আপন মাহমুদের কবিতার বিষয়াশয়

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

কাব্য মােস্তফা

কবিতার শরীরে ভিন্নাদর্শ নিয়ে হাজির হওয়া এক কবির নাম আপন মাহমুদ। চলমান কালপর্বের কবিতাধারার এক শক্তিমান কবি। প্রকৃতপক্ষে তার সময়কার কবিদের থেকে কবিতার প্রকাশভঙ্গি ও নান্দনিক বিষয়বৈচিত্রের কারণে তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অল্লায়ুপ্রাপ্ত

কবিদের মধ্যে তারও ছিল দ্যুতিময় কবিতার ভাষাপ্রকরণ। খুব কম সময়ের মধ্যে নিজ ঘরানা তৈরি করতে পারার কারণে অনেকেই তাকে শূন্যের অন্যতম বা সবচেয়ে শক্তিমান কবি মনে করেন। তার প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ- ‘সকালের দাঁড়িকমা। মানবির অনুভব-প্রেম, দুঃখ, জিজ্ঞাসা , ভাবাবেগ ও দর্শনকেন্দ্রিকতা মিশে আছে তার কবিতায়।।

কবিতার অনেক লাইন সুঁয়ে যায় বারবার ভাললাগার সীমানা। প্রতিটি কবিতা একবার পড়ে কখনাে বিমুখ হতে পারবে না কবিতার পাঠক। যতবার পড়া যায় ততবারই মুদ্ধতা রেখে যায়। এমনিতেই কবিতার ভিতর একধরণের সংবেদন থাকে যা কবিতা পড়ার সময় পাঠক বা অন্য কবিকে আবেশাতক্রান্ত্র করে রাখে। সমকালীন কবিদের মধ্যে এত অল্প কবিতা লিখে পাঠক ও সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের কাছে আপন মাহমুদ আরাে বেশি আপন হয়ে ওঠেন শুধুমাত্র কবিতার জাদুতে। তার কবিতার জাদু এত সহজে ছুঁয়ে যায়, যে কবিতার সাথে মেলবন্ধন করে উঠতে পারে না তার মুখেও ভাললাগার অনুভূতি লেগে থাকে।

আপন মাহমুদ যে সমকালের অন্যতম কবি তার প্রমাণ ‘সকালের দাঁড়িকমার প্রতিটি কবিতায় পাওয়া যায়। কোন কবিই সমকালীন বিষয়বস্তু ও ঘটনাপ্রবাহকে উপেক্ষা করতে পারেন না, তেমনি মুছতেও পারেন না কোন ঐতিহাসিক ঘটনা অথবা ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা কিন্তু ঘটনাকে কবিতার ফ্রেমেবন্ধি করে রাখতে পারেন। কোন্ কবিতা কালােত্তীর্ণ হবে তা বলা কঠিন। যে কবিতা পাঠকের মনে অনুরণন তােলে, দাগ কাটে সেটাকেই আপাতত ভাল কবিতা বলা যায়। আপন মাহমুদ কবিতা ইতিবাচকভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। একজন সফল কবির কবিতা পাঠমাত্রই অনুরণিত, সঞ্চারিত হয়ে ওঠে পাঠকচিত্ত। সে বিবেচনায় আপনকে আমরা সফল ও সার্থক কবি বলেতেই পারি। আর একজন সফল কবি মুষ্টিমেয় পাঠকের কাছে হলেও পৌছাতে পারে, তাদের কাছে বেঁচে থাকে ভাললাগায়, ভালবাসায়।

আপন মাহমুদের কবিতায় যে নান্দনিকতা ফুটে উঠেছে তা আমাদের মুগ্ধ করে, পুলকিত করে। কবিতার নিজস্ব ঘরানা তৈরির ক্ষেত্রে কবির স্বকীয় উপস্থাপনা ও বাচনিক প্রত্যয় যে কোন কবিতাপ্রেমী পাঠকের চোখে পড়ার মতাে। যেমন –

তােমাকেই জানাতে চেয়েছিলাম কেন ঘুম হয়নি সুদীর্ঘকাল – শােনাতে/ চেয়েছিলাম মেঘ, বৃষ্টি ও নারী নূপুর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গান – অথচ/ শীতকাল এসে কবিতার দিকে তাকিয়ে বললাে ‘কুয়াশাই জয়ী!/ তােমাকে ডাকতে চেয়েছিলাম পেছন থেকে, অথচ বিলবাের্ড/ এসে সামনে দাড়াল।

এই উল্লেখিত কবিতাংশে কবি ব্যাক্তিক চাওয়া-পাওয়া ও ব্যর্থ মুহূর্তগুলাে সুচারুরূপে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছেন। কতটা সুখের বদলে দুঃখ-কষ্ট কুড়িয়ে কবি হয়ে উঠেছেন, তার কবিতায় উঠে এসেছে ভিন্নভাবে –

সম্পর্কের খাতা খুলে দেখি – পৃষ্ঠার ওপর দিয়ে ধেয়ে গেছে ঝড়, হেঁটে গেছে জল,/ ঝড়ের সঙ্গে জলের কগড়াঝাঁটি হয়ে গেছে খুব/ কিছুই পড়া যাচ্ছে না/তবু, সম্পর্কের নতুন খাতা খােলার অভিপ্রায়/ আমাকে দৃশ্য জমাতে বলে – হাসি জমাতে বলে, / শব্দ জমাতে বলে/ এই সবদৃশ্য, হাসি ও শব্দের ধাধার ভেতর কত গান একা একা বাজে!

এভাবেই তার কবিতা উতরে গেছে উৎকর্ষের সােপান। প্রায় প্রতিটি কবিতা পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। তিনি শুধু নাগরিক চেতনার কিবা নিসর্গের কবি নন, পুরােপুরি নিসর্গ যাপনের কবি। তাই বার বার ছুটে গেছেন গ্রামে, শৈশবকালে, বাল্যস্মৃতি থেকে কুয়াশায়, শুকিয়ে যাওয়া নদীর কাছে যাকে তার কাছে মনে হয়েছে হাতের মুঠোয় ঘুমিয়ে থাকা স্বদেশ। এখনকার মানুষ কতটা বিচ্ছিন্নবােধে আক্রান্ত, নগর জর্জতা ও ব্যাক্তিক দ্বিধাদ্বন্দের টুকরাে টুকরাে অনুষঙ্গ কবিতার নান্দনিকায় উঠে এসেছে। যেমন –

রাষ্ট্রপতির হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া পায়রাটা/ দেখে- আমার বােধের ভেতরও একঝঁক পায়রা/ উড়ে গেল…/ রাষ্ট্রপতি পায়রা বিক্রেতার ঠিকানা জানেন,/ অথচ, পায়রা কেন উড়তে ভালবাসে- এমন প্রশ্নের/ জবাবে উপস্থিত সকলেই বিব্রিত বােধ করলেন!/ এ সব রাষ্ট্রপতির হাত ফসকে পৃথিবী কবে বের হবে?

এমন সুলিখিত কবিতার মধ্যদিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন সুন্দর পৃথিবীর। কবির সাথে বাক্তিগতভাবে আমার তেমন কোন যােগসূত্র গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তার কবিতার সাথে

মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে পাঠক হিসেবে। ব্যক্তিক যােগ না থাকলেও এটুকু বুঝতে পারি যে তার সময়ের সতীর্থদের থেকে তিনি বেশ আলাদা আর একাকী -নিঃসঙ্গ, বিষণ্নতায় বিভাের হয়ে থাকতেন।

“সকালের দাঁড়িকমা পড়লে বােঝা যায় কবির কাছে জীবন কিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল। তার কবিতার এক বলিষ্ট ও শক্তিশালী প্রতীক বা অনুষঙ্গ মা। তার মা। আবহমান বাঙালি মায়ের স্বরূপ। মাকে নানাভাবে নানাভাষায় প্রকাশের চেষ্টা তার কবিতায় দেখা যায় যা অন্য কবি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রা যােগ করেছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শৈশবের স্মৃতিতে বারবার মাকেই সবার মতাে কবিও শুধু দেখেননি তুলে এনেছেন কবিতায়। যা পাঠকের পাঠের সময় নিজের মায়ের কথা তীব্রভাবে মনে করিয়ে দেয়। এই বইয়ের কবিতা পড়লে মন আটকে যায় কবিতার ভিতর। যেমন- ‘নদী হত্যা করে কারা যেন রেলগাড়ি ছেড়ে দিয়েছে পৃথিবীতে।’ জীবনের কিছু কিছু টুকরাে টুকরাে গল্প কিছু স্মৃতি-বিস্মৃতি, স্বপ্ন-বিষন্নতা ও দার্শনিকবােধ উঠে এসেছে আপনের কবিতায়। আরও আমরা দেখতে পাই

রাজমিস্ত্রি বাবার কথা, পেটের পীড়ায় আত্মহননকারী দাদীর কথা, নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের হাহাকার জড়ানাের কষ্টের কথা।

আপন মাহমুদ সমকালীন অন্যসব কবি থেকে স্বতন্ত্র। সচেতনভাবে তিনি তার কবিতাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে চেয়েছেন ও পেরেছেন। অন্যদের পথে হাঁটতে চাননি তিনি, নিজের অবস্থান তৈরি করার জন্য বেছে নিয়েছেন ভিন্নপথ। তিনি প্রকাশ করেছেন –

উল্টো পথেই হাঁটি, শুনেছি এ পথেই পাওয়া যায় ডােডােপাখির/ বরফাচ্ছন্ন ডানা, আদিমতম গুহার ওম, আর ব্যক্তিগত/ আকাশের খোড়াখুড়ি…’। 

সব কবিই স্বপ্ন ধারক, হেঁটে বেড়ান অজানাকে জানা-বােঝার জন্য। অনেকের অনেক স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন থেকে যায় কিন্তু কবির স্বপ্ন কবিতা হয়ে ওঠে। সে আপন মনে লিখে যায় কবিতার ভিতর তার স্বপ্নকথা। আপনও লিখে গেছেন-

স্বপ্ন থেকে মাইল খানেক দূরে আমাদের ঘুড়ি উড়েছিলাে – ঘুড়িতে/ আঁকা ছিলাে চোখ – চোখে বােকা চাউনি – শেষবার নারী/ থেকে বেড়িয়ে আসার পথে মায়ের সঙ্গে দেখা – মা তখনাে বাবা ও তার সম্পর্কের দূরত্ব মাপছিলেন – মাপছিলেন/ সংসার নিয়ে দেখা তার প্রথম ও শেষ স্বপ্নের পরিধি -।

কবি পাওয়া না পাওয়ার বেদনা নিয়ে নীরবে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এই শূন্যতা পূরণ হবার নয়। তবে আপন মাহমুদ কবিতায় বেঁচে থাকবেন দীর্ঘকাল…

মন্তব্য: