অস্থিরতার পলাতক ঘ্রাণ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সজল আহমেদ

চরিত্রলিপি :

আকাশ- স্বপ্ন ফেরিওয়ালা। বয়স- ছদ্মবেশী। কাঁধে একটা ঝোলা। তার ভিতর অক্ষরসমুদ্র এবং নানা রঙের তেজপাতার মতাে জীর্ণ খােলা খামের বাণ্ডিল। বাউল- চিরচেনা পােষাকে। ডাকপিয়ন- গ্রাম্য, সহজ-সরল, দায়িত্বশীল। ভাঙা সাইকেল ও কাঁধে চিঠিভর্তি একটা বহুপুরনাে ব্যাগ। মূত্তিকা- বয়স বাইশ-তেইশ এর মাঝামাঝি। লাল শাড়ি পড়া, চাহনিতে তীব্র ক্লেদের ছায়া। স্থান- খােলা আকাশের নিচে সমুদ্রের কাছাকাছি। সময়- পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যা, রাত, গভীর রাত।

দৃশ্য-১: পড়ন্ত বিকেল

(পড়ন্ত বিকেলের ঘন রােদ হামাগুড়ি দিয়ে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রে। তার ভিতর শূন্যতার ঢেউ জুলন্ত সিগারেটের ধোঁয়ার মতাে পালিয়ে যাচ্ছ। ঢেউ এর খুব কাছাকাছি বসে আছে আকাশ। তার কয়েক ভগ্নাংশ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্তিকা। তার চাহনির লেন্স তীক্ষ্ণ। খােলা চুল বাতাসে উড়ছে। অস্থিরতায় কাঁপছে তার সমস্ত শরীর। এর মধ্যদিয়ে অতিক্রম হয় সময়ের ঘােলা জল। হঠাৎ মৃত্তিকা দেখে নানা রঙের প্রজাপতি গুলাে গােধূলির লাল আভায় স্নান করছে। এভাবেই তার শৈশব আর সমুদ্রস্নান চুরি হয়ে যায় খােলা আকাশের নীচে। বহু দূর থেকে তখন ভেসে আসে বাউলের সুর। তারপর শুরু হয় ঢেউ এর পিঠে ঢেউ এর অবিরাম খেলা।)

বাউল : ‘একখানা দুঃখ দিলে

আধখানা সুখ দিই,

এক ফোটা জল দিলে

আধফোটা রােদ দিই।

মৃত্তিকা: এই তাে ঢের ভালাে, নির্দিষ্ট দূরত্বে

তােমার আমার মুখােমুখি কথােপকথন।

আকাশ: নিঃশ্বাসের গােল অভিমানি বাতাসকে ঘিরে

উড়ে বেড়ায় শব্দেরা;

যেখানে, তুমি, আমি কাল্পনিক

তবুও দ্বন্দ্ব থাকে দূরত্বে।

মৃত্তিকা: সম্পর্কের একটা নাম থাকে

যা আমাদের নেই,

ইচ্ছের মিছিল আছে

শুধু শ্লোগান নেই।

আকাশ: ভয় নেই,

এতটা দীর্ঘশ্বাস ফুসফুসে জমা নেই:

আছে সীমানা, আছে কাঁটাতার,

পার যদি ভেঙ্গে ফেল দেওয়াল

অথবা পালিয়ে যাও স্বপ্ন নিয়ে।

মৃক্তিকা: ফিরে আসি নি আমি

তবু পিছনে তাকাই,

শূন্যতায় ভিজে যায়

বুকের নকশিকাঁথা,

তবুও কেন স্বপ্ন দেখাও

যত বার মৃত্যুকে আপন ভাবি।

আকাশ: স্বপ্নের ছাই উড়ে যায়

তখন, পিছু নেয় চোরাবালির তীব্র ঢেউ

বুকের গভীরে কাদা জমে

তবুও ভিড়ের মাঝে কত একা আমি।

মৃত্তিকা : একাকীত্ব বােধ খুঁজে বেড়াই

তীব্র স্নায়ুযুদ্ধে কেঁপে ওঠে সমস্ত শরীর

তখন, জোনাকিরা জেলে দেয় আলাে

আমিও মাতাল হয়ে হারিয়ে যাই

তােমার উদাস মনের গভীরে।

আকাশ : এ কী নির্মাণ প্রতিনিয়ত

তােমার আমার যুগলস্নায়ুতে!

যেন বেড়ে গেছে।

বুকের উনুনের উত্তাপ

যেখানে কান্না পুড়িয়ে

তৈরি কর তুমি

মাছির গুন গুন শব্দের মিছিল।

মুক্তিকা:  তােমার উড়ন্ত চুলে

ঢেকে গেছে শেষ বিকেলের সূর্য

তবুও স্পর্শ করতে চাই

অপার্থিব আলাের উৎসকে।

আকাশ : তবে কি এখন নামবে বৃষ্টি!

যার অপেক্ষায় তুমি-আমি।

মৃত্তিকা : কন-কনে শীতের ভিতরও

ঘেমে ওঠে আমার শরীর,

তবে কি দূরত্বের সীমানা,

আঁধার ডিঙিয়ে

খুঁজে পেল তার গন্তব্য।

আকাশ : এ কী বিষমাখা প্রশ্নের তীর

ছুঁড়ে দিলে আমার বুকে

তবে কি আবার ফিরে আসবে

আলােকিত জ্যোৎস্নার ঢেউ

শুরু হবে এ বুকে নিশ্চুপ রক্তক্ষরণ।

দৃশ্য-২: সন্ধ্যা

(সন্ধ্যার চিবুকে লাল, নীল, স্বপ্নের ক্ষত। তবুও উন্মাদ খােলা আকাশ। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সাইকেলের টুং টাং শব্দ। সমুদ্রও ক্ষুদ্র হতে বিশাল হতে শুরু করেছে। স্রোতের মায়ায় শব্দেরা খেলা শুরু করে, শুরু হয় আদিম নৃত্য। যার পাশে বয়ে যায় পুরনাে সময়ের স্রোত। মৃক্তিকা অপেক্ষায় থাকে ডাক পিয়নের, নাকি চিঠির জন্যে, নাকি চিঠিতে লেখা শব্দগুলাের জন্য। এ কি অপেক্ষা নাকি অক্ষরের জন্য মায়া। অভিমানের তীব্র নােনা জল জমে ওঠে বুকের গভীর হতে। তবুও শেষ হয় না, এ অপেক্ষা। যুগে যুগে তৈরি হয় মাটির গ্রাণ, যাকে শরীরে মেখে শুরু হয় সমুদ্রস্নান। তারপর; পশ্চিমের আকাশে উড়ে যায় এক ঝাঁক গাংচিল। যেন জীবন্ত স্বপ্নের উড়ন্ত ঘুড়ি উড়ে গেল।)

ডাকপিয়ন : ‘চিঠি নেবে, চিঠি;

সুখ-দুঃখ ভরা চিঠি।

চিঠি নেবে, চিঠি;

চোখের জলে ভেজা চিঠি।

চিঠি নেবে, চিঠি।

মৃক্তিকা : এ কী তবে মৃত্যুর স্বাদহীন রঙ!

বালকের হাতে খােলা বালিকার প্রথম বােতাম

এসব স্মৃতির কোন রঙ নেই

সব বর্ণহীন, ভাজ করা সাদা কাগজ।

আকাশ : এত রঙ খুঁজে লাভ কী?

কষ্টের আবার রঙ!

মূক্তিকা : সন্ধ্যার বিষণ্ন ছায়ার চাদর

ঢেকে রাখে তােমার মুখ,

বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায়

সমস্ত শব্দের ব্যতিচার

আমার ঠোঁট কেঁপে ওঠে

ঘেমে যায় নাভিমূল।

আকাশ : আঁধার এলে, উন্মুক্ত হয় আলো

ডিম্বক ফেটে বেরিয়ে আসে লীথান জিন

সম্পর্ক ছিড়ে যায় সূর্যাস্তে

শুধু থাকে তীব্র ব্যথার মিথ ও ফসিল।

মৃত্তিকা: এ কি আগুন নাকি রােদ?

নাকি মাংস পােড়ানাে গন্ধ?

আকাশ : এ শরীর নতুন করে

পুড়িয়ে লাভ কী!

পুরনাে ছাই ফেলে দিয়ে

অতীতকে অস্বীকার করা যায় না

এ যেন ছেলেভােলানাে কয়েক

মুহূর্তের আলােড়ন।

মৃক্তিকা : এ জমিতে জল ঢেল না

মাটি অনুর্বর হয়ে গেছে,

বিকলাঙ্গ স্বপ্নের জন্ম

আর চাই না।

আকাশ: কুমারী শব্দের চিঠিগুলাে

সারা রাত জেগে থাকে

আমার পাশে সবুজ ঘাসের ওপর

তখন আমি ঘুমিয়ে পড়ি

স্বপ্ন দেখবাে বলে।

মৃক্তিকা : ঠিকানা চাই না

চাই, গােপন সন্ধ্যার ছায়া

ফিরে যদি আসে পাখির পালক

তবুও চাই রক্তাত্ত আঁচড়।

আকাশ : নিজের ছায়ায় ভরে ওঠে

আলাের সরল পথ,

যে পথে ফিরে এসেছে

মাটির ঘ্রাণ তৈরি হয়েছে।

রঙের উপর, জলের সম্পর্ক।

দৃশ্য-৩: রাত

(নিজেকে লুকিয়ে রেখে মৃত্তিকা জেলে দেয় রাতের বাতিঘর। নক্ষত্রের আলােয় ভরে ওঠে চারিদিক। বুকের ভিতর জমানাে শব্দের খই সে উড়িয়ে দেয় রাতের আকাশে তখন পায়ের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসে। আলাের নিচে শুরু হয়, জোনাকি পােকার নগ্ন নৃত্য। বাউল ফিরে আসে আলাের মায়ায়। কণ্ঠনালী বেয়ে নামতে থাকে বরফের শুভ্র চাঁই। আঁধার আরাে ঘন হয়; তারপর শুরু হয় স্নায়ুর ভাঁজ খােলার শব্দ।)

বাউল : “ভিতরে-বাহিরে আছে দ্বন্দ্ব

আছে মােমের খােলস,

ভাের এলে রাত মরে যায়

লাগে না হয়ত মন্দ,

কাছে গেলে

বাড়ে তােমার-আমার দূরত্ব।

মৃক্তিকা: ভালােবাসা ফিরে পাই নি

ভালােলাগা ফিরে পেয়েছি

আকাশ : দুঃখের ভিতর দুঃখ দিয়ে

কেন করুণা করতে চাও?

মৃত্তিকা: বৃত্তের বাইরে জল আটকে আছে

মনের কাছে তুমি,

স্বপ্নের ভিতর লাল শাড়ির মায়া

বুকের কাছে তুমি।

আকাশ : তারপর আমরা দু’জন

মিছিলের গান হয়ে

উড়ে বেড়াই সন্ধ্যার বাতাসে

আবেগে থাকে দূরত্ব

মরণে তাকে তৃষ্ণা

বােধের ভিতর এক-একটা টিকটিকির লেজ

শুরশুরি দেয় আপন ভেবে

জ্যোৎস্নায় ভরে ওঠে

তােমার শাড়ির নগ্ন আঁচোল

শুধু আমি চলে যাই, চলে যাই।

মৃক্তিকা: নারী কি জানে নারীর দুঃখ?

নারী কি জানে নারীর আনন্দ?

আমি শুধু পাতা ওড়াই

স্মৃতির ভিতর জমিয়ে রাখি

পুরুষ তাের দূরত্ব।

আকাশ : বুকের কাছে উদ্বাস্তু পাথর হয়ে

যে সময় চলে গেছে।

তার সবটুকু আজ ফিরিয়ে দিতে পারাে?

জানি তােমার দুঃস্বপ্নে আজও

বেঁচে থাকে আমার দীর্ঘশ্বাস

তবু তুমি অচেনা নারী

চেনা এই বুকের বাতিঘরে।

মৃক্তিকা: অভিমানি দুঃখরাও

মুখ ঘুরিয়ে নেয়

বয়স বাড়লে

যেমন রাতের নিয়ন বাতি

ফুরিয়ে যায় ভাের হতেই।

আকাশ: দীর্ঘ এই রাত

এক সময় ফুরিয়ে যাবে

ফুরিয়ে যাবে তােমার

শিউলী ফোটানাে শাদা হাসি।

মৃক্তিকা: তােমার মৌন সময়ের ঘ্রাণ

নেমে আসে মাঠের সবুজ ঘাসে

ভিতরে থাকে নির্মম শেফালী ফুলের

কয়েকটি লাল সুতাের কাগজ-ঘুড়ি।

আকাশ: নষ্ট হয় গােলাপী রাত

নষ্ট হয় জীবনসমুদ্র

নষ্ট হয় কাঁচের দূরত্ব

নষ্ট হয় রূপালী চাঁদ।

দৃশ্য-৪ : গভীর রাত

(গােপন ঈর্ষার ব্যর্থ কল্পনা শেষে আকাশ ফিরে আসে গভীর রাতের আকাশের নির্জন নক্ষত্রের মতাে। দীর্ঘ রাতে থাকে ফেরারী বাতাস, সমুদ্রের গর্জন, দূরত্বের মায়া এবং অচেনা মৃত্তিকা। ক্লান্ত জোনাকির স্বপ্ন ছড়ানাে আলােতে প্রতিফলিত হয় মানব-মানবীর দীর্ঘশ্বাস। রাতের বুকে জমে থাকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলাে-ছায়ার প্রতিচ্ছবি। অবশেষে বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায় চোখের নােনা জল, অবশেষে মুক্তি, অবশেষে ভাের এবং আলােক রশ্মি।)

বাউল : জেগে থাকি রাত

সাথে থাকে চাঁদ

ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে মন

যদি না শেষ হতাে এ জীবন।

মৃক্তিকা:  দীর্ঘ ক্লান্তিতে ঘুম আসে না

জেগে থাকি পূবের মতাে

উষ্ণ হাতের কাছে ফিরে যাই

যত বার ব্যর্থ হই তােমাকে ভুলতে।

আকাশ: একপাশে মাংস একপাশে কংকাল

কে আমার বেশি আপন?

কে জানে ভালােবাসতে?

মৃত্তিকা: পুরুষ না বাউল কে তুমি ফিরে আসোে?

এখানে সংসার নেই, হাড়িতে চাল নেই

আছে কাল্পনিক সত্য-মিথ্যার মিথ

যেখানে জানালার পাশে শুয়ে থাকে

কয়েকটি ব্যর্থ নক্ষত্রের হলুদ কামনা।

আকাশ: উত্তেজনায় ঘেমে ওঠে হৃৎপিণ্ড

জলের আগুনে থাকে তৃষ্ণা

কামনায় থাকে পবিত্র পাপ

নৈঃশব্দে থাকে নিঃসঙ্গবােধ।

মুক্তিকা : স্পর্শে বেড়ে যায় বয়স

অবাক চোখ দু’টি গােল হয়ে

ঝুলে থাকে সরল দোলকের সাথে।

আকাশ : যদি একাধিক শব্দ

আমার স্বপ্নগুলােকে জমা রাখে

তবে প্রতি মুহূর্তে স্মৃতিতে

কারা এসে ভিড় জমায়!

সব অচেনা মনে হয় কেন?

মৃক্তিকা : এভাবে নয়

স্বপ্নের ভিতর আরাে গভীর হয় সে জল,

তাকে তুমি স্পর্শ করাে না

শুধু জেনাে সব জলে

কমে না তৃষ্ণা

বরং আরাে বেড়ে যায়।

আকাশ : নিজেকে নিয়ে আমি

কখনােই ভাবি নি

যত ভাবনার ফসল

সবই তােমাকে ঘিরে

এ বুকে প্রতিদিন

কত রােদ জ্বলে আর নেভে

হিসেব রাখি না তার

শুধু দেখে যাই নীরবে।

মৃত্তিকা : যেখানেই যাও

মনে রেখাে সমুদ্রকে

ভুলে যেও রাতের অন্ধকারকে

ভুলে যেও এই নারীর ছায়াকে।

আকাশ : সে তাে ছায়া নয়

ধ্রুবপদী সত্য তার অস্তিত্ব

যাকে খুঁজে পাই কারণে-অকারণে

নিঃশ্বাসে এবং দীর্ঘশ্বাসে।

মৃক্তিকা : পাগলামী করাে না;

শাদা পাঞ্জাবীর গায়ে

কেন লাগালে কালাে রক্তের দাগ?

মন্তব্য: