লৌহমানবী ইরম শর্মিলা চনুর সাক্ষাৎকার

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

ইরম চনু শর্মিলা। জন্ম ১৪ মার্চ ১৯৭২। ভারতের মনিপুর রাজ্যের একজন নাগরিক অধিকার কর্মী, রাজনীতিবিদ এবং কবি। তিনি লৌহমানবি হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৬ বছর অনশন তিনি এই অনশন চালিয়ে যান যার সমাপ্তি ঘটে ৯ আগস্ট ২০১৬ তারিখে। পাঁচশত সপ্তাহ ধরে তিনি খাবার-পানীয় প্রত্যাখ্যান করেন। তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদের অনশনকারী বলা হয়।

২০১৪ সালে দু’টি রাজনৈতিক দল তাকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীতার প্রস্তাব দিলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর তাকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় যেহেতু আইন অনুযায়ী একজন কারাবন্দী ভোট দিতে পারে না। ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট একটি কোর্ট থেকে কারাবাস থেকে মুক্তির নির্দেশ দেয়। ২২ আগস্ট ২০১৪ তাকে একই অভিযোগে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৫ দিনের বিচারিক হাজতবাসে পাঠানো হয়। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাকে prisoner of conscience (বিবেকবন্দী) হিসাবে ঘোষণা করেছে.  

শান্তি মিছিলের কোন অর্থই হয় না

বাঙলায়ন ও ফুটনোটঃ মাইবম সাধন

প্রঃ আপনি কেন এই অনশন শুরু করেছেন?

উঃ আমার জন্মভূমি মনিপুরের জন্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না কালাকানুন ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ারস এ্যক্ট ১৯৫৮’ প্রত্যাহার হয়, আমার অনশন চলতে থাকবে।

প্রঃ যে ঘটনা আপনাকে এই অনশন সূচীতে নিয়ে এসেছে, সেটা একটু বলবেন?

উঃ আমরা মলোম-এ গিয়েছিলাম একটা সভার কাজে। সেটি ছিল কয়েকদিনের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য একটি শান্তি মিছিলের প্রস্তুতি সভা। কিন্তু ওখানে সশস্ত্র বাহিনী নিরীহ মানুষদের যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করলো, তা বর্ণনাতীত। সত্যি বলতে, শান্তি মিছিলের কোন অর্থই হয় না। পরিবর্তনের জন্য আরো কিছু করতে হবে।

প্রঃ কিন্তু কেন এই কর্মসূচী? কেনইবা আমৃত্যু অনশন?

উঃ এছাড়া আমার কোন গত্যন্তর ছিল না। আর অনশন এক ধরণের আধ্যাত্মবাদ, যা মানসিক সংযম প্রদায়ক।

প্রঃ এই অনশন তো আপনার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আপনার স্বাস্থ্য, শরীর ভেঙে গেছে।

উঃ এটা আহামরি কিছু না। নিরর্থক অনেকেই তো মরছে, আমরাও মারা যাবো একদিন।

প্রঃ আপনি কি নিঃসংশয় যে এটাই প্রতিবাদের সঠিক উপায়? আর নিজের শরীরকে এভাবে যন্ত্রণা দেয়া? 

উঃ এটা কোন যন্ত্রণাভোগ নয়। শাস্তিও নয়। এটা আমার দায়িত্ব।

প্রঃ আপনার পরিবার-পরিজন এই অনশনের সিদ্ধান্ত কিভাবে দেখেছে?

উঃ আমার মা এবিষয়ে অবগত আছেন। যদিও তিনি নিরক্ষর এবং খুবই সাধারণ কিন্তু তাঁর এই সাহস আছে যা আমাকে ভরসা যোগায়।

প্রঃ কতদিন আগে মায়ের সাথে শেষ দেখা হয়েছে?

উঃ সম্ভবত পাঁচ বছর আগে। আমরা দুজনেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, যতদিন পর্যন্ত না আমি আমার লক্ষ্যে পৌছচ্ছি ততদিন পর্যন্ত তিনি আমার সাথে দেখা করবেন না। 

প্রঃ অতি শক্ত সিদ্ধান্ত আপনাদের দুজনের জন্যই…  

উঃ না, ততোটা নয়। (একটু থেমে) এটাকে কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না, আমরা প্রত্যেকেই এখানে এসেছি কিছু দায়-দায়িত্ব নিয়ে। আর সে দায়িত্ব নিজেদেরই/এককভাবে পালন করতে হবে।

প্রঃ ঠিক কী কারণে আপনাকে বন্দি করেছে? জানেন কি?

উঃ আমার ইচ্ছেয় হয়নি। রাষ্ট্রের চোখে অনশন নাকি বেআইনি! 

প্রঃ কিন্তু সরকার বলছে যে আমরণ অনশন একপ্রকার আত্মহত্যার শামিল যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। 

উঃ বলতে পারে, তাতে আমার করার কিছু নেই। কারণ আত্মহত্যার কোন অভীপ্সা আমার নেই। যদি থাকতো তাহলে তো আপনার সাথে এভাবে কথা বলতাম না। আমার অন্য কোন উপায় নেই, অনশনই আমার প্রতিবাদের একমাত্র পথ বা সঠিক উপায়।

প্রঃ কিন্তু এভাবে কতদূর?

উঃ উত্তর জানা নেই। যদিও আমি আশাবাদী। আমার অবস্থান সত্যের পক্ষে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, সত্যেরই শেষ পর্যন্ত জয় হয়। ঈশ্বর আমার সহায়। তিনিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন (তাঁর নাকের সাথে যুক্ত টিউবকে দেখিয়ে)।

প্রঃ হাসপাতালে কীভাবে সময় কাটছে আপনার?

উঃ আমি নিয়মিত যোগাসন করি। এর ফলে আমার দেহ ও মন ভালো থাকে। এবং পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেছে (নাকে যুক্ত টিউব দেখিয়ে)। যদিও এটি বিশ্রী, কটূ অনেকের কাছে কিন্তু এখন আমার কাছে এটি স্বাভাবিক।

প্রঃ তো এখানে আপনি সবথেকে কী বেশি অভাববোধ করছেন?

উঃ মানুষ। এই হাসপাতালে যেহেতু আমি একজন বন্দী ও চারিদিকে পুলিশ প্রহরা, অনুমতি ছাড়া কেউ আমার সাথে দেখা করতে পারে না। তাই মানুষের লোকজনের অভাব সব থেকে বেশি অনুভূত হয়।

প্রঃ যদি আপনার শেষ ইচ্ছা বা ইচ্ছা পূরণের একটা সুযোগ দেয়া হয়, কী চাইবেন?

উঃ আমার ইচ্ছা! মানুষ হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারটুকু যেন আমরা পাই।

প্রঃ আপনি কি মনে করেন আফস্পা বাতিল হবে? যার জন্য আপনি লড়াই করছেন, তা কি আপনি পাবেন?

উঃ আমার লড়াই একটি কঠিন সত্যসাপেক্ষ। কিন্তু আমি সইতে পারবো, ধৈর্য্য ধরতে হবে।  চূড়ান্ত বিজয় একদিন আসবেই। যদি ততদিন আমি বেঁচে থাকি। ততদিন পর্যন্ত আমাকে অবশ্যই ধৈর্য্য রাখতে হবে।

ফুটনোট: 

আফস্পা- আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ারস এ্যক্ট ১৯৫৮ (Armed Forces Special Powers Act 1958), শান্তিপ্রিয় মনিপুর তথা বর্হিবিশ্বের গণতান্ত্রিক শিবিরে এটি কালাকানুন নামেই পরিচিত। এই আইনবলে সেনাসদস্যরা বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে। সত্যি বলতে, এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির হাতিয়ার। ‘উপদ্রুত অঞ্চল’ এর তকমা সেটিয়ে ১৯৮০ সাল থেকে মনিপুরে এবং নিকট সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে এই কালাকানুন বলবৎ হয়।

মলোম- বাংলা উচ্চারণে মালোম (একইভাবে চনুর উচ্চারণ চানু)। মনিপুরের রাজধানী ইম্ফালের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি উপশহর। মাত্র ৯ কিমি দূরত্বে ইম্ফালের পশ্চিমাংশে অবস্থিত এ শহরটি মূলত একটি বাজারকে কেন্দ্র করেই জনজাতির গোড়াপত্তন। বাজারটি শহরের নামেই মলোম বাজার নামে পরিচিত। আর এই বাজারের সন্নিকটে (বাস স্ট্যান্ডে) ২০০০ সালের ১লা নভেম্বরে প্যারামিলিটারি সেনাসদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে এই বর্ণনাতীত হত্যাযজ্ঞের কালাকানুন প্রত্যাহারের দাবিতে অষ্টবিংশে ইরম শর্মিলা চনু তার অনশন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। 

——————————————————————————————

সূত্রঃ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন ভারতীয় চিত্রনির্মাতা কবিতা যোশী। প্রকাশিত হয় তেহেলকা পত্রিকায়। ২৫শে মার্চ, ২০০৬।

মন্তব্য: