ফন গোয়েটে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মূল জার্মান থেকে অনুবাদ: ইসফান্দিয়র আরিয়ন 

যেহেতু সব ধারার অনুবাদের মাধ্যমে জর্মনরা সর্বদা প্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে সেহেতু পুনরাবৃত্তি নয় বরং এই ক্ষেত্রে পরিচিত কিছু শেখানোতে আমরা নিজেদের বাধিত মনে করি। অনুবাদ ত্রিবিধ হয়ে থাকে। প্রথমটি স্বদেশের অনুভূতি দিয়ে ভিনদেশের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। সরল গদ্য (schlicht-prosaisch)  অনুবাদ এক্ষেত্রে সর্বোত্তম। কারণ, গদ্যের মাধ্যমে পদ্যের সব বৈশিষ্ট্যকে সম্পূর্ণরূপে রহিত করা যায়; এটি নিজেই পদ্যের উচ্ছ্বাসকে স্থির পানির স্তরে নামিয়ে আনতে পারে এমনকি শুরুতে তা সবকিছু ছাপিয়ে উঠলেও। কারণ, গদ্য এভাবে আমাদের দেশীয় আটপৌরে অনুভূতির মধ্যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে ভিনদেশী দুর্লভ অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের চমকে দেয়। আমাদের সাথে কী ঘটছে তা একরকম আমরা বুঝতেই পারি না। আর ইত্যবসরে গদ্য আমাদেরকে উচ্চতর মানসিকতা দিয়ে ঋণের জালে বেঁধে ফেলে- এতে আমরা সত্যিই উন্নীত হই। প্রতিবার অধ্যয়নের পর লুথার কর্তৃক অনূদিত বাইবেল এমনই অভিব্যক্তি নিয়ে আসবে।

কেউ যদি নিবেলুঙগেন এমন যথোপযুক্ত গদ্যে অনুবাদ করতো ও অনুবাদ করে তা Volksbuch-এ অন্তর্ভুক্ত করতো তাহলে কতো কী-না অর্জিত হত এবং অসামান্য, একনিষ্ঠ, বিষণ্ন ও হতাশাচ্ছন্ন শৌর্যবীর্যের কাহিনি তার পুরো উদ্যম নিয়ে এখনও আমাদের মধ্যে কথিত হত। এখনও কেউ যদি পুরনো এসব বিষয়ে দৃঢ়চিত্তে মনোনিবেশ করতো তাহলে কতই-না সুবিবেচনা প্রসূত ও মোক্ষম কাজ হতো।

দ্বিতীয় একটি যুগের কথায় আসা যাক যেখানে একজন অনুবাদক নিজেকে ভিনদেশী আবহে রূপান্তর করে ঠিকই কিন্তু ভিনদেশী ভাব-ধারণাকে মানানসই করে নিয়ে নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়। যথার্থ শব্দে এমন যুগকে আমি অনুকরণের যুগ হিসেবে অভিহিত করতে পছন্দ করব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি বিজ্ঞ লোকের কাজ যারা নিজেরাই অনুকরণের কাজে বেশ আগ্রহী হয়ে থাকে। যাবতীয় কাব্যিক অনুবাদের ক্ষেত্রে ফরাসীরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। দেলিলের অনুবাদ থেকেই শয়ে শয়ে উদাহরণ সামনে চলে আসে। ফরাসীরা ভিনদেশী শব্দের উচ্চারণকে মুখে তুলেছে, অনুভূতি, চিন্তা এমনকি বস্তুকে পর্যন্ত প্রক্রিয়াজাত করেছে – যেন প্রায় সমস্ত ভিনদেশী ফলের জন্য প্রয়োজনীয় মাটি তাদের রয়েছে যাতে উদ্দিষ্ট ফলটি যে মাটির তেমন মাটিতে জন্মাতে পারে।

ভীলান্ডের অনুবাদ এমন অনুবাদের পর্যায়ে পড়ে। তাঁরও নিজস্ব অনুভূতিশক্তি ও রুচিবোধ ছিল যার বদৌলতে তিনি প্রাচীনত্বের ও ভিনদেশের এত নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে সে স্থানে তিনি নিজের স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। এমন চমৎকার ব্যক্তি স্বীয় যুগের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। এমন এক অসামান্য কাজ তিনি সম্পাদন করেছিলেন যে তাঁর সমসাময়িকদের কাছে তা মনোরম ও উপভোগ্য মনে হয়েছিল – কিভাবে তিনি একে নিজের আয়ত্তে এনেছিলেন ও কিভাবে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা মুখ্য নয়।

মানবমাত্রই যেহেতু আমরা সুনিশ্চিত ও অনিশ্চিত কোনো অবস্থার জন্য বিলম্ব সইতে পারি না, অধিকন্তু আর কিছু না হলেও সর্বদা অবস্থান্তর করতে বাধ্য তাই তৃতীয় যুগটির সাথেও আমাদের পরিচয় ঘটেছিল। বলতে গেলে এটিই তিনটি যুগের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চস্তরের ও সর্বশেষ ধাপ। এই ধাপে অনুবাদক মূলের হুবহু রচনা করেন যাতে একের বদলে অন্যটি না দাঁড়ায় বরং অন্যটি একের স্থলে ধর্তব্য হয় ।

এই ধারাটি শুরুতেই তীব্র বাধার মুখোমুখি হয়। কারণ, যিনি অনুবাদ করেছেন তিনি মূলের সাথে এত বেশি সংশ্লিষ্ট থেকেছেন যে স্বজাতির অনন্যতার অনেকাংশ অথবা অল্প হলেও তিনি ত্যাগ করেছেন। ত্যাগ করে তিনি তৃতীয় ধারার অনুবাদ তৈরি করেছেন যা অনুধাবন করতে হলে সাধারণের রুচিবোধ প্রশিক্ষিতজনের মতো উন্নত হওয়া বাঞ্চনীয়।

ফস তাঁর মূল্যায়নটুকু পর্যন্ত পাননি। ধীরে ধীরে পাঠক নতুন এই ধারার সাথে ঐকতানিক হয়ে ওঠে ও তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ততদিন পর্যন্ত তিনি সাধারণ পাঠককে খুশিই করতে পারেন নি। তখন কী ঘটেছিল; কীসব বহুমুখী প্রতিভা জর্মনদের আয়ত্তে ছিল; অলঙ্কার, ছন্দ ও মাত্রাজনিত কত কী উপকারী বস্তুতে বিজ্ঞ-ধীমান যুবকদের হাতে হুনরী ছিল; কীভাবে আরিওস্ত ও তাস্সো, শেক্সপিয়র ও কালদেরোন জর্মনকৃত বিদেশীর বেশভূষায় দুবার বা তিনবার আমাদের সম্মুখে আনীত হয়েছিল – সেসব যিনি এখন পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি এমনটা আশা করতেই পারেন যে, সাহিত্যের ইতিহাস কোনো রাখঢাক না রেখে একদিন ঠিকই বলে দেবে, এতসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই পথে প্রথম পা বাড়িয়ে ছিল কে?

অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রাচ্যের সর্বোৎকৃষ্ট রচনাগুলির ফন হামারকৃত অনুবাদ এমন ধারার প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে তিনি একরকম পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, বাহ্যিক কোনো রূপের চেয়ে অনুবাদ মূল রচনার কাছাকাছি থাকা উত্তম। ফেরদৌসীর চরণগুলো আমাদের উল্লিখিত বন্ধু অনুবাদ করেছেন আবার একই চরণগুলো পুনর্গঠিত রূপে অন্য একজন অনুবাদ করেছেন যা ঋঁহফমৎঁনবহ-এ আপনারা পড়তে পারবেন। পড়ে অনুধাবন করতে পারবেন যে, ফন হামারের অনুবাদের কী সুবিধা। এভাবে কবির রচনা পুনর্গঠন করাকে আমরা সবচেয়ে দুঃখজনক ভুল হিসেবেই দেখি যা একজন অধ্যবসায়ী ও সমর্থ অনুবাদক করতে পারে।

যেহেতু প্রতিটি ভাষার সাহিত্যে উক্ত তিন যুগ ঘুরে ফিরে আসে,  পরস্পর পরস্পরকে উল্টে দেয় অর্থাৎ উক্ত তিন ধারা একইসাথে চর্চিত হয় সেহেতু গদ্যে শাহনামার ও নিজামীর রচনাসমগ্রের অনুবাদ হয়তো সামঞ্জস্যবজায় রাখত। দ্রুতপঠনের জন্য, রচনাবলির প্রধান অর্থকে উন্মোচিত করার লক্ষ্যে হয়তো লোকে এসব পড়ত। ঐতিহাসিক, কাল্পনিক, সার্বজনীন নৈতিক বিষয়াবলি আমরা উপভোগ করতাম এবং দেহভঙ্গি ও চিন্তাভঙ্গির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটত যতক্ষণ না আমরা পরস্পরের সাথে এর মাধ্যমে ভাতৃত্ববোধে সম্পর্কিত হতাম।

শকুন্তলার এমন একটি অনুবাদ আমরা জর্মনরা করেছি। তাই লোক আমাদের হাততালি দেয়। সেটাই স্মরণ করুন। এজন্য এর সাধারণ গদ্য যে গদ্যে শকুন্তলা অনূদিত হয়েছিল তা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ, এমন গদ্যের ফলে কাব্যটি উন্মোচিত হয়েছে। এখন তৃতীয় ধারার অনুবাদের জন্য নির্ধারিত সময় চলে এসেছে। মূল রচনায় ব্যবহৃত নানাবিধ উপভাষা, ছন্দ, মাত্রা ও বাগধারার সাথে এই অনুবাদ সঙ্গতি বজায় রাখে এবং সাথে সাথে কাব্যের অনুপম গুণাবলিকে সুখপাঠ্য ও সুপরিচিত উপায়ে তা নতুন করে নির্মাণ করে। এমন চিরায়ত কাজের একটি পা-ুলিপি পারি শহরে পাওয়া যায়। তাই সেখানকার সাকিন এমন জর্মন দেশীয় কেউ তেমন একটি কাজ করে অমর সম্মান পেতে পারেন।

‘মেঘদূতম্’-এর ইংরেজী অনুবাদ যিনি করেছেন তিনি এমন একটি কাজের জন্য ধন্যবাদার্হ। কারণ, এমন একটি কাজের সাথে প্রথম পরিচয় আমাদের জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। এর অনুবাদ কিন্তু দ্বিতীয় যুগের নিদর্শন যাতে প্রচুর শব্দান্তরণ ও সম্পূরক শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয় যার ফলে উক্ত অনুবাদ উত্তরের কান ও অনুভূতিকে এর ঋহৃহভভহৃপ্তরমব ঔধসনঁং-এর মাধ্যমে খোশামুদি করে। আমাদের কোজেগার্টেন এর কিছু চরণমূলভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন যা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অনুভূতি দেয় আমাদের। তাঁকে ধন্যবাদ দেব বলে তিনি আমাকে ঋণী করে রেখেছেন। ইংরেজ অনুবাদ একই সাথে নিজের অনুবাদে মূলভাবের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন যা নান্দনিক চোখমাত্রই তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলে ও নিন্দা জানায়।

তৃতীয় যুগটিকে কেন আমরা একইসাথে সর্বশেষ যুগ বলছি অল্প কয়েকটি কথায় তা ব্যাখ্যা করছি। মূলের সাথে কোনো অনুবাদ যখন নিজেকে পরিচয় করাতে সচেষ্ট হয় তখন শেষ পর্যন্ত এটি মূলের আন্তচরণিক ভাষ্যহিসেবে দাঁড়ায় এবং এভাবে আমরা মূল রচনার ঘরে এসে হাজির হই। ঘরের ও বাইরের জনের যে নৈকট্যে, পরিচিত ও অপরিচিত জনের যে নৈকট্যে বৃত্তটি অবিরাম ঘুরছে মূল রচনার দুয়ারে এসে অবশেষে তা সম্পূর্ণ হয়।

টিকা:

১. Joseph Görres I Johann Gottfried von Herder কর্তৃক সংগৃহীত ১৮শ শতকের শেষের দিকে প্রকাশিত জর্মন দেশীয় লোককাহিনির সংকলন।

২. Jacque Delille ফরাসি কবি ও অনুবাদক। ভার্জিলের গেওর্গিকা (Georgica) ও আয়েনেইস (Aeneis) এবং মিল্টনের প্যারাডাইজ লস্ট্ অনুবাদ করেন তিনি।

৩. Christoph Martin Wieland জর্মন কবি, লেখক ও অনুবাদক। শেক্সপিয়রের নাটক জর্মন ভাষায় অনুবাদ করেন।

৪. Johann Heinrich Voss জর্মন কবি  ও অনুবাদক। জর্মন ভাষায় তিনি হোমারের ওদেসি ও ইলিয়াড অনুবাদ করেন।

৫. Joseph von Hammer-Purgstall অস্ট্রীয় প্রাচ্যতাত্ত্বিক। তিনি আরবী, ফারসী ও তুর্কী ভাষা থেকে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুবাদ করেন।

মন্তব্য: