অনুবাদ মনোজিৎকুমার দাস
(ইন্দিরা সুন্দরাজন দক্ষিণভারতীয়া ভাষা বলয়ের অন্যতম তামিলভাষী কথাসাহিত্যিক। তামিলভাষার সমকালীন লেখকদের লেখা গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ দক্ষিণভারতীয় সমাজের নানা অনুষঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। সামাজিক সমস্যার অনুষঙ্গে ইন্দিরা সুন্দরাজনের লেখা তামিলভাষার ছোট গল্পের ডঃ ভি. আয়োথি অনুবাদকৃত Honourable People ইংরেজি গল্প থেকে বঙ্গানুবাদ পত্রস্থ করা হল।)
কালো পিচঢালা রাস্তাটার সবটা এক রকম চওড়া নয়, আবার তেমন সরুও নয়। উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে এঁকে বেঁকে চলে গেছে। গাড়ির চাকায় পিষ্ঠ হওয়া একটা কুকুরের মৃতদেহ রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে। রক্তের ধারা অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। মহানন্দে একঝাঁক মাছি মৃতদেহটাকে ঘিরে বন বন করছে। যানবাহন মৃতদেহটাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় মাছিগুলো ভয়ে এদিক ওদিকে উড়ে যাচ্ছে। কোন কোন গাড়িচালক ক্ষণিকর জন্যে ওখানটাতে গাড়ির গতি কমিয়ে ক্ষণিকের জন্যে ওদিকে তাকিয়ে ওটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে ছুটছে। কারো মুখেই মরা কুকুরটির প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার এপাশে ওপাশে অনেকগুলো বাড়ি ও দোকানপাট।
..কী দুভাগ্য। ওখান থেকে মরা কুকুরটাকে কী কেউই সরিয়ে নেবে না— যতসব বিচ্ছিরি কান্ডকারখানা।” রঙ্গন একইকথা বারবার বলে চলেছে। কিন্তু কেউই ওটাকে ওখান থেকে তুলে দূরে ফেলে দেবার জন্যে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। পাশের সুতোর দোকানী সুতো বেচাবিক্রি করতে ব্যস্ত। মরা কুকুরটার দিকে নজর দেবার মত ফুরসত তার কোথায়। সুতো নিতে আসা বৃদ্ধ লোকটি দোকানীকে জিজ্ঞেস করল, “বলরাম, তোমার দোকানের ওপারে পড়ে থাকা মরা কুকুরটাকে লক্ষ করনি। ওটা ওখানে রেখে তুমি কীভাবে এখানে বসে আছ?” “ও জন্যে আমাকে কী করতে হবে বল? বলরাম প্রত্যুত্তর বলল।
“ওটাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলতে তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি না। কিছু মনে করো না, আমি শুধু বলছি, তুমি কি ওটাকে ওখান থেকে দূরে ফেলে দিতে পার না?” ওটা করতে আমাকে কেন বলছ? তুমিও তো ওই কাজটা করতে পার।”
বৃদ্ধ লোকটি তার কথা শুনে ওখান থেকে কেটে পড়লেও বলরাম তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগল, “তুমি কী রাস্তায় চাপা পড়ে মরা তাবত কুকুরগুলোর সৎকার করার দাযিত্ব আমার ঘাড়ে চাপিযে দিতে চাও? ডাইভারগুলো রোজই তো একটা না একটা কুকুরকে মেরে রেখে যাচ্ছে।” পাশের দোকানের কৃষ্ণপিল্লাই নিচু হযে বসে চুলিতে কাঠ গুজতে গুজতে বলল, “ বলরাম, তুমি ওটার দিকে না তাকিয়ে কি থাকতে পারবে ? তুমি তোমার নাকে কি কাপড় গুজে রাখবে ?”
কৃষ্ণ তুমি মুখ সামলে কথা বলবে। আমার নাক না হয় সর্দিতে বন্ধ হযে আছে। তুমি কেন মরা কুকুরটাকে ওখান খেকে না ফেলে দিয়ে আজেবাজে কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করছো?” কৃষ্ণপিলই বলরামের কথায কর্ণপাত না করে ওখানটাকে বসে চিরুণী দিয়ে দাড়ি আঁচড়াতে শুরু করল। এমন সময় রঙাগনের চায়ের দোকানে এলাকার গ্রাম্যডাক্তার কাথিরসান এসে উপস্থিত। দু’পাশের দোকানীরা সবাই ডাক্তারটিকে ভাল চোখেই দেখে। তাকে ভালচোখে দেখার কারণও আছে, অন্য ডাক্তাররা যেখানে দশ রুপি ভিজিট নেয় সেখানে কাখিরসান মাত্র পঞ্চাশ পয়সা নিয়ে থাকে।
“রঙ্গ, মরা কুকুরটাকে ওখানে দেখেও তুমি চুপ করে আছ ? তোমার ব্যবসায়ের পক্ষে মরাটা ওখানে পড়ে থাকা মোটেই ভাল নয়।” কাথিরসান রঙ্গনকে বলল। “কাথির, তুমি কী বিপদের কথা বলতে যাচ্ছ ? তুমিই বল, আমি আমার ব্যবসা বন্ধ রেখে কী মরা কুকুরটাকে নিয়ে পড়ে থাকব ?” রঙ্গন বিরক্তির সাথে প্রত্যুত্তর বলল ।
ডাক্তার চায়ে চুমুক দিতে দিতে রঙ্গনের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, “আমি বলতে চাচ্ছি, মরা কুকুরটার দেহ থেকে প্লেগ কিংবা ওই ধরনের রোগের জার্ম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।” কাথির কথা থামিয়ে চায়ের কাপে আর একটা চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “যদি তুমি মরা কুকুরটাকে ওখান থেকে ফেলে দিতে টালবাহানা কর আর একবার যদি রোগব্যধি ছড়িয়ে পড়ে তবে এক কাড়ি অর্থ অর্থ তহবিল থেকে বেরিয়ে যাবে তা কি ভেবে দেখেছ?”
“হ্যাঁ, তা ভেবে দেখেছি। কিন্তু আমি এখন কী করব ?” রঙ্গন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল।
“আমি বলি কী, এস আমরা সকলে মিলে কাজটা করি। হয় ওটাকে ওখান খেকে ফেলে দেই নতুবা মিউনিসিপ্যালিটিকে ফোন করি।”
“তোমার প্রথম কথাটা যুক্তিযুক্ত নয়, তবে তোমার দ্বিতীয় কথাটা মেনে নেয়া যেতে পারে।”
“কিন্তু, এখানেও একটা কথা আছে। মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন কাজটা তড়িঘড়ি করে করবে না। আমরা ওদের উপর ভরসা রাখতে পারি না। আমাদেরই উদ্যোগী হয়ে ওটাকে কোথায়ও পুঁতে রাখা উচিৎ।”
“তবে কোথায় ওটাকে পুঁতে রাখা হবে সেটা একটা কথা বটে! এখানটাতে গায়ে গাযে বাড়ি! এক ইঞ্চি জমির যা দাম তাতে মরাটাকে পোঁতার জন্যে এক চিলতে জমি পাওয়া সত্যিই দুরুহ। আমরা ওটাকে শ্মশানের ওদিকে না হয় ফেলে দিতে পারি।”
“তা বেশ, তবে তাই কর।”
“তাই কর বললেই তো হবে না! কিন্তু কাজটা করবে কে? এটাই প্রশ্ন, তা, আমি একাই ওটাকে এখান থেকে ফেলে দিতে পারি। কিন্তু তারপর…”
“ঠিক আছে! তুমিই তাহলে কাজটা কর।”
“তুমি আমাকে প্লেগের ভয় দেখাচ্ছ- তা দেখাও- কিন্তু একা আমি ওটা কীভাবে করব? তুমিও আমাকে সাহায্য করতে পার।”
“আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই কিন্তু তুমি তো জান আমার হাতে মোটেই সময় নেই। আমি ডক্তার মানুষ। কাজটা খুবই সহজ, তাই বিষয়টা তুমি নিজেই দেখ। চায়ের দাম না দিয়ে তড়িঘড়ি ওখান থেকে প্রস্থান করলো।
“বড় কাজের লোক, বড় বড় কথা বলে উনি কেটে পড়লেন।” রঙ্গন উচ্চস্বরে বলে উঠল। বলরাম তার কথার সমর্থনে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল যারা নিজেদের বাপমায়ের সৎকার করতে…।” তার কথা শেষ হবার আগেই একটা লড়ি মরা কুকুরটার রক্তমাংসের পিন্ডের উপর দিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল। চরম দূর্গন্ধে চারিদিক ভরে উঠল। বেলা এগারোটা মক হতে চলল। রঙ্দন বিরস বদনে তখনও বসে আছে, তার চায়ের দোকানে আজ তেমন খদ্দেরের দেখা নেই। তার ব্যবসার বারোটা বাজার জন্যে সে কুকুরটাকে অভিসম্পাত করতে লাগল। শত শত লোক রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে, কিন্তু মরা কুকুরটার জন্যে কারোরই মাথা ব্যথা নেই। শুধুমাত্র তারই ব্যবসায় লালবাতি জ্বলার ব্যবস্থা। অগ্যতা রঙ্গন নিজেই মিউনিসিপ্যালিটিতে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিল। কাছের মুদি দোকানের মারিক ছেত্রিয়ার লোকার কলের জন্য দু’রুপি দাবী করে বসল।
রঙ্গন মনের খেদে বলল, “রাস্তা থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকেই মরা কুকুরটাকে অপসারণের জন্য চেষ্টা করতে হবে। দু’রুপি এ জন্যে…।
“আজ কুকুর মরল, আগামীকাল ষাড় মরবে, আর আমাকে এ জন্যে দানছত্র খুলে বসতে হবে।”
রঙ্গনের মনের খেদ শুনে মুদিটি মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের ফোন নম্বরে কল করার জন্যে চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু ও পান্ত থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সে রঙ্গনের উদ্দেশ্যে বলল, “ তোমার ফোন পেয়ে মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন এসে হাজির হবে সে গুড়ে বালি।” এক সময় ও প্রান্ত থেকে কন্ঠ ভেসে এল। “ হ্যালো, এটা কি মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারের অফিস..”
“সুপ্রভাত, পেট্রাই মেইন রোড থেকে বলছি, কমিশনার মহোদয কি অফিসে আছেন।?”
“ব্যাপার কী?”
“একটা কুকুর লরি চাপা পড়ে রাস্তায মরে পড়ে আছে।”
“আপনারা কি কমিশনার মহোদযকে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যোগদানের জন্যে নিমন্ত্রন জানাচ্ছেন?”
“তা না, স্যার… দয়া করে মিউনিসিপ্যালিটির কয়েকজন লোককে মরা কুকুরটাকে অপসারণের জন্যে পাঠান।”
“কাজটা কি আপনার নিজেরা সমাধা করতে পারে না? বড়জোর দশ মিনিটের কাজ। এ জন্যে মিউনিসিপ্যালিটির সাহায্য কামনা করছেন? তা ঠিক আছে। মিউনিসিপ্যালিটির লোকজনকে পাঠাচ্ছি।” ছেতিয়ার ফোনে মিউনিসিপ্যালিটির সাথে যোগাযোগ করতে পারায বেজায় খুশি। সে রঙ্গনকে খুশির খবরটা জানাতে দেরি করর না।
“কিন্তু তারা কখন আসবে ?” রঙ্গনের ধৈর্যের বাঁধ মানছে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয় হয়, কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির লোকজনের দেখা নেই। ওই অবস্থায রঙ্গন কান্না ছাড়া আর কীবা উপায় অবশিষ্ট আছে। বলরাম, অবুদেপ্পান, এথিরাজ রঙ্গনের দুঃখে ব্যথিত হযে তার কাছে উপস্থিত হযে সমবেত কন্ঠে বলল, “দিনে দিনে জগতটা গোল্লায় যেতে সেছে। আমরা কোন দুনিয়াতে বাস করছি। একটা মরা কুকুরকে রাস্তা থেকে সরাতে সক্ষম হরাম না। তাজ্জব ব্যাপার আর কাকে বলে।” এক সময তাদের কথা থামিযে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। ওদের মাঝ থেকে এবার একজন বলে উঠল, “একেই বলে ঘোর করিকার, সারা পৃথিবীটাই জাহান্নামে যেতে বসেছে, মিউনিসিপ্যালিটির কথা আর কী বলার আছে।”
সাতটা আটটা কুকুর দল বেঁধে সকাল থেকেই এদিকে ওদিকে ঘোরাফেরা করছিল। এখন ওরা মরা কুকুরটার চারপাশে চক্কর দিচ্ছে। তারা যেন কটাক্ষ করে বোঝাতে চাচ্ছে মানুষের মুরোদ কতটা! বলরাম রাগে ফুঁসে উঠে চিৎকার করে কুকুরকে তাড়া লাগাল। অপর দিকে স্বজাতির উপর কুকুরগুলোর মমত্ববোধের পরিচয় পেয়ে কৃষ্ণপিলাই অবাক হল। মিউনিসিপ্যালিটির থেকে কাউকেই সেখানে আসতে না দেখে রঙ্ন শেষমেষ রাজাকান্নু নামের এ দোকানদারকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মিউনিসিপ্যালিটিতে পাঠাবার ব্যবস্থা করল। রাজাকান্নু সাইকেলে প্যাডেল মেরে মিউনিসিপ্যালিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পিছন পিছন একটা কুকুর সঙ্গে করে একজন বাজিকর ওখানে এসে হাজির। রাস্তার ল্যামপোস্টের দ’একটা আলো মিটমিট করে জ্বলতে শুরু করেছ্ েলোকজনের দৃষ্টি আকর্ষনের বাজিকর ডুগডুগি বাজাতে শুরু করল।
“ডুগ ডুগ ডুগ ভদ্রলোকজন, আমার কুকুরটাকে নিয়ে আমি কয়েকটা বাজি দেখাব। আমার খেলার জাদুতে আপনার মোহিত হবেনই হবেনই হবেন। আপনার ছেলেমেয়েদের জয়জয়াকার হোক।” বাজিকরের কথা শুনে বলরাম চিৎকার করে বলল, “বুরবুক কোথাকার। আমরা মরছি মরা কুকুর নিয়ে আর উনি এলেন আমাদের জাদু দেখাতে। যাও এখান থেকে কেটে পড়।” বাজিকর তার কুকুরটার দিকে তাকাল। কুকুরটা মরা কুকুরটার চারপাশের মাটি শুকে দেখে বুঝে ফেলল এখানে জাদু দেখানো সম্ভব নয়। বাজিকরের কুকুরটি মৃত কুকুরের চারপাশে চক্কর দিয়ে দুঃখ জানানোর অনুভূতি প্রকাশ করল। বাজিকর বুঝতে এ অবস্থায ওখানে আর জাদু দেখানো সম্ভব নয়, তাছাড়া সে নিজেও ক্ষুধার্ত।
মিউনিসিপ্যালিটির দু’একটা রুমে তখনো বাতি জ্বলছে। কয়েকজন সান্ধ্যখবরের কাগজ পড়ায ব্যস্ত। কমিশনারের রুমে তালা ঝুলছে। কমিশনারের দর্শনার্থীর মধ্যে রাজাকান্নু একাই মাতে সেখানে উপস্থিত। পাশ থেকে কে একজন বেরিযে এসে রাজাকান্নুকে ওখানে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করল সে কেন এবঙ কার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এসেছে। “লড়ি চাপা পড়ে রাস্তায একটা কুকুর মরে পড়ে আছে। দুর্গন্ধে টেকা দায হয়ে উঠেছে। এখনই ওটাকে ওখান থেকে অপসারণ করা দরকার….।” রাজাকান্নু প্রত্যুত্তরে বলর। “এটা জলকর পরিশোধের দপ্তর। আপনার বিষয়টা স্বাস্থ দপ্তরকে জানাতে হবে। আগামীকাল সকাল ছাড়া তো ওই দপ্তর খোলা পাওয়া যাবে না। সবাই অফিস ছেড়ে চলে গেছে।” “আমরা সকালে ফোন করেছিলাম। কিন্তু এ পর্যন্ত কেওই ওখানে যায়নি।”
“ওহ, আপনি ফোন করেছিলেন। স্বশরীরে আসেননি কেন ? আমাদের কত কাজ!” কথা বলতে বলতে কর্মচারিিট সান্ধ্যখবরের কাগজটি ভাঁজ করতে শুর করল। রাজাকান্নু ওখান থেকে চলে এল।
রাস্তার ঝামেলা মিটিযে ওখানকার লোকজনের অসুবিধা দূর করার জন্যে বাজিকর নিজেই কুকুরটার মৃতদেহ রাস্তা থেকে অপসারণ করতে সিদ্ধান্ত নিল। সে নাকমুখ এক টুকরো কাপড় দিয়ে বেঁধে নিল। একটা ছেড়া কাপড়ের উপর
কুকুরের মৃতদেহটাকে তুলে টানতে টানতে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। পাশের লোকজন আগ্রহ ভরে দৃশ্যটা অবলোকন করতে লাগল। চলমান যানবাহনগুলোর চালকরা ওখানটাতে কী হচ্ছে তা দেখার জন্যে গাড়ির গতি কমিয়ে বাইরে ক্ষনিক দৃষ্টিপাত করে আবার গাড়ি দ্রুতবেগে চালিয়ে দৃষ্টির আড়ালে অন্তর্হিত হচ্ছে। রক্তমাংসের পিন্ড পাকানো দেহটা টেনে নেবার সময় বাজিকরের নিজের কুকুরটা তাকে অনুসরণ করল। বাজিকর ওটা টানতে টানতে একটা জলের নালার কাছে নিয়ে এল। ওটা সমাহিত করার পর বাজিকর ঘেমে নেয়ে উঠেছে। সসার শরীরে একরাশ ক্লান্তি। তথন দোকানীদের মধ্যে একমাত্র রঙ্গনই গামলা পরিস্কার করতে ব্যস্ত। বাজিকরকে ফিরে আসতে দেখে রঙ্গন তার দিকে একটা কয়েন ছুড়ে ফেলে দিল। কয়েনটা ওইভাবে ছুড়ে ফেলায় বাজিকর বেজায় অখুশি হল। সে হতাশ দৃষ্টিতে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল। কুকুরটার মৃতদেহ রাস্তার যেখানটায় পড়েছিল সেদিকে একবার তাকিয়ে এতক্ষন যানবাহনগুলো ওটাকে পাশ কাটিযে চলছিল এখন ওগুলো সোজাসুজি ছুট চলছে। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে বাজিকর দাঁড়িয়ে না থাকতে পেরে মাটিতে পড়ে গেল। কুকুরটা করুণাদৃষ্টিতে মনিবের দিকে তাকাল। এক সময় সেও মনিবের পাশে শুয়ে পড়ল।
সময় বয়ে যাচ্ছে। রাতের আঁধঅর নামতে নামতেই রাস্তাটা কেন যেন হঠাৎ করে জেগে উঠল। একটি সরকারী জীপ রাস্তাটাতে থেমে পড়ল। কয়েকজন সরকরী লোক গাড়ি থেকে নেমে আদেশনির্দেশ দিতে আরাম্ভ করল। আগামীকাল এই রাস্তা দিয়ে মন্ত্রীমহোদয় গমন করবেন। যতটা সম্ভব এই রাস্তাটাকে সাফসুরত করতে হবে। এই রাস্তার পাশের একটা বাড়ীতে তিনি যাবেন। ওই বাড়ীতে মন্ত্রীর পার্টির ্কটা ছেলে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেছে। মন্ত্রীমহোদয় ছেলেটির পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিতে আসছেন। মন্ত্রীমহোদয় স্থানীয় লোকজনের অভাব অভিযোগের কথাও শুনবেন। রাস্তার ধুলোবালি পরিস্কার করে ক্লোরিন পাউডার ছিটানো হচ্ছে।
অল্প সময়ের মধ্যে সরকারী কর্মকর্তা আর সান্ত্রীতে এলাকাটা ভরে উঠল। “আমরা উদ্বিগ্ন। মন্ত্রীমহোদয় এলাকা থেকে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের স্বস্তি নেই।” কেতাদুরস্ত এক কর্মকর্তা কথগুলো বললে অন্যানেরা মাথা নুইয়ে যার যার কাজে লেগে গেল। কয়েকজন লোক ট্রাফিকের নিয়ম অনুযায়ী রাস্তার মাঝখান দিয়ে সাদা দাগ দিতে ব্যস্ত। কয়েকজন লোক রাতেই রাস্তাটা ঝাঁট দিতে আরাম্ভ লাগল।
“দেখ, এটা আবার কী! একজন অফিসার বাজিকরের দিকে নির্দেশ করে থাগুলো বলরেন। বাজিকর -এর আর মাথা তুলে দেখার ক্ষমতা নেই। অফিসারটি এবার উচ্চস্বরে তার প্রতি চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ ভিক্ষুক, তুই রাস্তার উপর ঘুমোচ্ছিস কেন? শয়তান এখান থেকে নিকাল যা।” “স্যার, আমি ভিক্ষুক নই…” বাজিকর কষ্টের সঙ্গে কথগুলো বলার চেষ্টা করলে একটা পুলিশ তার মুখে লাথি মেরে বলল, “আর একটা কথা না বলে এখান থেকে নিকাল যা। তোদের মত লোকজন শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নষ্ট করে ফেলছে। রাস্তা দেখলেই ঘুমুতে ইচ্ছে করে। এটা কি তোর বাপের সম্পত্তি… রাস্তা গাড়িঘোড়া চলার জন্যে… এখান থেকে এখনই দূর হ।” পুলিশের গালিগালাজ শুনে বাজিকর খোঁড়াতে খোঁড়াতে কষ্টের সঙ্গে ওখান থেকে প্রস্থান করল।