বাংলা নববর্ষ: বাঙালির আত্মানুসন্ধান

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

বীরেন মুখার্জী

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। নদীমাতৃক এদেশে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত এবং ঋতুভিত্তিক। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন হিসেবে ধার্য হয়ে আসছে সুদূর অতীত থেকে। বলা যায়, বাঙলা সন গণনার সময়পর্ব থেকে বাঙালি জাতীগোষ্ঠীর সংস্কৃতির এই শুভ সূচনা। তবে সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই বাঙালিরা বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্নভাবে দিনটি পালন করতো বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। পহেলা বৈশাখ দিনটি যতটা ধর্মীয় অনুভূতিসিক্ত, তারচে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে। সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুরাজির আবর্তন-বিবর্তনের ধরণসংক্রান্ত জ্ঞান মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। এরপর এসেছে জ্যোতিষশাস্ত্র। মানুষ দিন, মাস, বছর গণনায় পারদর্শী হয়েছে। সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা-উড়িষ্যায় ইলাহি সন, ফসলি বা মৌসুমি সন ও বিলায়েতি সনের প্রচলন ছিল। ঘরে ফসল তোলার সময়ের সঙ্গে খাজনা আদায়ের সময়টি সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় বাঙালি জনগণকে ব্যাপক সমস্যার সস্মুখীন হতে হতো। এজন্য সম্রাট আকবর জ্যোতিষ-শাস্ত্রবিদ আমির ফতেউল্লাহ্ সিরাজিকে দিয়ে হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ উদ্ভাবন ও প্রচলন করেন। পরে বঙ্গাব্দরূপে এটি পরিচিত ও গৃহীত হয়। তখন থেকে বাঙালি কৃষি সমাজে দিনটি সমাদৃত ও পূজিত হয়ে আসছে। 

লৌকিকতা

বৈশাখের সঙ্গে বাংলা ভাষার মানুষের বিশ্বাস এবং অভ্যাস জড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে নানাবিধ সংস্কার। পহেলা বৈশাখ যেমন একদিকে বাঙালির হৃদয়ে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে অন্যদিকে ‘ভূমিহীন’ অর্থাৎ বর্গাচাষীদের জন্য এ দিনটি কিছুটা হলেও যন্ত্রণাদায়ক। আগে বছরের প্রথম দিনটিতে সম্পাদিত হতো জমিদারের রাজস্বের হিসেব। প্রজারা বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে মিষ্টি খেয়ে যেত। ব্যবসায়ীরা লাভক্ষতির হিসেবের পুরনো খাতার পালা চুকিয়ে নতুন খাতার সূচনা করতো। যার নাম হালখাতা। ‘হাল’ মানে তো নতুন বা চলতি, তাই নতুন হিসেব সংরক্ষণের অনুষ্ঠানরূপেও গণ্য হতো বছরের প্রথম দিনটি। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে সিঁদূরচর্চিত আম্রপল্লবশোভিত মঙ্গলঘট স্থাপন করে আত্মীয়-বন্ধু, খাতক, মহাজনদেরকে মিষ্টিমুখ করানো হতো। এভাবে লৌকিক সামাজিকতার নবায়ন হতো। এ অবশ্য বাঙালির অতীত ইতিহাস। সে সময় ‘আমানি উৎসব’ অর্থাৎ পান্তাভাত খেয়ে মাঠে যাবার প্রথাটি পহেলা বৈশাখের অঙ্গীভূত বলে বিবেচনা করতো ভূমিজীবী মানুষ। গ্রামের বধূরা বর্ণবৈচিত্র্যময় নতুন শাড়িটি অঙ্গে জড়িয়ে উৎফুল্ল হতো। বর্তমান সময়ে এসে এই সমাজে যে বহুবর্ণিল নববর্ষ উৎসব উদযাপন তা অতীতে গ্রাম্য বধূদের সাজ পোশাকের সেই বিশেষত্বটিই যেন ধরা পড়ে। তাছাড়া বিগত দিনে লোকসংস্কৃতি-আশ্রয়ী যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি পরিবেশন করা হতো সে সবই এখন ‘আধুনিক ফর্মে’ পরিবেশিত হচ্ছে। বলা যেতে পারে, বাঙালির প্রকৃত জীবন-ইতিহাস অতীতের সঙ্গেই নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। যে কারণে বাঙালির আত্মানুসন্ধানের জন্য ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতির উৎসবের স্মরণাপন্ন হতে হয়। 

বৈশাখের যে লৌকিকতা তা শুরু হয় পরিবার থেকে। আত্মীয়, বন্ধু, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশি সুহৃদজনকে শুভেচ্ছা জানানো ও কুশল বিনিময় চলে ছোট-বড়োদের মধ্যে। নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় বহু মানুষের সমাগম হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ মহামিলনের ক্ষেত্র এই মেলা। বছর শুরুর আগের দিন বসে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, পরবর্তীকালে নববর্ষ-উৎসবের সঙ্গে এ মেলা একীভূত হয়ে যায়। শিশুকিশোরেরা চড়কি, নাগরদোলা, বাঁশি, তালপাতার সেপাই- এসবের আনন্দে মেতে উঠতো মেলায় গিয়ে। কিশোরীরা ব্যস্ত হতো চুড়ি, ফিতে, চুলের ক্লিপ, আলতা, কাজল ইত্যাদি কেনার জন্য। তাদেরকে মেলায় নিয়ে আসা অভিভাবকদের ওপর বাড়ির গৃহিণীদের ফরমাইশ থাকতো- দা, বঁটি, চালুনি, কুলো, টুকরি ইত্যাদি গৃহস্থালি-কর্মের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করে আনার। বাড়িঘরে ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা, শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যদিয়ে পূর্ণ আনন্দের সঙ্গে দিনটিকে অতিবাহিত করার মধ্যে নিহিত থাকতো সারাটি বছর শুভ হোক এই প্রত্যয় এবং বিশ্বাস। মূলত এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি ঐতিহ্যের উন্মেষ ঘটে অতীত থেকে। বিবর্তিত জীবনধারায় লৌকিক এ ধারাটি এখনো প্রবহমান। আর এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই বাঙালির আত্মপরিচয়ের মূলমন্ত্র নিহিত। 

পৌরাণিক বৈশাখ

হিন্দু পুরাণে বৈশাখ নিয়ে নানা তথ্য বিবৃত রয়েছে। যা বৈশাখের অতীতস্বরূপ বোঝাতে গবেষকরা উল্লেখ করে থাকেন। লোকগবেষক আতোয়ার রহমান ‘বৈশাখ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘বৈশাখ তার নামের জন্য বৈশাখ নক্ষত্রের কাছে ঋণী। পুরাণের মতে বিশাখা চন্দ্রের সপ্তবিংশ পত্নীর অন্যতম। এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতে কেবল নক্ষত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের অবস্থানের সাথে বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থানের সম্পর্ক দেখে মাস ভাগ এবং মাসগুলির নামকরণ করেছিলেন। বিশাখা উষ্ণতার সূচক।’ সঙ্গত কারণে বৈশাখের সঙ্গে যে ‘উষ্ণতা’ বা ‘খরতাপ’-এর সামঞ্জস্য রয়েছে তা বলা বাহুল্য। বৈশাখের স্বরূপ বিশ্লেষণে এই দিকটির গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়। কবি কালিদাস তার ‘ঋতু সংহার’-এ বৈশাখ তথা গ্রীষ্ম ঋতুর সূচনা নিয়ে অবিস্মরণীয় কবিতা রচনা করেছেন। 

আমাদের দেশের মতো বিশ্বের নানা দেশে বর্ষবরণের রেওয়াজ প্রচলিত আছে। তবে বিবর্তনের ধারায় আমাদের দেশের সংস্কৃতি মিশ্রসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হলেও বাঙালির নিজস্বতা একেবারে বিলীন হয় নি। দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছে মাত্র। তবে বৈশাখ বা নববর্ষ পালনের যে চাকচিক্য তাতে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মিল খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। পাশ্চাত্যের বর্ষবরণের আদলে আমাদের দেশেও বর্তমানে কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, সংগীত-নৃত্যের মাধ্যমে প্রাণে গতি সঞ্চার এবং সর্বশেষ ফোন সংস্কৃতির মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ এ ক্ষেত্রে নবতর ধারার সূচনা করেছে।  

বৈখাখের পৌরাণিক দিকে বিশ্লেষণ দেখা যায়, ‘মাস হিসেবে বৈশাখের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, যা প্রকৃতিতে ও মানবজীবনে প্রত্যক্ষ করা যায়। খররৌদ্র, দাবদাহ, ধূ ধূ মাঠ, জলাভাব, কালবৈশাখীর ঝড়, ঝরাপাতা, গাছে গাছে নতুন পাতার আবির্ভাব, আমের কলি ইত্যাদি প্রকৃতি-পরিবেশের রূপ-রূপান্তরের সঙ্গে বাংলার মানুষের মন-প্রাণ-আত্মার যোগ আছে।’ ১ ফলে তৎকালীন সমাজে বৈশাখের প্রথম দিনটির জন্য কৃষিজীবিদের অন্যরকম অপেক্ষা কাজ করতো। এই দিনটি আসার আগেই ঘর-বাড়ি পরিচ্ছন্ন করা, ব্যবহৃত তৈজসপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবসা ক্ষেত্র ধোয়া মোছা করা হতো। এ কাজগুলোর মধ্যে সামাজিক সফলতার কাক্সক্ষা নিহিত থাকতো। গোটা বছরটি ভালোভাবে অতিবাহিত হওয়ার বিশ্বাস থেকে প্রতিটি পরিবার এ দিনটিকে যথাসাধ্য আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করতো। সৌভাগ্যের সূচক-বড়োসড়ো মাছ, মিস্টির হাড়ি আসতো ঘরে। গতদিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিনে তৈলবিহীন নিরামিষ ব্যঞ্জন রান্না করার রীতি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। পরদিন সমারোহে মাছ খাওয়ার সঙ্গতি বাঁচিয়ে রাখার কথা বিবেচনা করেই।

জাতীয়তাবোধের বৈশাখ

বাঙালি জাতি বার বার বিদেশি শক্তির শাসন-শোষণে, নিপীড়িত-নিঃগৃহিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-উৎসব পালনে বাঙালি জাতিকে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে- যা আজ ইতিহাস। এরপরও বাঙালি তার আপন সত্তা ও ঐতিহ্যিক আদর্শ বিচ্যুত, অথর্ব জাতিতে পরিণত হয় নি। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগোত্তর সময়ে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানভূমির অসাড়তা প্রমাণিত হওয়ার পর প্রগতিশীল ছাত্র-বুদ্ধিজীবীর চেতনায় পহেলা বৈশাখ নতুন রাজনৈতিক মাত্রায় বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার প্রশ্নে শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালির বিক্ষোভ এ জাতির মধ্যে যে চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে তা প্রকারান্তরে বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ। তখন থেকে বাংলা নববর্ষ ভিন্নমাত্রা নিয়ে বাঙালি জাতি উদযাপন করতে শুরু করে। তখন যে অনুষ্ঠানই করা হোক না কেন তা ছিল পাকিস্তানি শাসনাধীনে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংসের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ। এর মধ্যে নববর্ষ বা বাংলা বর্ষবরণ উৎসব হয়ে উঠেছিল বাঙালি চেতনার ধারক ও বাহক। এসব উৎসব প্রগতিশীল চেতনায় বিস্তার লাভ করে প্রতিটি প্রতিবাদে, আন্দোলনে, সংগ্রামে অলক্ষ্যে প্রেরণা জুগিয়েছে। তবে, বাঙালি জাতীগোষ্ঠী বর্তমান সময়ে এসে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে যে পহেলা বৈশাখ বা বাঙলা নববর্ষ উদযাপন করছে তা উপনিবেশিক আমলে অতটা সহজ ছিল না। বাঙলা সংস্কৃতির ওপর বার বার যে আঘাত এসেছে সে সম্পর্কে গবেষক ওয়াকিল আহমদ বলেন, ‘আজকের প্রজন্ম নববর্ষকে যেভাবে পালন করে, স্বাধীনতার পূর্বকালে সেভাবে পালন করার সুযোগ ছিল না। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়, বরং রাখ-ঢাক করে কিছু লোক ছোট-খাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। তারা তা করতেন জাতীয়তাবোধের প্রণোদনা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাব আছে; এই ক্লাবের উদ্যোগে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ষাটের দশকে এরূপ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আমরা বিরূপ সমালোচনার সম্মুখিন হই-পাকিস্তানি সংস্কৃতির বরখেলাপ করে বাঙালি সংস্কৃতির আমদানি করছি। তারা ঠিকই ধরেছিল। সেদিন জাতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার পুলক আমাদের অন্তরে কাজ করেছিল- কথাটা সত্য। রবীন্দ্র সাহিত্য ও সংগীতচর্চা বন্ধ করার যে চক্রান্ত হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল একই- বাঙালি জাতীয়তাবোধকে ধ্বংস করা। ১৪ ডিসেম্বর ‘৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে এটা অন্যতম বকড় কারণ ছিল। আমরা সেদিন অমর একুশের মতো বাংলা নববর্ষকে আনুষ্ঠানিক পালন করে আমাদের স্বাধীকার চেতনা, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত রাখতে চেয়েছিলাম।’২  বলা বাহুল্য এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত তরুণরা গোপনে, মৌলবাদী গোষ্ঠী ও শাসকের রক্তচক্ষুর আড়ালে আয়োজন করতেন বৈশাখী অনুষ্ঠানমালার। যেখানে বাধা, সেখানেই তা অতিক্রমের প্রয়াস জোরালো হয়ে ওঠে। এভাবেই এটি হয়ে উঠতে থাকে বাঙালির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও হাতিয়ার। 

সংস্কৃতির রূপ

নদীমাতৃক গ্রাম থেকে উদ্ভূত এই উৎসব আজ শহরে, নগরে, রাজধানীতে সম্প্রসারিত হয়েছে। নতুন নতুন মাত্রা লাভ করে বিশাল এক অসাম্প্রদায়িক আনন্দ মেলার রূপ পরিগ্রহ করেছে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর বৈশাখী মেলায়। এটি এখন আর ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভক্ষতির হিসেব-আশ্রয়ী হালখাতানির্ভর অনুষ্ঠানমাত্র নয়, এ অনেক ব্যাপক, দূরসঞ্চারী এবং বহুমাত্রিকতায় পূর্ণ আমাদের অন্যতম জাতীয় উৎসব। বাঙালি জাতীয়তার এবং আত্মপরিচয়েরও ভিত্তি। এই দিনটি এলে, সবার অন্তরঙ্গ একাত্মতার মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় যেন গৌণ হয়ে যায়, বড় হয়ে ওঠে বাঙালিত্বের অনুভব। প্রতিবছরই এতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা, বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসমাগম এবং উৎসাহের জোয়ার। গোটাদেশের সর্বত্র, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনুভূত হয় এর স্পন্দন। অবশ্য, নববর্ষ উৎসব পালনের ধরণ নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও শোনা যায়। কেউ কেউ এর মধ্যে বিজাতীয় ঐতিহ্যের গন্ধ খুঁজে পান। কিন্তু যেভাবেই পালিত হোক, বাঙালি যে এই একটি দিনের জন্য হলেও তার জাতিসত্তাকে অনুভব করে, শেকড়ের কাছে ফিরে আসে। 

বৈশাখের শিল্পরীতি

‘প্রাচীনকাল থেকে জীবিকার ছলে শিল্প এসে ধর্মের কাঁধে চড়ে মানববর্তী হয়েছে। শিল্প-বিপ্লবের পরে কলাবিদ্যার কোনও ক্ষতি সাধিত হয়েছে এমত উচ্চারণ অবাস্তব। তখন সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের মধ্য দিয়ে বৃহৎ বা শক্তিমান জাতি অন্যজাতিকে শোষণ করেছে’ ৩ -বাঙালির শিল্পচিন্তার জায়গাটিতে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের এই উপলব্ধিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ পহেলা বৈশাখে খাজনা দেয়া-নেয়ার বিষয়টি শোষণের একটি দিক হিসেবেও বিবেচিত। এছাড়া বর্তমান বাস্তবতায় প্রবল প্রতাপে বিজ্ঞানমুখি পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী শক্তি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে জেঁকে বসেছে। পাশ্চাত্যের পণ্যশাসিত সমাজব্যবস্থা অকাঠ্যরূপে ঢুকে গেছে বাঙালি সমাজব্যবস্থায়। বাঙালিরা ‘সানস্ক্রীম’ মেখে বৈশাখের আতিশয্যে গা ভাসাচ্ছে। বৈশাখের উঠোন আল্পনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, মাটির পাত্রের আল্পনা, পটচিত্র, নকশী বুনন সবক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে বাজছে বিশ্বায়নের দুন্দুভি। বাঙলার খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিকতা উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে বৈশাখের শিল্পরীতি থেকে। বাঙালির নিজস্ব শিল্পকর্ম পণ্যরূপে বাঙালি জনপদকে কৌশলে বেঁধে ফেলছে। বৈশাখ বাঙালিকে নিতান্ত আনন্দ দেয়ার পরিবর্তে যেন মেতে উঠেছে বাণিজ্যিকতায়। অথচ, বাঙালির শিল্পরীতিতে বাণিজ্যের কোনো স্থান নেই। বাঙালির আছে শিকড়ের অনুভব, মাটিলগ্নি মমতার সান্নিধ্য। বৈশাখকে কেন্দ্র করে তাই কিছুটা হলেও বাঙালিকে মাটিবর্তী হতে অনুপ্রাণিত করে। 

বলা যায়, পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে আবাহন করার আকাক্সক্ষা থেকেই পালিত হয়ে আসছে বর্ষবরণ-উৎসব। নতুন সম্ভাবনার প্রত্যাশায় নতুনকে বরণ করার এই রীতি বাঙালি জাতীয়তাবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পহেলা বৈশাখ নানানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ-কোথাও এর উপলক্ষ ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত, কোথাওবা এর আশ্রয় আর্থ-সামাজিক। পহেলা বৈশাখের এ উৎসবের আয়োজনের মধ্যে বাঙালির ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়, তাই জাতিসত্তা-অনুভূতির নবায়নের দিনও এটি। সুতরাং বাঙালির আত্মানুসন্ধানে বারবারই আমাদের ফিরে যেতে হবে লৌকিক বিশ্বাসকে-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গ্রাম্য সংস্কৃতির অত্যন্ত গভীরে। 

তথ্যনির্দেশ:

১. বাংলা নববর্ষের চেতনা, প্রবন্ধ: ওয়াকিল আহমদ

২. বাংলা নববর্ষের চেতনা, প্রবন্ধ: ওয়াকিল আহমদ

৩. প্রবল বৈশাখ: পণ্য সভ্যতায় শিল্প সংকট , প্রবন্ধ: সেলিম আল দীন

দোহাই

১. লোকজীবন ও বৈশাখী মেলা, প্রবন্ধ: মোহাম্মদ সাইদুর

২. বৈশাখ, প্রবন্ধ: আতোয়ার রহমান 

৩. বাংলাদেশের উৎসব নববর্ষ, সম্পাদক: মোবারক হোসেন

মন্তব্য: