সুকান্তের কবিতা : বিপ্লবী উচ্চারণ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মােহাম্মদ নূরুল হক

বাংলা কবিতার যে ধারাটি সংগ্রাম, প্রতিবাদের পথে বিকশিত- সে ধারার প্রথম সার্থক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিই প্রথম দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাহিত্যিক কলম ধরে বিস্ময়করভাবে সফল হন। তার কবিতায় প্রথম গণমানুষের কণ্ঠস্বর শােনা যায় এবং সে কণ্ঠস্বরে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অস্থির চিত্তের, চঙ্চল; প্রকৃতপক্ষে প্রেমের কবি। তাঁর রাজনীতি-সমাজ সচেতনমূলক কবিতার প্রাচর্য সত্ত্বেও এ কথা সত্য। ফলে তার কবিতা শুধু সংগ্রামের কবিতা হিসেবে আর

থাকেনি; তিনি একই সঙ্গে অন্যান্য ধারার কবিতাও লিখেছেন, যার সংখ্যা সুপ্রচুর। পরবর্তী সময়ে শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবী ধারার কবিতা রচনায় যারা অবতীর্ণ হয়েছেন তাদের মধ্যে সুকান্তের কবিতার প্রকাশরীতিও স্বতন্ত্র। আধুনিক বাংলা কবিতায় বিপ্লবী ধারার কবিতা রচনার ক্ষেত্রে সুকান্তের স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয় এবং উজ্জ্বল। তার আগে আর কারও কবিতা একান্তভাবে শ্রেণীসংগ্রামের নয়; নয় সম্পূর্ণ বিপ্লবী ধারার সুভাষ মুখােপাধ্যায়কে মনে রেখেও একথা দ্বিধাহীন বলা যায়। পূর্ববর্তী কবিদের কবিতার একটি অংশমাত্র সংগ্রামী চেতনাসমৃদ্ধ; সম্পূর্ণ নয়। কিন্তু সুকান্তের কবিতার প্রায় সবটাই শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে।

যে দেশে মানুষ জন্মগ্রহণ করেই জানতে পারে ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি এবং হিসাবের খাতায় “রক্তখরচ ই লেখা সে দেশে ‘পদাঘাত অনিবার্য। সুতরাং শােষক শ্রেণীকে প্রণাম করার দিন শেষ হয়ে আসে স্বাধীনতাকামী কবির কাছে :

তাইতাে চলেছি দিন পঞ্জিকা লিখে

বিদ্রোহ আজ। বিপ্লব চারিদিকে

(অনুভব : সুকান্ত সমগ্র পৃঃ ৩৩)

মানুষ স্পষ্টই দুই শিবিরে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণী শােষিত, যারা সংখ্যায় বেশী। দ্বিতীয় শ্রেণী শােষক, যারা সংখ্যায় কম। এই কমসংখ্যক শােষক শ্রেণীর অত্যাচারে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ শঙ্কিত। পৃথিবীতে সম্পদ সীমিত। আর এই সীমিত সম্পদের সিংহ ভাগই পুঁজিপতিরা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। তাদেরই ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে সম্পদের বণ্টন। শ্রমজীবীদের উদয়াস্ত পরিশ্রমের ফসল ভােগ করে শােষকশ্রেণী। অথচ শ্রমজীবীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবিও উত্থাপন করতে পারেন না। এর কারণ অস্পষ্ট নয়।

শাসক ও শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অবস্থাথান নেওয়া সহজ্য নয়। শাসকশ্রেণীর অন্যায়ের প্রতিবাদ বিপ্লবভিন্ন অসম্ভব। কিন্তু ব্যর্থ বিপ্লবে সাধারণ শ্রমজীবীর পরাজয় অনিবার্য। তাই সাধারণ মানুষ দুঃশাসন এবং শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নেয় না। যতই সাধারণ মানুষ নীরব থাকুক, শােষকরা তাদের ওপর নিরন্তর অত্যাচারের খা গ ঝুলিয়ে রাখে। বিভিন্ন অজুহাতে তার প্রয়ােগও করে। শ্রমিকের শ্রমের ফসল অন্যের গােলায় উঠবে অথচ শ্রমিক থাকবে নিরন্ন, এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়ােজন।

তবু আমরা জানি

চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে

চাপা থাকবে না।

আমাদের দেহে তােমাদের এই পদাগাত।

আর সম্রাট হুমায়ুনের মত

একদিন তােমাদেরও হতে পারে পদস্থলন।

(সিঁড়িঃ সুকান্ত সমগ্র পৃঃ ২৭)

স্বদেশ পরাধীন। সেখানে বিপ্লবী, স্বাধীনতাকামী মানুষের স্থায়ী ঠিকানা অম্বেষণ বৃথা। প্রকৃত দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর ঠিকানা তাে প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী দেশ এবং প্রতিটি বিপ্লবী। প্রাণ তাে একই সূত্রে গাঁথা। তাদের ভিন্ন করে দেখার সুযােগ নেই। স্বদেশ মুক্ত হওয়ার আগে প্রকৃত স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীর ঠিকানা স্থির হয়ই বা কী করে!

পৃথিবী যেখানে অন্যায় অত্যাচারে আকীর্ণ, সেখানে শান্তির বারতা অর্থহীন: সেখানে প্রয়ােজন সংগ্রাম আর গণ অভ্যুত্থান। যুদ্ধ ছাড়া অত্যাচারী শােষক শ্রেণীর পতন সম্ভব নয়। কারণ, শােষক শ্রেণী কখনাে স্বেচ্ছায় শ্রমিকের হাতে শাসনভার সমর্পন করবে না এবং করেও না। তারা চিরকালই নানা অজুহাতে ক্ষমতার শীর্ষে আরােহণ করে থাকে এবং থাকার পথ তৈরি করে। আর তাই বিপ্লবী দেশপ্রেমিকের চোখে লেলিন হয়ে ওঠেন আদর্শ প্রতীক-

লেলিন ভূমিষ্ট রক্তের ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ

বিপ্লবী স্পন্দিত মনে হয় আমিই লেলিন

( লেলিন: সুকান্ত সমগ্র পৃঃ ৩২)

লেলিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় সত্য; তবে তা স্থায়ী হয় না। আবার জেগে ওঠে অত্যাচারী, মজুতদার, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাের লুষ্ঠন, রাহাজানির ফলে ভারতবর্ষে নেমে আসে জ্বরা, মৃত্যু, ক্ষুধা আর সংকটময় সকাল-সন্ধ্যা। দেশে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কৃষকের ফসল মজুতদার মুনাফাখােরদের জিম্মায় চলে গেলে সাধারণ

মানুষের অন্ন জোটে না। ফলে মানুষের মুখের হাসি শুকিয়ে যায়; বিষণ্নতা বাসা বাঁধে খেটে খাওয়া মানুষের মনে। কবি চঞ্চল হয়ে ওঠেন-

ভারতবর্ষের পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ

দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ

রক্তে আনাে লাল

রাত্রীর গভীর বৃন্ত থেকে ছিড়ে আনাে ফুটন্ত সকাল

কারণ

নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ

টলােমলাে এ দুর্দিন, থরােথরাে জীর্ণ বনিয়াদ।

তাইতাে রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি

বিক্ষুদ্ধ টাইফুন- মত্ত চঞ্চল ধরণী;

বিপন্ন পৃথিবীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক…

(বিবৃতি: সুকান্ত সমগ্র পৃষঃ ৩৭)

যে জনজীবনে স্বাধীনতা নেই, নেই ক্ষুধার অন্ন; চিকিৎসা ও সম্পদের সুষম বন্টন; সে জনজীবনে হাসি, প্রেম ভালবাসা অবান্তর। যে জনজীবনে নিরন্নের আত্মচিত্কারে আকাশ চৌচির, পুর্ণিমা চাদ … ঝলসানাে রুটি’র মতােই মনে হয় ক্ষুধার্ত মানুষের, সে জনজীবনে বিনােদন অপ্রত্যাশিত, বেমানান। পৃথিবীর পরিব্রাজকযােদ্ধা সমগ্র প্রতারিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়ােজিত। প্রেয়সীর কথা মনে পড়লেও ঘরে ফেরার সময় হয়ে ওঠে না। তবু একবার কোনও এক ফাকে মনে পড়ে প্রিয় রমণীর কথা। সেখানেও ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামে দৃঢ় প্রত্যয় এবং দীর্ঘশ্বাস।

আমি যেন সেই বাতিওয়ালা

যে সন্ধ্যায় রাজ পথে বাতি জালিয়ে ফেরে

অথচ নিজের ঘরে নেই বাতি জ্বালার সামর্থ্য

নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অদ্ধকার

(প্রিয়তমাসু সুকান্ত সমগ্র পৃ: ৭৩)

শােষক শ্রেণীর হাত থেকে শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের চাবি কেড়ে আনতে হলে সবার আগে রাষ্ট্রের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়ােজন। কারণ স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যতীত স্বাধীনভাবে কোনাে চিন্তার প্রকাশ, বিকাশ এবং বাস্তবায়ন কখনাে সম্ভব নয়। মহাজনদের হাত থেকে খেটে খাওয়া মানুষের সম্পদ ফিরিয়ে আনতে হলে স্বাধীন স্বদেশভূমির ব্যবস্থাটা আগেই করা দরকার। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে সুকান্তের পঙ্ক্তিগুলাে-

বন্ধু তােমার ছাড়াে উদ্বেগ, সুতীক্ষ করাে চিত্ত

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত

মূঢ় শত্রুকে হানাে শ্রোতে রুখে তন্দ্রাকে করাে ছিন্ন

একাগ্র দেশের শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন

(উদ্যোগ : সুকান্ত সমগ্র পৃ: ১০৫)

বাঁচাব দেশ আমার দেশ হানবাে প্রতিপক্ষ

এ জনতার অন্ধচোখে আনবাে দৃঢ় লক্ষ্য

বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী

এদেশে জনবাহিনী তাই নিমিষে হয় তৈরী

(ছুরি : সুকান্ত সমগ্র : ৭৩)

তার অধিকাংশ সফল কবিতা নিরূপিত ছন্দে রচিত; তবে ছন্দের প্রচলিত নিয়মের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে গদ্য ছন্দেও কবি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার অধিকাংশ কবিতা বিপ্লবী ধারার হওয়ার পরও শ্লোগানসর্বস্ব নয়; নয় তাৎক্ষণিক ঘটনাপুঞ্জের সাংবাদিক প্রতিবেদন কিংবা রাজনৈতিক বিবৃতি। শব্দ নির্বাচন ও প্রয়ােগে তার পরিমিতি বােধ তার কণ্ঠস্বরকে দিয়েছে প্রাতিস্বিক চারিত্র্য। উপমা ব্যবহারেও কবি অভিনব। বিশেষত পূর্ণিমা চাঁদকে প্রিয়ার সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা না করে ঝলসানাে রুটির সঙ্গে তুলনা করে কবি ক্ষুধার্ত মানুষের অসহনীয় পর্যায়ের যে চিত্র অংকন করেছেন, তেমন করে আর কেউ দেখাতে সক্ষম হননি। এখানে কবি কাব্যিক সত্য ও বস্তুগত সত্যের যে সমন্বয় সাধন করে দেখিয়েছেন তা আধুনিক কবিতার পাঠক মাত্রই সম্পূর্ণ নতুন উপমার ব্যবহার লক্ষে করে বিস্ময়াভিভূত। পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের অনুভবে ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানাে রুটি’ বাক্যটি প্রবচনের মর্যাদা লাভ করে।

সুকান্তের কবিতা নিবিড়ভাবে পাঠ করে পাঠকের বােধে যে বিষয়টি প্রতিভাত হয় তা হচ্ছে কিছু কবিতা বাদ দিলে সিংহভাগ কবিতাই বিপ্লব, স্বাধীনতা এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের বিষয় সম্পৃক্ত। তার কবিতা পাঠে সে কণ্ঠস্বরটি পাঠকের কানের কাছে ক্রমাগত গর্জন করে ওঠে- তা বিপ্লবের। সেখানে আপস নেই; আছে কেবল সংগ্রাম, অসহযােগিতা আর প্রতিবাদ। প্রকৃত বিপ্লবী কবিতার স্বাদ গ্রহণ করতে হলে সুকান্তের কবিতার কাছে পাঠককে বার-বার ফিরে যেতে হয়; কবিতার পঙ়ক্তিতে পঙক্তিতে বিপ্লবের স্লোগান এবং দীপ্ত ঘােষণার এমন অজর প্রকাশের প্রাচুর্য পাঠকের মনে ক্রমাগত যে অনুরণন তােলে তা দীর্ঘকাল বঞ্চিত মানুষের মুক্তির মন্ত্রে রূপান্তরিত হতে হতে পাঠকের নতুন চিন্তার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। আর এ জন্যই পাঠকের কাছে সুকান্ত ভট্টাচার্য আপাদ-মস্তক একজন বিপ্লবী কবি; অন্য কথায় শ্রেণীসংগ্রামের কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।

মন্তব্য: