আন্তরিক আলাপনে কথাসাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেন

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সাক্ষাৎকার গ্রহণে- ড. তপন রায়

আন্তরিক আলাপনে কথাসাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেন

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে হোসেনউদ্দীন হোসেন নিভৃতচারী ও বিরলপ্রজ কথাসাহিত্যিক। ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার ঝিকরগাছা  উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, মননধর্মী গবেষক ইত্যাদি নানা অভিধায় তাঁকে অভিহিত করা যায়। ষাটের দশক থেকে সাহিত্যসাধনায় ব্রতী থাকলেও তিনি লিখেছেন পাঁচটি উপন্যাস। উপন্যাসগুলো হলো : (১) নষ্ট মানুষ (১৯৭৪), (২) প্লাবন এবং একজন নূহ (১৯৭৯), (৩) সাধুহাটির লোকজন (২০০১), (৪) ইঁদুর ও মানুষেরা (২০০৮), (৫) সোনালীজলের কাঁকড়া (২০১১)। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ বনভূমি ও অন্যান্য গল্প (২০১৩)। তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ শেষ বিদায়ের আগে (২০১৫)। এছাড়া রয়েছে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ’, উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘যশোর জেলার কিংবদন্তী’ ১ম খণ্ড (১৯৭৪), ২য় খণ্ড (১৯৭৯), ‘যশোরাদ্য দেশ’ (১৯৭৪), ‘অমৃত বৈদেশিক’ (১৯৭৫), ‘ভলতেয়ার ফবেয়ার তলস্তয়: ত্রয়ী উপন্যাস ও যুগমানুষ’(১৯৮৮), দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাঙলার বিদ্রোহ’ প্রথম খ- (২০০৩), দ্বিতীয় খণ্ড (২০০৬), ‘ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবিব (১৯৯৪)’, ‘বিশ্ব মানব : ভলতেয়ার (২০১৫) সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২১।

হোসেনউদ্দীন হোসেনের উপন্যাস ‘প্লাবন এবং একজন নূহ’ ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে ‘ফাণ্ড এ্যান্ড এ নূহ’ নামে ব্রিটেনের মিনার্ভা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের জন্য তিনি ২০০৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে পান Top 100 Writers স্বর্ণপদক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইঁদুর ও মানুষেরা’ ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে Mice and Men নামে। এই উপন্যাসটি কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ শ্রেণিতে পাঠ্য। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুরস্কার। তবু হোসেনউদ্দীন হোসেনকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান এখনো আমরা তাঁকে দিতে পারি নি। মুক্তিযোদ্ধা, নিরোহঙ্কারী এই মানুষটি নিজেকে পরিচয় দেন একজন কৃষক হিসেবে। কথাসাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেনের সঙ্গে একান্ত আলাপ চারিতায় জেনে নেব তার একান্ত কিছু কথা। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন গবেষক ও লেখক ড. তপন রায়।

তপন রায় : আপনার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণা বা উৎসাহ সম্পর্কে কিছু বলুন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : আমি অল্প বয়স থেকেই কিছু ভাবতাম। তখনই চিন্তা করি এই ভাবনাকে কীভাবে প্রকাশ করা যায়। সেখান থেকেই লেখার পরিকল্পনা। বুঝতাম না কি লিখছি। লেখা হয়ে উঠছে কি-না এ বিষয়ে দ্বিধাও ছিল। সেটা শৈশবের ব্যাপার। চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি কিছু পদ লিখলাম। লিখে ভাবলাম এটা হয়তো বিশাল কিছু হয়ে গেছে। প্রথম তা মানুষকে জানানোর তাগিদ থেকেই সেই লেখা গাছে ঝুলিয়ে রাখা যায় কি-না চিন্তা করলাম। এরপর আমি হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। আমি যে লেখালেখি করি তা জানাজানি হলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি নাকি লেখ, তা কি লিখেছ দেখি’। আমি তো ভয়ে আর কিছু বলতে চাই না। তারপর আমার কবিতার খাতা এনে স্যারকে দেখালাম। প্রধান শিক্ষক আমাদের অঙ্কের স্যার কালিদাস চক্রবর্তীকে বললেন, দেখোতো কিছু হয়েছে কি-না। কালিদাস স্যার পরদিন ডেকে আমাকে বললেন তোমার তো ছন্দ হয় না। তারপর  তিনি আমাকে ছন্দ সম্পর্কে শেখালেন। তখন বুঝলাম লেখালেখির কাজটা আমি যত সহজ মনে করেছিলাম তত সহজ নয়। তখন আমি ঐ ছন্দগুলো অনুশীলন করতে করতে লেখালেখির কাজে এগিয়ে যাই।

তপন রায় : আপনার লেখা প্রথম গ্রন্থ কখোন প্রকাশিত হলো?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে আমি দুটো উপন্যাস লিখি। উপন্যাস দুটি হলো ‘পত্তন’ ও ‘রূপবতী’। এই দুটি উপন্যাস নিয়ে আমি  ঢাকায় গেলাম, তখন ঢাকার এক প্রকাশককে দেখালাম। তখন তিনি বললেন এটা আমরা ছাপাবো। আমি উপন্যাস দুটি প্রকাশককে দিলাম। কিছুদিন পরই শুরু হলো ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন। তারপর সত্তরের নির্বাচন-আন্দোলন। এরপর তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরে আমিও যুদ্ধে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ থেকে ফিরে কিছুদিন পর ঢাকায় গেলাম। আমি সেই প্রকাশককে খুঁজতে লাগলাম। তিনি যেখানে ছিলেন সেখানে পেলাম না, পরে বাংলাবাজারে গিয়ে তাকে পেলাম। তিনি আমাকে জানালেন যুদ্ধের মধ্যে দোকান লুটপাট হলে সেগুলো হারিয়ে গেছে। তো আর কি, আমার কাছেও ঐ উপন্যাস দুটির কোনো পাণ্ডুলিপি না থাকায় তা আর প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। তখন প্রকাশক আমাকে বললেন, আপনার কাছে কি অন্য কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি আছে? আমি তাকে জানালাম, আছে। আমি তখন আমার লেখা যশোর জেলার কিংবদন্তী; যশোরাদ্য দেশ; আর একটি উপন্যাস নষ্ট মানুষ তাকে দিলাম। তিনি একত্রে ১৯৭৪ সালে প্রকাশ করলেন।

তপন রায় : কবিতা দিয়ে আপনার লেখালেখি শুরু আবার কথাসাহিত্যও লেখেন সেই সাথে আপনি একজন গবেষকও বটে এই সম্পর্কে কিছু বলেন।

হোসেনউদ্দীন হোসেন : গবেষণার কাজটি আমি শুরু করেছি ১৯৬৫ সাল থেকেই। যশোর জেলা সম্পর্কে লেখার কিছু উপাদান পেয়েছিলাম। তখন মনে করলাম এর উপর কিছু কাজ করা যায়। ইতিহাসের উপাদান আছে, কিছু কিংবদন্তি আছে। পরে সেটা যশোর জেলার কিংবদন্তী নামে গ্রন্থ’াকারে প্রকাশিত হলো; আরো প্রকাশিত হলো যশোরাদ্য দেশ। আর বাংলার সামাজিক ইতিহাস নিয়ে আমার আর একটি বই বাঙলার বিদ্রোহ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।

তপন রায় : কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস- সাহিত্যের কোন মাধ্যমে আপনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : আমার লেখালেখি শুরু কবিতা দিয়ে। পরে দেখলাম কবিতার মাধ্যমে সবকিছু প্রকাশ করা সহজ হয় না। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় আমি গবেষণামূলক লেখা পাঠাতাম। পরে যেটা ‘দৈনিক বাংলা’ হয়। ঐ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগে কাজ করতেন কবি আহসান হাবিব। তিনি আমাকে বললেন, আমাদের দেশে তো গদ্য লেখকের অভাব। আপনি গদ্য লেখেন। তারপর আমি কবিতাটা ছেড়ে দিই এবং গদ্যে চলে আসি। তবে নাটক ছাড়া আমি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস এই তিন মাধ্যমেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করি।

তপন রায় : আপনি কি খুব সময় নিয়ে লেখেন? নাকি একটানা লিখে একটা গল্প-উপন্যাস শেষ করেন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : একটানা কখনো আমি লিখি না। আমি লিখি, ভাবি এবং আবার লিখি। একটানা আমি লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি না। আমি দেখি যে আমি যা লিখতে চাচ্ছি তা আসলে রূপ পাচ্ছে কি-না। আমি লেখা শেষ করে রেখে দিই। কিছু দিন পড়ি না। পরবর্তীকালে দেখি কি লিখলাম। ভাল না লাগলে পরিবর্তন করি। এভাবে লেখার কাজটা চালিয়ে যাই।

তপন রায় : কোনো কোনো লেখক বলেন, তারা লেখা শুরু করে লিখতে লিখতে গল্প বা উপন্যাসের পরিণতি নির্ধারণ করেন, আপনার ক্ষেত্রে কেমনটি ঘটে?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : আমি চরিত্র ঠিক করে লিখতে বসি। যেমন ধরেন খল চরিত্র, তো ঐ চরিত্রটি যখন দাঁড় করাতে যাই তখন চারিপাশের পরিবেশ ওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তখন আমি ঐ পরিবেশ ও অন্য চরিত্রগুলোকে তার সঙ্গে যুক্ত করে দিই। এই হচ্ছে মূল বিষয়। কিন্তু আমি আগে থেকেই চরিত্রের পরিণতি নির্ধারণ করি না। ওর ক্রিয়াকলাপই একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। তা সে নায়ক চরিত্র হোক কিংবা খল  চরিত্র হোক আর যে চরিত্র হোক না কেন। তার পরিণতি তার কর্মের মধ্য দিয়েই নির্ধারণ হবে আমি মনে করি। আমি কেবল চরিত্র তৈরি করি।

তপন রায় : এখন নতুন কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখছেন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : আমি এখন একটা গল্প লিখছি, গল্পটার নাম হলো ‘পীর’। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের পীরের প্রতি একটা আকর্ষণ আছে। এখনো দেখা যায়, এই মুরিদরা কোনো পীরের কাছে যায় এমন কিছু উপাদান আমি পেয়েছি। দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষও পীরের ভাববাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন তার সেই আধুনিকতা থাকে না। এই বিষয়ে ঐ গল্পটা লিখছি। কিছুদিন আগে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের উপর একটি প্রবন্ধ লিখেছি। আমাদের দেশের কমনাল চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেছিলেন। সেটাকে আমি সামনে এনে আবুল কালাম আজাদকে দেখাতে চেয়েছি।

তপন রায় : আপনার সাহিত্যচর্চায় বিশেষ কারো অবদান আছে কি?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : তেমন বিশেষ কারো অবদান নেই। তবে যখন প্রথম লিখতে শুরু করি তখন থেকেই পত্রপত্রিকা থেকে উৎসাহ পেতে থাকি। আমি তেমন কোনো সাহিত্যিক গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিলাম না। পঞ্চাশ সনের কথা বলছি, তখন যশোর জেলার ‘যশোর সাহিত্য সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এর পরিচালক ছিলেন কমলাকান্ত মজুমদার। এই সংগঠন মাইকেল মধুসূদনের ওপর বড় অনুষ্ঠান করতেন। তখন কলকাতা, ঢাকা থেকে বড় বড় কবি আসতেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের কথা এখনো মনে আছে, মনোজ বসু, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন। তাদের কথা আমার মধ্যে দারুণ আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

তপন রায় : একজন সাহিত্যিকের কী কী গুণ থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : একজন লেখন যখন লেখেন তখন তাকে ভাবতে হবে তার কথা কীভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করবেন। প্রকাশ করার কৌশলটা তাকে আয়ত্ত করতে হবে। সেই আয়ত্ত করতে জানলে ভাষাটাও তার নিজস্ব হয়ে যায়। এই কৌশল আয়ত্ত করতে না পারলে সে লেখক হতে পারে না।

তপন রায় : লেখকের জীবনাভিজ্ঞতার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : সাহিত্য হচ্ছে শিল্প। শিল্পের সাথে সম্পর্ক থাকে অভিজ্ঞতার। বাস্তবতার সাথে যদি আমার সম্পর্ক না থাকে, তাহলে সেটা আমি সাহিত্যে প্রকাশ করতে পারবো না। যে বাস্তবতার সঙ্গে আমরা আছি সাহিত্যের বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। লেখক যেটা তৈরি করেন অর্থাৎ যে জগৎ তৈরি করেন সেটাই হচ্ছে সাহিত্যের বাস্তবতা।

তপন রায় : আপনার লেখা উপন্যাস ইঁদুর ও মানুষেরা; কিংবা সাধুহাটির লোকজন এ দেখা যায় ইতিহাস ও আর্থ-সামাজিক জীবনাভিজ্ঞতা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে? এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

হোসেনউদ্দীন হোসেন : আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। যুদ্ধ থেকে যখন ফিরে আসি তখন আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভাবছিলাম দেশটা কীভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম আমাদের একটা ভালো দেশ হবে, এখানে অভাব থাকবে না, মানুষের কথা বলার অধিকার থাকবে। মানুষ যা চায়, মানুষের ইচ্ছা প্রকাশ করার জন্য যা চায়, আমাদের কামনা ছিল তাই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর দেখলাম ভিন্ন জিনিস। একদিকে প্রগতিশীল অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বন্দ্ব। যেটা এখানো বহমান। আমার ‘ইঁদুর ও মানুষেরা’ উপন্যাসে এটা আছে। সেখানে প্রগতিশীলতার প্রতিনিধিত্ব করছে সরখেল। ‘সাধুহাটির লোকজন’ এর মধ্যে আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে।

তপন রায় : এ যাবৎ লেখা আপনার উপন্যাসগুলোর মধ্যে আপনার কাছে প্রিয় কোনটি?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : এটা বলা তো কঠিন আমার সব সৃষ্টিই আমার কাছে ভাল। পাঠকই শেষ পর্যন্ত বিচার করবে। এটা নির্ভর করে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সেই দৃষ্টিভঙ্গির দিকেই লেখককে তাকিয়ে থাকতে হয়। 

তপন রায় : ‘প্লাবন এবং একজন নূহ’ উপন্যাসটি আপনাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে, এই স্বীকৃতি কি আপনাকে উদ্দীপনা যুগিয়েছে?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : এটা আমার কাছে খুবই আশাব্যঞ্জক ছিল। আমাদের দেশে বন্যা দিয়ে উপন্যাস অনেকে লিখেছেন কিন্তু আমার বিবেচনায় মনোগ্রাহী সেইভাবে হয় নি। আমি দেখলাম আমি তো সাধারণ মানুষের সঙ্গেই থাকি, তাদের যে সংগ্রাম তা যদি আমি আমার লেখায় না আনতে পারি তাহলে আর লেখার কোনো অর্থই হয় না। এই জন্য আমি দেখলাম, মানুষ সবসময় প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করছে আবার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথেও যুদ্ধ করছে। সেটারই রূপ দেবার চেষ্টা করেছি আমি ঐ উপন্যাসটির মধ্যে।

তপন রায় : আপনার প্রথম উপন্যাস ‘নষ্ট মানুষ’ সম্পর্কে কিছু বলুন? 

হোসেনউদ্দীন হোসেন : এটাও আমার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। পঞ্চাশ বছর আগে এই জায়গাটার অবস্থা কি ছিল। উপন্যাসটিতে একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা আছে। যে মহিলাটা ট্রেনে কেটে মারা গেল তার মৃতদেহটা শববাহকরা ঘাড়ে করে নিয়ে আসছে, তার রক্তাক্ত শাড়ি বাতাসে উড়ছে। একটি মানুষের মৃত্যুর পর কি ঘটতে পারে সেটা দেখাতে চেষ্টা করেছি।

তপন রায় : আপনার উপন্যাস ‘সোনালিজলের কাঁকড়া’  সম্পর্কে বলুন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : এখানে বিভাগপূর্ব সময়ের সমাজবাস্তবতা স্থান পেয়েছে। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অর্থের পেছনে কীভাবে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে তার পরিবার পরিজনকে পেছনে ফেলে, তারই একটি খণ্ডচিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের অবস্থান কেমন হতে পারে? কাঁকড়ার মতো তারা হয়ে গেছে। অনুভুতি বলে তাদের কিছু নেই। সোনালি জল হচ্ছে অর্থ-বিত্ত আর কাঁকড়া হচ্ছে বিত্তের মোহ-আবেগ-অনুভূতি স্খলিত মানুষ। তাদের মন বলে কিছু নেই, সব কাঁকড়ার বাহিরাবরণের মতো হয়ে গেছে। 

তপন রায় : বাংলা সাহিত্য আপনার প্রিয় লেখক কারা?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : বাংলা সাহিত্যের লেখকদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। তারাশঙ্করের কিছু বই ভালো লেগেছে, রবীন্দ্রনাথ তো আছেই। বাংলাদেশের শওকত আলীর গল্প আমাকে স্পর্শ করেছে।

তপন রায় : আজকাল বিশ্বব্যাপী ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য নতুন এক জোয়ারের সৃষ্টি করেছে। এঁদের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : তাদের দেশের পরিবেশ আলাদা। তাছাড়া আমরা তাদের সাহিত্য পড়ি অনুবাদের মাধ্যমে। আনুবাদের মধ্য দিয়ে আসলটা কিন্তু বোঝা যায় না। হয় অনুবাদটা খুব ভালো হয়, আর নয়তো যেগুলো অনেক ভালো উপন্যাস সেগুলোর অনুবাদ আমাদের সেইভাবে স্পর্শ করে না। সাহিত্যের মধ্যে যে যাদুবিদ্যা, আসলে যাদুবিদ্যা বলে কিছু নেই। পুতুল নাচ দেখেছেন আপনি, একজন তো নাচায়। এখন সে কীভাবে নাচাচ্ছে সেটা একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার থাকে। এখন এটাতো হচ্ছে কল্পনার ব্যাপার। কেউ হয়তো যাদুর মতো করে লিখছে। এই নামটা কিন্তু আমরা দিইনি, ওখানকার আলোচকরা দিয়েছেন। আর একটা কথা হচ্ছে উত্তরাধুনিকতা, আমাদের দেশে আমরা বুঝি না যে আধুনিকতার উত্তরটা কি হতে পরে। প্রতিমুহূর্তে তো আমরা বদলাচ্ছি। আমাদের অগ্রগমন তো সামনের দিকে। আমরা তো পেছনের দিকে যাচ্ছি না। আমরা প্রতিমুহূর্তেই আধুনিকতার দিকে যাচ্ছি। চেতনাও আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলতে কোন জিনিস নেই। কীভাবে প্রকাশ করবে যিনি শিল্পী তিনি জানেন। তার শব্দগুলো যদি শিল্পসম্মত হয়, কথাগুলো যদি শিল্পের মধ্যে আসে তাহলে কিন্তু তা টিকবে, আর শিল্পের মধ্যে যদি না আসে তাহলে কিন্তু টিকবে না, স্টেটমেন্ট হয়ে যাবে। 

তপন রায় : সারা পৃথিবীতে এখন স্যাটেলাইট মাধ্যম বা চলচিত্র ইত্যাদি ভিজ্যুয়াল মাধ্যমগুলো যেভাবে মানুষের চেতনাকে দখল করছে তাতে সাহিত্য ভবিষ্যতে মানুষের চেতনাকে প্রভাবিত করবার ক্ষমতাকে ক্রমেই হারিয়ে ফেলবে, এমন কি আপনার আশংকা হয়?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : সাহিত্য ক্রমেই পণ্য হয়ে উঠছে। প্রকৃত সাহিত্য বেশি পাঠক পায় না। পাঠক সেখানে কমই থাকে। আজকের ডিজিটাল যুগে অনেক কিছুই কমার্শিয়াল হয়ে উঠেছে। এখন অনেক লেখক পাঠক বা শ্রোতার মানোরঞ্জনের জন্য এগুলো সৃষ্টি করছে। এখানে সাহিত্য বলে  কিছু নেই।

তপন রায় : আমাদের দেশের সাহিত্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে বলুন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : আমাদের দেশে এখন সবকিছুই প্রচারমূলক হয়ে গেছে। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন সাহিত্যের যে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে, সাহিত্যিক কতখানি অবদান রাখছে এর ওপর কিন্তু দেওয়া হয় না। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে তদবিরের ওপর। যারা এসবের কর্ণধার তাদের যদি আপনার অনুকূলে টানতে পারেন তাহলে আপনি পুরস্কার পাবেন। কিন্তু একজন লেখক কেন পুরস্কার  পাবেন, সাহিত্যে তার অবদান কতখানি, এটাতো একটা বিচার-বিশ্লেষণের ব্যাপার। এখন দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারটি বড় হয়ে উঠেছে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে এটাই হবে। কারণ পুঁজির যে তেজ- যে শক্তিটা তা সব কিছুকেই প্রভাবিত করছে।

তপন রায় : আমাদের মত দেশগুলোতে যেখানে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো, সেখানে সাহিত্য কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : বিপ্লব ঘটাতে হবে মূলত সাহিত্যের মাধ্যমে। সে অথনৈতিক বিপ্লব হোক আর রাজনৈতিক বিপ্লব হোক, এগুলো আসবে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সাহিত্যিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এখন প্রপাগা-া ছড়ানো হচ্ছে  মিডিয়ার মাধ্যমে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টক-শো গুলোতে পয়সা দিয়ে কিছু লোককে কথা বলানো হচ্ছে ঐ লোকগুলো কারা? এই লোকগুলো অধিকাংশ জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা ঢাকা শহরে আছে, তাদের কিছু গ্রুপ করা আছে, সেই গ্রুপের প্রচার করার জন্য টিভি আছে। তাদেরকে একটি বিষয় দেওয়া হচ্ছে, ঐ বিষয় সম্পর্কে কিছু বলার জন্য। এক ধরণের চটকদারিতা, ঐ চটকদারিতা কোনো কিছু অর্জন করতে পারে না। কিছু প্রকৃত সাহিত্য যে হচ্ছে না, তা নয়। তারা কিন্তু কোনো লোভের বশবর্তি হয় না। আমাদের দেশে লিটলম্যাগগুলোতে প্রকৃত সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে। পক্ষান্তরে বড় বড় পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন রঙ-বেরঙের বিজ্ঞাপন দিয়ে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। সেগুলো সাহিত্য নয়, ওগুলো টিকবেও না।

তপন রায় : আমাদের দেশে সাম্প্রতিক যে সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একে রোধ করবার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের বাইরে স্বাধীনভাবে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন কি সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : কিছু কিছু গ্রুপ সৃষ্টি হয়ে গেছে, তারা চাচ্ছে মূল জায়গায় ফিরে যেতে। একটি সংগঠন প্রথম দিকে কাজ করছে ভাল। পরবর্তীতে তারা হয়ে যাচ্ছে কমার্শিয়াল। স্যাটেলাইট মাধ্যমগুলো তাদের লোভ দেখাচ্ছে। কিছু কিছু পত্রিকা তারা কিন্তু চেষ্টা করছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকে থাকতে পারছে না। এই করতে করতে সামনের দিকে এগুবে, রাতারাতি কোনো বিপ্লব হয় না। আমাদের দেশের অর্থনীতি এখন কি? কমার্শিয়াল পুঁজিও নয়, দালালি করা। এখানে ই-াস্ট্রিয়াল পুঁজি যদি শক্তিশালী না হয়, এই টাকাটার সার্কুলেশন যদি তৃণমূল পর্যন্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থা থাকবে। এখন তো সব হয়ে গেছে বাইরের বাজারমুখি। বাইরে থেকে এখানে আমদানি করা হচ্ছে। রপ্তানির ব্যবস্থা এখানে কম। দেশটা একটা ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। 

তপন রায় : লেখকের সামাজিক দায় কতখানি? আপনি তা স্বীকার  করেন কী? 

হোসেনউদ্দীন হোসেন : সাহিত্যিকের দায় তো আছেই। আমি কেন লিখি? সমাজের জন্য তো লিখি। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি কোন্ মানুষের জন্য লিখি এর উপর নির্ভর করছে সমস্ত কিছু। আমার সমাজে যে সমস্যাগুলো তা আমি লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি। আর আমি যদি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সাহিত্য সৃষ্টি করি, তবে তা সমাজের কোনোই কাজে দেবে না।

তপন রায় : অনেক লেখক মফস্বলে লেখালেখি শুরু করলেও পরবর্তীতে রাজধানীতেই আশ্রয় গ্রহণ করে সেক্ষেত্রে আপনি ব্যতিক্রম, কেন সারাজীবন মফস্বলে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন?

হোসেনউদ্দীন হোসেন : আমার কাজ হচ্ছে শিল্পের সঙ্গে থাকা। সেক্ষেত্রে আমার রাজধানীতে থাকার প্রয়োজন কি? প্রকৃত শিল্পের সাধনায় আমার লক্ষ। বাংলাদেশের বৃহত্তর অঞ্চল হলো গ্রাম, নগরের সংখ্যা তো খুব কম। সাধারণ মানুষের জন্যই আমার সাহিত্য সাধনা। সে জন্য তাদের কাছাকাছি থাকাটাই আমার শিল্পের জন্য মঙ্গল। রাজধানীতে থাকতে হলে আমাকে ওখানকার জীবনমানে অভ্যস্ত হতে হলে কমার্শিয়াল কাজের সাথে যুক্ত হতে হতো। সে ক্ষেত্রে আমার শিল্পের সাধনা ব্যাহত হতো। আমার সাহিত্যের জন্য গ্রামে থাকাই আমার জন্য উপযোগী।

তপন রায় : এতক্ষণ আপনার আন্তরিক আলাপনের জন্য ধন্যবাদ। 

হোসেন উদ্দীন হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ। 

মন্তব্য: