়ে আসে। তখন আবার হালকা হয় সে। 

কখন ভোর কেটেছে। পুবের আকাশে সূর্যটা ঝিকঝিক করছে। তবু উঠতে মন চাইছে না আমেনার। সাঁতার কাটে। ডুব দেয়। পানি ছিটায়। খেলা করে। পেটের নিচে কলসি উবুড় করে ধরে ভাসতে থাকে। যেন সেই বালিকা বয়স ফিরে পেয়েছে। এক সময় তফেজ হাজীর গলা পেয়ে উঠল সে।

-হ্যাঁ, যা ভাইবিছি তাই।

-ক্যান, দাদা, কাইল্ই যে ট্যাকা দিনু! আবার আইজ্ ক্যান?

-ট্যাকা না, ট্যাকা না। খবর শুইনি গেনু তোর কাছে। তে দেখছি যে তুই নাই।

-কী খবর, দাদা?

-সাংঘাতিক খবর! হুসেন বিষ খায়ে মইরিছে। 

-কী বুইল্ছেন?

-সত্যি কথা রে বইন। 

বালুর ওপরেই বসে পড়ল আমেনা। -সত্যি বুইল্ছেন, দাদা?

-সত্যি! লিজের চোখে দেইখি আনু! তামান পাড়ার লোক দেখছে। মইরি ঘরের ভিতরেই পইড়ি আছে।

-আমার কুনু দুঃখ নাই, দাদা। আমার লিজের সুয়ামিক্ মার্ইলো… তার লাশডা যে আমি চোখের দেখাও দেখতে পানুনি! 

হতাশ হলো হাজী। সে মনে করেছিল, ব্যবসায়ী পার্টনারের মৃত্যু সংবাদে কাতর হবে আমেনা। টাকা-পয়সা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে। কেননা, এর সঙ্গে তার ব্যবসা এবং টাকার ব্যাপারও জড়িত। Ñকিন্তুক্ ম্যা মান্ষের আঠারো কলা। বুঝা মুশকিল! মনে মনে ভাবল সে। 

Ñআপনে এ্যাখুন যান দাদা। আমি জানডাক্ আর ইট্টুক ঠাণ্ডা কইরি আসি। 

স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই ফাল্গুনের বালুঝড়ের মতো কেমন যেন আলভোলা হয়ে গেছে মেয়েটা। তারপর হোসেন ছিল। বিপদের দিনে লোকটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। রক্তের কেউ না হলেও এক সঙ্গে ব্যবসা করতো। সেই লোকটাও মরল। মেয়েটা এখন পাগল না হয়। আমেনার আচরণ দেখে তার সে রকমই বোধ হলো। এখন নিজেকেই ভারি বোকা মনে হচ্ছে হাজীর। সে দ্রুত বিদায় নেয়।

শাড়ি পেঁচিয়ে বেঁধে শক্ত করে পরে আমেনা। তারপর গাঙে ঝাঁপ দেয়। ঝাঁপাঝাঁপি করে, আর কাঁদে। ডুব দেয়, আর কাঁদে। ঝাঁপ, ডুব, আর কান্না! যতক্ষণ না ক্লান্তি চাপে। তবু যেন অনেক হালকা মনে হয় শরীরটা। মনটাও কেমন ফুরফুর করে। 

কলসি কাঁখে পাড়ে ওঠে আমেনা। সামনে পোয়া মাইলটাক্ চর। তারপর তার স্বামীর মতোই একহারা সটান শরীরের আকাশছোঁয়া তালগাছটা। 

মন্তব্য: