একটি অপ্রকাশিত কবিতার আত্মকাহিনী

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সুদেব চক্রবর্তী

আমি এক অখ্যাত কবির অপ্রকাশিত কবিতা, জন্মেছিলাম বারুণী স্নানের ঘাটে, কবি সেখানে বসেছিল বাল্মীকির আরশে। আমার জন্মের পর কবিচোখের সূর্যের হাসি ঢেউ তুলেছিল প্রবাহিনীতে। তমালের ডালে বসে থাকা পাখিটাও হয়ত ডেকে উঠেছিল, প্রচার করেছিল আমার জন্ম-সমাচার; সেই থেকেই কবির পকেটে বসতি আমার।

এরপর কবি ঘুরে বেড়িয়েছে পিচঢালা পথ, মেলডিতে ভরা শপিংমল, এমনকি ভুভুজেলায় মাতোয়ারা খেলার মাঠেও। কবি বার বার পকেট থেকে বের করত আমাকে। তার চশমার প্রতিবিম্বে দেখতে পেতাম নিজেকে। সেই প্রথম নিজেকে আয়নায় দেখা। দেখলাম রক্তিম কালিতে লেখা- তোমার জন্য প্রিয়তমা। বুঝে নিলাম আমার জন্ম বিশেষ কারো জন্য।

কবির চোখের কোনায় দীর্ঘশ্বাসের আভায় লেখা থাকত- আজও দেখা হয়নি ‘তাহার’ সাথে। কবি তাকে খুঁজে চলেছে বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলিতে। শার্টের পকেটে আত্মসুখে মগ্ন হতাম যখন কল্পনা করতাম আমার স্নান হবে কোনো এক কোমল হাতে, হয়ত আমাকে সে তার বুকের উপর রেখে শুয়ে পড়বে বিছানায়, যেখান থেকে ভেসে আসে প্রেমের মাদকতা।

কিন্তু কবে? কেটে গেল দিনের পর দিন, মাস, বছর। শার্টের পকেটে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম- দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। তবু জানি- এই যন্ত্রণার চেয়েও অধিক কষ্ট বরফের মত জমে চলেছে কবির বুকে। প্রিয়তমার সাথে দেখা না হবার হত-আশায় কবিকে দেখেছি নিকোটিনে পুড়ে যেতে, অতঃপর শুন্যে তাকিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছে দীর্ঘশ্বাস। বাতাসের ডানায় ভেসে কখনও কি সেই নাতিদীর্ঘ শ্বাস পৌঁছেছিল ‘তাহার’ কাছে?

অপেক্ষার ধূসরতায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে গেল কান্নার রোলে। বুক পকেটে থেকে এতদিনে মুখস্ত হয়ে গেছিল মানুষের নিঃশ্বাসের স্পন্দন। দেখি, থেমে গেছে সব- কবির বুকে নেমে এসেছে ভয়ানক নিথরতা। ক্রন্দনরতরা জানে না কবির পকেটে আমিও ঢুকরে কাঁদছি।

কবির দেহ নামানো হল উঠোনে। ধূপের মোহনীয় গন্ধ আজ ব্যথাবাষ্পে পরিণত। কত লোক আসছে, রেখে যাচ্ছে ফুল আর মুঠো মুঠো দীর্ঘশ্বাস। ফুলের গন্ধ টের পাচ্ছি- সে গন্ধ আজ কেবলি শোকের। কত নারী এল, রেখে গেল নিষ্পাপ অশ্রু। তাদের মধ্যে কি ছিল সেই নারী- যার জন্য জন্ম আমার! হয়ত এসেছিল, কেউ তো জানে না আমি পড়ে আছি কবির পকেটে। শব্দব্রহ্মে আমার নির্মাণ, তবু আজ আমি শব্দহীন।

শুরু হল বিদায় যাত্রা। শ্মশানবন্ধুরা বয়ে চলেছে কবির দেহ- বয়ে চলেছে আমাকে। বোধনের পর কেটে গেল কত বছর! মেলেনি পূজা- প্রেমের অর্ঘ; বিসর্জনেই পরিণতি এই অপ্রকাশিত কবিতার। হায়! আমি সহমরণে যাচ্ছি কবির সাথে।

মন্তব্য: