মানুষের মানচিত্র ৪
ভাসান যে দিতে চাও, কোন দেশে যাবা? যাবা সে কোন বন্দরে
আমারে একলা থুয়ে? এই ঘর যেবনের কে দেবে পাহারা?
এমন কদম ফুল- ফোটা-ফুল থুয়ে কেউ পরবাসে যায়।
তুমি কেন যেতে চাও বুঝি সব, তবু এই পরান মানে না।
লােকে কয় ভিন দেশে মেয়ে মানুষেরা নাকি বেজায় বেহায়া,
শরীরের মন্ত্র দিয়ে আটকায় শাদা-সিধে পুরুষ মানুষ।
তােমারে না হারাই যেন সেই দিব্যি দিয়ে যাও জলের কসম,
আর বলি মাস মাস খােরাকি পাঠাতে যেন হয় নাকো দেরি।
পুবের না পশ্চিমের দেশ, কোন দেশে যাবা মাঝি, কোন দেশ?
সেখানে কেমন জানি লােকজন, মানুষের আচার বিচার।
শুনেছি দক্ষিনে ভয়, আজদাহা দরিয়ায় বেশুমার খিধে,
পাহাড় সমান ফনা আচমকা টেনে নেয় পেটের ভেতর।
দক্ষিনে যেওনা মাঝি, কালাপানি দরিয়ায় কামােট কুমির।
তােমারে হারাই যদি গলায় কলসি বেঁধে ডুব দেবাে জেনাে,
তােমারে হারাই যদি ধুতুরার বিষ খেয়ে জুড়ােবাে পরান।
পরবাসে যাবা মাঝি, মনে ভেবাে ভরা গােলা রেখে গেছ ঘরে-
সােমত্ত বয়স দেহে মাঝি-বউ দিন গানে, ফেরে না ভাতার,
গলায় কলসি বাঁধা হয় নাকো তার। পেটের আগুনে পােড়ে
অতপর ঘরদোর, সােনার গতর আর সব শেষে পােড়ে
তার যৌবনের কড়ি। মাঝি বউ দিন গােনে, তবু দিন গােনে…
বিশ্বাসে বিষের বকুল
যদি সব নদী ফিরে আসে নীড়ে, জন্মের নিকটে,
তবু শরীরে ঘামের গন্ধ আমি তাে ফিরিনি আজো
লাঙলের ফলায় মেখে ক্লান্ত-বিশ্রাম,
চুলে নােখে অসভ্যতা, আমি তাে ফিরিনি গহে বনবাস বিরাগী বাউল।
নদীও নদীর ভেতরে মেলে আছে অন্ত ঋণা,
প্রাপ্যের কাছে যতাে পাওয়া ছিলাে, যতো চাওয়া ছিলাে,
তারও কি অধিক তুমি দিয়েছিলে ভুলে
আমার জন্মাের কাছে নিবেদিত বিষের বকুল?
স্টেশন জেগেছিলাে- হুইসেলে কেঁপেছিলাে রাত,
তবুতাে একটি মানুষ নির্ধারিত আসনে এসে বসেনি।
লােহার সাঁকো বেয়ে নেমে যাওয়া ডাউন-ট্রেন,
তবুতাে একটি মানুষ জানালায় রাখেনি মাথা, রাতজাগা চুল।
যদি সব পাখি ফিরে যায় নীড়ে মমতা-কাতর,
যদি সব নদী অধিক প্রাপ্যের লােভে নেমে আসে
পুরাতন জন্মের ঋণে,
তবু বিশ্বাসে ঘামের গন্ধ আমি তাে ফিরিনি আজো-
হেঁসেলে পােড়া ভাত, নিদ্রা-নিহত সেই পোয়াতি কুকুর,
দুধের ফেনার ভেতরে মৃত শিশুদের শীর্ণ শরীর,
বিষের বকুল, গােলাপের লাশ-
সেখানেই আমার কিছু প্রয়ােজন ছিলাে,
সেখানেই আমার শুধু পিছুডাক ছিলাে।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
তার চোখ বাঁধা হলাে।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলাে তার মুখ।
থ্যাতলানাে ঠোটজোড়া লালা রক্তে একাকার হলাে,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লাে কংক্রিটে।
মা… মাগাে… চেঁচিয়ে উঠলাে সে।
পাঁচশাে পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলাে তার বুক।
পােড়া মাংশের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লাে ঘারের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টস্টসে আুরের মতাে ফোস্কা তুলতে লাগলাে।
দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতাে বাঁকা হয়ে গেল দেহ,
এবার সে চিতকার করতে পারলাে না।
তাকে চিৎ করা হলাে।
পেটের উপর উঠে এলাে দুইজোড়া বুট, কালাে ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিল,
বলেছিলাে অনাহার ও ক্ষুধার কথা।
সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলাে।
বুঝি সে-কারণে
ফর ফর কোরে টেনে ছিড়ে নেয়া হলাে তার শার্ট।
প্যান্ট খােলা হলাে। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস।
তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতাে উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পােস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লােহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলাে।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।
তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ঢুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথির হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলাে।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা।
লােহার সাঁড়াশি দিয়ে
একটি একটি কোরে উপড়ে নেয়া হলাে তার নির্দোষ নােখগুলাে।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।
সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে থােকা থােকা কৃষ্ণচূড়ার মতাে
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত।
তার থ্যাতলানাে একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের উপর,
আর সেই হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত্তর দুর্বিনীত লাভা-
ফাঁসির মঞ্চ থেকে
ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাদের যাত্রার শুরু।
এক একটি জন্মের সমান মেধাবী মৃত্যু
এক একটি পতিজ্ঞা-পুষ্ট মৃত্যুর সােপান
দুর্যোগ-অন্ধকারে তুলে রাখে সূর্যময় হাত-
তুমুল তিমিরে তবু শুরু হয় আমাদের সঠিক সংগ্রাম।
মৃত্যুর মঞ্চ থেকে
মৃত্যুর ভূমি থেকে
আমাদের প্রথম উত্থান।
যাকে তুমি মৃত্যু বলাে, যাকে তুমি বলাে শেষ সমূল পতন
আমি তার গভীরে লুকোনাে বিশ্বাসী বারুদের চোখ দেখে বলি
এই সব মৃত্যু কোনাে শেষ নয়, কোনাে বিনাশ, পতন নয়…
এইসব মৃত্যু থেকে শুরু হয় আমাদের সূর্যময় পথ,
এই ফাঁসির মঞ্চ থেকেই আমাদের যাত্রার শুরু।