রুদ্রের কবিতায় প্রবাহিত বাংলাদেশের মানচিত্রের গভীর থেকে উঠে আসা প্রাণস্পর্শী গ্রাম

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

পাবলাে শাহি

সত্তরের দশকের কবিতায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১) স্বাতন্ত্র্যচিহিনিত কবি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বেড়ে ওঠা কিশাের রুদ্র স্বাধীনতা উত্তর কালে সত্তর দশকে কবিতায় নিয়ে আসলেন রাজনৈতিক চিন্তা, আবেগের উদ্দামতা এবং উদার জীবনাবেগ। ফলে, পাঠকমহলে গ্রহণযােগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা। রাজনৈতিক মুখপত্রের মতাে তাঁর কবিতা একাত্তর-উত্তর বাংলাদেশের সমাজ জীবনের অসঙ্গতি, হতাশা, অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছে। তাঁর কবিতার গুণ বা ক্রটি একই অর্থে চিহ্নিত আর তা হচ্ছে আধুনিকদের মতাে সর্বসংস্কারমুক্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দ্বারা শাণিত, শ্লোগানকে কবিতার

ভাষায় গ্রহণ- যার ফলে অনেকটা, কবিতার শাশ্বত নন্দনত্ত্ব হয়তাে হারিয়ে গেলাে তাঁর কবিতা থেকে, কিন্তু সমসাময়িক বাংলাদেশ উঠে এসেছে জান্তব সময়ের পিঠে সওয়ার হয়ে। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে- যখন বাংলদেশের সমাজ মানসকে সেনাতন্ত্রের শাসনে

আতঙ্কশিহরিত, সেনাতন্ত্রের আগ্রাসী ও রক্তলােলুপ রাজনৈতিক চেহারা বাংলার সমাজ মানসকে করে তুলেছে হতাশা- যন্ত্রণায় সর্বগ্রাসী। সেই জাতীয় পরিস্থিতিতে কবিতা অঙ্গনে রুদ্রের আবির্ভাব। ফলে আবেগ, মানবতাবাদী ও প্রগতিবাদী রাজনীতি রুদ্রের কবিমনকে তাড়িত করেছিল। রুদ্রের কবিতা তাই অতিমাত্রায় রাজনীতিমনস্ক। কার্যত ষাটের, সত্তরের ও

আশির দশক জাতীয় জীবনে রাজনীতি চর্চা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

সুতরাং কবিতার যে গভীরতর সামাজিক ভূমিকা রয়েছে, এবং যে উদ্দেশ্যে তার এই ভূমিকা পালন, যেহেতু কবিতা হচ্ছে শব্দ-সমাবেশ, বা শব্দই কবিতা, শব্দাবলী সেই ভূমিকা পালনের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। …বন্ধ্যা ব্যভিচারী শব্দের অসামাজিক অথবা স্বেচ্ছাখেয়ালী আচরণ নিন্দিত হলেও কবিতা চিত্তের গভীরে অনুভূত পরিলক্ষিত ও আবিষ্কৃত সাদৃশ্য, উপমা-কল্পনা, দূরান্বয় ও প্রসঙ্গের সেতু পার হয়ে আভিধানিক ভাব-অর্থ অতিক্রান্ত সামাজিক অস্তিত্বঘনিষ্ঠ নতুন অর্থ-ভাবব্ঞ্জনায় উত্তরণের অধিকার কবিতার শব্দাবলীর আছে।১

অনিবার্যভাবে রুদ্রের কবিতার শব্দাবলী সামাজিক অস্তিত্বঘনিষ্ঠ বিষয় নিয়েই নির্ভীক আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যার পরিণতিতে এক শ্রেণীর পাঠকের কাছে তার লােকপ্রিয়তা লক্ষ করা যায়। সেদিক থেকে রুদ্র বাংলাদেশের প্রগতিবাদী কবিদের সহােদর। তাঁর লেখা- মুক্তিযুদ্ধে চেতনা, ধর্মনিরেপেক্ষ অসামপ্রদায়িকতা, প্রতিবাদ ও দ্রোহ- এই সব বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত।

ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাদের যাত্রার শুরু।

এক একটি জন্মের সমান মেধাবী মৃত্যু

এক একটি প্রতিজ্ঞা-পুষ্ট মৃত্যুর সােপান

দুর্যোগ-অন্ধকারে তুলে রাখে সূর্যময় হাত-

মৃত্যুর মঞ্চ থেকে

মৃত্যুর ভূমি থেকে

আমাদের প্রথম উত্থান। (“ফাসির মঞ্চ থেকে’, রচনা সমগ্র)

নির্ভীক ফাঁসির মঞ্চ থেকে কবিতার যে অভিযাত্রা, সূর্যময় হাতে সেই নির্ভীকতা পৌঁছে দেয় আমাদের সঠিক সংগ্রাম। ফলে, কবির শব্দগুলি হাত তুলে দাঁড়ায়, আত্মদ্রোহের জগত থেকে মুক্ত হয়ে সে দ্রোহ সমাজজীবনকে বেগবান করে।

মিছিলে তােমার দৃপ্ত পদক্ষেপ,

উন্নত হাতে জীবনের দাবি মাখা।

মিছিলেই তুমি নারী হয়ে ওঠো বেশি,

যেমন শিশু ও শস্যের উৎসবে।

(“মিছিল ও নারীর গল্প’, রচনা সমগ্র)

অধিকার আদায়ের দীপ্ত শপথ রচিত হয় লাখ মানুষে। মিছিলে, রাজপথে প্রকম্পিত হয় স্বৈরাচার-শােষক। জীবনের দাবিমাখা লক্ষ হাতের নির্দেশনা শিশু ও শস্য জন্মাবার উৎসের মতাে।

যে-ভাবে তােমার চোখে মিশে থাকে বেদনার লাভা

বিক্ষোরণ বুকে নিয়ে আমিও তেমনি আছি।

আমার নিকটে রাখাে, বুকে রাখাে শীতার্ত স্বদেশ-

প্রয়ােজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনাে।

(“নিরাপদ দেশলাই'”, রচনা সমগ্র)

স্বদেশের বিস্ফোরণ উন্মুখ মানুষের লাভা বুকে নিয়ে শিল্প বানান কবি, এবং প্রয়ােজনে এই লাভা জ্বলে উঠবে অগ্নিগিরির মতাে- কেননা কবির স্বপ্নের স্বদেশ আলহীন এক খণ্ড মানবজমিনের ঠিকানা হয়তাে এভাবে রচিত হবে।

কবে পাবাে? কবে পাবাে আলহীন এক খণ্ড মানব-জমিন?

পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি।

মহুয়ার মদ খেয়ে মন্ত হয়ে থাকা সেই পার্বণের তিথি

কবে পাবাে? কবে পাবাে শর্তহীন আবাদের নির্বিরােধ দিন।

   (“মানুষের মানচিত-১’, রচনা সমগ্র)

এই প্রবণতা রুদ্রের কবিতার প্রধানত বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত। কিন্তু একজন কবির ভেতরেই থাকে ভাব-অর্থের অতিক্রান্ত অপর ভাবব্যঞ্জনার শিল্প ব্যাকরণ, আর তা রুদ্রের প্রেমচেতনার দরােজা দিয়ে বেরিয়ে আসে। রুদ্রের কবিতাতেও তাঁর বহিঃপ্রকাশ সুতীব্র।

মানব-অস্তিত্বের বহুমুখী টানাপােড়েন, ব্যক্তিমুখীনতা, সংবেদ, সংরাগ, আততি যে তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত, তা বলা যাবে না। ব্যক্তিমত্তার সর্বৈব বিকাশ যে-কোন সংবেদনশীল মানুষের মতাে প্রেমও তাঁর আরাধ্য। কিন্তু আত্মপ্রেমের স্বার্থপর ভূখণ্ড থেকে রুদ্রের কবিমন বারবার হয়েছে সজ্মজীবনমুখী- ব্যক্তির পরিবর্তে সমষ্টিই উঠেছে তাঁর পরম আশ্রয়স্থল।২

এই সত্যের পাশাপাশি হৃদয় উত্থিত আবেগ তাঁর কবিতায় দুরলক্ষ নয়। যেখানে শরীর মাংস আছে, আছে ফুলের প্রতি আগ্রহ ও প্রত্যাখ্যান- তাঁর নারী লিবিডােচেতনা থেকে সরে এসে মাটি খুঁড়ে শস্য তুলে আনে।

অতােটা হৃদয় প্রয়ােজন নেই,

কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই।

এতােটা গ্রহণ এতাে প্রশংসা প্রয়ােজন নেই,

           কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখ্যান।…

অতােটা ফুলের প্রয়ােজন নেই

ভাষাহীন মুখ নিরীহ জীবন

প্রয়ােজন নেই- প্রয়ােজন নেই

কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত

রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই

          চাই কিছু লাল তীব্র আগুন।

(‘অবেলায় শঙ্খধ্বনি, রচনা সমগ্র)

যেখানে অনাহারে ভােগা মানুষের ঘৃণা ও ব্যথার অনুরণন ধরে রাখে অধর, সেখানে প্রেমের নীলিমাবিলাস তাৎপর্যহীন, সেখানে বুকভরে জ্বলতে থাকে তুসের আগুন বিষ, দহন ও দ্বিধা ভরা সে আগুন। তাই, রুদ্রের কবিতা প্রেমচেতনার বেদনা বিলাস থেকে মুক্ত হয়ে ওঠে তাৎপর্যময় অস্তিত্বময় রাজনীতির দীক্ষায়, ক্ষুধা ও খরার এই অবেলা তাঁকে ফুলের সৌন্দর্যের আনন্দে আত্মাহুতি দিতে বাধা দেয় বরং তিনি সাহসের প্ররেচনায় পথ চলেন।

সাহস আমাকে প্রেরণা দেয়

জীবন কিছুটা যাতনা শেখায়

ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায়

           অতােটা ফুলের প্রয়ােজন নেই।

(‘অবেলায় শঙ্খধ্বনি, রচনা সমগ্র)

রুদ্রের বক্ষে তাই জমা হয় গ্লানি যেমন, তেমনি অনেক কথা, অনেক গান, অনেক হাসি। আর বেদনার পায়ে চুমু দিয়ে কবি বুঝতে পারেন যারা আকাশ ছাড়া নীলিমা প্রার্থনা করে তারা কত ভুঁইফোড়, তারা পড়ে থাকে বিশ্বাসের অন্ধকারে।

কতাে গ্লানিতে এতাে কথানিয়ে, এতাে গান, এতাে হাসি নিয়ে বুকে

              নিশ্চুপ হয়ে থাকি

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতাে জীবন,

(“অভিমানের খেয়া’, রচনা সমগ্র)

স্বাধীনতা উত্তর নৈরাজ্য, দুঃশাসন, বেদনা ও ক্ষুৎপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আহাজারি আমাদের স্বপ্নকে চূর্ণ করে দেয়। অনিবার্যভাবেই দেশে ঘটে সেনা অভ্যুত্থান। সঙ্গত কারণেই রুদ্রের কবিতার মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে দ্রোহ- তাই তার প্রশ্ন, আত্মজিজ্ঞাসা-

দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করাে

কোন পক্ষে যাবে।

(‘সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি, ছােবল)

রুদ্র স্বভাবগতভাবেই মুক্তিকামী মানুষের দলে। তাই তাঁর বর্ণাঢ্য স্পর্থা কবিতায় প্রকাশিত হয়। ভীরুতা ও অসহায়তা নয়- সংগ্রমের স্পর্ধাই তাঁর হাতিয়ার। এই অনিবার্য উপলব্ধি তথাকথিত ভীরু ভাববিশ্বকে ব্যঙ্গ করে তিনি ঘােষণা দেন-

শ্লোগানে কাঁপুক বিশ্ব, চলাে, আমরা এগিয়ে যাই

প্রথমে পােড়াই চলাে অন্তর্গত ভীরুতার পাপ,

বাড়তি মেদের মতাে বিশ্বাসের দ্বিধা ও জড়তা

সহস্র বর্ষের গ্লানি, পরাধীন স্নায়ুতন্ত্রীগুলাে

যুক্তির আঘাতে চলাে মুক্ত করি চেতনার জট।

(“মিছিল’, রচনা সমগ্র)

এই ভাববিশ্বের ভীরুতা, দ্বিধা, জড়তা সহসাই ভাঙতে পারেন কেননা তাকে যন্ত্রণা দেয় তিতুমীর, সিপাহীবিপ্লব। তাঁর এই দ্রোহ চেতনাকে উজ্জ্বল করেছে ঐতিহ্য প্রীতি।

প্রৌঢ় পৃথিবীর নগ্ন খুলিতে পা রেখে এক অঘ্রাণী যুবক,

করতলে মাটি ছুঁয়ে রক্তে মাংসে পেতে চাই শাণিত আগুন,

বন্ধ্যা অদ্ধকার তবু মৃত মানুষের মতাে বয়ে আনে শীত

       বয়ে আনে কবরের হলুদ কাফনে বাধা একরাশ স্মৃতি।

পাণ্ডুর রমণী দেহ- কালাে কৃষকের বুকে

শস্যের সম্পাত নিয়ে একফালি মুগ্ধ চাঁদ

কাস্তের চিৎকারে দুলে তুলে দেবে নাকি কিছু ফেলে আসা শ্রম,

             শ্রমের ক্ষমতা।…

মানুষ জানে না তবু কতাে হাড় কারােটির ধুলাে জ’মে জ’মে

একটি নক্ষত্রের বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে সেই রাতে।

(‘নক্ষত্রের খুলাে”, রচনা সমগ্র)

আধুনিক কবিতার লক্ষ্য তাকে হতে হবে সত্য থেকে জাত অভিজ্ঞতার চিত্রকল্প। আধুনিক কবিতা অনেক বেশি সমাজ-রাজনীতি সচেতন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার নন্দনবীক্ষা নিয়ে তাঁর সময়কে যেভাবে দেখেছেন, ঠিক সেভাবেই নিরাভরণ বােধকে পৌছে দেন পাঠকমেধায়। এটা তাঁর প্রথম ধারার কবিতা। আর দ্বিতীয় ধারায় রয়েছে একই কালে দূর-ঐতিহ্যের প্রতি দুর্বলতা এবং শব্দ-শিল্পের প্রতি তৃষ্ণা- যা তাকে খুব সহজেই বিশিষ্ট করে তােলে। অভিজ্ঞতা, তীক্ষ্ণদৃষ্টি ও ভৌগােলিক-ইতিহাস জ্ঞান শেষ পর্যন্ত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে দিয়েছে পরিণতি, স্থিতধী শক্তি আর শিল্পের স্থায়িত্ব।৩

এ ক্ষেত্রে আল মাহমুদের সােনালি কাবিন-এর স্মৃতি অর্থাৎ কবিতার ভাষার এই প্রয়ােগ, ভাষারীতি অনেকাংশে একরকম হলেও জিজ্ঞাসা বা ব্যাখ্যাটা রুদ্রের আলাদা। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষাকেও ব্যবহারও পরিমিতি বােধ তাঁর কবিতাকে সংযত করেছে।

ভাসান যে দিতে চাও, কোন দেশে যাবা? যাবা সে কোন বন্দরে

আমারে একলা থুয়ে? এইঘর, যৈবনের কে দেবে পাহারা?

এমন কদম ফুল-ফোটা ফুল থুয়ে কেউ পরাবাসে যায়।

তুমি কেন যেতে চাও বুঝি সব, তবু এই পরান মানে না।

লােকে কয় ভিন দেশে মেয়ে মানুষেরা নাকি বেজায় বেহায়া,

শরীরের মন্ত্র দিয়ে আটকায় শাদা-সিধে পুরুষ মানুষ।

তােমারে না হারাই যেন সেই দিব্যি দিয়ে যাও জলের কসম

আর বলি মাস মাস খােরাকি পাঠাতে যেন হয় নাকো দেরি।

(“মানুষের মানচিত্রঃ ৪’, রচনা সমগ্র)

রুদ্রের কবিতার প্রধানতম প্রেরণাগত উৎস আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতিসত্তার শেকড়। আত্মা আর রক্তের সঙ্গে মিশে আছে তাঁর এই বােধশিখা। সত্তর দশকের বাংলা কবিতায় এই ছিল রুদ্রের দাম্ভিক প্রকাশ। তাঁর কবিতার ভাষায় প্রথম প্রকাশ পেল দ্ব্যর্থহীন ভাষা- যেখানে উপস্থাপিত সমকাল, দেশ ও জাতি অন্বেষণের অন্তর্তাগিদ। ফলে, রুদ্রের কবিতায় আবেগ আর সমকাল এত তীব্র ছিল যে, তা কখনাে কখনাে কবিতার ভাষা হারিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষা অর্থাৎ শ্লোগানে রূপান্তরিত করেছে। যেমন ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনাে শকুন’ কিংবা ‘ধর্ষিতা বােনের শাড়ি-ই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা’ এই ধরণের পঙক্তি। এ সত্ত্বেও রুদ্রের কবিতার মহিমা হচ্ছে- তাঁর চোখ ছিল বিশাল বাংলার দিকে যে বাংলা তাঁর অস্তিত্ব আর ঠিকানা। উপদ্রুত উপকুলে যে কবির বাস সেই কবি অস্থির সময় পার করে প্রার্থনা করেন ফিরে চাই স্বর্ণ গ্রামের।

মূলত এই ভাবনাগুলি রুদ্রের রাজনৈতিক সজ্ঞানতার ফসল। তাই তাঁর সংবেদনশীল কবিমানসে নির্মিত হয়েছে এই বিষয়ে অন্তর্দাহ। ফলে, তাঁর ব্যক্তি জীবনে ও কবিতায় এই প্রভাব লক্ষণীয়। তাই সহযাত্রীদের মুখােশ দেখেও, পতন দেখেও তিনি প্রত্যয়ের শপথ নেন, স্বপ্ন দেখেন। নিজেকে দ্ধ করেও তাঁর স্বপ্নের দেশে হাঁটা, স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে চলা। এ ক্ষেত্রে হয়তাে মার্ক্সীয় বীক্ষা তাঁকে ইতিহাস জ্ঞান ও রাজনীতি সচেতন ভাবনা দ্বারা চালিত করেছে। জীবনবিমুখ শিল্পী ও শিল্প তাঁর কাছে ঘৃণার, পরিত্যাজ্য।

তােমাদের শিল্প মানে ইদুরের গর্তে পলায়ন,

তােমাদের শিল্প মানে হিজড়ার অক্ষম রমণ।

তােমাদের শিল্প হলাে প্রতারণা, শব্দের জোচুরি,

তােমাদের শিল্প হলাে অন্ধকারে আঁধার সন্ধান।

(“নুপুংশক কবিদের প্রতি’, রচনা সমগ্র)

তাই মার্ক্সীয় সজ্ঞানতার প্রশ্নে কবি অভিজ্ঞান থেকে কথা বলেন, শুধু রক্ত আমাদের জীবনকে পাল্টে যে দেয় না সে কথা তিনি তা বিশ্বাস করেন। তাই রক্তের সঙ্গে সঙ্গে চাই সুনির্দিষ্ট দর্শন ও বল প্রয়ােগের ক্ষমতা।

শুধু রক্ত দিয়ে আজ পান্টনাে যাবে না জীবন,

শুধু রক্তে আজ আর কৃষ্ণচুড়া ফুটবে না ডালে।

শুধু মৃত্যু দিয়ে আজ আর পাল্টানাে যাবে না আঁধার

শুধু রক্তে আজ আর কৃষ্ণচূড়া ফুটবে না দেশে।

অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই, স্বপ্নবান অস্ত্র চাই হাতে।

(অস্ত্র চাই, রচনা সমগ্র)

প্রবলভাবে দেশ ও মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষণ রুদ্রের কবিতার চাবিকাটি। উপদ্রুত উপকূল, ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম, মানুষের মানচিত্র, ছােবল, দিয়েছিল সফল আকাশ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রুদ্রের সেই দ্রোহ ও সজ্ঞানতার বহিঃপ্রকাশ। রুদ্রের কবিমানসের প্রকৃতি ও জীবনজিজ্ঞাসার বৈশিষ্ট্য জুড়ে আছে স্বদেশ, স্বকাল আর দেশের মানুষের মানচিত্র। ফলে, সঙ্গত কারণেই তাঁর কবিতায় এসেছে সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যাযজ্ঞের বিবরণ।

স্বাধীনতা-উত্তর নৈরাজ্য, প্রতারণা, খাদ্য-সংকট, দুঃশাসন, মানুষের স্বপ্ন ও বাসনা চূর্ণ করে ফেলে। অরক্ষিত স্বাধীনতা ও ক্ষুৎপীড়িত মানুষের রােনাজারি রুদ্রের কবি আত্মাকে মর্মপীড়নে পৌঁছে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটে সেনা অভ্যুত্থান ফলে রুদ্র লেখেন

“দাঁড়াও নিজেকে প্রশ্ন করাে- কোন পক্ষে যাবে” (সমস্ত্রবাহিনীর প্রতি/ছােবল)।৪

রুদ্রের এমন অনেক কবিতা আছে যা পড়লে মনে হয় ভিতরে কোথাও যেন সশন্দে দ্রোহ ফেটে পড়ছে, ক্রোধে কাঁপছে কোনাে মানুষ, গর্জন করছে কোনাে যুবক, অথবা উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরেছে কেউ। মাঝে মাঝে তাঁর কবিতার ভিতরে কান পাতলে কান্না শুনি, শােকের মাতম শুনি। চোখ ভিজে যায়। কিন্তু পরাজিত হতে দেয় না সে, আমাকে নয়, ক্রন্দনরতা অসহায় নিভৃত গ্রামের মেয়েটিকে নয়, নিজেকে তাে নয়ই। আমাদের সময়ে দেশ ও মানুষকে নিয়ে এই ধরনের কবিতা লেখার বিপদ আছে, মানুষ ভাবতে পারে কবি বেসাত করতে নেমেছেন আবেগের, সন্তা দেশপ্রেমের, প্লোগানের। বৈচিত্র্যহীন অন্ধকার জীবন যখন উঠে আসে কবিতায়, পাঠকও ক্লান্ত হতে পারে, জড়িয়ে পড়তে পারেন অবসাদে। এখন অসহায়, দরিদ্র, নিরন্ন মানুষকে নিয়ে কিছু লেখা সেকেলেও হয়ে গেছে, এবং সত্য যে, অনেক কবি আবেগকে শাসন করতে শেখার আগেই ইনিয়ে বিনিয়ে সর্বহারা মানুষ ও শ্রেণি সংগ্রাম বিষয়ে কবিতা লিখে পাতার পর পাতা ভরেছেন। পাঠকের প্রত্যাশাকে ঐ অসংযত আবেগ যে পথে নিয়ে গেছে, তাতে ইচ্ছাপুরণের সহজ উপায় কিছু দাঁড়িয়ে গেছে। শ্লোগানেই যেন মুক্তি, শ্লোগানসর্বস্বতাই যেন বিদ্রোহের ধর্ম।

রুদ্র সচেতন ছিলেন এই বিপদ সম্পর্কে। তাঁর কবিতার মাঝে মধ্যে শ্লোগানের ঐতিহ্য উঁকি দেয়, কখনাে কখনাে দেখি তিনি উচ্চকিত ঘােষণা দেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই…। রুদ্র ….সেকেলে হয়ে যাওয়া বিষয়কে কবিতা-কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন, মানুষকে নিয়ে লিখেছেন এবং মানুষের জন্য লিখেছেন। একই সংগে, একটি নিজস্ব স্টাইল ও তিনি সৃষ্টি করেছেন। যা গভীর ও অন্তরঙ্গ অথচ বহির্মুখী।৫

সামাজিক দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক সচেতনতা সত্তরের দশকের পলায়ন পর অন্য কবিদের থেকে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তাপ রুদ্রের কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কখনাে তা শ্লোগান শাসিত ভাষা, কখনাে তা দ্রোহ আর আক্ষেপের আবার কখনাে তা মা-মাটির প্রতি দায়বদ্ধ অঙ্গীকারের বাণীরূপ পেয়েছে। কালিক দ্রোহ রুদ্রের কবিতার প্রধানতম অনুষঙ্গ-

(এক)   আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই

           আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখি,

              [বাতাসে লাশের গন্ধ’, রু.মু.শ.র)

(দুই)   ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাদের যাত্রা শরু।

         এক একটি জন্মের সমান মেধাবী মৃত্যু

             (‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে, রু.মু.শ.র)

(তিন) করতলে মাটি ছুঁয়ে রক্তে মাংসে পেতে চায়   শাণিত আগুন,…

         -কালাে কৃষকের বুকে

শস্যের সম্পাত নিয়ে একফালি মুদ্ধ চাঁদ

            (‘নক্ষত্রের খুলাে’, রু.মু.শ.র)

রাজনৈতিক চেতনা, ঐহিত্য ও প্রকৃতি প্রেমের আবেগময় প্রকাশ রুদ্রের কবিতা। উচ্চকণ্ঠ হওয়ায় তাঁর কবিতার ভাষা কখনাে আবেগ দ্বারা তাড়িত, কখনাে শ্লোগান দ্বারা ঋদ্ধ। স্বাধীনতা-উত্তর কালে যে সােচ্চার কবি কণ্ঠের জন্ম হয়েছিল রুদ্র তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রেম তাঁর কবিতার অন্যতম প্রসঙ্গ হলেও তিনি রাজনৈতিক সচেতন ধারার কবি হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছেন। রাজনীতি সচেতন শব্দ নির্মাণেই তাঁর স্বতন্ত্র কবিভাষার পরিচয় মেলে। দৃষ্টান্ত-

‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, ‘মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য”, “স্বাধীনতা একি তবে নষ্টজন্ম’, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে পুরনাে শকুন’, ‘জন্মের সমান মেধাবীমৃত্যু’, ‘মৃত্যুরভূমি থেকে আমাদের প্রথম উত্থান’, ‘মানুষের বুকের প্রদেশে’, ‘রক্তে মাংসে পেতে চায় শাণিত আগুন’, ‘বন্ধ্যা অন্ধকার’, ‘কবরের হলুদ কাফনে বাঁধা একরাশ স্মৃতি’, ‘শস্যের সম্পদ নিয়ে একফালি মুগ্ধ চাঁদ’, ক্ষুধার শয্যা পেতে’, ‘মননের হাড় থেকে ছিড়ে খায় বােধি প্রেম’, একটি নক্ষত্রের বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে সেই রাতে’, ‘আছে স্নায়ু জুড়ে আন্দোলিত স্বপ্নের স্বদেশ’ প্রভৃতি বাক্য ও শব্দ রুদ্রের কবি বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে। প্রেম তাঁর কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ হলেও প্রধান অনুষঙ্গ মা-মাটি-মানুষ। সঙ্গত কারণেই উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদের ভাষায় তাঁর কবিতার শব্দালঙ্কার হিসাবে চিহ্নিত।

রুদ্র তাই হয়ে উঠেছেন স্বাধীনতা-উত্তর কালের মানুষের হতাশা, অপ্রাপ্তি, স্বৈরাচারবিরােধী মুভমেন্ট ইত্যাদি প্রত্যয়দীপ্ত ভাষার কবি; সেখানেই তাঁর ভাষাবৈশিষ্ট্য ও অভিনবত্ব চিহ্নিত। রুদ্রের কবিতার মধ্যে প্রবাহিত হয় বাংলাদেশের মানচিত্রের গভীর থেকে উঠে আসা প্রাণস্পর্শী গ্রাম, অসহায় মানুষের নুয়ে পড়া শরীর- যেন এত নগ্ন কান্না, এত আর্তি যেন পুরাে বাংলাদেশের গােঙানি, আমাদের বুক চিরে চিৎকার করে ওঠে। মূলত, রুদ্রের উপস্থাপনার ভাষা বক্তব্য, তীব্র-শ্লোগানমুখী কিন্তু কবিতার সংগীতময়তা রক্ষিত হয়েছে তাঁর ছন্দ প্রয়ােগে, সেখানে তিনি প্রথানুরাগী। ফলে, রুদ্র সােচ্চার প্রতিবাদী, স্বৈরাচার ও শােষণবিরােধী এক দ্রোহী আর তাঁর বুকে কবিতার ভাষায় লেখা আছে দেশাত্মবােধ, গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গান।

তথ্যসূত্র

১. আজীজুল হক, অস্তিত্বচেতনা ও আমাদের কবিতা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ফাল্গুন ১৩৯১ পূ. ১৪

২. রফিকউল্লাহ খান, বাংলাদেশের কবিতা সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর, একুশে পাবলিকেশন লিমিটেড, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০২, পূ. ১৮২

৩. বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতন্ত্ব, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫

৪. তপন বাগচি, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: জীবন দর্শন ও সাহিত্য বৈশিষ্ট্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ১৩১

৫. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, উদ্ধৃত, তপন বাগচি, প্রাগুক্ত, পূ. ১৩২-৩৩

মন্তব্য: