নাজমুল হাসান বাবু
কাছে ডাকা অথবা পাশে থাকা
অনেক শুনেছি ওর নাম। আমাদের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে এরকম একটা ছেলে জেনে দেখার আগ্রহ জন্মে। ছেলেটা নাকি লেখা-লেখিও করে এরকম একটা কথা শোনার পর আগ্রহটা আরো বেড়ে যায়। আমার এ আগ্রহের স্থায়ীত্ব কতটুকু হবে তা-ই এখন ভাবনার একমাত্র বিষয়। কারণ অন্যরকম কাউকে দেখলেই মাঝে মাঝে আমার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। তারপরও নিজেকে মানিয়ে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার এ এক অদ্ভুত অভ্যাস, কোন একটা বিষয় মাথায় একবার ঢুকলেই হলো- তাকে নিয়ে এই সেই, সাত-পাঁচ চৌদ্দ ভাবা শুরু।
ক্লাশ চলছে। বেঞ্চের এককোনে বসে আছে পূর্ব। অনেকটা অগোছালো, উদাস দৃষ্টি। অসহায়ত্বের একটা ছাপ ক্রমেই যেন স্পষ্ট হচ্ছে। দেখে মায়া হলো। ক্লাশ শেষে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। জানতে চাইলাম- কেমন আছো?
অনেকটা নির্বিকভাবে একটু হাসলো পূর্ব। তারপর সাবলীল উত্তর- ভালো, তুমি কেমন আছো?
– হ্যা ভালো। তোমার কথা অনেক শোনেছি। দেখার একটা ইচ্ছে ছিল, দেখলাম, ভালো লাগলো।
ক্ষাণিকটা লাজুক হেসে পূর্ব জানতে চাইল আমার নাম। কথা ফুরিয়ে যায় ভেবে একটু কৌশলী উত্তর দিলাম- কোন নামটা বলবো? সবাই যে নামে ডাকে, নাকি পেপার্স-এ যা লেখি?
– সবার সাথে আমিও একাত্ব হতে চাই।
– It’s ok. তাহলে আমাকে আঁচল বলেই জানতে পারো।
– সুন্দর একটা নাম।
– সত্যি কি তাই?
– হ্যা সত্যি। কিছু কিছু জিনিস এমনিতেই সুন্দর, কিছু নিজের কাছেই ভালো লেগে যায়।
– তবে তোমার নামটাও সুন্দর। অনেকটা এক্সেপশনাল।
– হবে হয়তো।
ওর হবে হয়তো কথাটা শোনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। হবে হয়তো, হয়তো হ্যা, নয়তো না টাইপের কথাগুলো শোনলে আমার কেমন জানি বিরক্ত লাগে। চুপচাপ বসে রইলাম। পূর্বও অনেকটা চুপ থেকে নীরবতা ভেঙ্গে বলল- কোন কারণে কি বিরক্ত?
– না। না।
নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে বললামÑ লেখালেখি কেমন চলছে?
– আমি লেখালেখি করি একথা তোমাকে কে বলেছে?
– কে বলেছে এটা কিন্তু কোন মূখ্য বিষয় নয়। বরং আমি জানি এটাই বা কম কিসে?
– আপাতঃত চলছে না।
– কেন?
– ইচ্ছে করে না।
– বাব্বা। তো ইচ্ছে করে না কেন?
এবার পূর্বকে অনেকটা বিরক্ত মনে হলো। ওকে বিরক্তিমুক্ত করতেই বললাম- আচ্ছা অন্য একসময় তোমার লেখাগুলো পড়ব।
এরপর প্রতিদিন ওর সাথে কিছু সময় আড্ডা মারা, ওর লেখাগুলো পড়ার ফাকে ফাকে ওর প্রতি কেমন জানি একটা আগ্রহ জন্মে যায়। ধীরে ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে, সমান তালেই বাড়ে ভালোলাগা।
এখন আমি ওর একজন ভালো বন্ধু, একজন ভালো পাঠক। পূর্ব যা কিছুই লিখে আমাকে পড়তে দেয়। আমারও কেমন যেন ওর লেখার প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ জন্মে গেছে। আরো দশজন লেখকের চেয়ে রে লেখা আমার কাছে ভালো লাগে। কেন লাগে জানি না। মাঝে মধ্যে ওর লেখায় কিছু খোজে বের করার চেষ্টা করি। কেন করি তাও জানি না, তবে লেখাগুলো পড়ে পড়ে ওকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি। বুঝলাম দু’য়ের মাঝে বিভেদের রেখা টেনেছে ওর সীমাবদ্ধতা। সে থেকেই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম দায়বদ্ধতা থেকেই ওর পাশে থাকবো বন্ধু হয়ে।
একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল অথবা ছলনা
শিক্ষা সফরে যাচ্ছি। অনেকে মিলে বেশ আনন্দ করছি। হৈ-হুল্লুরের মাঝে মনে পড়ল পূর্বের কথা। আচ্ছা সবাই আসতে পারলেও ও আসল না কেন? ও সারাক্ষণ এ একটা বিষয় নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এভাবে কি জীবন চলে? মুর্হূতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর নম্বরটা কালেক্ট করে ফোন দিলাম। কোন প্রকার ভনিতা না করে বললামÑ হ্যালো পূর্ব।
– হ্যা কেমন আছো।
– কেমন আছো মানে? আমি কে?
– তুমি আঁচল।
– কিভাবে বুঝলে?
– কোন কিছু চিনতে হলে মুর্হূতের মধ্যেই চিনতে হয়। চিনতে সময় নিলে চেনা হয়না, সেটা হয় আরাধনা।
– আচ্ছা ঠিক আছে। এবার বলো ট্যুরে আসলে না কেন?
– আঁচল আমি মিথ্যে বলার চেষ্টা করি না। সর্বোপরি আমি তোমার সাথে মিথ্যে বলবো না। আমার না আসার পেছনে কোন কারণ নেই। আমি ইচ্ছে করেই আসিনি।
– কাজটা তুমি অবশ্যই ঠিক করোনি। আগে আসি। এসেই তেমাকে মজাটা বুঝাবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে, বলেই পূর্ব ফোনটা রেখে দিল। নিশ্চয় ও অনেক ব্যস্ত। এতো সীমাবদ্ধতার মাঝেও পড়াশোনার পাশাপাশি ও চাকুরী করে। কিছুক্ষণ পর হাতের চাপে কল চলে গেল পূর্বের কাছে। কেটে দিলাম না। ভাবলাম ও আবার কি মনে করে। বুঝিয়ে বললাম ব্যাপারটা।
– ও আচ্ছা। ঠিক আছে। নম্বরটা কি তুমি ব্যবহার করো?
– না। এটা আমার আম্মু ব্যবহার করেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে। বলেই রেখে দিল পূর্ব।
একটি সুন্দর আশা অথবা অসুন্দর প্রত্যাশা
পুকুর পাড়ে একা বসে আছে পূর্ব। আমি আসতেই একটু হাসলো। জানতে চাইল আমার পড়াশোনার খবর।
– না ভালো না মন্দ।
– এ অবস্থার কারণ?
– এমনেই। তোমার কি খবর?
– আমার আবার পড়াশোনা।
– সিরিয়াস হওয়া উচিত নয় কি?
– না।
– না কেন?
– কি হবে এসব করে?
– তাহলে এখানে আসার দরকারটা কি?
– শুধুই তোমাদের সাথে দেখা করার জন্য। বলতে পারো নিজের একাকীত্ব ঘোচাতে।
পূর্বের এ রকম অনুভূতি আশা করিনি, তাই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিছুটা চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলাম- নিজেকে এভাবে ভাবো কেন?
– বড়ো একা লাগে বলে। আমিও স্বপ্ন দেখি কারো বসতি গড়ে উঠবে আমার অন্তর মহলে, বাহিরটাকে সাজিয়ে নিবে মানিয়ে নেবার ধূসর পর্দায়।
দু’জনেই চুপচাপ থাকার পর পূর্ব আবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল- পূর্বাচলে রাজউকের একটা প্লট পেয়েছি। ওখানে একটা বাড়ি বানাবো। বাড়িটার নামও ঠিক করে রেখেছি।
– কি নাম?
– পূর্বাচল।
– এ নাম কেন?
– এর আধেকটা আমি জানি, বাকীটা তুমি।
– এখানে আমাকে টানছো কেন?
– টানার আর কেউ নেই বলেই হয়তো টানছি।
আমি ওর এরকম আকস্মিকতাকে মেনে নিলাম। আসলেই তো ও বড় একা, একমাত্র আমিই তো ওকে বুঝতে চাই, বুঝাতে চাই।
একটি নির্ঘুম রাত অথবা দুঃস্বপ্নের মৃত্যু
রাত নয়টা পচিশ। পূর্ব আমাকে ফোন দিল।
– কি করছো?
– রুটি আর চা বানাচ্ছি। তুমি?
– কিছুই না। বসে বসে তোমার সাথে কথা বলছি। আচ্ছা ঠিক আছে। ফ্রি হও, পরে কথা বলছি। ফ্রি হলে অবশ্যই মিসড কল দিও।
– কখন ফ্রি হবো বুঝে নিও।
রাত এগারটা ত্রিশ। পূর্বকে মিসড কল দিলাম। কল করলো ও।
– তোমার কলের অপেক্ষায় ছিলাম।
– সত্যি? But I am sorry, because I have no sufficient balance for a call.
– It’s ok.
– এবার বলো, আমার থেকে সময় চাওয়ার দরকার হলো কেন?
– নয় হচ্ছে আমার শুভ সংখ্যা। এ সালটাও নয় সাল। তাছাড়া আমার জন্মমাসটাও হচ্ছে নয়।
– সুন্দর তো।
– হ্যা সুন্দর। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ৯৯৯ তারিখটায় আমি কারো প্রেমে পড়বো। সে আমাকে ভালোবাসলো কি নাবাসলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এমনকি আমি তাকে কোনদিন বলতেও চাই না।
– এটা কোন কথা হলো নাকি। আচ্ছা ঠিক আছে এবার বলো তুমি কার প্রেমে পড়বে।
– আমি ঠিক জানি না। আর তাকে নির্বাচন করার দায়িত্ব তোমার।
– অদ্ভুত। এটা কিভাবে সম্ভব? তুমি কার প্রেমে পড়বে সেটা তোমার ব্যাপার। তুমি কেন আমার পছন্দ করা মানুষের প্রেমে পড়বে? আর আমি-ই বা কিভাবে তোমাকে খুজে দেব?
– কাউকে খোজে দিতে না পারলে আমি তোমার প্রেমেই পড়বো।
আমার মেজাজ অনেকটা চড়ে গেল। বলে কি ও? নিজেকে শান্ত রাখার জন্য নিশ্চুপ রইলাম। ও আবার বলল- আরে ভয় পাবার কিছু নেই। তোমাকে আমার প্রেমে পড়তে হবে না। আর আমিও তোমাকে কোনদিন বলব না ভালোবাসি।
– আচ্ছা আমি অবশ্যই খোজবো। আর আমার একার পক্ষে তো খোজে বের করা সম্ভব হবে না, তাই আমার বরকেও সাথে নিয়ে খোজবো।
– মানে?
– মানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করছি।
– কিন্তু তুমি ছাড়াতো আমার প্রেমের কথা আর কেউ জানবে না।
– আচ্ছা ঠিক আছে সেটা পরে দেখা যাবে।
এরপর আরো কিছুক্ষণ এভাবে এলোমেলো কথা চলল। অতঃপর লাইনটা কেটে গেল।
রাত বারটা পনের। লাইনটা কাটার সাথে সাথেই পূর্ব আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল- ফোনটা কাটলে কেন?
– আমি কাটিনি
– ঠিক আছে।
এভাবে কথা চলল আরো প্রায় চল্লিশ মিনিট।
রাত একটা ত্রিশ।
– চার্জ শেষ হয়ে গেছে, তাই লাইন কেটে গেছে।
– চার্জে লাগিয়ে নাও।
– দরকারটা কি?
– আমার কথা শেষ হয়নি।
– আমার আর ভাল্লাগছে না, ঘুম পাচ্ছে।
– প্লিজ। একটু কষ্ট করো না হয় আমার জন্য।
– আচ্ছা ঠিক আছে বলো।
– সত্যি বলতে কি আঁচল, আমি কাউকে বিশ্বাস করতে চাই, কারো উপর নির্ভর করতে চাই।
– এসবতো মেয়েদের কথা।
– ছেলে-মেয়েতে বিভেদ না করে বাস্তবতা উপলব্ধি করো।
– আবারো সেই পূরনো প্যাচাল?
– তুমি ছাড়া আর কেউ কি আছে যে আমাকে বুঝবে?
– অনেকেই বুঝতে পারে। চেষ্টা করে দেখো।
ধীরে ধীরে ওর কথাবার্তা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। ঘুমে আমারও দু’চোখ বুঝে আসছে। তাই ওকে বললাম- পূর্ব প্লিজ, আমি এখন রাখবো।
– না। আমার কথা শেষ হয়নি।
– আর কি কথা। এত বকবক তুমি করতে পারো জানা ছিলো না।
– অজানাকে জানাও আরেক কাজ।
– আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বলো আমি ঘুমাই।
– একটা গান শোনাও।
– এসব পাগলামীর মানে কি পূর্ব? এত রাতে কেউ কি গান গায়? এখন আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে, এবার রাখো।
চার্জ শেষ হয়ে ফোন বন্ধ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে ফোন চালু করে চার্জে দিলাম। এতক্ষণে হয়তো ও কয়েকবার চেষ্টা করে ফেলেছে নিশ্চিত। প্রচুর টেনশন হচ্ছে, ও না জানি আবারো কল করে। পরক্ষণেই আবার কল করলো ও।
– আমার ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন চার্জ হচ্ছে।
– গুড।
– গুড মানে?
– গুড মানে গুড।
– আমি এবার ঘুমাবো।
– বিরক্ত হচ্ছো?
– শুধু বিরক্ত না। মহা-মহা-মহাবিরক্ত।
– আচ্ছা মুক্তি দিতে পারি এক শর্তে।
– কি শর্ত?
– প্রতিদিন আমার সাথে যতখুশি কথা বলতে হবে।
– আমি পারবো না।
– তাহলে তোমার আজ মুক্তি নেই।
– রাত এখন কটা বাজে হিসেব আছে?
– হ্যা। মাত্র দুটো ত্রিশ।
– এটা মাত্র!
– হ্যা। আচ্ছা ঠিক আছে, প্রতিদিন পাঁচ মিনিট?
– প্রতিদিনের দরকারটা কি?
– আমার কি দরকার সেটা তো আমিই বুঝবো।
– আমি পারব না। প্রতিদিন এক মিনিটও না। যখন মন চাইবে তখন।
– আমি প্রতিদিন কল করব।
– আমি রিসিভ করব না।
– সে তুমি পারবে না এটা আমার বিশ্বাস।
– আচ্ছা দেখা যাবে। এখন রাখি, বাই বলেই রেখে দিলাম।
ওর বলা আজ রাতের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাতে আর ঘুম হল না। ওর প্রতি আমার যা ধারণা ছিল আজ ঘটল তার উল্টো। এখন দেখছি ওর মনটাও প্রতীবন্ধী। তাছাড়া সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে ওর অস্বাভাবিক আচরণ। সিদ্ধান্ত নিলাম ওর সাথে আস্তে আস্তে যোগাযোগ ছেড়ে দেবো। ও তো শুধুই আমার একজন ভালো বন্ধু। তাহলে ওর জন্য আমি এত সেক্রিফাইস করব কেন? আর পূর্বই বা আমার সাথে এমন আচরণ করবে কেন? একজন বন্ধুর সাথে এমন আচরণ কোন সুস্থ্য মানুষের কাজ নয়। ওকে নিয়ে যতই ভাবছি ততই মনে হচ্ছে ও অনেক বেশি ক্রেজি। পূর্বের সাথে কন্টিনিউ করে নিজেকে প্রভাবিত করতে চাইনা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম আজ থেকেই ওর সাথে সর্ম্পক রাখবো না।
একটি প্রতিক্ষা অথবা প্রতিরক্ষা
সে রাতের পর পূর্বের প্রতি কেমন যেন একটা অন্যরকম বিরক্তি কাজ করছে। এরপর আরো কয়েকদিন ও ফোন করেছিল। রিসিভ করিনি বা কেটে দিয়েছি।
আজ আবার ওর সাথে দেখা হলো। আজকে পূর্বকে মনে হচ্ছে নতুন করে দেখছি। হয়তো সে রাতের পর আর দেখিনি বলেই এমনটা হচ্ছে।
আগের মতোই নীরব, এতটুকুও পরিবর্তিত মনে হলোনা ওকে। এতকিছু করেও যেন কিছুই জানে না এ রকম স্বাভাবিক মনে হচ্ছে পূর্বকে। আমিও নিজেকে সামলে নিয়ে পাশ এড়িয়ে যেতে চাইলাম। অন্য সময়ের মতোই ও এক চিলতে হেসে বলল- কেমন আছো?
– হ্যা ভালো।
আমি চুপচাপ থেকে আবার পত্রিকা পড়তে লাগলাম। ওর আচরণও কেমন যেন পাল্টে গেল। সেই প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তের মতোই ওকে নিঃসঙ্গ, অসহায় মনে হলো। ওর চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কেমন যেন মায়া হচ্ছে ওর প্রতি। আবার বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বিরক্ত লাগছে।
এখন আর ওর কোন লেখাই পড়া হয়না। কেমন যেন ভালো লাগে না। মনে হয় এরচেয়ে বাজে লেখা আর হয়না। অথচ আগে কতই না ভালো লাগত, এ প্রশ্ন করলে নিজেকে বড্ড বোকা মনে হয়। বোকা না হলে ঐ লেখা কেউ পড়ে আর কারো ভালো লাগে? এতো ভালো ভালো লেখকদের ভিরে ওর লেখা ভালো লাগতে যাবে কেন? হয়তো তখন ওকে সঙ্গ দিতে গিয়ে নিজেকেই নিঃসঙ্গ করে ফেলেছিলাম।
আগে ওর সাথে যেটুকু কথা হতো এখন আর সেভাবে কথাও হয়না। মাঝে মাঝেই চোখাচোখি হয়ে গেলে নিজেকে আড়াল করি। পূর্বও কোন না কোন কাজে ব্যস্ততা দেখায়।
এখন পূর্বের সাথে তেমন একটা দেখা হয় না বললেই চলে। দেখা হয়েই গেলে অপরিচিতের মতোই চলে যাই গন্তব্যে। তবে মাঝে মাঝেই খোজ নেই ও কেমন থাকে।
পড়াশোনা শেষ করে যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছি। অন্যান্য বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হয়, কারো কারো সাথে ফোনেও যোগাযোগ হয়। তবে পূর্বের আর কোন খোজ রাখিনি।
একযুগ ভুলে যাওয়া অথবা অতীতকে ফিরে পাওয়া তিন কাঠার চেয়ে পাঁচ কাঠাতেই বাড়ি বানালে সুন্দর হবে। তাই উত্তরাতে প্লটের আবেদন না করে পূর্বাচলে করলাম। পূর্বাচলে প্লটের জন্য আবেদন করতে গিয়েই মনে পড়ল পূর্বের কথা। ওর কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল পূর্বাচলে ও একটা প্লট কিনেছিল। এতদিনে নিশ্চয় সেখানটাতে বাড়ি বানিয়ে সংসার সাজিয়েছে নিজের মতো করে। প্লট পেলে অবশ্যই তো দেখতে যাওয়া হবে একদিন। সেদিনই ওর বাড়িটা দেখে আসবো। সব ঠিকঠাক থাকলে চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। বাড়িটার নামতো পূর্বাচলই রাখার কথা।
পূর্বের কথা ভাবতে ভাবতে রাজউক থেকে বাসায় ফিরে এলাম। কয়েকদিন পরেই প্লট পাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
আজ প্লটের ব্যাপারে জানতে রাজউক যেতে হবে বিকেল চারটার মধ্যে। সময় মতোই পৌছেও গেলাম। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো বিস্তারিত জানতে। ফলাফল শূন্য। ভাগ্যে প্লট জুটেনি। মন খারাপ হয়ে গেল। একটা চাপা কষ্ট বুকে চেপে রাজউক থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে পড়ল পূর্বের কথা। বুকের ডানপাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। এতদিনে নিশ্চয় ওর অনেক বই বেরিয়েছে। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা হলেও বাসায় না ফিরে চলে এলাম নীলক্ষেতে। একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম- পূর্বের সবশেষ বই কোনটা? দোকানদার জ্বি দিচ্ছি বলে কম বয়সী একটা ছেলেকে ডেকে বললÑ ঐ “পূর্বাচল, একটি বসতবাড়ি অথবা একটি আত্মজীবনী” বইটি দে।
বইটিকে হাতে পেয়ে অনেকটা হাল্কা হলাম। আবেগ আর উত্তেজনায় বাড়ি ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। খাওয়া হলো না। সামান্য ফ্রেশ হয়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কায় মোম আর দিয়াশলাই নিয়ে পড়তে বসলাম।
পৃষ্ঠা নম্বর তিন। কবিতার শিরোনাম- ধূসর মেঘ আর চাঁদের গল্প।
কেউ কেউ ভুলে যায় বেমালুম
বাশির সুর বা রাখাল বালকের গল্প
তবুও উদাসী দৃষ্টি ছড়ায় ধান ক্ষেতের ফাকে ফাকে ঘাস ফরিং এর অবাধ বিচরণ
ব্যাঙের ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ শব্দ মূর্ছনা তোলে বাতাসের শীর্ষে-
কোন কিছু ফেলে যাওয়াই কি ভুলে যাওয়া?
তুমি আমিও তো ছিলাম আদরে মাখামাখি বা
সচেতন পাপড়ীর মতো সাজানোর ধ্যানে
সুন্দরেরা ঝড়ে পড়ে মুহূর্তের উত্তেজনায়।
শিশির কণা যেভাবে একে দিতো রাজটিকা
লাজে মরতো গোলাপ শুকিয়ে যাওয়ার ব্যর্থতায়।
আবার শরীরটা কেমন যেন লাগছে। মাথার উপর পূর্ণগতিতে ফ্যান ঘুরছে। তবুও ঘামছি। ছিড়ে ফেললাম বইয়ের পাতাটা। দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে এককোনে ধরিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। আবার চোখ খোলে পড়া শুরু। ঘামের মাত্রা বাড়ছে। সারা শরীর ভিজে গেছে। বইয়ের পাতা এক এক করে পড়ছি আর আগুনে পুড়ছি।
পৃষ্টা নম্বর ষোল। শিরোনাম- বৃষ্টির জলকেলি
তোমার সামনে দাঁড়িয়েছি আষাঢ়-শ্রাবণের পালা দেখবো বলে
মুখোমুখি হয়ে হাত বাড়িয়েছি কাছে পাবার জন্য নয়, কাছে টানতে।
পার্বনে দেখবো তোমার হেলানো কোমরের ভাঁজ
একথা তুমি বলতে পারো না, আবার
মাতোয়ারা হবো না উৎসবে একথাও বলতে পারিনা।
জৈবিকতা-প্রেমের সহাবস্থান মনীষীরা বলে,
তাই বলেই আমি বন্ধুত্ব আর প্রেমের
স্বচ্চ কাচের দেয়ালটাকে ভেঙ্গে দেবো না।
তাহলে অসুবিধা ছিলো কোথায় ঘুরে দাঁড়াতে,
আমার চেহারায় দেখতে তোমার প্রতিচ্ছবি?
পৃষ্টা নম্বর সতের। পৃষ্টা নম্বর আঠারো। পৃষ্টা নম্বর ঊনিশ। এক এক করে পড়ছি আর সাথে সাথেই ছিড়ে পুড়ে ফেলছি। কিছু ভাললাগছে না। যতউ পড়ছি ক্রমেই কষ্টটা বাড়ছে। শরীরে কাপনির মতো মনে হচ্ছে। তবুও পড়ছি।
পৃষ্ট নম্বর বায়ান্ন। কবিতার শিরোনাম- ভাগ্যরাও নিমর্ম হয় গড়ে ওঠার আদলে
অদ্ভুত এক স্বপ্নে আজ আবার তোমাকে দেখলাম।
আগের সেই লাবন্যে কি যে তোমার বৈচিত্রতা,
তা কি করে বুঝাই বলো?
যে তোমাকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়েছিলাম নিজেকে
তাকেই আবার ফিরে পেলাম তোমার মাঝে।
‘কেমন আছো বন্ধু আমার, ক্ষমা করো সময়ের নিমর্মতাকে।’
এটাই ছিলো তোমার শেষ কথা।
পৃষ্টা নম্বর তেষট্টি। শিরোনাম- হারিয়ে যাওয়া সাধের পুতুল
দিনে দিনে জমে ওঠা ধুলার আস্তর দিনে দিনেই মুছি।
সোকেসে সাজানো স্থির অঙ্গের চাহনী তোমার
ধরে রেখেছে আমায় অনেক কাল।
সংসারের একমাত্র উপকরণ হয়েও বললে না
একটি কথাও কোনদিন মনের ভুলে।
তবুও তোমাকে নিয়েই কেটে গেল একজীবন।
তোমার মতো করে আমিও বন্ধী রইলাম আগের খোলসেই-
গড়ে ওঠা সংসারে শুধু তোমাকে নিয়ে মেতে উঠি আহ্লাদে।
প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। পাতাটা ছিড়ে পুড়তে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে যায় নিচে। কুড়াতে গিয়ে বুঝলাম শক্তি বিলিয়েছি পাতায় পাতায়। তবুও চেষ্টা করলাম তুলতে। সফল হলাম। দেখলাম দেশলাইয়ের আর একটি কাঠি আছে। এটাকে পুড়ানো হলেও অপোড়ানো আরেকটি পাতা থেকে যাবে। আর পারছি না। তবুও পড়তে হবে, পুড়তেও হবে। কিন্তু কিভাবে পারব এ ভাবনা ভাবার কোন শক্তি আমার এ মুর্হূতে নেই।
পৃষ্টা নম্বর চৌষট্টি। কবিতার শিরোনাম- পূর্বাচল
রৌদ্রোজ্জল এই সকালে জেনে গেছে পড়শিরা,
আমি গড়ে তোলছি আমার বসতবাড়ি।
তোমার জন্য খোলা রইল দু’টো চোখ
খোলা মাঠের বিশাল বুকে দেখব তোমার অবাধ বিচরণ
শুধু চেয়ে নিলাম তিনহাতের কিছু বেশি জায়গা
পূর্বাচলের জন্য…
আজ পনের আশ্বিন।
পৃষ্টার পাদটীকায় লেখা রয়েছে- পুনঃশ্চ: শেষ লাইনটি প্রকাশকের লেখা।
আমি পূর্ব বলে চিৎকার করে উঠলাম। পাশের রোম থেকে স্বপ্ন(স্পর্শের বাবা) ছুটে এসে আমার মাথাটা ওর বুকে টেনে নিয়ে জানতে চাইলÑ কি হয়েছে তোমার!
—————————————————– (সংক্ষেপিত)