২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নাবেল পুরস্কার ও সত্যেন বােস।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

জহুরুল হক

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির বা পদার্থকে ভর দানকারী কণা নিয়ে গবেষণার জন্য ২০১৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নােবেল পুরস্কার পান- ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস ও বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী সােয়া আগলার। পদার্থের ভর দানকারী কণিকাটির পােশাকি নাম ‘ঈশ্বর কণা’। কণিকাটির নামের সাথে বা সব মিলে তাদের সাথে পরােক্ষভাবে স্মরণীয় হয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বােস।

কেন কণাটির সাথে সত্যেন বােসের নাম এল? তাবৎ দুনিয়ার সব মৌলিক কণাকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে- তার একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য বাঙালি অধ্যাপক সত্যেন বােসের নামে বােস কণা বা ‘বােসন’ আর অন্যটি ইতালিয় বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে ফার্মি কণা বা ফার্মিওন।

সব মৌলিক কণারই একটি বিশেষ ধর্ম হচ্ছে ঘূর্ণন (Spin) যা কিনা পূর্ণ সংখ্যা (0,1,2,.) অর্ধপূর্ণ সংখ্যা (½, 3/2, …) দ্বারা নির্দেশিত হয়। যে কণাগুলির স্পিন পূর্ণ সংখ্যা সে কণার দল ‘বােসন’। আর যাদের মান অর্ধপূর্ণ সংখ্যা তা হল ‘ফার্মিওন’। কণাগুলাের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সহজ ভাষায় বললে- ফার্মিওন কণাগুলাে যেন একটু ঝগড়াটে ধরনের, একই ধরনের কণা হলেও এক জায়গায় থাকতে পারে না- থাকতে হয় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। সে তুলনায় ‘বােসন’ কণা শান্ত, সামাজিক, বন্ধু বৎসল, সঙ্গ প্রিয় আড্ডাবাজ। ‘বােসন’ কণা যত খুশি গাদা-গাদি করে রাখা যায় এক জায়গায়, এতে কোনাে সমস্যা হয় না। এমনি একটি পরিচিত বােসন কণা হলাে আলাের কণা ফোটন। আর ফার্মিওন কণা হচ্ছে ইলেকট্রন। ফার্মিওনের জন্য এক ধরনের পরিসংখ্যান সূত্রই গড়ে ওঠেছে-সেটা ফার্মিডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্স নামে পরিচিত। বােসনের পরিসংখ্যান সূত্রকে বলা হয় বােস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স।

আবিষ্কৃত ঈশ্বর কণাটি বােস আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স সূত্র মেনে চলে। তাই এটি বােসন কণা ছাড়া আর কী? এ কণাটি আবিষ্কারের ফলে শূন্য ঘুর্ণনের কোনাে কণার প্রথম দেখা মিলল। বস্তুর ভর দানকারী এ ‘বােসন’ কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে ১৯৬৮ সালে পিটার হিগসসহ ছয় বিজ্ঞানী একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। হিগস ও তাঁর সহকর্মীরা এ গবেষণা এগিয়ে নিয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যন বােসের বােস আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স তত্ত্বের সাহায্যে। আবার যেহেতু এরকম কণার সম্ভাবনার কথা তাত্ত্বিভাবে হিগসই প্রথম বলেছিলেন-তাই হিগস ও সত্যেন বােসের নাম যােগ হয়ে কণার নাম হয়েছে ‘হিগস-বোসন’ কণা। এ কণার অস্তিত্ব তখন কেবল তাত্ত্বিকভাবে কাগজে কলমে ছিল। তাত্ত্বিক এ সম্ভাবনার পর বিজ্ঞানীরা এ কণাকে ধরতে বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই ধরা দেয় না কণাটি। মেলেনি কোনাে-ভাবেই এই ভূতুড়ে কণার সন্ধান। ত্যক্ত -বিরক্ত বিজ্ঞানীরা এ অধরা কণাকে তখন ‘গড ডাম’ পার্টিকল নামে ডাকতে থাকেন। পরে গড ড্যাম নামটি আর একটু পরিবর্তিত হয়ে ‘গড পার্টিকল’ বা ‘ঈশ্বর কণা’ হয়ে যায়- যার আসল নাম বােসন বা হিগস-বােসন কণা।

এই ঈশ্বর কণা এবং পৃথিবীর সৃস্টি রহস্য নিয়ে গবেষণার জন্য লার্জ হ্যাড্রন কোলাইভার সংক্ষেপে এল. এইচ. সি (Large Hadron Collider, L.H.C.) হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র একটি কণা ত্বরক (পার্টিকল এক্সেলেরটর) ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে মাটির প্রায় ১০০ মিটার নিচে তৈরি করা হয়েছে। বৃত্তাকার এই কণা ত্বরকের পরিসীমা ২৭ কিলােমিটার। এ যন্ত্রের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। যন্ত্রটাকে একটা মিনি বিগ ব্যাং (Big bang) বলা যায়। ৪৮ বছর ধরে পদার্থ বিজ্ঞানীরা ভর দানকারী যে রহস্যকণার সন্ধানে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। যে কণা না থাকলে কোনাে কিছুর ভর থাকত না। আর ভর না থাকলে পরমাণু ও যে কোনাে বস্তু গঠনকারী মৌলিক কণাগুলাে আলাের গতিতে অবিরত ছুটে বেড়াত। তার মানে এরা কখনাে জমাট বাঁধত না। যার অর্থ কোনাে পদার্থ সৃষ্টি হতাে না। আর তাহলে হতাে না কিছুই সৃষ্টি। অথচ সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ্ব আর বিশ্ব জুড়ে রয়েছে পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালাসহ কতই না বস্তু। বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গােলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেলেন।

অবশেষে ৪ জুলাই ২০১২ সেই অধরা কণার আবিষ্কারের ঘােষণা দেয়া হয়। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত ইউরােপের প্রভাবশালী বিজ্ঞান সংস্থা European Organization for Nuclear Research (CERN) জেনেভা ও লন্ডনে পৃথক পৃথক সম্মেলনে এ আবিষ্কারের ঘােষণা দেন।

সার্ন (CERN)-এর বিজ্ঞানীদের এই অধরা কণার আবিষ্কারের ঘােষণার সাথে সাথেই নােবেল পুরস্কার পাওয়াটা যেন ঠিকই হয়েছিল। শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

যে বিজ্ঞানীর নামে এত আলােচিত কণার নাম হয়েছে হিগস বােসন কণা। যে বিজ্ঞানীর তত্ত্ব সারা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়তে হয়- তিনি হলেন বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসু বা সত্যেন বােস। সত্যেন বােস ১৯২১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার হিসেবে যােগদান করেন। তখন তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৪০০ টাকা। তরুণ শিক্ষক সত্যেন বােস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্লান্কের বিকিরণ তত্ত্ব পড়াতেন- পড়াতে গিয়ে তাঁর খটকা লাগে। কিছুতেই তত্ত্বটি তিনি ঠিকভাবে মেলাতে পারছিলেন না। তাঁর কাছে মনে হলাে- তত্ত্বে কোথাও কোনাে অসংগতি আছে। সেই তত্ত্বটি সত্যেন বােস দেখলেন সন্দেহের চোখে। শেষ পর্যন্ত তত্ত্বটি সত্যেন বােস নিজের মতাে করে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান। যে তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্লাঙ্ক নােবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন- তার মানে পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা যাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন সেই তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক তােলা- তা আবার সদ্য প্রতিষ্ঠিত চাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ বছরের একজন তরুণ বাঙালি অধ্যাপকের! এটা বিস্মিত মনে হতে পারে। আসলে ঐ তত্ত্বে অসংগতিই ছিল। অসংগতিটি কী এবং তা কী হবে তাও বের করেন সত্যেন বােস। এ নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখলেন- নাম ‘প্লাঙ্কস ল অ্যান্ড দ্যা লাইট কোয়ান্টাম হাইপােথিসিস’। চার পৃষ্ঠার এ প্রবন্ধটি পাঠালেন লন্ডনে-ফিলােসােফিক্যাল ম্যাগাজিনের দপ্তরে যারা এর আগেও তাঁর গবেষণাপত্র ছেপেছিল। এবার না ছেপে পাঠাল ফেরত। বসু এবার তা পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে। সাথে একটা চিঠি। চিঠিতে আইনস্টাইস-কে ‘শ্রদ্ধেয় গুরু’ সম্বােধন করে সত্যেন বােস লিখলপন- ‘পর্যবেক্ষণ আর মতামতের জন্য আপনার কাছেই এ প্রবন্ধ পাঠালাম। পড়ার পর আপনি কী মনে করেন তা জানার জন্য তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি। লেখাটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করার মতাে যথেষ্ট ভাষা জ্ঞান আমার নেই। যদি মনে করেন এটি ছাপার যোগ্য সে ক্ষেত্রে এটি ‘সাইটশ্রিফট ফুয়ার ফিজিকে’ প্রকাশের ব্যবস্থা করলে আমি কৃতজ্ঞ থাকবাে। প্রবন্ধ পেয়ে আইনস্টাইন চমৎকৃত হলেন খানিকটা- কারণ বিগত বিশ বছর ধরে তিনি যে মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাই আজ না চাইতেই একেবারে হাতে! আইনস্টাইন নিজেই অনুবাদ করে গবেষণা পত্রটি ১৯২৪ সালে জুলাই মাসের প্রথম দিকে সাইটশ্রিফট ফুয়ার ফিজিক (Zeitschrift Fur physik) জার্নালে ছাপানাের ব্যবস্থা করে দেন। প্রবন্ধটির সাথে আইনস্টাইন ফুটনােটে লিখেছিলেন ‘বােসের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’। শুধুমাত্র অনুবাদ এবং একটি ফুটনােটের জন্য বিশ্বখ্যাত এই পরিসংখ্যান সূত্রটিতে আইনস্টাইনের নাম ঢুকে গেছে- এটাকে কেউ বােস স্ট্যাটিস্টিক্স বলে না- সবাই এটাকে বলে বােস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার পর- আইনস্টাইন নিজে সেটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন এবং বের হয়ে এলাে জগদ্বিখ্যাত- বসু-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থা (Bose-Einstein Condensation) সংক্ষেপে-বেক (BEC)। এটাকে বলে পদার্থের পঞ্চম অবস্থা। এই ‘বেক’ এর ওপর কাজ করার জন্য ২০০১ সালে তিনজন পদার্থবিজ্ঞানীকে নােবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সত্যেন বােস নােবেল পুরস্কার পাননি কিন্তু তাঁর কাজের ওপর গবেষণা করে অনেকেই নােবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে পেলেন আরও দুজন। নােবেল পুরস্কার কেবল জীবিতরাই পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে হয়তাে সত্যেন বােস কখনও সেটা পাবেন না। তবে এখন মানুষ জানে- নােবেল পুরস্কার দিতে পারলে নােবেল কমিটিই ধন্য হতে পারতাে। 

সত্যেন বােস- সুদীর্ঘ ২৪ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য গৌরবময় ২৪টি বছর! সত্যেন বােস ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ। তিনি বলেছেন- ‘যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তারা হয় বাংলা জানেন না, না হয় বিজ্ঞান বােঝেন না’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে তিনি সহকর্মী ও বিজ্ঞান চিন্তাবীদদের সহায়তায় দ্বিমাসিক বাংলা বিজ্ঞান পত্রিকা ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ প্রকাশ করেন। ভারত বিভক্তির পর মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে বিজ্ঞান আলােচনা ও বিজ্ঞান চিন্তা প্রসারের অয়ােজনে ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ স্থাপন ও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান পত্রিকা ‘জ্ঞান বিজ্ঞান’ প্রকাশ করেন।

উচ্চতর গবেষণা শেষে ইউরােপ থেকে ফিরে সত্যেন বােস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ডিনপদে আসীন হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলের প্রভােস্টও ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সত্যেন বোস পদার্থবিজ্ঞান বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন করে তুলেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদানের আগে ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বােস যৌথভাবে আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিক তত্ত্বের’ অনুবাদ করেন। আর এ অনুবাদের জন্য তাঁরা আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে অনুমতিও নিয়েছিলেন।

সত্যেন বােস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে উচ্চতর গবেষণার একপর্যায়ে প্যারিসে কুরি গবেষণাগারে কাজ করেছেন। পরে তিনি কাজ করেছেন বিজ্ঞানী মেরি কুরির সাথে রেডিয়াম ইন্সটিটিউটেও। অসাধারণ এ বিজ্ঞানী দেশ বিভাগের ঠিক আগ মুহূর্তে কলকাতা ফিরে যান। তাঁর কর্মময় জীবনে একটা অংশ তিনি শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন।

১৮৯৪ সালে ১লা জানুয়ারি উত্তর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সত্যেন বাস- ১৯৭৪ সালে ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে ৮০ বছর বয়সে কর্মময় এই মানুষটির জীবনাবসান হয়। এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল ‘বোস প্রফেসরশিপ’-

যা বােস চেয়ার নামে পরিচিত। পদার্থবিজ্ঞানে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ব্যক্তিদের এ পদে মনােনয়ন দেয়া হয়। বিশ্ব বরেণ্য এই বিজ্ঞানী সত্যেন বােস বয়ে এনেছেন দেশের জন্য দুর্লভ সম্মান। তিনি বাঙালির গৌরব, উপমহাদেশের অহংকার আর পৃথিবীর বিস্ময়।

মন্তব্য: