আঠারােই সেপ্টেম্বর

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এম, আসলাম লিটন

১.

হালাে মঈন! ফোন ধরিস না কোনাে?’ মায়ের কণ্ঠে আকুলতা।

‘মা, আসলে একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম, ধরতে পারিনি। স্যরি মা, বলাে কেমন আছোে?’

‘ভাল, তুই কেমন আছিস বাবা? সম্ভ, বৌমা? ওরা কেমন আছে?’

‘সবাই ভাল আছি মা। আমাদের নিয়ে তুমি মােটেই চিন্তা করাে না।’

‘সম্ভ অনেক বড় হয়ে গেছে নারে?’

‘হুম, চার বছরে পড়লাে। লম্বাও হয়েছে বেশ! খুবই দুষ্টু হয়েছে মা।’

‘তাের মতই! তুইও কি কম ছিলি ছােটবেলায়! একবার যদি চোখের দেখাটাও দেখতে পেতাম! মরেও শান্তি পেতাম!’

‘এসব কথা বলাে না তাে মা। সব সময় আজেবাজে চিন্তা করে শরীর নষ্ট করোে!’

‘বৌমা আর সম্ভকে নিয়ে একবার আয় না বাবা!’

‘যাবাে মা, হাতের কাজ গুলাে একটু গুছিয়ে নিই।’

‘তাের যদি খুব ব্যস্ততা থাকে তাে বৌমা কে পাঠিয়ে দে না একবার! আমেরিকান মেয়েরা তাে একাই যাতায়াত করতে পারে।’

‘ওরও খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে মা। আমরা নতুন একটা ফার্ম দিয়েছি। গুছিয়ে উঠতে হিমসিম খাচ্ছি।’

‘ও!’ মায়ের বুকে হাহাকার খেলে যায়।

‘তােমার কি শরীর খারাপ মা? তােমার গলা এমন লাগছে কেন?’

মা ঈষৎ স্তম্ভিত। ঈষৎ আশ্চার্যান্বিত এবং আপ্লুতও। ছেলে তার কণ্ঠ শুনে শরীরের অবস্থা অনুভব করতে পারছে! তার মানে ভোলেনি! মাকে ভুলে যায়নি মঈন। সুখানুভূতি খেলে যায় মায়ের সর্বাঙ্গে। বিলােড়িত অজস্র ধবল পালক উড়ে যায় বাউল বাতাসে। সমস্ত ভালােলাগাকে কণ্ঠে পুঞ্জিভূত করলেন মা।

‘কই নাতাে! একটু দুর্বল লাগে ক’দিন থেকে। এমন কিছু না। একা একা থাকতে আর ভাল লাগে নারে মঈন।’

‘তােমাকে তাে কতবার বললাম মা, চলে এসাে! আমেরিকায় কি মানুষ থাকে না? কী যে তােমার ইচ্ছা, বুঝি না!’

না বােঝার কী আছে? এই বাড়িতে জমে আছে শতজনমের প্রেম! কত স্মৃতি, কত সহগ্র ভালবাসা! চাইলেই কি আর সবকিছু ছিন্ন করা যায়! কেউ পারে পারুক, আমি পারবাে না! সেই সতের বছর বয়সে যখন বেনারসী আবৃত হয়ে এই বাড়িতে পদার্পণ, তখন শাশুড়ি বলােছিলেন, ‘লাল বেনারসী পরে ঢুকলে বৌমা, সাদা কাফন ছাড়া বের হইওনা।’ কিশােরী বুকের গহীনে সেই মর্মরগাথা এমন ভাবে গেঁথে গেছে যা আজ চাইলেও উপড়াতে পারবাে না। তােরা কেউ বােঝার চেষ্টা করিস না আমার মন্ত্র-মর্যাদার কথা।

এসব কথা বলতে ইচ্ছে করলেও বলেন না মা। কেউ বুঝলে বুঝবে, না বুঝলেও কিছুকরার নাই। তাই শত ব্যকুলতাময় উত্তরমালাকে অগ্রাহ্য করে মা শধু একটি কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন ‘না বাবা, ভিনদেশে গিয়ে থাকতে পারবাে না।’

‘কী আর করা! ঠিক আছে, যদি কখনাে মতামত পরিবর্তন করাে তাহলে বলো, আমি সব ব্যবস্থা করবাে।’ মঈনের কণ্ঠে হালছাড়ার গান।

মা কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন। লাইন কেটে গেল। মােবাইল ফোনটা গালে ঠেকিয়ে বসে থাকলেন মা। মায়ের গালে ছুঁয়ে গেল মঈনের নরম গাল। রক্তের প্রবাহ অনুভব করলেন মা। যেন দুই রক্তস্রোতধারা মিলিত হয়ে সঞ্চারিত হচ্ছে ধমনীতে। প্রবাহিত হচ্ছে মগজের কোষ থেকে বক্ষে… বক্ষ থেকে আপাদমস্তক।

ছেলে যে সেই পড়ালেখা করতে আমেরিকা গেল, আর এলাে না। মা পথ চেয়ে বসে থাকেন নিরন্তর। ছেলে আসে না। পড়াশুনা শেষ করলাে। আমেরিকাতেই কাজে লেগে গেল। বিদেশিনীকে বিয়ে থা করলাে। পুত্রের বাবা হলাে… জীবন প্রসারিত হলাে ওখানেই। সময় আর ফাঁক-ফোকর রাখেনি।

পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা স্বামী স্বপেশায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘তােমার কলিজার দুটি অংশ, একটি আমি আর আরেকটি মঈন। কথাটা বড়ই মধুর ঠেকেছিল মায়ের মনে তাই কলিজাটা আর বেশি ভাগে বিভক্ত করেননি মা। অথচ সেই স্বামী হুট করে চলে গেলেন অনন্ত পরবাসে। মঈন ঠাঁই নিল আমেরিকায়।

সেই থেকে নিঃসঙ্গতা! শুধুই নিঃসঙ্গতা। মা এখন খেলা করেন শুধুই বিছানা-পত্র, আসবাব-পত্র, তৈজসপত্র আর দরজা-জানালার সাথে। একঘেঁয়েমি গ্রাস করলে আশ্রয় নেন উপর তলার ভাড়াটে কন্যা তনুশ্রীর কাছে। অবােধ শিশুর মত খেলাপাতি খেলেন কিছুক্ষণ! অথবা কারণে অকারণে ছুটে যান গলির মােড়ে শুকুরের মুদির দোকানে। লবণ অথবা বিস্কুট কেনার ছলনায়। এই তাে মায়ের সংসার, জীবনের পরিসর! এরাই তার খেলার

সাথী, পুত্র-কন্যা। পরম বন্ধু!

এসবেও যখন আর ভাল্লাগেনা, মা নিভৃতে হাতের মুঠিতে চেপে ধরেন মােবাইল ফোন সেটটা। বােতামগুলােয় বিলি কাটেন পরম পরশে। মঈনের নাম্বারটা বের করে বােতামে চাপ দিয়েও কেটে দেন বারংবার। কে জানে, হয়তাে ব্যস্ত আছে! ক্লায়েন্ট ফেস করতে হিমসিম খাচ্ছে। বিরক্ত করা কি ঠিক হবে?

হবে। আমি বিরক্ত করবাে না তাে ক করবে? আমি মা। নিঃসঙ্গ মায়ের গহীনে যখন রক্তক্ষরণ হয়, তখন মা তাে তার কলজের টুকরােকে নাড়া দেবেই। এটা তার অধিকার। চিরন্তন অধিকার! পৃথিবীর কারাে সাধ্য কী বাধ সাধার!

তবুও চুপসে যান মা। মহাকালের শূন্যতা গ্রাস করে বুকে। অবশেষে মােবাইল ফোনের সেটটা গালে চেপে ধরেন পরম সুখে। নিমেষেই বুঁদ হয়ে যান ঘােরে। কল্পনার ক্যানভাসে আঁকতে থাকেন অজস্র জলর। ভাসা-ভাসা, ধোঁয়া ধোঁয়া… ঘােলাটে সব বিচিত্র ছবি….!

জলে একাকার হয়ে রঙগুলাে ঢেপসে যায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়… এক রঙ আরেক রঙের

সাথে মিশে জন্ম নেয় আরেকটি রঙ! আবেসিত মনে মা চাপ দেন ফোন সেটের সেন্ড বাটনে। তার বুকের হাহাকার ছুটে চলে ক্ষীপ্র গতিতে। দেয়াল ভেদ করে… লােকালয় ভেদ করে… মাঠ-ঘাট-প্রান্তর ভেদ করে

যােজন যােজন দূরে…. বহু দূরে… স্বপ্লের রাজ্যে।

‘হ্যালাে, মা! ফোন কেটে দিলে কেন?’

‘আমি তাে কাটিনি বাবা”

‘ও। নেটওয়ার্কের সমস্যা হতে পারে।’

‘হবে হয়তাে,…’

আজকাল সত্যি নেটওয়ার্কের বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। যান্ত্রিক নেটওয়ার্ক যত বিকসিত হচ্ছে বিলীন হয়ে যাচ্ছে উপস্থিত অনুভব। তাইতাে সন্তানের গাল ভেবে চেপে ধরতে হয়ছে ধাতব ফোন। অনুভেদক কথামালায় সমাপ্ত হচ্ছে দায়িত্ব।

‘চুপ কেন মা! কিছু বলবে?’

‘একবার আয় না বাবা! তােদের দেখতাে বড় ইচ্ছে করছে!’

‘আচ্ছ মা, আসবাে.. সত্যি আসবাে!’

‘কবে রে?’

‘তুমি যেদিন বলবে?’

‘আঠারাে তারিখ তাের জন্মদিন, আয় না বাবা।’

‘ও তাই তাে। ভুলেই গেছিলাম। ঠিক আছে মা, আসবাে… অবশ্যই আসবাে!’

‘ঠিক তাে?’

‘একদম ঠিক মা।’

চেউ উথলে উঠলাে মায়ের সমুদ্রে। জলােচ্ছ্বাস আছড়ে পড়লাে তীরে। সূর্যরশ্মি থেকে ঝরে পড়া আলাের ফোটন গুলাে নাচতে নাচতে নেমে এলাে বিস্তীর্ণ জলরাশির চাদরে। প্রস্কুটিত পুষ্প জানান দিল বসন্ত কাল। উৎসবে মুখরিত প্রকৃতি। সেই উৎসবে বিলীন হলাে মায়ের উচ্ছ্বাস। প্রজাপতি তার ডানায় পেল শতজনমের ভর। মা এখন উড়ছেন… বেডরুম থেকে

ড্রইং রুমে… ড্রইংরুম থেকে রান্নাঘরে… দরজা জানালা.. আসবাবপত্রে, তৈজসপত্রে… উপরতলার ভাড়াটে তনুশ্রী আর শুকুরের মুদির দোকানে… !

থাকবে কোথায়, শােবে কোথায়, বসবে কোথায়, হাঁটবে কোথায়… কী খাবে.. কী পরবে… মায়ের মনে অজস্র প্রশ্নের ফুলঝুরি।

আঠারােই সেপ্টেম্বর। উদ্বিগ্নতায় সারাদিন পার করলেন মা। পাখির ডানা ঝাপটানাের অনুশব্দেও বিচলিত মাতৃবক্ষ। ছুটে গেলেন বারংবার দরজার দিকে বারংবার হতাশাবিদ্ধ। মা ব্যাকুলতায় হেঁটেছেন সারাদিন। বেডরুম থেকে ড্রইংরুমে… রান্নাঘর থেকে বারান্দা… দরজা থেকে জানালায়.. তনুশ্রীর উপরতলায় এবং শুকুরের মুদির দোকানে। দিন গেল…

বিকেল গেল.. সন্ধ্যে পেরিয়ে এখন মধ্যরাত। গহীন অন্ধকার গ্রাস করেছে পৃথিবী।

অবশেষে আঁধারঘনকালে পুঞ্জিভূত হতাশাকে দুমড়ে মুচড়ে বিমােহিত হলেন মা। এমন রাত বুঝি আর ফিরবে না কখনাে…! অতএব আলিঙ্গনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিলেন তিনি। একে একে বন্ধ করে দিলেন সমস্ত দরজা-জানালা, বৈদ্যুতিক পাখা… সমন্ত আলাে।

দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন ফুল আর বেলুনে সজ্জিত কক্ষে। টেবিলে থরে থরে সজ্জিত রাখা হয়েছে দুধের ঘন পায়েশ. জর্দাপােলাও, পিঠা-পুলি… ফলমূল আর তিনস্তরবিশিষ্ট কলেট কেক। মা অতঃপর এই কক্ষের বাতিও নিভিয়ে দিলেন। নিমেষেই অন্ধকার… গাঢ় অন্ধকার আহ! কী বিমােহিতকর মুহূর্ত!

মােমবাতি জ্বাললেন মা। তিনস্তর বিশিষ্ট চকলেট কেকের ওপর পুঁতে দিলেন সেটা। আলাে আঁধারীময় কক্ষটি পরিণত হলাে ইন্দ্রপুরিতে। মায়াডােরে আপ্লুত হলেন মা। অন্ধকার ভেদ করে ধেয়ে আসা আলাের স্রোতে পুণ্যস্নান সারলেন। অতঃপর স্টেইনলেস স্টিলের চুরিটা হাতে তুলে নিয়ে দুপ্তহস্তে চালিয়ে দিলেন চকলেট কেকের বুকে। ফিনকি দিয়ে বিচ্ছুরিত হলাে লাল রক্ত। আর বুকের ভেতর থেকে উদৃগীরিত হতে হতে শুরু করলাে সেই কালজয়ী গান… জন্মদিন… শুভ জন্মদিন তােমার…!

নিমেষেই জুলে উঠলাে আরেরকটি মােমবাতি। আরেকটি… আরেকটি.. আরেকটি… আরেক ডজন… শত থেকে সহস্র! কক্ষময় গ্রাস করলাে প্রজ্জ্বলিত মােমবাতির সমাবেশ। স্তরে স্তরে সারিবদ্ধ মােমবাতিগুলাে সমবেত নৃত্য যখন মত্ত হলাে মা তখন প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করলেন। দড়দড়িয়ে ঘামছেন মা। কাপছে পুরাে শরীর। মা তবু বিচলিত নন। হাতে

তখনাে চকচকে চুরি… যেন হজরত ইসমাইলের গলায় সজোরে ছুরি চালিয়ে গর্বিত হজরত ইব্রাহিম। কণ্ঠে মহামিলনের সুর! মা গাইছেন… কাঁপছেন… এবং দুলছেন স্বপ্নদোলায়!

৩.

‘মাইল এ্যাটাক, সামলাতে পারেননি। পােস্টমাের্টেম রিপাের্টটা পেলে বােঝা যাবে।’ 

পুলিশ কর্মকর্তার কথায় ঘাের কাটে মঈনের। কতক্ষণ থানায় বসে মনে করতে পারছে না। মাঝে মাঝেই চিন্তার সুতাে ছিড়ে ঝিড়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে।

‘এটাকে পুলিশ কেস হিসেবে নিচ্ছেন কেন?’

‘পুলিশ দরজা ভেঙে ঘর থেকে লাশ বের করেছে। এটা পুলিশ কেস হিসেবই বিবেচিত হবে।’

মায়ের মরা মুখটি দেখার ভাগ্য হয়নি মঈনের। লাশ সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা এই ছােট্ট শহরে নেই। অবশ্য ফোনে মঈনের পরামর্শেই শেষ পর্যন্ত দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। শুকুর আর তনুশ্রী সব ব্যবস্থা করেছে।

হাতের মুঠোয় ফোনটা নাড়াচাড়া করছে মঈন। মায়ের নাম্বার স্ত্রীনে ভেসে উঠতেই রিং দিতে ইচ্ছে করলাে। কিন্তু মা এখন কোথায়! নেট ওয়ার্ক কি পাওয়া যাবে? অনুভেদক আন্তঃজালের কি সাধ্য আছে সেখানে পৌছাবার!

‘আপনার না আঠারাে তারিখ আসার কথা ছিল?’

আবারাে ফিরে আসে মঈন। ‘কই, না তাে! কে বললাে?’

‘এরকমই তাে শুনলাম। আপনি নাকি ফোনে জানিয়েছিলেন আপনার মাকে?’

‘কোথাও ভুল হচ্ছে আপনাদের। গত সপ্তাহে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে লাইনটা কেটে গেল। আর তাে লাইনই পেলাম না। অনেক চেষ্টা করেছি।’

‘ফোন সেটটা আমরা যখন হাতে পাই তখন ব্যাটারীতে চার্জ ছিল না। আপনার মা আপনার জন্মদিন পালনের সব ব্যবস্থা করেছিলেন।’

হোঁচট খেলাে মঈন। মনে পড়লাে আঠারই সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন ছিল।

মন্তব্য: