আপন অবুঝ শালিকের মতাে উড়ে গেছে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আঁখি সিদ্দিকা

নােনা জলে ভেসে ভেসে-

কবিদের শশ্মানে আগুন জলে না

স্মৃতিতে ভেসে থাকে রােদ ও আকাশ

আমার বেদনার নাম দীপ্ত কুয়াশা।

কবি আপন মাহমুদ জীবনের ছায়াজলে ভেসে ভেসে চলে গ্যালাে কুয়াশার দেশে, আর তার ফেরা হবে না ইলিশ গন্ধের এই শহর-জনপদে। আপনকে নিয়ে আমার লিখবার কথা না বরং আপনের বই নিয়ে একটা লেখা লিখতে চাওয়া আমার ছিল। আপনের সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প দিনের, অল্প কিছু সময়ের। ২০১১ সালের একুশে বইমেলায় আমার প্রথম বই ছায়াচর প্রকাশিত হয়। ওইবছর-ই আপনেরও একমাত্র বই সকালের দাড়ি কমা বের হয়। বাঙলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনে অনুজ এহসান(এহসান হায়দার) পরিচয় করিয়ে দেয়। কথায় কথায় অনেক বিষয় নিয়ে এগুতে থাকা। এক কপি মলাটও সে নেয় সাথে আমার একটা বই। তারপর আর দেখা নেই-হঠাৎ আবার দেখা মে মাসের একটা দুপুরে এই বাংলা একাডেমিতে। তখনও অনেক আডডা হয়। তারপর আরাে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে কবিতার নানা বিষয় নিয়ে। আমাদের মলাট-এ লিখবে কথা দিয়েছিল কবিতা সংখ্যায় কিন্তু আপন তার আগেই হারিয়ে গেল- রােদ আর জোনাকিদের দেশে।

মলাট-কবিতা সংখ্যায় আপন ঠিক লিখতে পারেনি কিন্তু আমরা আপন সম্পর্কে একটা মূল্যায়ন রাখতে পেরেছিলাম অনু হােসেনের কল্যাণে আর ছেপেছিলাম তার লেখা কবিতা।

কবি আপন মাহমুদ কে ছিলেন?

কী-ই তার পরিচয়?

কবিতা দেবী কেন তাকে ভালােবাসলেন আর পাঠালেন কেন তারার দেশে?

অতঅত প্রশ্ন আমার কেন?

উত্তর একটাই প্রতিদিন-ই তাে সূর্য ওঠে আবার সূর্য নিজের মতাে করে ডুবেও যায় কিন্তু আপন কী সেই সূর্য ছিল নাকি হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা-যার কবিতা এক মায়া জাদুতে ফেলে হারিয়ে গেল! আমি নিজে সে যখন মারা যায় যেতে পারিনি আর তাই তার উদ্দেশে মলাট-এর মাসিক আড্ডা অলাতচক্র একটি আসরকে উৎসর্গ করি, তার কবিতা পড়ি। প্রত্যেকেই আলােচনা করেছিলেন তাকে নিয়ে। অনেকেই এসেছিলেন টিএসসির সেই আড্ডায়। যখন খবরটা পাই অদ্ভুতভাবে আমি থমকে যাই আপন মারা গেছে শুনে। কী আশ্চর্য আপন কে সেদিনই তাে দেখলাম ভালাে! আপন চলে গেল। ওর কবিতা নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল, আগ্রহ বলতে আপন তার কবিতার জাদুতে মােহাবিষ্ট করত। পরে শুনেছি আপন সংগ্রামী। আর এই সংগ্রাম করার দক্ষতা হয়তাে ওকে আরও বেশি কবি করে সাহায্য করেছে।

দাঁড়ি-কমার দেহ পাঠ

আপন তার সময়কে কখনােই আটকে রাখতে চাননি। আদিতে তার বড্ড বিশ্বাস ছিল। আর বিশ্বাস ছিল কলম এবং কবিতার খাতার প্রতি। জীবনের ক্লান্তি তার কাছে কিছুই মনে হতো না। কাজের ভেতরেই তাই গড়ে তুলছিলেন একটু একটু করে নিজের কবিতার জগৎ- কবিতার প্রাসাদ, রাজ্য। তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতি হাতড়ে ফিরতেন, খুঁজে ফিরতেন শেকড়ের গল্প। এ কারণেই কবি আপন মাহমুদ তার দাদার টিপসই-টা উঠিয়ে দেন বইয়ের ফ্লাপে।  শেকড়প্রেমী আর অসম্ভব আবেগি কবি আপন। জীবনের সাথে রােজ তার দেখা হতাে বােধ করি একাকী কাজের ভীড়ে আর তাই বুঝি লিখলেন-

উল্টোপথেই হাটি, শুনেছি এ পথেই পাওয়া যায় ডােডাপাখির

বরফাচ্ছন্ন ডানা, আদিমতম গুহার ওম, আর ব্যক্তিগত

আকাশের খােড়াখুড়ি।(উপ্টোপথ, সকালের দাড়ি কমা, পৃষ্ঠা-৪৭)

যাঁরা ক্ষণজন্মা শিল্পী তাঁদের জন্য আমাদের কষ্ট হয়। মনে হয় তাঁরা কেন আরও লিখবেন না! কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে অসংখ্য কবিতার শিল্পী-সাহিত্যিক। সুবাস বিলানোর আগেই হারিয়ে যাওয়া এরা সত্যি বন্ধুদের কাঁদায়। আলােচ্য আপন মাহমুদকে ঘিরেও একই অনুভূতি। আপন মাহমুদ কেন আরও লিখবেন না! কেনই বা একটি সকালের দাঁড়ি-কমা-ই তাঁর অনাগত সম্ভাবনাকে জানান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। এই রকম নানা প্রশ্নের ঠোকাঠুকি চলে মক্তিষ্কে। আসলে এসব মন থেকে বেদনার উচ্চারণ দিয়ে শুধু কবিতার একাগ্র পাঠকের মন ভরানাে যায় না। কবিতার জাদু ভাষার জাদু সবচেয়ে জরুরি। যা আপনের কবিতায় লক্ষ্য করা যায়।

আপন মাহমুদের কবিতা সাধারণ মানুষের এক ধরনের জীবনকথা, হয়ত এই জীবনটাই আপনের কিংবা আপনেরই কোনাে স্বজনের। আপন কথা বলেন কিংবা কথা বলতে তিনি পছন্দ করেন। সে কথামালা নিজের জীবনপথকে যেমন বিশ্লেষণ করে, পাশাপাশি অন্য সত্তার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক, সীমা, যােজন-বিয়ােজনকে তুলে ধরে। সকালের দাঁড়ি-কমার ৯-১৮ পৃষ্ঠা জুড়ে মা সিরিজের কবিতা। টানা দশটি কবিতা মাকে নিয়ে। সন্তানের চেতনার বহুমাত্রিক বেষ্টনী কবিতাগুলােকে নিজস্বতা দিয়েছে। ধ্রুপদী অনুভূতি আছে যা মনের মধ্যে অনায়াসে দাগ কাটে। কোথা থেকে কোন কবিতারপ্রেমি আপন মাহমুদকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেন-

মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে

শুনেছি, সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলাে

পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি (মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া, সকালের দাড়ি কমা, পৃষ্ঠা-

০৯)।

পৃথিবীতে প্রজাপতি জন্মের পেছনে এমন প্রেমাস্পদজনিত ঘটনাপ্রবাহের কাল্পনিক অনুভব কবিতা পাঠের অভ্যাসকে আরও একধাপ এগিয়ে দেবে। কল্পনাশক্তিই মহতকবির বড় সম্পদ। পরের স্তবকে ‘মা, পৃথিবীর যেকানাে নারী থেকে যাকে কখনােই আলাদা করা যায় না এ লাইনটির ক্ষেত্রেও কল্পনার এবং ধ্রুব সত্য কথার গাঁথুনি আছে। যে মাকে নিয়ে করির এত আবেগ সেই মায়ের বেদনাকে নিজের করে দেখাতেই শেষ স্তবকে বলেন-

মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে।

অথচ, তার মুখের দিকে তাকিয়ে কখনােই মনে হয়নি

জীবনে একটাও প্রজাপতি তার খোঁপায় বসেছে।

এ বেদনা জমাট বাঁধে। বহুদিন ধরে মাকে দেখার পরই কেবল এভাবে বলা যায়। সম্পর্কের বীজ শুধু মানুষ থেকে মানুষেই থাকে, তা নয়। প্রকৃতির সঙ্গে তার যােগসাজশে প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। মায়ের সম্পর্ক যেখানে গােলাপ বা চন্দ্রমল্লিকার মতাে ফুলের সঙ্গেই ভালাে হবার কথা সেখানে ঘাসফুলের সঙ্গে হয়েছে। কারণ মা জানান, জীবনের যত কফ… থুতু আর হারাবার বেদনা এমনকি প্রসববেদনাও ঘাসফুলের কাছে জমা করেছেন। কবিরও সেই থেকে নীল ঘাসফুলই প্রিয় হয়েছে। তার কোনো বাজারমূল্য থাক বা না থাক, সেই ফুলই মাকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্মৃতির উপাদান বা সংবেদনায় অন্য উপাদানে মাকে খোঁজা নতুন বিছু নয়, অথচ আপন মাহমুদ যেভাবে ওই পরিবেশকে জীবন্ত করেন, সেটাই নতুন। মায়ের সঙ্গহীন পৃথিবীতে কবি নিঃসঙ্গ। তার চাপে কখনাে নিজেকেই দোষারােপ করেন। তাঁর মনে হয়- মা, তােমার বেজার মুখের প্রতিবেশী আমি এক চুপচাপ বালক। এই বালক প্রসববেদনার সময় থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিল তারপর তার কোনাে বিশ্রাম জোটেনি। বন্ধুর মতাে ছায়া বা বটের ছায়াও পায়নি। গৌণসত্তার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে তিনি বিচার করেন নৈঃসঙ্গ। এভাবে চলতে চলতে হয়তাে আড়ষ্ট হয়ে যাবেন নিজেও। তাই জিজ্ঞাসা- আড়ষ্টতার হাত ধরে কতদূর যাবে মায়ের বােবা ছেলেগুলাে। কিন্তু আশাও হারাননি।

অতঃপর দাঁড়াতে চান এবং বিশ্বাস করেন- ‘দাঁড়াতে জানলে সকল দূরই একদিন নিকটে চলে আসে। পারস্পারিক সম্পর্কের এমন ভেদ-অভেদ করে কবি জানান দেন তাঁর কাব্যের শক্তি। এ শক্তিকে জানা যাবে তাঁর গল্প বলার গতিময়তা দেখে।

মন্তব্য: