বাতাসে লাশের গন্ধ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মাহমুদ কামাল

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ যখন উপযুক্ত শিরোনামের কবিতাটি রচনা করে তখন ওর বয়স মাত্র একুশ বছর। তরুণ রুদ্র’র এই কবিতাটি সেই সময়ে বিপুল আলােড়ন তুলেছিল। জন্ম হচ্ছিল নানা ঘটনার। আগে আমরা কবিতাটি আবার পাঠ করি। পাঠপরবর্তী আমরা জানবাে ঘটনার সেই অংকুরােদগমঃ

আজো আমি বাতাসে লাশের গদ্ধ পাই

আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্নৃত্য দেখি,

ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে

এ-দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে

মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।

এই রক্তমাখা মাটির ললাট ভুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলাে।

জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধার,

আজ তারা আলােহীন খাঁচা ভালােবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,

স্বাধীনতা- একি তবে নষ্ট জন্ম ?

একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরােনাে শকুন।

বাতাসে লাশের গন্ধ-

নিয়ন আলােয় তবু নতকীর দেহে দোলে মাংশের তুফান।

মাটিতে রক্তের দাগ-

চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ-চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার খুম আসেনা-

তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিতকার,

নদীতে পানার মতাে ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ

মুণ্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর

ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে- আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি ঘুমুতে পারিনা..

রক্তের কাফনে মােড়া- কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে

সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা

স্বাধীনতা, সে- আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-

স্বাধীনতা সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বােনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

তখন সামরিক শাসন। সঙ্গত কারণে কবিতাটি সরকারের গাত্রদাহর বিষয় হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের অরণি গােষ্ঠীর আয়ােজনে টাঙ্গাইলে দু’দিন ব্যাপি সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে রুদ্র কবিতাটি পাঠ করেছিল। কবিতাটির খবর আমরা

আগেই জানতাম। সময় অনুকূলে নয় বলে আমরা কবিতটি তাকে পাঠ না করার পরামর্শ দিই। দু’দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, কবি শামসুর রাহমান, আব্দুস সাত্তার, শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী, মাহমুদুল হক, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবু কায়সার, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রাজীব আহসান চৌধুরী, বুলবুল খান মাহবুব, অরুণাভ সরকার, সানাউল হক খান, হুমায়ন আজাদ, মাহবুব সাদিক, শিহাব সরকার, জাহাঙ্গীর ফিরােজ, মাহবুব হাসান, ফারুক মাহমুদ, হাসান হাফিজ, কামাল চৌধুরী, আতাহার খান, জাফর ওয়াজেদ, আলমগীর রেজা চৌধুরী, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, গােলাম সাবদার সিদ্দিকীসহ শতাধিক কবি ও লেখক। রুদ্র আমাদের ঘনিষ্ট বন্ধু। কামাল চৌধুরী নাকি জাফর ওয়াজেদ ঠিক মনে করতে পারছি না। তাদের দু’জনের একজন কবিতাটি পড়ার প্রেরণা দিয়েছিলাে অন্যজন করেছিলাে নিষেধ। আয়ােজক হিসেবে আমরা বিড়ম্বনায় পড়বাে ভেবে কবিতাটি রুদ্র না পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অনুষ্ঠানে যথারীতি সে কবিতাটি পাঠ করে আলােড়ন তুলে ফেলে। ওর চেহারা, কণ্ঠস্বর, পড়ার ভঙ্গি সর্বোপরি কবিতার বিষয়বস্তুর চুম্বক আকর্ষণে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা আলােড়িত হয়েছিলেন। পাশাপাশি সরকারের গােয়েন্দারা নড়াচড়া শুরু করে দেয়। রুদ্র কিন্তু নির্বিকার। তখন টাঙ্গাইলে থাকার জন্য ভালাে মানের হােটেল ছিল না। আপ্যায়ন

নামের গেস্ট হাউসটি সবেধন নীলমনি। সেখানে ও এবং ওর বন্ধুরা রাত যাপন করছিল। এদিকে সম্ভাব্য হেনস্তায় আমরা যখন চিন্তিত তখন জানতে পারি রুদ্র রয়েছে বেসামাল অবস্থায়। শরীরের প্রতি ওই অত্যাচার ওর আমৃত্যু ছিল। তবে, সেদিন নানা ধরণের প্রক্রিয়ার কারণে রুদ্রকে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হয়নি। কিন্তু গভীর রাতে তাকে আমরা ‘সাবাস বন্ধু’ বলতে ভুলিনি। কবিতাটি ওর প্রথম কাব্য ‘উপদ্রুত উপকূল’ গ্রন্থে ছাপা

হয়েছিল। বইটি বুক সােসাইটি থেকে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বের হয়েছিল। প্রকাশক হিশেবে নাম ছিল আরেক প্রতিবাদী লেখক আহমদ ছফার। গ্রন্থটির উৎসর্গপত্রটি

ছিল:

থামাও থামাও এই মর্মঘাতি করুণ বিনাশ

এই ঘাের অপচয় রােধ করাে হত্যার প্লাবন

     শিরাজ শিকদার

শেখ মুজিবর রহমান

     আবু তাহের

উপর্যুক্ত তিনজনের মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক কিন্তু তাতে রয়েছে চমৎকার পারম্পর্য। সে পারম্পর্যের বিশ্লেষণে না গিয়ে শুধু এটুকু বলতে পারি উৎসর্গপত্রটি ছিল সাহসিকতাপূর্ণ এক ব্যাতিক্রমি। এবার কবিতাটি সম্পর্কে দু’চার কথা: কবিতাটির ভাষা খুবই ঝরঝরে, বােধগম্যতার বিপরীতে কোনও আড়াল নেই। সমসাময়িক বিষয়বস্তু কবিতাটিকে গতিময় করেছে। কবিতাটি মাত্র একুশ বছর বয়সে লেখা। স্বদেশচেতনা অর্থ্যাৎ দেশাত্মবােধের উদ্দীপনা থেকেই প্রতিবাদ হিসেবে রুদ্র কবিতাটি লিখেছে। এ প্রসঙ্গে সুকান্তের নাম মনে উঁকি দিলেও আঙ্গিকগত দিক থেকে কবিতাটি একেবারেই ভিন্ন। তবে সামনে এসে যায় তুষার রায় (১৯৩৪-১৯৭৭) এর নাম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ষাট দশকের এই কবি মাত্র ৪৩ বৎসর জীবনের কাব্য পরিমন্ডলে প্রতিবাদী চেতনাকেই প্রকাশ করেছেন। রুদ্রর জীবনও মাত্র ৩৫ বছরের। শুধু ‘বাতাসে লাশের গন্ধই নয়, উপদ্রুত উপকূল’ কাব্যের প্রায় প্রতিটি কবিতাই সমাজ-বাস্তবতানির্ভর। আলােচ্য কবিতায় রুদ্র খুব সচেতনভাবেই, জাতীয় নয়- ‘জাতির’ শব্দটি প্রয়ােগ করেছে। জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরােনাে শকুন পংক্তি নিকট অতীতের ভীতিকর ছবিটিই ভেসে ওঠে। বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহাসিক রূপটিকে স্পষ্ট করার জন্যই জাতি শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবির কাব্যকুশলতার পরিচয় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

রুদ্র বাতাসে লাশের গন্ধ কবিতাটি লিখেছে ৩৭ বছর আগে। রুদ্র নেই কিন্তু ধারাবাহিক এই সময়ে অসংখ্য লাশের তীব্র গন্ধ আমাদের জনজীবনকে বিপ্নিত করে তুলছে।

মন্তব্য: