আয়শা আল-কাবি’র চারটি অণুগল্প

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

http://www.banipal.co.uk/images/contributors/contributor_20110915170353_1.jpg

আয়শা আল-কাবি আমিরাতের এক গল্পকার, চিত্রশিল্পী ও অনুবাদক। কর্মজীবনে তিনি আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়, আরব আমিরাত কমিশন ফর ইউনেস্কো ও আবুধাবি টিভিতে কাজ করেছেন। ২০১১ সালে তিনি তাঁর বই বাড়ির বিড়ালদের জন্য কোনো সান্ত¦না নেই এর জন্য ‘সাহিত্যে আমিরাতের নারী’ পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর ছোটগল্পের দুটি বই, আন্তর্জাতিক ছোটগল্পের একটি অনুবাদ বই ও কবিতার একটি অনুবাদ বই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান গল্পগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জন পীট। 

আয়শা আল-কাবি’র চারটি অণুগল্প

ভাষান্তর: হাসিনুল ইসলাম

বাড়ির বিড়ালদের কোনো বিশ্রাম নেই

তার ছোট্ট বাচ্চাকে বাইরে খেলতে পাঠিয়ে সে তার পুরুষের চারদিকে চক্কর দিচ্ছিল, তখন তার চোখেমুখে বেশ প্রেমভাব। ওর পিঠের কোমল চুলের জঙ্গলে হাত বুলাচ্ছিল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে মিউ মিউ করল, আর লেজটা নাচিয়ে চলল। ওর ফুলে থাকা পেটে মাথাটা গুঁজে খুব প্রেমাদরে ঘষতে থাকল। নিজেই নিজের গরগরানির আওয়াজ শুনল।

সে মধ্যস্থতা করল…

এরপর সে পরম আবেগে উষ্ণ জিহ্বা দিয়ে ওর লেজ চাটতে থাকল। ও ঘুম থেকে জেগে উঠল, বিরক্ত হল, পায়ের থাবা ছড়িয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল, আর বলল: “তাহলে রাস্তার বিড়ালদের জন্য তুমি কি রেখেছ?”

একথা বলে সে মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তার দিকে এগোল।

একটি স্মৃতিচিহ্ন

কানের দুলটা খুব সাধারণ হলেও, এটা খুব সুন্দর। অশ্রুবিন্দুর আকারে এটা একটা ক্রিস্টাল বিন্দু। তবে এর স্বচ্ছ চেহারা বা হালকা ওজন, কোনোটাই এর বিশেষত্ব ছিল না যার জন্য একে এত ভালবাসা হতো। আসলে এটা ছিল তার জীবনের সবচে বেশি ভালবাসার মানুষ, তার প্রেমিক প্রবরের দেওয়া উপহার। তার চুলে যখন বিউটিশিয়ানের হাতের টান পড়ল, তখন কিভাবে যেন দুলটা খুলে গেল। এটা তার গায়ে চড়ানো গাউন বেয়ে গড়িয়ে এসে চেয়ারের পাশে মাটিতে পড়ে গেল। বিউটিশিয়ান কফির কাপ নেওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করলে দুলটা তার স্যান্ডেলের তলায় আটকে গেল। সেই মহিলা সেলুন থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সি থেকে বেরোনের সময় সে তার স্যান্ডেলটা গাড়ির মেঝেতে থাকা মাদুরে ঘষে নিতে দুলটা সেখানে খুলে গিয়ে সেখানেই কয়েক ঘন্টা পড়ে থাকল। এরপর আরেক ব্যক্তি বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সিতে উঠলে দুলটা তার নজরে পড়ল। দুলটা তাকে এমনভাবে আকর্ষণ করল যে সে সেই দেশ প্রথমবার ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দুলটা তার কাছে রাখতে চাইল। দেশে ফেরার পর কোনো একদিন লোকটার স্ত্রী যখন দুলটা তার অফিসের ডেস্কের ড্রয়ারে দেখতে পেল, মহিলা সেই ট্যাক্সির কাহিনী কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না। সে কল্পনা করল, দুলটা আসলে সেই নারীর যার সাথে তার স্বামী সেই দেশের কোনো হোটেলে সময় দিয়েছিল, আর মেয়েটা তার দুল বালিশে ফেলে চলে গিয়েছিল। তার স্বামী নিশ্চয় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তখন সেই দুল রেখে দিয়েছে। তাদের দুজনের মাঝে ঝগড়া অনেকদূর গড়াল, একসময় মহিলা রাগের চোটে দুলটাকে এক ড্রেনে ছুড়ে ফেলে দিল যেন তার স্বামীর কাছ থেকে ওটার সব স্মৃতি সারা জীবনের জন্য মুছে যায়।

দুলটার মূল মালিক আজো সেই বিউটি পার্লারে গেলে সেখানকার মেয়েদেরকে দুলটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে, যদি তারা সেটি কখনো পেয়ে থাকে। দুলটা ছিল অশ্রুবিন্দুর আকারের।

ট্যাপ ও সিঙ্ক

ট্যাপ সিঙ্ককে বলল:

“তোমার কাজটা কি মামুলি, দেখো, বেসিনে পানি ধরে রেখে সেটা বের করে দেওয়া”

সিঙ্ক রেগে উঠে উত্তর দিল:

“তাহলে তুমি মনে করছ, লোকেরা আমাকে ছাড়াই তোমার কাছে সবকিছু পরিস্কার করবে? তোমার বিন্দু বিন্দু পানি সবকিছু নোংরা করে দিবে।”

ট্যাপ তখন বিদ্রুপাত্মকভাবে হেসে বলল, “কি বোকা তুমি! তুমি কি বুঝছ না, তুমি আমার উপর কতটা নির্ভরশীল? আমি না থাকলে তোমার কোনো মূল্যই নেই।”

“তোমার ঔদ্ধত্বের আসলেই সীমা নেই! তোমাকে যেমন আমার প্রয়োজন, তেমনি আমাকেও তোমার প্রয়োজন।”

এরপর ট্যাপটা রাগে গরগর করতে করতে তার মাথাটা দুবার ঘুরিয়ে এমন মোচড় দিল যে প্যাচটা কেটে গেল। সে বলল,“এখন তুমি বুঝবে, আমার মূল্য কতখানি। আমাকে ছাড়া তোমার কতটুকু চলে তা এবার দেখবে।”

পরবর্তী দিনগুলিতে লোকজন সেই বেসিনের দিকে এগোল না। কেউ কেউ আবার রাগে লাথিও মারল। এক সপ্তাহ পর এক লোক আসল, তার হাতে সব যন্ত্রপাতি। লোকটা প্রায় এক ঘন্টা কাজ করল, এরপর সেই উদ্ধত ট্যাপটাকে তার ব্যাগের অন্ধকারে পুরে নিল। সিঙ্কটা সেখানেই থাকল, আর লোকজন নতুন ট্যাপটা থেকে পানি নিতে চারপাশে ভিড় জমাল।

এক প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন

ছেলেটি প্রথমবার যখন ট্রাঙ্কটা দেখল, তার চোখ ছানাবড়া হয়ে পড়ল। ট্রাঙ্কটা বলতে গেলে লুকান ছিল, তার দাদাই ওটা লুকিয়ে রেখেছিল যেন। আসলে ছেলেটার ঘড়িতে সমস্যা দেখা দিলে তার দাদা যখন ওটা ঠিক করে দেবে বলে কথা দিয়েছিল তখনই ওই ট্রাঙ্কটা থেকে ঘড়ি মেরামতের যন্ত্রপাতি বের করার প্রশ্ন আসল। ছোট ছেলেটা ট্রাঙ্কের ভেতর হাত ডুবিয়ে হাতড়ে হাতড়ে একবারে তলায় কিছু একটা ধরতে পারল।

সে তার দম আটকে আসা থামিয়ে বলল,“এটা কি, দাদা?”

“এটাকে পকেট ঘড়ি বলে,” তার দাদা বলল। “আমার দাদা যে’বার প্রথম ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন, সে’বার তিনি এটা নিয়ে এসেছিলেন।”

তিনি সেই গোলাকার, খোদাই করা বাক্সটি খুললেন। ওর ভেতর একটা ঘড়ি।

“দাদা, আমারটা নিয়ে এটা আমাকে দাও,” ছেলেটি বারবার অনুনয় বিনয় করে বলতে থাকল।

দাদা হাসলেন: “এটা তোমার কোনো কাজেই আসবে না, দাদু। এটা তো অচল, আর একে তো আর ঠিক করাও যাবে না।”

“তাহলে এটা রেখেছ কেন, দাদু?”

সেই সন্ধ্যায় তিনি বিছানায় তার স্ত্রীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন, এমনভাবে বিছানায় উঠলেন যেন তার স্ত্রীর ঘুম না ভাঙে। মহিলা তো তখন গভীর ঘুমে কাদা, কারণ তার নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তিনি সেখানে শুয়ে থাকলেন, আর ছোট ছেলেটাকে যে উত্তরটা দিয়েছিলেন সেটা আওড়াতে থাকলেন: “কিছু কিছু জিনিস আমরা আর ব্যবহার করতে পারি না কিন্তু সেটা হাতছাড়া করার মতো সাহসও আমাদের থাকে না।”

মন্তব্য: