সুকান্ত ভট্টাচার্য -এর কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

ছাড়পত্র

যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে

তার মুখে খবর পেলুম ।

সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,

নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার

জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে

খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত

উত্তোলিত, উদ্ভাসিত

কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।

সে ভাষা বােঝে না কেউ,

কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।

আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা।

পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের

পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর

অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বাংসন্ত্রপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযােগ্য ক’রে যাব আমি-

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস।

হে মহাজীবন

হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়

এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনাে

পদ-লালিত্যঝঙ্কার মুছে যাক

গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানাে!

প্রয়ােজন নেই, কবিতার স্লিদ্ধতা-

কবিতা তােমায় দিলাম আজকে ছুটি,

েক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময় ।

পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানাে রুটি।

সিঁড়ি

আমরা সিঁড়ি,

তােমরা আমাদের মাড়িয়ে

প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,

তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে

তােমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক

পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।

তােমরা তা জানাে,

তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত

ঢেকে রাখতে চাও তােমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে

আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে

তােমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।

তবুও আমরা জানি,

চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে

চাপা থাকবে না।

আমাদের দেহে তােমাদের এই পদাঘাত।

আর সম্রাট হুমায়ুনের মতাে

একদিন তােমাদেরও হতে পারে পদস্থলন

সুতরাং

এত দিন ছিল বাঁধা সড়ক,

আজ চোখে দেখি শুধু নরক!

এত আঘাত কি সইবে,

যদি না বাঁচি দৈবে?

চারিপাশে লেগে গেছে মড়ক।

বহুদিনকার উপার্জন,

আজ দিতে হবে বিসর্জন।

নিষ্ফল যদি পন্থা

সুতরাং ছেঁড়া কন্থা

মনে হয় শ্রেয় বর্জন।

আমার মৃত্যুর পর

আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন,

বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে

জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে,

উজ্জ্বল আলাের চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন।

পরিচয়ভারে ন্যুজ অনেকের ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের

মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের।

কিছুকাল সম্তর্পনে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ।

জীবনের যত অনাদর

আমার মৃত্যুর পর,

লাঞ্ছনার বেদনার, স্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর।

অনুভব

।১৯৪৬৷

বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে

আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে,

এত বিদ্রোহ কখনাে দেখে নি কেউ,

দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ;

স্বপ্নচূড়ার থেকে নেমে এসাে সব-

শুনেছ? শুনেছ উদ্দাম কলরব?

নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট;

রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট।

প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত,

দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত;

তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি,

তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি।

তাইতাে চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে-

বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে ।

মন্তব্য: