পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কবিতা : এক বর্ণিল উড়াল।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সুবীর সরকার

বাংলা ভাষায় লেখা বাংলা কবিতা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকা, আন্দামান, বহির্বঙ্গজুড়ে বাংলা কবিতার নিবিড় চর্চা ও অনুশীলন চলছে ধারাবাহিকভাবেই। এছাড়া পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীরা নিজের মতন লিখে চলেছেন কবিতা। চর্যাপদ থেকে সবসময় বাংলা কবিতা তার নিজস্বতায় বহুমাত্রিকতাই বয়ন করেছে। বাংলাদেশের কবিতায় আমরা পাই ঐতিহ্যচেতনা, দেশকাল, মুক্তিযুদ্ধ ও আবহমানতাকে আমাদের এখানেও কালখণ্ডকে মান্যতা দেয়া হয়েছে সবসময়। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় বিচিত্র রঙের উদ্ভাস। বহুরৈখিক ভাবনাবিশ্বের চিরায়তকে চিরনতুনভাবে পাই। কবিতা নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে চারপাশে। ইন্টারনেট সারা পৃথিবীকে মিলিয়ে দিয়েছে। অনলাইন ম্যাগ, ওয়েবপত্রিকা, ব্লগ পারস্পরিক বিনিময়ের মুক্তদিগন্ত। নেগেটিভ দিককে উপেক্ষা করেই বলা যায়, এসবের ভিতর দিয়ে আমাদের বাংলা কবিতা নুতন এক ডিসকোর্সের ভুবনায়ন। কানাডা থেকে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণেরা বের করে যাচ্ছে- জলভূমি। খাতুনে জান্নাত ফকির ইলিয়াস মাসুদ খান সৌম্য দাশগুপ্ত আর্যনীল মুখােপাধ্যায় রেজা নুর তাপস গায়েন মজনু শাহ ও আরাে অনেকেই বাংলা কবিতা, পত্রপত্রিকা নিয়ে পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে কি অসামান্য কাজ করে চলেছেন! যাই হােক, সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে কবিতার হালহকিকত নিয়ে কিছু বলতে হবে এবার। সাম্প্রতিক সময়, মানে ধরা যাক, বিগত ১০ বছরে পশ্চিমবাংলার বাংলা কবিতায় অনেক বাঁকবদল ঘটেছে, ঘটে চলেছে। আমি কিছু বৈশিষ্ট্য/লক্ষণ তুলে ধরছি,

ক। এক ঝাক তরুণ, তরুণতর কবি লিখতে এসেছেন

খ। ভাষাবিন্যাস, শব্দব্যবহারে এরা সাহসী

গ। যে কোন বিষয়ে এরা লিখতে পারেন

ঘ। দলবদ্ধতায় কখনাে এরা এদরেকে সঙ্ঘবদ্ধ করে থাকেন

ঙ। কেন্দ্রিকতাকে ভেঙে দিয়ে প্রান্তের প্রাধান্য

চ। প্রতিষ্ঠানকে তােয়াক্কা না করে নিজের স্বতন্ত্র পথে চলার চেষ্টা

ছ। কলকাতার পাশাপাশি মফঃস্বল থেকে প্রচুর তরেুণেরা লিখতে এসেছেন

জ। পূর্ববর্তী প্রথা ও পথ থেকে সরে আসার প্রবনতা

ঝ। ঐতিহ্যচেতনার সাবেকি আদলকে উপেক্ষা করে এরা নুতন এক ঐতিহ্যচেতনাকেই তুলে এনেছেন।

ঞ। ক্রমাগত লিখে যাবার স্বতঃস্ফৃর্ততা

ট। প্রচারিত, পাঠকের কাছে পৌঁছবার একটা তাগিদ

ঠ। প্রচলিত ছন্দকে অস্বীকার করা

ড। আঞ্চলিকতাকে, পুরাকল্প ও মিথকে ব্যবহার নুতন প্রয়াস

ধ। লিটল ম্যাগের পাশাপাশি ওয়েবম্যাগ, ব্লগ, গ্রুপ, সামাজিক সাইটে নিজেদের প্রকাশ ও কবিতার দিকবিদিক, তত্ব, প্রকরণ নিয়ে বিতর্ক আলােচনায় অংশ নেয়ার প্রবণতা

ন। অধ্যাপকীয় ফতােয়াকে অগ্রাহ্য করা

প। রাজনীতি ও সমাজসচেতনতাও লক্ষনীয়। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের ঘটনা কিম্বা ধর্ষণের মতন ঘটনায় কবিরা কিন্তু রাজপথে নেমে এসেছিল

ফ। সরাসরি কথা বলবার প্রবণতা, কিছু আপাত রুক্ষতা হয়তাে

ব। চাপিয়ে দেওয়া বা শিখিয়ে দেয়া তত্বকে মেনে না নিয়ে নিজের পথেই নিজের মতাে হেঁটে চলা। ব্যাক্তিস্বাধীনতাই গুরুত্ব পেয়েছে

ভ। স্বভাবকবিত্ব ও স্বভাব কবিতাকে চূড়ান্তভাবে অগ্রাহ্য করা

ম। আবেগের বাহ্যিক সংযম

য। বিশ্বনাগরিকত্বের বােধ

এই বৈশিষ্ট্যগুলাের বাইরেও অনেকে হেঁটেছেন। কেউ প্রতিষ্ঠানে প্রচুর লিখেছেন। তবে মূলতঃ এটাই মূল উপজীব্য বলে আমার মনে হয়েছে। তবে একটা কথা না বললেই নয় যে, প্রচুর বই বেরুচ্ছে; প্রচুর লেখা প্রকাশের জায়গা তৈরি হওয়ায় পাঠক নিজের মতন পড়ার সুযােগ পেয়েছে। আর, কবিতার প্রতি আগ্রহও অনেক বেড়েছে। বই তাে বিক্রিও হচ্ছে। মহকুমার লিটলম্যাগ মেলাগুলিই তার প্রমাণ দেবে। এই তাে, সেদিন; কলকাতা লিটলম্যাগ মেলায় তরুণ কবি উল্কা-র নুতন বই প্রায় ২০০ কপি বিক্রি হলাে। পুরুলিয়া, জলপাইগুড়ি, বাকুড়ায় ছােট কাগজকে কেন্দ্র করে উন্মাদনাও বিরল দৃশ্য নয়। সমকালীন কবিরা এখন নিজেদের মধ্যে নিয়মিত বিনিময় করেন। তারা অনেক যূথবদ্ধ। পাশাপাশি এখন ই-বুক প্রকাশ পাচ্ছে নিয়মিত। পৌঁছেও যায় পাঠকের কাছে। কবিতা যেন উৎসবগাঁথা, কার্নিভাল হয়ে উঠেছে; সাম্প্রতিক কবিদের উন্মাদনা সেই প্রমাণই তাে দেয়।

সাম্প্রতিক পশ্চিমবাংলার কবিতায় এতাে মেধাবী ও পরিশ্রমী কবি এর আগে এতাে তুমুলভাবে আসে নি। কতাে বিচিত্র বিষয়ের, বহুরৈখিকতার ছড়ানাে রােদমেঘমায়া। বিষয় ছাপিয়ে আসে বিষয়হীনতাই! স্মার্ট শব্দের, নাগরিক ও গ্রামীন জীবনের নানান অনুসর্গ জড়িয়ে থাকে তাদের কবিতার পরতে পরতে। যেমন,

১। ভ্ৰমণের সময় প্রতিটি মুহূর্ত গুনতে থাকুন (অভিজিৎ দাশগুপ্ত)

২। বসন্তে ডেকে উঠেছে কোকিল

    এই সম্বিতে 

    উপকূল জুড়ে মিহিভাব (সঙঘমিত্রা হালদার)

৩। জলের সাথেই সবাই দুলছে পরবর্তী নগ্নতার জন্য (রমিত দে)

৪। প্রিয় দুপুর ভাত ডিঙিয়ে ফেলছে (তম্ময় ধর)

৫। তার নামের গােড়ায় অজস্র আলাে এসে পাহারা দিচ্ছে রােজ (গৌরব চক্রবর্তী)

মজা ও ম্যাজিক দিয়ে ভরানাে কবিতাভুবন। শব্দগুলি গড়িয়ে যায় ব্যাটারির মতাে। বহুমুখিতায় জায়মান করে তােলার প্রয়াস। আবার,

১। কেঁপে উঠছে

     দ্রুত ফেলে যাওয়া পুনর্জন্ম (নীলাজ চক্রবর্তী)

২। খালি পায়ে হেঁটে আসি ঝিঙেফুল রােদ

    বিকেলবেলার, (পীযুষ সরকার)

৩। দেবলীনা আশকারা দিও না, আশকারা দিও না এতাে

     আমার সহ্যশক্তি সীমিত (জুবিন ঘােষ)

৪। আমার ঘুমের রাজ্য জুড়ে যারা যাতায়াত করে 

   পরী, ডাইনীদের মতঃ নীলচে সবুজ গন্ধ। (মানিক সাহা)

৫। মৃত মানুষেরা দাঁড়ায় না

    কথা বলে না

    শুয়ে থাকে (বিশ্বজিৎ লায়েক)

জীবনের পাকে পাকে জড়িয়ে যেতে যেতে দৃশ্যের বাইরে গিয়ে আদতে কিন্তু জেগে উঠতে থাকে দৃশ্যরাই। কোন ছকের মােহে আটকে থাকেন না কবিরা। বিচিত্রসব কোরাসের ভিতর জীবনময় অভিযাত্রা। জেগে ওঠে বহুস্বর লােকগানের উঠোনে,

১। ছুটির শৃঙ্খলে খেলার মাঠ

    ঘুঘুর কণ্ঠস্বর নিঝুম দুপুর। (রােশনি ইসলাম)

২। প্রাক্তন প্রেমিকদের অভিশপ্ত ঘুম ভাঙতে থাকে (উল্কা)

৩। গাছের কাছে এসে দ্যাখাে, তােমার ডাক নাম দূষণ- (তানিয়া চক্রবর্তী)

৪। ব্যাগভর্তি সূর্যান্ত আগামী দিনের জন্য (শমীক ষান্নিগ্রাহী)

৫। ধনেশ পাখির এক সংক্ষিপ্ত উড়ে যাওয়া- (অরূপরতন ঘােষ)

কবিতার কি বহুবর্ণ বিস্তার। দেখাকে কতরকমভাবে দেখা করে তুলতে পারা যায়। হাসপাতালের দিকে চলে যাওয়া মানুষের একা একা বেঁচে থাকা মানুষের দিন কালের ভিতর কেমন দূরাগত হয়ে থাকা এক যাপন উঠে আসতে থাকে,

১। এখন বালিতে কোনাে ঘােড়া নেই।

    ঘােড়াদের ভাই-বেরাদর নেই। (দোলনচাঁপা চক্রবর্তী)

২। কী এমন কথা কেউ লিখে রেখে যায়নি সেদিন? (দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায়)

৩। চোখে তার কাঁচা রঙের আলাে (সৌম্যজিৎ আচার্য)

৪। বরান্নে এসাে,

    খচিত হও মধু ও লাম্পট্যে (সব্যসাচী হাজরা)

৫। গর্ভের সমস্ত তুমিতে দ্যাখাে

    কোথাও দাঁড়িয়ে আছে (অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়)

৬। তােমাকে বসাই আর হাতের তালুতে তােমার উদভ্রান্ত খোঁপাটি খুলে যায় (অরুণ পাঠক)

সময়কে, মানে যে সময়ে কবির যাপন; তাকে তাে কোনকালেই অস্বীকার করতে পারেন নি কবি। কবিতা দেশকালপ্রেক্ষিত আবশ্যিকভাবেই আসবে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কবিতায় তার প্রতিফলন তীব্রভাবেই আছে। জীবনকে, জীবনের সমগ্রতা দিয়েই মেখে নিয়েছেন কবিরা। কথা, গাঁথা, কিংবদন্তি, প্রেমে-অপ্রেমে এক গহনকুহককুয়াশায় ডুবে গিয়ে মেধার লাঙল দিয়ে কবিতাকে এক অন্তহীন জার্নির দেশে গড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কবি প্রতিষ্ঠানে তার নিজের কবিতাটিই লিখেছেন, প্রতিষ্ঠানের আদিষ্ট হয়ে নন। নুতন এই কবিদের সাহস ও মগ্নতা রয়েছে। তারা কেবল খনন করে চলেছেন নুতন নুতন কূপ ও জলাধার। ত্রুটিবিচ্যুতি কিছু থাকতেই পারে; কিন্তু সে সব ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে এটাই, জমজমাট এক হাটগঞ্জের উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছেন সাম্প্রতিক কবিরা, যা মুখ্যতই এক গোপন ঝাউবন হয়ে ওঠে ক্রমশ।

মন্তব্য: