কবি শহীদ কাদরীর একান্ত সাক্ষাতে কবি শামস আল মমীন

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

পঞ্চাশ-উত্তর বাংলা কবিতায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সৃষ্টিতে যে ক’জন কবির নাম নেয়া যায় কবি শহীদ কাদরী হলেন তাঁদের অন্যতম। বিশ্ব-নাগরিকতা বোধ, আধুনিক নাগরিক জীবনের সুখ-দুঃখ, রাষ্ট্রযন্ত্রের কূটকৌশল এসব কিছু তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে স্বতস্ফূর্তভাবে। জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯৪২, কলকাতায়। দেশ ভাগের পর বাবার হাত ধরে আসেন ঢাকায়। বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী এই কবি দেশ ছাড়েন ১৯৭৮ সালে। প্রথমে জার্মানি তারপর লন্ডন হয়ে বর্তমান নিবাস মার্কিন মুল্লুকে। কবিতা লেখা শুরু করেন পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। ১৯৫৬ সালে প্রথম কবিতা ‘এই শীতে’ প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’য়। ১৯৬৭-এ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৮ সালে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০০৯-এ যার নাম ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’।

বাংলা কবিতা এবং স্বদেশের সাথে অভিমান করে আছেন কবি শহীদ কাদরী গত ৩২ বছর। একুশে পদক (২০১১) ও বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান এ কবির সাথে আলাপচারিতায় বসেছিলেন আরেক মার্কিন প্রবাসী কবি শামস আল মমীন।  

শামস আল মমীন : প্রায় চব্বিশ বছর কবিতাহীন কেমন আছেন? 

শহীদ কাদরী : চব্বিশ বছর ধরে কবিতা লিখছি না এটা সত্যি কথা কিন্তু কবিতাহীন আমি না। কীটস-এর একটি কথা আপনার মনে আছে নিশ্চয়, Poetry of the earth is never dead. অর্থাৎ পৃথিবীতে কখনই কবিতার দিন শেষ হবে না। জীবনকাব্য দ্বারা এখানো আমি পরিবৃত। কবিতা আমি এখনও পড়ি। 

শামস আল মমীন : সপ্তাহের দিনগুলো আপনি কীভাবে কাটান?

শহীদ কাদরী : আমি Site counselor হিসাবে কাজ করি। দিনের একটা অংশ ঘুমাই আর বাকী সময় বই-টই পড়ি। 

শামস আল মমীন : কখন বুঝতে পারলেন আপনি কবিতা লিখতে পারবেন?

শহীদ কাদরী : কবিতা লিখতে পারবো এরকম বিশ্বাস কখনই ছিল না। সব সময় দোদুল্যমান ছিলাম। অল্প বয়সে আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের। শামসুর রাহমানকে প্রায়ই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করতাম, আমার কি হবে? – হ্যাঁ তবে আপনার মধ্যে দুটো Opposing force কাজ করছে। আপনি খুব ভালো লিখতে পারেন অথবা আপনি নষ্টও হয়ে যেতে পারেন। 

শামস আল মমীন : তাহলে বলা যায়, শুরুতেই আপনি শামসুর রাহমান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? 

শহীদ কাদরী : সত্যি কথা বলতে কি, লেখা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। ১৯৫৬ সালে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। আমি তখন স্কুলে পড়ি। বুদ্ধদেব বসু আমার কবিতা ছেপেছেন, আমি মনে করলাম, আমার হয়ে গেছে আর লেখার দরকার নেই। তারপর দু’বছর আর আমি কবিতা লিখিনি। এর একটা কারণ হলো, তখন খালেদ চৌধুরী, সুকুমার মজুমদার ওঁদের সাথে আমার পরিচয় হয়, এঁরা ছিলেন দার্শনিক। এঁরা তখন হেগেল, প্লেটো, কান্ট পড়ছেন। আমাদের মধ্যে একটা কথা উঠলো, কবিরা কবিতায় অনুপ্রেরণা বা আবেগে অনেক কথা বলেন যার কোন অর্থ হয় না। এবং প্লেটো যে কারণে তার রিপাবলিক থেকে কবিতাকে নির্বাসন দিয়েছেন। জীবনের অর্থ সত্যের উদঘাটন এবং তা একমাত্র দর্শনেই সম্ভব। আমি তখন তুমুল বেগে দর্শন পড়া শুরু করলাম। কবিতাকে ছেলেমানুষির মতো মনে হওয়া শুরু করলো। একদিন আমরা বসে আছি চুচিং চাওতে, ঢাকার প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, হঠাৎ সৈয়দ শামসুর হক এসে বলল- আমার প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছে ‘একদা একরাত্রি’ আপনাকে বইটা দিতে চাই। আপনি কাল চিত্রালী অফিসে আসেন। পরের দিন চিত্রালী অফিসে গেলাম। হক আমাকে বইটি দিয়ে বলল, যদি পারেন একটা রিভিউ লিখে দেন। আমি বললাম, তাহলে বইটা আমি বাসায় নিয়ে যাই। হক বলল, না শহীদ ভাই আপনি একবার গেলে আপনাকে আর পাওয়া যাবে না। এখানে বসেই লিখে দেন। 

শামস আল মমীন : আমরা যতটুকু জানি, আপনি কারো বইয়ের রিভিউ লেখেন না। 

শহীদ কাদরী : ঐ বইটার রিভিউ লিখেছিলাম। (না লেখার কোন কারণ ছিলো না, আলসেমীর জন্যই লেখা হতো না। আমাকে জোর করলেই আমি লিখতাম। কেউ জোর করতো না তাই লেখাও হতো না।) হক জোর করলো তাই লিখলাম। 

সৈয়দ হক পরে একদিন বলল, বইটার একটা প্রকাশনা উৎসবের মতো করেছিলাম এক রেস্টুরেন্টে। ওখানে শামসুর রাহমানের সাথে দেখা হলো, বইটা তাকে দিতেই তিনি বললেন, ‘আহ্ আজকে শহীদ কোথায়, ও ছেলেটা লিখতে পারতো। ও নিজেকে নষ্ট করল খামোখা-ই। এই কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগলো। বাড়িতে এসে ঐদিন সন্ধ্যায় আমি ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ কবিতাটা লিখে ফেললাম। 

শামস আল মমীন : কবিতাটা কি একটানে লিখেছিলেন?

শহীদ কাদরী : একটানা। আধঘন্টার মধ্যে লিখে শেষ করেছি।

শামস আল মমীন : এটাতো প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা। 

শহীদ কাদরী : আমি তখন বুঝতেও পারিনি এটা একটা ভালো কবিতা হয়েছে। পরে আল মাহমুদ কবিতাটা আমার কাছে থেকে নিয়ে সমকাল-এ ছাপে। অনেকেই কবিতাটার প্রশংসা করলো। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আমাকে বললো, এত অল্প বয়সে ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’র মতো কবিতা লিখেছো, এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। 

শামস আল মমীন : আমরা ৮০/৯০ দশকের কবিতা লেখার পরিবেশ সম্পর্কে মোটামুটি জানি। আপনাদের সময় কবিদের মধ্যে কি ধরনের সম্পর্ক ছিল? কিংবা কবিদের আড্ডাগুলোর পরিবেশ কেমন ছিল? 

শহীদ কাদরী : তখন ঢাকা ছোট্ট শহর ছিল। এবং আড্ডাগুলো ছিল মুলত পত্রিকা কেন্দ্রিক। সমকাল অফিসে আড্ডা হতো। সওগাত অফিসে আড্ডা হতো। এসব জায়গায় প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের দেখা হতো। আল মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় সওগাত অফিসেই। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে আল মাহমুদ যেদিন প্রথম সওগাত অফিসে আসে সেদিনই সওগাতে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়। আব্দুল গাফফার চৌধুরী সওগাত পত্রিকার কবিতার অংশ সম্পাদনা করতেন। ঐ সন্ধ্যাতেই আল মাহমুদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো। তাঁর হাতে ছিল মার্কসবাদ। 

শামস আল মমীন : এটা কি ৫৬ সালের কথা?

শহীদ কাদরী : সঠিক মনে নাই তবে ৫৫/৫৬ সাল হবে। 

শামস আল মমীন : আমরা জানি বৃদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার তখন দারুণ প্রতাপ। কবিতা ছাপার পর আপনাদের মনে কী জাগরণ সৃষ্টি হয় যে, হ্যাঁ আমাদের হবে। 

শহীদ কাদরী : প্রচন্ডভাবে, প্রচন্ডভাবে। আসলে আমাদের মধ্যে যিনি জাগরণ সৃষ্টি করেন তিনি হলেন শামসুর রাহমান। আমার মনে আছে, এক দুপুরে পিয়ন এসে ‘কবিতা’ পত্রিকা (আমার বড় ভাই কবিতা পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন) দিয়ে গেল বাসায়। তখন আমি এক বন্ধু বাচ্চুসহ ভাত খাচ্ছিলাম। বাচ্চু ছিল ফিল্ম ডিরেক্টর, ও ছবি বানিয়েছিলো ‘আগুন নিয়ে খেলা’। দেখেছেন ছবিটা?

শামস আল মমীন : হ্যাঁ, দেখেছি। 

শহীদ কাদরী : পত্রিকা খুলে দেখি শেষ পৃষ্ঠায় ‘রুপালী স্নান’ শামসুর রাহমান। পড়ে খুব ভাল লাগলো। আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমার বড় ভাই (ছাত্র, ইংরেজীতে অনার্স) তাকে বললাম, দেখতো কবিতাটা কেমন লাগে। পড়ে তিনি বললেন- It’s a piece of magical writing. এতো নামের ভিড়ে শামসুর রাহমানের নামটা খুব জ্বলজ্বল করে দাঁড়িয়ে আছে। 

এর তিন মাস পর আবার কবিতা এলো। প্রথম কবিতাটিই শামসুর রাহমানের। ‘তার শয্যার পাশে’ তারপর ছিল সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী এঁদের কবিতা। ব্যাপারটা সাংঘাতিকভাবে আমাকে strike করলো। তখন আমাদের মধ্যে একটা ধারণা হলো যে, হয়তো আমাদের পক্ষেও সম্ভব। আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি, শামসুর রাহমানের প্রধান অবদান হলো তিনি আমাদের সাহসের সীমা সম্প্রসারিত করেছেন।

শামস আল মমীন : এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, শামসুর রাহমানের কোন কবিতার বই বেরুবার আগেই তিনি কবি হিসাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। 

শহীদ কাদরী : এটা সত্যি কথা।

শামস আল মমীন : এর কারণ কি?

শহীদ কাদরী : এর দু’টো কারণ আছে। প্রথমটা তাঁর কবিতার নিজস্ব গুণ যা সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, সময়টা ছিল ৫০-এর দশক যা বাংলা কবিতার জন্য খুব সুসময় ছিল না। কারণ ৩০-এর পাঁচজন কবির পর কলকাতায় সে কবিতার চর্চা হচ্ছিল তা ছিল রাজনীতি ভিত্তিক। এবং তখনকার বিখ্যাত কবি ছিলেন সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এঁদের কবিতা যদিও উজ্জ্বল কিন্তু একপেশে। এঁদের প্রভাবে কবিতা হয়ে উঠেছিল শ্লোগানমুখী। জীবনে যেমন রুটির প্রয়োজন আছে তেমনি গোলাপেরও প্রয়োজন আছে। তখন মার্কসবাদী আন্দোলনের এমন ঢেউ এসেছিল যে আমরা শুধু রুটির কথাই বলছিলাম গোলাপের কথা বলছিলাম না। কবিতার আবহাওয়া বদলে গিয়েছিলো। অনেকে এ ধরনের কথা বলেছিলো যে, কবিতায় অন্য কথাও বলা উচিত। শামসুর রাহমান তখন লিখলেন শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ… দেখি ছায়া নিয়ে শরীরে ছড়ায়’।

শামস আল মমীন : এখনো আপনার মুখস্থ আছে? 

শহীদ কাদরী : এই কবিতাটা একটু নতুন সুর, নতুন এক ডিমেনশন্ দিয়েছে বাংলা কবিতাকে। 

শামস আল মমীন : এই সময় এমন কোন কবি ছিলেন না যাঁকে কেউ ফলো করতে পারে? তখন কবি ছিলেন আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, কিন্তু আমি ঠিক জানি না এঁরা কেউ প্রতিনিধিত্বশীল কবি ছিলেন কিনা। 

শহীদ কাদরী : এঁরা ছিলেন যুগ সন্ধিক্ষনের কবি। আধুনিক এবং অনাধুনিক এর মধ্যবর্তী পর্যায়ের কবি। আধুনিক কবিতার যে বিভিন্ন মাত্রা, এটা তাঁরা পুরোপুরি আয়ত্ব করতে পারেননি, যেটা শামসুর রাহমান পেরেছিলেন। 

শামস আল মমীন : ধরা যাক, আপনাদের কারো কবিতা যদি কবিতা পত্রিকায় ছাপা না হতো, (ভৌগলিক রাজনৈতিক কারণে) তাহলে আপনাদের কবিতা লেখায় কোনো ভাঁটা পড়ত বলে মনে হয়? 

শহীদ কাদরী : ভাঁটা পড়তে পারতো। কারণ তখন আমাদের সামনে এমন কোন দৃষ্টান্ত ছিলো না যার রুচি, কাব্যবোধ এবং বিচারের উপর আমরা আস্থা রাখতে পারি। তিরিশের কবিদের যে কাব্যকৃতি আর পাণ্ডিত্যের গভীরতা আমরা অনুভব করেছিলাম, তাতে আমরা এঁদের প্রতি আস্থা রাখতে পেরেছিলাম।

শামস আল মমীন : কবি ফরহাদ মজহার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র পর শামসুর রাহমান আর গ্রো করতে পারেননি। 

শহীদ কাদরী : না, কথাটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। 

শামস আল মমীন : আমি মনে করি, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’। 

শহীদ কাদরী : আমি আপনার সাথে একমত। ‘রৌদ্র করোটিতে’ তাঁর নিজস্ব কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই এবং আমি মনে করি ‘রোদ্র করোটিতে’ একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ। এবং তাঁর সমস্ত কবিতার দিকে তাকালে একটা জিনিস বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি যে কয়েকবার তাঁর বিবর্তন ঘটেছে এবং এদিকে থেকে তিনি খুব সৃষ্টিশীল। তাঁর লেখা ডেভেলপ করেনি এটা ভুল কথা।

শামস আল মমীন : তিরিশের পাঁচ কবির মধ্যে কাকে আপনার মতে সবচে শক্তিশালী মনে হয়? 

শহীদ কাদরী : শক্তিশালী কোন অর্থে?

শামস আল মমীন : সম্পূর্ণ কাব্যভাষা কার বেশী আয়ত্ত্বে ছিল?

শহীদ কাদরী : এটা ঠিক আমি বলতে পারব না। তবে আমাকে আকর্ষণ করে বেশি জীবনানন্দ এবং বিষ্ণু দে।

শামস আল মমীন : আমার জানা মতে শামসুর রাহমানের পছন্দ সুধীন্দ্রনাথ। 

শহীদ কাদরী : সুধীন্দ্রনাথ আমারও পছন্দ। তাঁর প্রভাব কিছু আমার উপরে পড়েছে কিছু শামসুর রাহমানের উপরেও পড়েছে। কিন্তু তার মূল কাব্যকৃতি, কিছু শব্দ ব্যবহার কৃতর্য্য শব্দ ব্যবহারের উপর তার নির্ভরশীলতা অনেক সময় তাঁর কবিতাকে অনঢ়, অচল করে দেয়।

শামস আল মমীন : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলেছেন। সুধীন দত্ত যেহেতু বাড়ীতে বাংলা বলতেন না, সে কারণে প্রতিদিনের কথকতা তিনি ঠিকভাবে আয়ত্ত্ব করতে পারেননি। তাঁর কাব্যভাষা বই নির্ভর।

শহীদ কাদরী : এটা পুরোপুরি সত্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের চলতি মুখের বুলি তিনি জানতেন না এটা ভুল। হাইনের কবিতার অনুবাদে চমৎকারভাবে তিনি চলতি মুখের ভাষা ব্যবহার করেছেন। আসলে সুধীন দত্ত বাংলা কবিতা এবং প্রবন্ধেও একটা জিনিস চেষ্টা করেছিলেন তা হলো জটিলতাকে নষ্ট না করে জটিল অবস্থাতেই তাকে ব্যক্ত করা। এবং এটা করতে গিয়ে তাঁকে অনেক নতুন শব্দ তৈরী করতে হয়েছে। তার জন্য মাঝে মাঝে তা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তার অর্জনটা হচ্ছে বাংলায় যে সব কথা বলা সম্ভব ছিলো না সে ধরনের কথা তিনি বলতে পেরেছেন। 

শামস আল মমীন : হুমায়ুন আজাদ বলছেন,‘বাংলা কবিতাকে একজন মহৎ (প্রধান) কবির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তাই এক দশকে পাঁচজন মহৎ কবির আবির্ভাব যারপরনাই বিস্ময়কর’।

শহীদ কাদরী : আমি সম্পূর্ণ একমত এ প্রসঙ্গে।

শামস আল মমীন : ফরহাদ মজহার বলছেন, তিরিশের যুগটা কেরানীদের যুগ (আকার ইকার)।

শহীদ কাদরী : এটা একটা  শ্লোগানের মতো উঠেছে বাংলাদেশে। কিন্তু আমার মনে হয় কথাটা সত্য নয়। যারা পশ্চিমা সাহিত্য পড়েছেন তারা জানেন ওরা তিরিশের মতো কবিতা লেখেননি। এবং তিরিশের কবিরা যে ধরনের কবিতা লেখেছেন পশ্চিমারা ঐ ধরনের কবিতা লেখেননি। যার জন্য অডেন-এলিয়েট পড়ে আমি যে স্বাদ পাই জীবনানন্দে, বুদ্ধদেব বসু পড়ে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ পাই।

শামস আল মমীন : ‘পশ্চিমা সাহিত্য, সভ্যতা এবং দর্শনের কিছুই জানতেন না বুদ্ধদেব বসু। সুধীন দত্তের বই পড়লে মনে হয় ওটা অপাঠ্য, একটা মুর্খের লেখা বই। তার কোন লেখাই complete না,’ বলছেন ফরহাদ মজহার (আকার ইকার)। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?

শহীদ কাদরী : আমি গভীরভাবে দর্শন র্চচা করেছি। সুধীন দত্ত কেনো দার্শনিক লেখক না। তিনি দর্শনের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেননি। তার প্রবন্ধে, ইংরেজীতে যাকে বলে এল্যুসিভ এবং এই এল্যুসিভনেস থেকে বোঝা যায় তিনি প্রচুর পড়াশুনা করেছেন এবং তার ছায়া  আছে তাঁর বক্তব্যে। দর্শনের যে সিদ্ধ-পদ্ধতি সেই অর্থে তিনি দার্শনিক না কিন্তু তার লেখা পড়ে মনে হয় তিনি মূর্খ এই উক্তির উৎসে এক ধরনের মূর্খামী আছে।

শামস আল মমীন : তিনি আবারো বলছেন, ‘তিরিশের কবিরা একটা সংস্কৃত বাংলা তৈরী করার চেষ্টা করেছেন’ (আকার ইকার)। 

শহীদ কাদরী : এ কথা একেবারেই গ্রাহ্য না।

শামস আল মমীন : ‘তিরিশের কবিরা বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি করেছেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টা হাস্যকরও বটে; বলেছেন ফরহাদ মহজার (আকার ইকার)। 

শহীদ কাদরী : তাঁর কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে, এতে আমার বলার কিছু নেই। খুব সম্ভব বাংলার লোকসাহিত্য তাঁর খুব পছন্দ। আমারও মনে হয়, বাংলার লোকসাহিত্য খুব রিচ, কিন্তু অত্যন্ত সীমিত। তিরিশের এই কবিরা যদি না আসতেন তবে বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্য ভয়াবহভাবে বাল্যকালে থেকে যেতো। 

শামস আল মমীন : তখনো রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। এবং তাঁকে অনুসরণ করে নতুনরা যদি কবিতা লিখতেন তাহলে কি নিম্নমানের কবিতা লেখা হতো?

শহীদ কাদরী : না, নিম্নমানের হয়তো হতো না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরও একটা সীমা ছিলো। তিরিশের কবিদের মূল অবদানই ছিল সেই সীমা ভেঙে আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রকে, আমাদের অনুভবের রাজ্যকে সম্প্রসারিত করা। রবীন্দ্রনাথকে যদি আমরা অনুসরণ করে যেতাম তাহলে আমরা একই বৃত্তে আবর্তিত হতে থাকতাম। 

শামস আল মমীন : আমি জানি না রবীন্দ্রনাথকে কেউ অতিক্রম করতে পারবেন কিনা। কেউ পারলে খুশিই হবো। আরেক প্রতিভার সংযোগ হবে বাংলা সাহিত্য। তাকে ফলো করেও আমরা অন্য কোন প্রতিভা পেতে পারতাম। 

শহীদ কাদরী : ফলো করার প্রশ্নটা আসছে না এই কারণেই যে, নিউটন যেটা আবিষ্কার করে গেছেন সেটাই যদি আমি আবার আবিষ্কার করি আমিতো তাহলে নিউটন হবো না। নিউটনের পর আইনেষ্টাইনের দরকার ছিলো। একজনকে আমরা তখনই বিজ্ঞানী বলি যখন সে বিজ্ঞানে নতুন কিছু যোগ করে। একজন লেখককেও নতুন কিছু যোগ করতে হবে তাহলেই সে লেখক। তা না হলে পূনরাবৃত্তি বা চর্বিত চর্বণ করে-তো কোন লাভ নেই। যারা রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে লিখবে তাদের লেখা পড়ব কেন? রবীন্দ্রনাথই পড়বো। 

শামস আল মমীন : তিরিশের কবিদের মধ্যে থেকেও জীবনানন্দ অন্যদের থেকে আলাদা। তাঁর কবিতার শব্দচয়নে পূনরাবৃত্তি খুব বেশী। সমালোচকরা বলেন, কবিতায় পুনরাবৃত্তি ভালো নয় তার পরেও জীবনানন্দ ভালো কবি। তার কারণ কি?

শহীদ কাদরী : T.S. Eliot-এর একটা লাইন বলি, You say I am repeating I say what I have said before I will say it again. রিপীটেশন হচ্ছে emphasis করার একটা পদ্ধতিমাত্র। এই রিপীটেশন মিউজিকেও আছে। তবলায় আছে, ড্রাম ও আছে, রাগ রাগনিতে আছে। রিপীটেশন রিদম তৈরী। Repetition is not necessarily bad. 

শামস আল মমীন : তিরিশের পর আমরা পাই সমর সেনকে। তাঁকে কি আমরা তিরিশের কবিদের সমান মর্যাদা দিতে পারি?

শহীদ কাদরী : একটা অসুবিধা আছে। সমর সেনের কবিতায় অনুভবের ক্ষেত্রটা সীমিত। একজন বড় কবি এবং একজন ছোট কবির মধ্যে craftsmanship বা skill এ তফাৎ হয় না। তফাৎটা হচ্ছে, অভিজ্ঞতার বিভিন্ন শেকড় বা রেঞ্জ কে কতখানি স্পর্শ  করেছে। সমর সেন অত্যন্ত শার্প, অত্যন্ত তীব্র অরিজিনাল একজন কবি কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রটা সীমিত। যেমন তাঁর কোন ভাল passionate কবিতা নেই। মৃত্যুর উপরে তার কোন ভাল কবিতা নেই। নিঃসঙ্গতার উপরে তার কোন ভাল কবিতা নেই। তাঁর কবিতার পুঁজিবাদী সমাজের alienation  আছে। জীবনের অনেক ডিমেনশন তার কবিতায় তিনি ধরতে পারেননি। 

শামস আল মমীন : সমর সেন কবিতা লিখেছেন বছর দশেক। এবং ঘোষণা দিয়ে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন তাঁর আরও লেখা উচিত ছিল, নাকি যা করেছেন তাই আমাদের জন্য মঙ্গল?

শহীদ কাদরী : আমি মনে করি উনি যা করেছেন সেটাই আমাদের জন্য মঙ্গল। অনেক সময় হয় কি একজন লেখক নতুন একটা ফর্ম আবিষ্কার করেন। এবং he becomes prisoner of that form। তিনি যখন তার আবিষ্কৃত আঙ্গিকের বাইরে আর যেতে পারলেন না। তখন তিনি বুঝেছেন আর পূনরাবৃত্তির কোন মানে হয় না। তার যে বক্তব্য ছিল তাও তিনি Exhaustedly বলেছেন। এরপর তাঁর নতুন কোন বক্তব্য জন্মায়নি। নতুন কোন দৃষ্টিভঙ্গি জন্মায়নি, এমন কি ভাষাও বদলায়নি। তাই তিনি আর নিজেকে repeat করেননি। 

শামস আল মমীন : অনেকের মতে শামসুর রাহমানের বর্তমান কবিতা শুধুই repetition উদাহরণ, কবি আবুল হোসেন ব্রাত্য রাইসুকে দেয়া সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমানে শামসুর রাহমান কবিতা লিখছেন দিনলিপির মতো। এগুলো কবিতা হচ্ছে না। 

শহীদ কাদরী : দিনলিপিও কবিতা হতে পারে। আমার মনে আছে, রবার্ট লয়েলের মৃত্যুর পর ঘড়ঃব ইড়ড়শং নামে একটা কবিতার বই বেরিয়েছিলো। তার প্রত্যেকটিই ছিল সনেট। এগুলো দিনলিপির মতো লেখা হয়েছিল। দিনলিপি লিখলেই কবিতা হবে না এমন কোন কথা নেই। আবুল হোসেন হয়তো বলতে চাচ্ছেন তাঁর কবিতা প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের তালিকা হয়ে যাচ্ছে সাহিত্য হচ্ছে না, সেটা আমি বলতে পারব না। কোন কোন কবির প্রয়োজন হয় একটা ভালো কবিতা লেখার আগে দশটা মাঝারি ধরনের কবিতা লেখা।

শামস আল মমীন : আপনার কি এরকম কখনো মনে হয়েছে যে, আহা! আমি দি ওমুকের মতো লিখতে পারতাম। 

শহীদ কাদরী : আমার সমসময় মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মতো লিরিক লিখতে পারলেই ভালো হতো। 

শামস আল মমীন : তাই নাকি!

(এ সময় শহীদ কাদরী তার স্বভাবসুলভ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন)।

শামস আল মমীন : আমাদের কবিতায় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এবং শহীদ কাদরী এই তিনটি নাম তিরত্নের মতো প্রায় একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। এবং কবি হিসাবে আপনি যখন প্রতিষ্ঠিত ঠিক সেই সময় দেশ ছাড়লেন কেন?

শহীদ কাদরী : আমি জার্মানীতে গিয়েছিলাম মাস তিনেকের জন্য। তাও পারিবারিক এবং অন্যদের প্রেসারে। ওখানে গিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটল যে মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গেলো। আমি জার্মানীতে আটকা পড়ে গেলাম। ফিরতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। তখন লন্ডনে কলকাতার আমার এক বাল্যবন্ধু একটা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ওকে সব খুলে বলতেই ও আমাকে একটা চাকরীর এপোয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দিলো। আমি লন্ডনে এসে হুসেন নামে এক বন্ধুর বাসায় উঠলাম। সৈয়দ শামসুল হক তখন বিবিসিতে কাজ করতেন। সাতদিন ঘুমটুম দিয়ে বিবিসিতে গেলাম। শামসুল হক বিবিসিতে একটা কাজ জুটিয়ে দিলো। তখন আমি কিছুটা উদাস ছিলাম।

শামস আল মমীন : তখন কি কবিতা লেখার কথা ভুলে গিয়েছিলেন?

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ, তখন আমি অনুভব করি মাথাটা আমার অদ্ভুতভাবে শূন্য। 

শামস আল মমীন : এমনিতেই মাথাটা শুন্য হয়ে গেলো না কি কোন ঘটনা ঘটেছিলো। 

শহীদ কাদরী : সব কিছু মিলিয়ে মনে হয়। 

শামস আল মমীন : হুমায়ূন আহমেদ বলছেন, একদিন আমার মা ফোন করে জানালো, তুই বাংলা একাডেমী পুরষ্কার পেয়েছিস। আমি তখন Ph.D করছি যুক্তরাষ্ট্রে। পড়াশুনা আর পারিপার্শ্বিক চাপে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমি কখনো লিখতাম (তাঁর তিনটি উপন্যাস তখন প্রকাশিত হয়েছিল) আপনার কি এরকম ব্যস্ততা ছিল না কি অন্য কিছুর জন্য কবিতা লেখেননি? 

শহীদ কাদরী : বিবিসিতে আমার কাজ ছিল খুবই হালকা। ব্যস্ততা ছিল না মোটেই। আসলে মনটা নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিলো।

শামস আল মমীন : দেশ ছেড়ে এসেছিলেন বলে?

শহীদ কাদরী : খানিকটা। সারাদিন কামরায় বসে থাকতাম আর সিগারেট খেতাম। ঢাকা থেকে আমার ভাই ফোন করে বললো ‘আমি খবর পাচ্ছি তোমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ 

শামস আল মমীন : আচ্ছা। এটা তো খুব ভালো সময় ছিলো কবিতা লেখার। 

শহীদ কাদরী : ইন্টেলেকচুয়ালি-ইমোশনালি mentally I was paralyzed for multiple reasons.

শামস আল মমীন : তারপর কি দেশে চলে গেলেন? এটা কি ৮২-র দিকে?

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ। 

শামস আল মমীন : বিবিসির চাকরী তো বেশ লোভনীয়। আপনার কি একদম পছন্দ হলো না। 

শহীদ কাদরী : চাকরীতে মন নেই (আবার সেই অট্টহাসি)। আমি আমার যৌবনের অধিকাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ক্যারিয়ার দরকার, টাকা পয়সা জমানো দরকার। ভবিষ্যৎ আছে এগুলো কখনো ভাবিনি। আমি অনেক রকম স্কোপ পেয়েছি কিন্তু কোনটাই কাজে লাগাইনি।

শামস আল মমীন : দেশে ফিরে  পুরানো বন্ধু বান্ধব এবং পারিবার্শ্বিক অবস্থার কি পরিবর্তন দেখলেন?

শহীদ কাদরী : দেশে যখন ফিরে গেলাম তখন শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলার এডিটর। তাঁর অফিসে গেলাম। দেখি তিনি বহু লোক দ্বারা পরিবৃত। তিনি বললেন বঙ্গভবনে মিটিং এ যেতে হবে, বসুন চা খান। আমার গাড়ী আছে আপনাকে পৌঁছে দেবে। (হাসতে হাসতে বললেন) তাঁর গাড়ী আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলো। ফজল শাহাবুদ্দীনের অনেক পরিকল্পনা। রাজনৈতিকভাবে তিনি একটা দলের সাথে জড়িত সেখানে আমার যোগ দেওয়া সম্ভব হলো না। আল মাহমুদ তাঁর রাজনৈতিক লোকজন নিয়ে ব্যস্ত। আমি দেখলাম, ওখানে বাস করতে হলে একটা দলের সাথে ভিড়তে হবে। এদের ব্যস্ততা আর নির্লিপ্ততা দেখে মনে হলো আমার আর জায়গা নেই দেশে।

শামস আল মমীন : তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন আমেরিকা চলে আসার?

শহীদ কাদরী : আমেরিকা আসার সিদ্ধান্ত নেইনি that was purely accident ভাইকে বললাম, আমার আরও এক মাসের ভিসা আছে লন্ডনের। ভাই বলল, মন খারাপ করে বসে থাকিস সারাক্ষণ, ভালই তো ছিলি ওখানে, তুই বরং চলে যা। এভাবেই আবার চলে আসলাম। 

শামস আল মমীন : আমেরিকা আসার কি কোন প্লান ছিল?

শহীদ কাদরী : না কোন প্লান ছিলো না। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে দেখা হলো লন্ডনে। তিনি ছিলেন আমেরিকান। তখন খুব একলা, নিঃসঙ্গ ছিলাম। বিয়ে করে ফেললাম তাকে। প্রথম বিয়ে যেমন না ভেবে করেছি, দ্বিতীয় বিয়েও তেমনি না ভেবে করেছি। তাঁকে আমি বলেছিলাম ‘I will have one home in two continents’. অর্থাৎ আসা যাওয়ার মধ্যে থাকব’। আমেরিকায় তখন আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পরিকল্পনা ছিল আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাবো। তখন সে তার অসুস্থ মাকে দেখতে চাইলো। এভাবেই আমেরিকা চলে আসলাম। 

শামস আল মমীন : তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমেরিকা থেকে যাবেন। 

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ। সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই থেকে যাবো। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করবো, বাংলা বই পড়ব না, বাঙ্গালীদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখব না। নতুন একটা জগতের জন্ম দেবো।

শামস আল মমীন : হঠাৎ এটা প্রতিজ্ঞা করলেন কেন বাংলা বই পড়বেন না, বাঙ্গালীদের সাথে সম্পর্ক রাখবেন না? বুঝলাম, আপনার কয়েকজন পুরোনো বন্ধু আপনাকে কষ্ট দিয়েছে। 

শহীদ কাদরী : মনের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরী হলো, দূর! আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। আমার মনে আছে লাইব্রেরীতে বসে একদিন বই পড়ছিলাম। কলম্বিয়া ইউনির্ভাসিটি থেকে প্রকাশিত Encyclopedia of world literature দেখে মনের মধ্যে ইচ্ছা জাগলো দেখিতো বাংলা সাহিত্যর কিছু আছে কিনা। বাংলা লিটারেচার এর উপর একটা প্রবন্ধ আছে। সেখানে আমার বন্ধুদের মধ্যে শামসুর রাহমানের নাম আছে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম (হাসতে হাসতে)।

শামস আল মমীন : শুধু শামসুর রাহমানের নাম? 

শহীদ কাদরী : শুধু শামসুর রাহমানের নাম। আমি খুব ইমপ্রেস হলাম এবং নিজের জন্য দুঃখও হলো যে আমি হয়তো লিখতে পারতাম, এটা আমি কি করলাম। এখন মনে হয় খুব দেরী হয়ে গেছে, ফেরার উপায় নাই। 

শামস আল মমীন : এটা সত্য যে প্রবাসে এসে ঘাঁটি ঠিক হতে একটু সময় লেগে যায়। কিন্তু আবার পুরনো জগতে সবাই ফিরেও আসে। হুমায়ূন আহমেদ, ইকবাল হাসান এবং আমি নিজেও তার উদাহারণ। সবাই একটা ব্রেক নিয়ে আবার ফিরে আসে, সে বন্ধুর প্ররোচনায় হোক অথবা মনের তাগিদেই হোক। আপনাকে কোন কিছুই স্পর্শ করলো না?

শহীদ কাদরী : পরিবেশেরও অভাব ছিলো। আমার স্ত্রীও এ ব্যাপারে interested ছিলো না। কেউ কেউ আমার স্ত্রীকে বলতো, Do you know your husband is a famous poet of Bangladesh? সে বলতো, Oh, ya-everybody who comes from Bangladesh is a famous person. (এ সময় আমরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি) আমার পরিবেশ আমার পক্ষে ছিল না কখনই। এটাও হয়তো কারণ হতে পারে। 

শামস আল মমীন : চুপচাপেওতো লিখতে পারতেন। ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’র মতো কবিতা যদি এক বসায় লিখতে পারেন। 

শহীদ কাদরী : ওটা একটা আবেগে হয়ে গেছে।

শামস আল মমীন : কফি টপি খেতে খেতে, মানে ধরুন, চুপ করে কফি খেতে গেলেন ঐ সময়টা কবিতা চর্চা করলেও তো হতো। 

শহীদ কাদরী : দেখি কি হয়, চেষ্টা করে দেখতে পারি আবার। 

শামস আল মমীন : মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আপনি যান, সেখানে দেখেন লোকে কবিতা পড়ছে, নতুন পুরনো কবির সাথে দেখা হচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণের সাথে আপনার দেখা হয়েছে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বোস্টনে গিয়ে দেখা করেছে; এদেরকে দেখেটেখেও মাথায় কখনো আসেনি, হেঁয়ালী করে হলেও কিছু লিখি। 

শহীদ কাদরী : অনেক সময় একটু উজ্জীবিত হই তবে সেটা খুব ক্ষীণায়ু (আবার হাসি)। 

শামস আল মমীন : খুব কম হলেও মাঝে মধ্যে দু’একটা নতুন কবিতা দেখা গেছে আপনার। আমার মনে আছে, ৮৬ সালে, (আমার সম্পাদনায়) নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দিগন্ত পত্রিকার জন্য ‘তৃতীয় রাইখের পতনের আগে’ এই শিরোনামে একটা ছোট কবিতা দিয়েছিলেন। এই কবিতাগুলো কি আগের লেখা না কি আমেরিকায় বসে লিখেছিলেন?

শহীদ কাদরী : এখানে বসে কিছু কবিতা যে লিখিনি তা না। সব মিলে একটা বইয়ের মতো হবে হয়তো। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে আছে।

শামস আল মমীন : এগুলো গুছিয়ে গাছিয়ে একটা বইতো করা যেতে পারে। 

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ, গুছিয়ে বসবো। প্ল্যান আছে আমার।

শামস আল মমীন : আপনি যে standard এ এক সময় কবিতা লিখেছেন সে standard এ আর কবিতা লিখতে পারবেন না, এই ভয় কি আপনার কবিতা না লেখার পেছনে কাজ করছে?

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ। কাজ করছে। আমাকে যদি কেউ বলতো আজে বাজে যা ইচ্ছা লেখো, তাহলে হয়তো আমি সাহস পেতাম (আবার সেই অট্টহাসি)। 

শামস আল মমীন : এটাও তো হতে পারে, যেমন শামসুর রাহমান একটা থিমের উপর বেশ কিছু কবিতা লেখেন, সেখানে থেকে ২/১ টা হয়তো ভাল কবিতা হয়… 

শহীদ কাদরী : এই সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবহিত। কিছুটা আলসেমীতো কাজ করে। মাঝে মাঝে নিজেকে বলি, দূর! আর কষ্ট করে লাভ কি, বাদ দাও। কিন্তু আমি এও জানি কষ্ট করলে হয়তো হতো। Mathew Arnold এর একটা কথা আছে, সূর্যের নিচে বসে পাথর ভাঙ্গার চেয়ে কষ্টকর লেখা।

শামস আল মমীন : শুধু বাস্তবতা দিয়ে কবিতা হয় না, একটু ফ্যান্টাসীও থাকে। ধরা যাক, আপনি দেশে থেকেই আরো দশটা কবিতার বই বের হতো। তাহলে আপনার বর্তমান অবস্থান কেমন হতো?

শহীদ কাদরী : পৃথিবীতে যারা প্রধান প্রধান কবি, তাদের কবিতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত ৭/৮টি প্রথম শ্রেণীর কবিতা লিখেছেন যেগুলো টিকবে। যেমন জীবনানন্দ, সুধীন দত্তের ৭/৮টি  প্রথম শ্রেণীর কবিতা আছে Keats এর কয়েকটা odes. সেদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় আমি ৫/৬ টি ভাল কবিতা লিখেছি। 

শামস আল মমীন : আমাদের নামগুলো বলবেন কি?

শহীদ কাদরী : যেমন, ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’, একটা মরা শালিক, আমি কিছু কিনবো না, সঙ্গতি।

শামস আল মমীন : উত্তরাধিকারী? 

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ, এটা একটা ভাল কবিতা। এই কবিতায় আমি যেটা বলার চেষ্টা করেছি সেটাকে ওরা ধার করা কবিতা বলছে… 

শামস আল মমীন : ওরা বলতে আপনি কাদের মিন করেছেন?

শহীদ কাদরী : সমালোচকরা। এই কবিতায় আমি আমাদের গোষ্ঠি হিসাবে historical time-কে define করার চেষ্টা করেছি। আমার জন্ম যখন হয়েছে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। কলকাতায় তখন ব্লাক আউট। আমি যখন জন্মেছি তখন খিজিরপুর ডকইয়র্ডে বম্বিং হয়েছে। আমেরিকান সৈনিকরা তখন কলকাতায় ছিলো। ওরা অনেককে রেপ্ করেছে এসব গল্পও শুনেছি। দাঙ্গা চলছে। এই ব্যাকগ্রাউন্ড-টা আমি ফবভরহব করেছি। ফবভরহব করেছি আমাদের সঙ্গে তিরিশের তফাৎটা। তিরিশের কবিরা জীবনের যেসব যন্ত্রনার কথা বলেছেন, নরকের কথা বলেছেন, নরককে তারা দূর থেকে দেখেছেন, কিন্তু আমাদের জন্ম সেই সময়ে। উত্তরাধিকার কবিতা লেখার পর শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং অনেকেই এই ধরনের কবিতা লিখেছেন।

শামস আল মমীন : ফরহাদ মজহার বলেছেন, শহীদ কাদরী দেশে থাকলে শামসুর রাহমানের যে খ্যাতি এটা হতো না। 

শহীদ কাদরী : না, এটা খুব ভাল কথা। আমি শামসুর রাহমানের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট ছিলাম কিন্তু আমরা পরস্পরকে প্রভাবিত করেছি। এর একটা কারণ হতে পারে, সৈয়দ নুরুদ্দিনের বাসায় তখন সাহিত্যের সাপ্তাহিক একটা আড্ডা হতো। সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আশরাফ আর তরুণদের মধ্যে আমি নিয়মিত হাজিরা দিতাম। সেখানেই অর্থাৎ নুরুদ্দিনের বাসায় Mirror of French poetry বইটা প্রথম পাই এবং প্রথম পড়ি মালার্মে, বোদলেয়ারসহ অনেক ফরাসী কবিদের কবিতা (বুদ্ধদেব তখনো বোদলেয়ার অনুবাদ করেননি)। ওখানেই ব্যাঙ-এর উপর একটা চমৎকার কবিতা ছিল। শামসুর রাহমানকে আমি বললাম, দেখেন একেবারে নতুন ধরনের কবিতা। তখন আমরা ফরাসী কবিতা ঘাটা শুরু করলাম। এবং অনুভব করলাম বাংলা কবিতায় conventional সৌন্দর্য আছে কিন্তু কুৎসিতের কোন উপস্থিতি নাই। যেটা ফরাসী কাব্যে প্রচুর পরিমাণে আছে। ভারতীয় নন্দন সাহিত্য থেকে ফরাসীরা তাদের কবিতায় Grotesque সূচনা করেন। এবং আমরা ভাবলাম Grotesque আমাদের কবিতায়ও আসা দরকার। বুদ্ধদেব এবং জীবনান্দের কবিতায় এর ব্যবহার কিছুটা আমরা দেখতে পাই। আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করেছি এবং প্রোগ্রাম করে লিখেছি। 

শামস আল মমীন : শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি অনেকে লুই আঁরাগের ‘লিবার্টি’ কবিতার সাথে তুলনা করেন কিন্তু আমি তাঁর ‘দুঃখ’ কবিতার সাথে ‘লিবার্টি’ কবিতার মিল বেশী পাই। 

শহীদ কাদরী : আপনি যা বলেছেন এটা সত্যি কথা। ‘দুঃখ’ কবিতাটা যখন প্রকাশ হলো তখন বুদ্ধদেব বসু বললেন, লুই আঁরাগের ‘লিবার্টি’ কবিতার প্রভাব আছে এই কবিতার উপর। ‘লিবার্টির’ সাথে ‘স্বাধীনতা তুমি’র কোন যোগাযোগ নাই।

শামস আল মমীন : ঐ সময়ে প্রচুর ফরাসী কবিতা পড়ার কারণে কি এই প্রভাব পড়েছে বলে আপনার মনে হয়? 

শহীদ কাদরী : তাতো কিছুটা হবেই। রবীন্দ্রনাথ এর উপরও এরকম অনেকের প্রভাব আছে।

শামস আল মমীন : আজি হতে শতবর্ষ পরে… এই পঙক্তিটি ইংরেজী থেকে নেয়া। 

শহীদ কাদরী : আমি জানি। 

শামস আল মমীন : আমরা রবীন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করি না। কিন্তু কনটেপেম্পারীদের একটু বেশী বকাঝকা করি মনে হয়। 

শহীদ কাদরী : এটা সমালোচকদের ব্যাপার। অনেকে সময় নিজের অজান্তে অবচেতনভাবে অন্যের পঙক্তি, চিন্তা ভাবনা চলে আসে। কিন্তু দেখতে হবে, কিভাবে আসছে। যেমন জীবনানন্দর ‘হায় চিল সোনালী ডানার চিল…’ এটা ইয়েটস্-এর একটা কবিতার অনুবাদের মতই মনে হয়। কিন্তু এটা ইয়েটস-এর কবিতার চেয়ে বেটার হয়ে গেছে।

শামস আল মমীন : রাজনীতিকে কবিতায় ঢুকতে দেবো না, মনে মনে এরকম প্রতিজ্ঞা করেই শামসুর রাহমান প্রথমদিকে কবিতা লেখেন। কিন্তু পরে তিনি প্রচুর রাজনীতিনির্ভর কবিতা লিখেছেন এবং খ্যাতিও পেয়েছেন। 

শহীদ কাদরী : এই সমস্যায় আমরাও ভুগেছি। এই সময়ে আমরা প্রত্যেকেই বুদ্ধদেবীয় নন্দনতত্বে অর্থাৎ শিল্পের জন্য শিল্প এই আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলাম। তখন আমরা মনে করেছিলাম রাজনীতি স্পর্শ করলে কবিতার পবিত্রতা নষ্ট হয়। এরকম একটা ধারণা দীর্ঘদিন আমাদের মধ্যে ছিল। ক্রমশ্য আমরা এখানে থেকে বেরিয়ে এসেছি।

শামস আল মমীন : আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন, বদ্ধুদেব বসু এক প্রবন্ধে, কিছু শব্দকে আধুনিক কবিতা থেকে বাতিল করে দিয়েছিলেন (প্রবন্ধটি তাঁর কোন গ্রন্থে প্রকাশ করেননি)। পরে রবীন্দ্রনাথের উপর কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি এসব শব্দকে আবার নিজেই ব্যবহার করেছেন এবং পরে স্বীকার করেন যে, কোন শব্দ একেবারে বাতিল হয়তো সম্ভব নয়… 

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ, আমি পড়েছি এই প্রবন্ধ। এবং আমরাও এক সময় এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। সেটা হচ্ছে যে, শুদ্ধ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করব না। প্রমথ চৌধুরী শুরু করলেন চলতি ক্রিয়াপদ। একবার চলতি ক্রিয়াপদ ব্যবহার করলে আর শুদ্ধ ক্রিয়াপদের মিশ্রণ ঘটাবো না। কিন্তু দেখা গেলো সম্পূর্ণভাবে বাদ দিলে ধ্বনিগতভাবে কিছু ক্রুটি থেকে যায়। একটা কথা আছে, শব্দের নিজস্ব কোন গুণ নেই। শব্দ কিভাবে ব্যবহৃত হলো তার উপরে তার গুণ পরিবর্তিত হয়। কিছু শব্দ বাদ দিলেই যে লেখা রিচ হবে এমন কোন কথা নেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব এখানেই যে নতুন করে আবার শুদ্ধ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে দেখালেন যে এর কাব্যিক সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি।

শামস আল মমীন : আল মাহমুদ এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রফিক আজাদের সমগ্র থেকে একট পঙক্তিও খুঁজে পেলাম না যাকে কবিতা বলা যায়।’ ব্যাপারটা আমার কাছে বেশী বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে, আপনার মতামত কি?

শহীদ কাদরী : আমার কাছেও তাই মনে হয়। এটা তাঁর চিরকালের ব্যাপার। তাঁর পক্ষ্যে অন্যকে স্বীকৃতি দেওয়া খুব কঠিন কাজ। এক ধরনের লেখককে দেখেছি যাদের কাছে অন্য লেখকদের কোন অস্তিত্বই নেই। আল মাহমুদ তাদের মধ্যে একজন।

শামস আল মমীন : রফিক আজাদের কিছু ভালো কবিতা আছে এটা তো অস্বীকার করা যায় না। 

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ষাট এবং উত্তর ষাটের কবিদের মধ্যে রফিক আজাদ একজন তাৎপর্যপূর্ণ কবি এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে একটা জিনিস প্রচলিত আছে, কাউকে স্বীকৃতি দিলে আমার যেন ঘাটতি পড়ে যাবে।

শামস আল মমীন : ফরহাদ মহজার বলেছেন, রফিক আজাদ, শামসুর রাহমানের চেয়ে ভালো কবিতা লিখেছেন। রফিক আজাদের কবিতার মধ্যে যে Prophetic Insight আছে তা শামসুর রাহমানের কবিতায় নেই। 

শহীদ কাদরী : ঐ লেখাটা আমি পড়েছি। Prophetic Insight কথাটার মানে কি ফরহাদ মজহার মনে হয় তা বোঝেন নাই। 

শামস আল মমীন : এরকম মন্তব্য পাল্টা মন্তব্যে নতুন লেখকেরাতো খুব দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগবে। 

শহীদ কাদরী : নিজের পাঠ অভিজ্ঞতা, নিজের রুচির উপর নির্ভর করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ উপায়। লেখকেদর মধ্যে ঈর্ষাটা প্রবল থাকে এবং অনেক সময় ওদের মন্তব্য গ্রহণযোগ্য না। আমরা শুনেছি, সুধীন দত্ত জীবনানন্দ দাসকে কবি মনে করতেন না। সুধীন্দ্রনাথের কাব্যাদর্শ ছিল ধ্রুপদী-ক্ল্যাসিকাল। তাঁর কাব্যাদর্শের কাছে জীবনানন্দকে অনেক শিথিল মনে হয়েছে। অতএব একজন লেখকের সম্বন্ধে আরেকজন লেখকের মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।

শামস আল মমীন :‘কবিদের মান অনুসারে নিয়েছি বেশী বা কম কবিতা’ আধুনিক বাঙলা কবিতার ভূমিকায় এ কথা বলেছেন হুমায়ূন আজাদ। এবং সেখানে আপনার কবিতা আছে ৭টি, মহাদেব সাহার ৪টি আর সিকদার আমিনুল হক এর মাত্র দুটি। প্রশ্ন, মহাদেব সাহা কি সিকদার আমিনুল হকের চেয়ে উঁচু মানের কবি? 

শহীদ কাদরী : না, না। একটা সংকলন হচ্ছে সংকলন কর্তার কাব্যিক বোধ এবং রুচির প্রতিফলন। এই সংকলনে আমরা তাঁর কাব্যবোধ, কাব্যাদর্শ এবং রুচি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। সেটা যে আমার কাব্যবোধ এবং রুচির সাথে মিলবে এমন কোন কথা নেই।

শামস আল মমীন : হুমায়ূন আজাদ নিজের যতগুলো কবিতা নিয়েছেন অন্য কেউ এরকম একটা সংকলন করলে তাঁর এতগুলো কবিতা নিতেন বলে আমার সন্দেহ হয়। 

শহীদ কাদরী : কথাটা ঠিক। আমি যদি সংকলন করি সেটা অন্য ধরনের হবে।

শামস আল মমীন : আপনার সংকলনে হুমায়ুন আজাদ, সিদকার আমিনুল হক এবং মহাদেব সাহাকে আপনি কিভাবে স্থান দিতেন। 

শহীদ কাদরী : হুমায়ূন আজাদ এবং সিকদারের কবিতা আমি মহাদেব সাহার চেয়ে বেশী নিতাম। 

শামস আল মমীন : অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিকে তিনি তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য এই সংকলন থেকে বাদ দিয়েছেন। আল মাহমুদ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমি মনে করি, একজন কবিকে মূল্যায়ন করা উচিত তাঁর কাব্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য নয়। 

শহীদ কাদরী : আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। এটা আল মাহমুদের প্রতি অবিচার কি না জানি না, তবে সংকলন হিসাবে এটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সৈয়দ আলী আহসানের কবিতাও নেয়া উচিত ছিল। এজরা পাউন্ড এক সময় ফ্যাসিবাদ প্রচার করেছেন, তাই বলে তো তার রচনার উৎকর্ষতাকে আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না।

শামস আল মমীন : হুমায়ূন আজাদ রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক কবি মনে করেন না। 

শহীদ কাদরী : রবীন্দ্রনাথ আধুনিক কবি। আধুনিকতারও অনেক মাত্রা আছে। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা তিরিশের কবিদের আধুনিকতা থেকে ভিন্ন। 

শামস আল মমীন : তাঁর ভাষায় রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক কবি, কোনমতেই আধুনিক নন। 

শহীদ কাদরী : মজার কথা, আধুনিক কবিতার আন্দোলন হিসাবে শুধু হয়েছিল এ্যান্টি রোমান্টিক কবিতার মুভমেন্ট। আজকে দেখতে পাচ্ছি আধুনিক কবিতাও রোমান্টিক।

শামস আল মমীন : উত্তরাধুনিক কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

শহীদ কাদরী : উত্তরাধুনিক কবিতার কনসেপ্টটা আমার কাছে খুব ক্লিয়ার না। এটা আধুনিকতারই একটা নতুন মাত্রা। আমার মনে আছে বিশ বছর আগে যাঁদের লেখা আমি আধুনিক হিসাবে পড়েছি আজকে তাদেরকে উত্তরাধুনিক বলা হচ্ছে। 

শামস আল মমীন : মডার্নিজম টার্মটা আসে কবিদের কাছ থেকে ১৯১০-এর দিকে আর পোষ্ট মডার্নিজম আসে সমালোচকদের কাছ থেকে ৫০-৬০ দশকের দিকে। বাংলাদেশেও অনেক কবি নিজেদেরকে উত্তরাধুনিক কবি হিসেবে চিহ্নিত করছেন। থিওরীতে এঁরা যতো সচল, লেখায় সেরকম আলাদা কিছু দেখা যাচ্ছে না। আপনার কি মনে হয়?

শহীদ কাদরী : থিওরীতেও পোষ্ট মডার্নিজম খুব সুস্পষ্ট না। আমি মডার্ণ বলতে বুঝি পোষ্ট মেডিএভেল। মধ্যযুগীয় মনটা হচ্ছে রিলিজিয়াস মাইন্ড বা বিশ্বাসী হৃদয়, যা রবীন্দ্রনাথে আছে। মডার্ণ মাইন্ড হচ্ছে সেটাই যার উপর বিজ্ঞানের অভিঘাত রয়েছে। মডার্ণ মাইন্ড হচ্ছে স্কেপটিকাল সন্দেহবাদী। কোন কিছুই বিশ্বাস করতে পারে না সবকিছু প্রশ্ন করে। ফলে বিশ্বাসীর মনে যে স্থিরতা এবং শান্তি আছে আধুনিক মনে সেই স্থিরতা বা শান্তি নেই। আধুনিক মন কোন কিছুকে পুরোপুরি গ্রহণ করে না। যার ফলে আধুনিক সাহিত্যে মানুষের অন্ধকার দিকটা এসেছে।

শামস আল মমীন : নম্বই দশকের কবিরা কেউ সরাসরি স্বীকার না করলেও নীরবে তাদের মধ্যে অগ্রজদের অস্বীকার করার একটা অঙ্গীকার আছে। 

শহীদ কাদরী : আমরাও চাই না তারা আমাদেরকে অনুসরণ করুক। আম এবং আতাফলের মধ্যে তফাৎ আছে। আমি এজন্যই আতাফল খাবো যে আম খেতে ইচ্ছা করছে না। প্রতিটি লেখকই একটা নতুন কোন ফল হবে এবং এজন্যই আমরা তার স্বাদ গ্রহণ করবো। 

শামস আল মমীন : ফরহাদ মজহারের ‘এবাদতনামা’কে সমালোচক মুস্তফা সায়ীদ বলেছেন, বাংলা সাহিত্যের অট্টহাসি। অন্যদিকে সলিমুল্লাহ খান বলছেন, ‘এবাদতনামা’ যদি বাংলা সাহিত্যের অট্টহাসি হয়ে থাকে তাহলে এখন আমাদের অট্টহাসিরই দরকার। 

শহীদ কাদরী : ‘এবাদতনামা’ অট্টহাসি হয়েছে এটা আমি বলব না। তবে আমার মতে, এগুলো খুব সামাজিক অকাব্যিক বক্তব্য, যেটা গদ্যেও লেখা সম্ভব ছিল। একটা কথা আছে, যে কথা গদ্যে বলা যায় সেকথা পদ্যে বলার দরকার কি? এখানেই গদ্যে পদ্যে তফাৎ। তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন সেটা বহু ব্যবহৃত ভাষা। ফররুখ আহমদ এ ভাষা ব্যবহার করেছেন। তালিম হোসেন এরকম কবিতা লিখেছেন। বাঙলা ভাষা এবং ধ্বনির উপর নির্ভর করে আমার যে শ্রুতি বা কান তৈরী হয়েছে সেই কানে খুব নন- মিউজিকাল ঠেকেছে। কবিতার ভাষা হিসাবে তা গ্রহণযোগ্য না। 

শামস আল মমীন : সলিমুল্লাহ খান বলছেন, ‘এবাদতনামা’ হচ্ছে পোষ্ট মডার্ণ কবিতার উজ্জ্বল উদাহরণ, যেখানে ফরহাদ মজহার সজ্ঞানে আধুনিকতাকে বর্জন করেছেন এবং আমাদের ট্রাডিশনকে গ্রহণ করেছেন। 

শহীদ কাদরী : এটা হচ্ছে পৃথিবী ট্রাডিশন। এটা আমাদের সব সময়ই ছিল। এই ট্রাডিশন সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই, এটা খুবই সীমিত। এটার উপর ভিত্তি করে জটিল কথা বলা যায় না। এর উদাহরণ হচ্ছে ‘এবাদতনামা’। এর কবিতাগুলো হচ্ছে সিম্পল ষ্টেটম্যান। আমরা যে যুগে বাস করছি, এই যুগে এতো সিম্পল ষ্টেটম্যান নাবালক সুলভ মনে হয়। 

শামস আল মমীন : আধুনিক কবি হিসাবে সিকদার আমিনুল হক কতখানি সার্থক? 

শহীদ কাদরী : সিকদারের কবিতা আমার ভালোই লাগে। তাঁর কবিতার আঙ্গিক এবং শৈলী যথেষ্ট নিপুণ। তাঁর বলার বিষয়টা খুবই সীমিত। তাঁর অধিকাংশ কবিতার থিম হচ্ছে নারী বাসনা। অন্য কোন বিষয়কে তিনি স্পর্শ করতে পারেননি। এটা তাঁকে কবি হিসাবে সীমিত করছে।

শামস আল মমীন : আধুনিক কবিতা কি জীবন ঘনিষ্ঠ না জীবন বর্জিত। 

শহীদ কাদরী : পৃথিবীর সব কবিতাই জীবন ঘনিষ্ট। 

শামস আল মমীন : বাংলা কবিতা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায় এ জন্য আধুনিক কবিতার ধারাটা এখন আর Flourish করছে না। এরকম একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়।

শহীদ কাদরী : মধ্যবিত্ত নগরবাসীরাই আধুনিক কবিতা লিখছেন। আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক যে জীবন তার সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই। মানুষের মনের মৌলিক যে আবেগ যেমন প্রেম, মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা, জন্ম, বিরহ এসব বিষয় এদের কবিতায় আছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এদের কবিতা জীবন বিমুখ কারণ ওদের কবিতায় লাঙ্গলের কথা হয়তো নেই, চাষবাস কিম্বা কুটিরের কথা নেই কিন্তু জীবনের গভীরতর কথাগুলো তাঁদের কবিতায় আছে।

শামস আল মমীন : নব্বই দশকের কবিতা আপনার কাছে কেমন লাগছে? তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে বলে মনে হয়? কোন পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন? 

শহীদ কাদরী : পরিবর্তন তো হচ্ছে কিন্তু ঠিক দশক হিসাবে সুস্পষ্ঠভাবে মনে নেই। আমাদের সাথে সময়, অভিজ্ঞতা, প্রেক্ষিত সবই ভিন্ন সৈনিক থেকে তাঁদের কবিতা আমাদের থেকে আলাদা, তাতে কোন সন্দেহ নাই। নব্বই দশকের বেশ কয়েকজনার লেখা বই আমি পড়েছি, এদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য রয়েছেন যেমন, মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, শামস আল মমীন, মারজুক রাসেল, চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, কামরুজ্জামান কামু, হাসান আল আব্দুল্লাহ এবং অনেকের নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। নব্বই দশকে বেশ কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি রয়েছেন বাংলা ভাষায়।

শামস আল মমীন : যাঁদের নাম আপনি বললেন এঁদের কাউকে কি আপনার ব্যতিক্রম মনে হয়েছে?

শহীদ কাদরী : (কিছুটা সময় নিয়ে) তরুণ কবিরা যখন লেখে তখন কাউকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা খুব কঠিন হয়ে ওঠে, এরা প্রত্যেকেই বেশ প্রতিশ্রুতিশীল এবং ভবিষ্যৎ কাব্য প্রয়াসকে আমি আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করবো।

শামস আল মমীন : এবার একটু অন্যদিকে ফিরে যাই। আমি আমেরিকার কালো কবিদের বেশ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করি এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই। হার্লেম রেনেসাঁর কথা আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এ সময়ের (১৯২০…) কবিদের লেখায় Black culture. Black pride, Black power, separatist idealogy. এবং What is symbol of evil. এইসব থিম প্রবলভাবে তাঁদের কবিতায় এসেছে এবং তাঁরা নিজেদের আমেরিকার মূলধারার কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন। এই বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন ছিল কি?

শহীদ কাদরী : দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এর প্রয়োজন হয়তো কিছুটা ছিল। আবার এটা তাঁদেরকে কিছুটা সীমিতও করেছে। তাদের লেখাগুলো শুধুমাত্র Blach experience in America হয়ে গেছে। এদের মধ্যে আমিরি বারাকা, মেলভিন টলসন ethnicity অর্থাৎ Blackness থেকে transcends করে মুল ধারার কবি হয়ে ওঠেন। Black poets দের নিয়ে কিছু এন্থোলজি বাজারে আছে এগুলো যেমন ইন্টারেন্টিং তেমনি লিমিটেড। 

শামস আল মমীন : ল্যাংষ্টন হিউজ কিন্তু প্রথম থেকেই ব্লাক থিমের উপর কবিতা লেখেও মূলধারায় স্থান করে নিয়েছিলেন।

শহীদ কাদরী : ল্যাংষ্টন হিউজ যখন কবিতা লেখতেন তখন তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তখন পৃথিবীতে কমিউনিষ্ট কবিরা সাম্যবাদী আদর্শে, শোষনের বিরুদ্ধে, নতুন সমাজের স্বপ্নে কবিতা লিখতেন এবং এটার মধ্যে নতুনত্ব ছিলো। তিনি যে শুধুমাত্র কালোদের কথা বলেছেন তা না। তিনি তৃতীয় বিশ্বের শোষিত মানুষের কথা বলেছেন এবং তার কবিতার ডিমেনশন অন্যান্য ব্লাক কবিদের চেয়ে অনেক বেশী ছিলো। পাবলো নেরুদা, লুই আঁরাগ, বিষ্ণু দে এদের পাশাপাশি আমরা ল্যাংষ্টন হিউজের কবিতা পড়েছি একজন বড়ো মার্কসিষ্ট কবি হিসাবে । 

শামস আল মমীন : ৫০-৬০র দশকে দেখা গেছে Gwendolyn brooks, Melvin Tolson, Rebert Hayden এর মতো প্রতিষ্ঠিত ব্লাক কবিরা existing modern style এর দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাহলে কি এটা বলায় যায় যে, তাঁরা মূলধারার আমেরিকান কবিদের Recongition চাচ্ছিলেন?

শহীদ কাদরী : ল্যাংষ্টন হিউজ, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়াম এক ধরনের কবিতা লিখেছেন এবং ওদের সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের কবিতা লিখেছেন টি, এস এলিয়ট। সমস্যা হচ্ছে, কোন কবিদের আমরা মুলধারার কবি বলবো। অনেকেই মনে করেন উইলিয়াম কার্লোস, উইলিয়াম এজরা পাউন্ড, বেরীম্যান। এলিয়ট বহুদিন ইংরেজী কবিতায় আধিপত্য করেছেন। কাজেই মূলধারাটা শনাক্ত করাও কঠিন কারণ এটা অনবরত বদলায়। 

শামস আল মমীন : টলসন কালো কবিদের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতায় (১৯৪৯) বলেন, The standard of poetry has changed completely. Negroes must become aware of this. This is the age of Eliot. 

শহীদ কাদরী : সেটাতো বদলে গেছে। এলিয়ট ’র যুগ আর নেই। এলিয়টের পরে আসে ডিলান থমাস। 

শামস আল মমীন : একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, বর্তমান কালো কবিরা যেমন মায়া এঞ্জেলো, রিতা ডাভ, এ্যাথরিজ লাইট, নিকি জিওভান্নি সবার লেখায় ক্ষোভ আছে, যন্ত্রণা আছে কিন্তু হার্লেম রেনেঁসার কবিদের পূর্বসুরীদের মতো এঁদের কণ্ঠস্বর অতো সোচ্চার নয়। 

শহীদ কাদরী : প্রথম পর্যায়ে তাঁরা নিজেদের existance কে establish করেছে এবং সেটা খুব সোচ্চার। সেই পর্যায়টা অতিক্রম করার পর এখন তাঁরা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই মূলধারার স্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

শামস আল মমীন : বর্তমান কবিরা প্রথম থেকেই মূলধারার দিকে ধাবিত। কিন্তু হার্লেম রেনেসাঁর কবিরা তা করেননি। তারা নিজেদের ব্লাক পোয়েট হিসাবেই establish করার চেষ্টা করেছেন। 

শহীদ কাদরী : এছাড়া কোন উপায় ছিলো না। কারণ তখনকার শ্বেতাঙ্গ সমাজ কালো লেখকদের প্রতি সংস্কারবদ্ধ অনিহায় ডুবে ছিলো। এই অনীহাকে ভাঙ্গতে সাহিত্যেও তাদের ব্লাক পাওয়ারের আন্দোলন করতে হয়েছে। ব্লাক পাওয়ারের আন্দোলন একটা আঘাতের মতো এসেছে। এখন সময় এসেছে, শিল্পের কৌশল অবলম্বন করে শৈল্পিক আবহ সৃষ্টি করা।

শামস আল মমীন : সীমাস হীনি সম্প্রতি Bewolf  এর আধুনিক অনুবাদ করেছেন। আপনি কি মনে করেন চর্যাপদ, ময়মনসিংহ গীতিকা এগুলোরও আধুনিক অনুবাদ হওয়া উচিত। 

শহীদ কাদরী : এটা চেষ্টা করে দেখলে মন্দ হয় না। old English আর মডার্ণ ইংলিস এর তফাৎটা খুব বেশী হয়ে গেছে। এবং দেখা গেছে, মডার্ণ ইংলিশ এতো রিচ যে old English থেকে অনুবাদ করলেও তেমন লুস্ করে না। কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকার যে ধ্বনি, আধুনিক বাংলায় অনুবাদ করলে তা হয়তো আর থাকবে না। যেমন- 

‘কোথা পাইবাম কলস কন্যা কোথা পাইবাম দড়ি 

তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি।’

এখানে যে ধ্বনির সাংঘাতিক সৌন্দর্য আছে চলতি বাংলায় তা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

শামস আল মমীন : শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এবং আপনার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগিয়েছে কিন্তু সেগুলোর ইংরেজী অনুবাদ হওয়ার পর ইংরেজী ভাষার পাঠকদের সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা কি অনুবাদের দুর্বলতা নাকি অন্য কোন কারণ আছে?

শহীদ কাদরী : আমার মনে হয় অনুবাদের দুর্বলতা। যিনি অনুবাদ করছেন তাঁর কাব্যিক ক্ষমতা সেই ভাষা শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর তুল্য হতে হবে। এবং সে জন্যই বুদ্ধদেব বলেছিলেন, শেক্সপিয়ারের সনেট অনুবাদ করার জন্য বাংলা ভাষায় একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি সুধীন দত্ত। প্রথম শ্রেণীর একজন কবির লেখা যদি তৃতীয় শ্রেণীর একজন গদ্য লেখক অনুবাদ করেন তার পরিণাম তো শোচনীয় হবেই।

শামস আল মমীন : তাহলে আপনি বলছেন যে একজন গদ্য লেখক যদি কবিতা অনুবাদ করেন সেই অনুবাদ মূলের কাছাকাছি হবে না? 

শহীদ কাদরী : বাংলা কবিতা যিনি ইংরেজীতে অনুবাদ করবেন তাকে ইংরেজী ভাষার একজন প্রথম শ্রেণীর কবি হতে হবে। 

শামস আল মমীন : বাংলাদেশে যাঁরা কবিতার অনুবাদক, যেমন কবীর চৌধুরী, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, মনজুরুল ইসলাম এঁরা কেউই কবি নন। আমি কবীর চৌধুরীকে একবার বলেছিলাম, একজন কবির পক্ষ্যেই কবিতা অনুবাদ সম্ভব, গদ্য লেখকের জন্য এটা হবে খুবই কঠিন কাজ। 

শহীদ কাদরী : ষ্টিফেন মালার্মের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন হাক্সলি, তিনি কবি নন একজন ঔপন্যাসিক কিন্তু খুব ভাল অনুবাদ করেছিলেন। এটাও সম্ভব কিন্তু সহজ নয়। 

শামস আল মমীন : কবিতায় এলিয়টের দুর্দান্ত দাপটের কথা মনে রেখে কবি Macleish John Peale Bishop কে এক চিঠিতে লিখেছিলেন After Eliot’ it was impossible to write anything except `more Eliot’ রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতায় কি এরকম একচ্ছত্র আধিপত্য কারো আছে বলে মনে হয়? 

শহীদ কাদরী : জীবনানন্দ দাশ।

শামস আল মমীন : আপনার কাছ থেকেই জানলাম, বহু বছর পর আপনি আপনার বড় ভাইকে ফোন করেছেন, দেশে ফেরার জন্য মনের দিক থেকে কোন তাগিদ অনুভব করছেন? 

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ। দেশে যাওয়ার জন্য আমি এখন রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছি।

শামস আল মমীন : দেশে গিয়ে আবারও কবিতা লিখবেন এ রকম কোন ইচ্ছা আছে আপনার?

শহীদ কাদরী : কবিতা লিখব না এরকম কোন প্রতিজ্ঞা করিনি। কবিতা লিখব এরকম প্রতিজ্ঞাও করিনি। যদি স্বতস্ফূর্তভাবে আসে তাহলে লিখব। 

শামস আল মমীন : বুদ্ধদেব বসু তার সমকালীন কবিদের কবিতা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা লিখেছেন। আমাদের দেশে কাউকে এরকম চোখে পড়ে না। আপনার সমকালীন কবিদের কবিতা নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা আছে কি?

শহীদ কাদরী : সমকালীন কবিদের নিয়ে লিখতে অনেক অসুবিধা আছে। সমকালীন কবিরা সাধারণত বন্ধু বান্ধব হয়। সব সময় বন্ধু বান্ধবদের কবিতা নিয়ে উচ্চ ধারণা ব্যক্ত করা সম্ভব না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বন্ধু বিচ্ছেদের সম্ভাবনাই বেশী। কে কতো ভাল লিখলো না লিখলো এই মূল্যায়নের চেয়ে জীবনে বন্ধু বান্ধবের সাথে সুসম্পর্ক অনেক বেশী মূল্যবান। তবে আমার ইচ্ছা আছে শামসুর রাহমানের কবিতার উপর একটা প্রবন্ধ লেখার। 

শামস আল মমীন : কবি আবুল হোসেন আপনাকে কটাক্ষ করে একটা কবিতা লিখেছেন এবং আপনি তা পড়েছেন। এ সম্বন্ধে কি আপনার কিছু বলার আছে?

শহীদ কাদরী : ওটাকে কবিতা হিসাবে গ্রাহ্য করা যায় না। তথ্যেও অনেক ভুল আছে। 

শামস আল মমীন : বাংলা ভাষার কবিতাপ্রেমী পাঠকদের আপনি কি এমন কিছু জানাতে চান যা আমি আপনাকে  জিজ্ঞেস করিনি অথচ আপনার বলতে ইচ্ছে করছে? 

শহীদ কাদরী : এমন কোন বিশেষ বক্তব্য নেই। তবে এটুকু বলব যে, কবিতা পাঠে চিত্তশুদ্ধি ঘটে এবং এখনও আমি কবিতা পড়ি। আমি পাঠকদেরকে বলবো কবিতাপাঠকে প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে। 

শামস আল মমীন : যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। আবার কবিতা লিখবেন এই আশা করছি। সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। 

শহীদ কাদরী : তোমাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য: