स्वदेश दीपक

স্বদেশ দীপক

স্বদেশ দীপক(জন্ম ১৯৪২) হিন্দিভাষার বিখ্যাত ভারতীয় প্লে রাইটার, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। হিন্দিভাষায় লেখা তাঁর  নাটক ‘ কোর্ট মার্শাল’ বিশেষভাবে সমাদৃত ও জনপ্রিয়। মূল হিন্দিসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় এটি অনূদিত হয়ে মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ছোটগল্প লেখার মাধ্যমে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের ফলে নিজস্ব আবাস ছেড়ে তার পরিবার রাজপুরা শহরে বসতি স্থাপন করার পর ম্যাট্রিকুলেশন থেকে স্নাতকোত্তর (হিন্দি ও ইংরেজি) ডিগ্রি  আম্বালা শহর থেকে অর্জন করেন। ভারত ভাগের ফলে দুর্ভোগের শিকার হয় তাঁর পরিবার।  তিনি তাঁর লেখা গল্পগুলোতে দেশবিভাগের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার কাহিনী তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখাসমৃদ্ধ গল্পসংকলনের নাম ‘ প্রতিনিধি কাহানিয়াঁ’।  হিন্দি ভাষায় লেখা তাঁর ছোটগল্পের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আশারোহি(১৯৭৩), মাতম(১৯৭৮) তমসা( ১৯৭৯), প্রতিনিধি কাহানিয়া( ১৯৮৫), বাল ভগবান (১৯৮৬) কিসি অপ্রিয় ঘটনা কা সমাচার নহিঁ(১৯৯০), মাসখরে কভী রোতে (১৯৯৭), নির্বাচিত কাহানিয়া (২০০৩) ইত্যাদি। তাঁর লেখা নাটকের মধ্যে নাম্বার ৫৭ স্কোয়ার্ডন ( ১৯৭৩), মায়াপোত (১৯৮৫) এর নাম করতে হয়। স্বদেশ দীপক প্লে রাইটার হিসাবে নাটক বাল ভগবান (১৯৮৯), কোর্ট মার্শাল (১৯৯১), জলতা হুয়া রথ (১৯৯৮), সবসে উদাস কবিতা (১৯৯৮), কাল কোঠারী (১৯৯৯) ইত্যাদি প্লে লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লেখায় সমাজের নানা ধরনের অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচার, দরিদ্রদের প্রতি নিপীড়নের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। হিন্দি ভাষায় লেখা স্বদেশ দীপকের   ‘পায়াপি পেট’ গল্পের নিরুপমা দত্তের ইংরেজিরা ভাষান্তর ‘অরিজিনাল সিন’ এর বঙ্গানুবাদ করা হলো ‘আদিম পাপ’ নামে।]

আদিম পাপ

স্বদেশ দীপক

অনুবাদ: মনোজিৎকুমার দাস

কয়েক মিনিট পর ক্ষুধার্ত কুকুরের মত লোকটার প্লেটের লুচি-পুরী ও অন্যান্য খাবারের উপর বালকটির লোলুপ দৃষ্টি পড়লো। লোকটার হাতে বড়সড় একটা ডিনার প্লেটে । ট্রেনের কোচে  লোকটার খাবার প্লেটের পাশে বালকটি দাঁড়িয়েছিল। প্লেটের খাবার দেখে তার শরীরটা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। তার সাত বছরের জীবনে তার একমাত্র সাথী ক্ষুধা। লোকটি উচ্ছিষ্ট খাবার কোচের জানালা দিয়ে ফেলে দেবে ভেবে ছেলেটির চোখদুটো উচ্ছিষ্ট খাবারের দিকে বিশেষভাবে নিবদ্ধ হলো। মুহূর্তের মধ্যে, লোকটির চোখ দুটো ছেলেটির লোলুপ দৃষ্টির উপর পড়ায় সে বিরক্ত হয়ে গোগ্রাসে তার খাবার খেতে লাগলো। ছেলেটির লোলুপ দৃষ্টির সামনে সে তার খাবার শেষ করে উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো জানালার বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে লোকটা ছেলেটির লোভী দৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলো। উষ্ঠিষ্ট খাবার ফেলে দেয়ায় ছেলেটির শরীর যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। তার জীবের জল নিমিষে উবে গেল। লম্বা একটা হুইসেল দিয়ে ট্রেনটি প্লাটফরমের ছাউনি নিচে গিয়ে ধীরে ধীরে থামলো।

প্রত্যেক দিনের মত ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে ঠেলাগাড়িতে খাবার বেচা হকারের কাছে পৌঁছালো। তাকে এখন হকারের অপরিষ্কার প্লেটগুলো পরিষ্কার করতে হবে, ছেলেটি ভাবলো। হকারটি তাকে দেখেও না দেখার ভান করলো। সে ভয়ে ভয়ে অনেকক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে একবার ইচ্ছে হলো ওখান থেকে চলে যাবার। শেষে হকারটি বলে বসলো, “এখান থেকে ভাগ, পরিষ্কার করার মত কিছু নেই।” 

ছেলেটি মাটির দিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। “শুনতে পাস্নি? কানে কি তুলো দিয়েছিস্? দেখলি তো পুরো ট্রেনের মাত্র দু’জন যাত্রী খাবার খেল। তা হলে কি বাসন ধোবার দরকার থাকতে পারে। হকারটি বললো, “মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যা। তা  না হলে তোর গালে একটা থাপ্পর মারবো।

ছেলেটি তার মাথা উঁচু করে হকারের দিকে তাকাবার চেষ্টা করলো ।  সে জানে মানুষ কখন কী অবস্থায় তাদের ধৈর্য হারিয়ে ফেললে এ ধরনের রাগ দেখায়। ছেলেটি ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

স্টেশনের আলোগুলো জ্বলে উঠলো। ছেলেটি উপলব্ধি করলো যে রাত নামছে, এখন তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। বাড়ি যাবার আগে তাকে আরো দুটো জায়গায় যাওয়া লাগবে। সে টি স্টলের সামনে এসে দাঁড়ালো। চাওয়ালা কেটলির জলে চায়ের পাতা দিয়ে তা ভাল ভাবে বয়েল করবার আগে ছেলেটি কেটলির গায়ে হাত দিলে চাওয়ালা তাকে গালি দিয়ে বললো,“এখান থেকে কেটে পড়! এটা তোর বাপের সম্পত্তি পেয়েছিস্। সব ভিক্ষুকরাই স্টেশনটাকে তাদের নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করে।”

ছেলেটি ওখান থেকে বের হবার সময় ভাবলো, সবাই গালমন্দ করতেই জানে। তার ইচ্ছে হলো সবাইকে অভিশাপ দিতে। চাওয়ালা রাগে গর্জে উঠে বললো,“ কী করছিস্?  কানে শুনতে পাস্ না। চা’র পাতা কাল নিস্। ওগুলো ফেলে দেবার আগে আবার ওগুলো ব্যবহার করবো।”

ছেলেটি ওখান থেকে কেটে পড়লো। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় একটুও বাতাস নেই। প্লাটফরমে সাদা কাগজের একটা ব্যাগ দেখতে পেয়ে  ছেলেটির মুখে হাসি ফুটলো । সে দৌড়ে গিয়ে ওটা তুলে নিয়ে মুখে পুরে ওটাতে ফুঁ দিলে তা ছোট্ট একটা বেলুনের আকার নিল। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সে বেলুনটিতে আঘাত করলো। শব্দ করে ওটা ফেটে গেলে ছেলেটি বেজায় আনন্দ পেল। তার প্রতি দুর্ব্যবহারের কথা ভুলে গিয়ে সে গোডাউনের দিকে হাঁটতে লাগলো। 

ওখানে গমের বস্তাগুলো মজবুত করে রাখা ছিল। ওখান থেকে ওগুলো মালগাড়িতে তুলে অন্য স্থানে পাঠানো হচ্ছিল। সে জানে না কোথায় পাঠানো হচ্ছিল। কিছু গম বস্তা থেকে বের হয়ে গোডাউনের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ছিল। ছেলেটি মেঝে থেকে সেগুলোকে ঝাড়– দিয়ে এক জায়গায় করে তার গায়ের শার্টটাকে একটা থলির মতো করে তার মধ্যে সেগুলো পুরে বাড়ি নিয়ে গেল। সেদিন সে জানে না মা সে গম থেকে কীভাবে ময়দা তৈরি করে রুটি বানিয়েছিল। দু’জন পুলিশ সব  সময়ই গোডাউনটা পাহাড়া দেয়। তাদের মধ্যে একজন পুলিশ লম্বা। নাকের নিচে বড় একজোড়া গোঁফ, লোকটা বাঁশের মতো লিকলিকে। ছেলেটি ভাবে লোকটা নাম মোচ্ছাল হবে হয়তো।  গোডাউনের মেঝেয় পড়ে থাকা গম ঝাট দিয়ে বালকটি এক জয়গায় করার সময় গোঁফওয়ালা পুলিশটা ছেলেটির পিঠে লাথি মারার চেষ্টা করলো। অন্য পুলিশটি গোডাউনের মধ্যে চক্কর দিচ্ছিল। ছেলেটি ভাবলো এ পুলিশটিকে মোটকা নামে ডাকা যেতে পারে। মোটকা ছেলেটিকে লাথি মারা থেকে মোচ্ছালকে বিরত করার জন্য চেষ্টা করলো। পুলিশ দুটোর হাতের বেতের লম্বা ছড়ি দুটো মজবুত। মোটকা পুলিশটিকে ছেলেটির ভাল লাগলো। গোডাউনের দরজার পাশে বসে পুলিশ দুটো বিড়ি টানতো।   

কিন্তু আজ, ছেলেটি ভেতরে যেতে ইতস্তত করছিল। আজ, পুলিশদুটো হাতে বন্দুক নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। প্রত্যেকটি বন্দুকের ডগায় ধারালো চাকু চকচক করছিল। ছেলেটি এগিয়ে এলো। মোচওয়ালা পুলিশটি তার দিকে তাকালো। ছেলেটি তার কাছে এগিয়ে এলে পুলিশটি তার গালে একটা থাপ্পর মরলো। ছেলেটি থাপ্পর খেয়ে ছিটকে পড়ে দরজার গিয়ে ধাক্কা খেল। মোচওয়ালা পুলিশটি ছেলেটির দিকে বন্দুক তাক করলো। ছেলেটির গলা থেকে ইঞ্চি দু’য়েক দূরে বন্দুকের চকচকে বেয়োনেট!

“তুই জানিস এটাকে কী বলে?”

ছেলেটি নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো।

“বেয়োনেট, শুয়োর এটা বেয়োনেট! এটা যদি একটু ঢুকিয়ে দেই তবে তোর গলা কেটে পড়ে যাবে।”

ছেলেটির পা দু’খানা থর থর করে কাঁপতে লাগলো। সে ওখান থেকে কেটে পড়তে চাইলো।

“কেটে পড়। বাচ্চা ছেলেটিকে মেরে  ফেলার  ভয় দেখিয়ো না।”

মোটকা এক ঝটকায় তার হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নিল।

ছেলেটি চোখ তুলে তাদের দিকে তাকালো।  তাকে কি ভেতরে ঢুকতে দিবে?

“তুই কি গম চাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ,” ছেলেটি তার মাথা নেড়ে ইতিবাচক ভঙ্গি করলো। “যা ভেতরে যা। তুই তোর বোনকে ভালবাসিছ্? কেন তুই আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আসিছ্?”

ছেলেটি এক পা এগিয়ে গেলে মোচওয়ালা পুলিশটি প্রথমে ছেলেটির চুল পেড়ে ধরলো। তারপর গলাটা ধরে নিজের দিকে টান দিল। সে তার লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে ছেলেটির নাকটা চেপে ধরলো। ছেলেটি চিৎকার করে উঠলো। এতে পুলিশটি আরো জোরে চাপ দিল। একটা ধাক্কা দিয়ে সে ছেলেটিকে মেঝের দিকে ছুঁড়ে দিল। মার খাওয়া একটা কুকুরের মত ছেলেটিকে দেখাচ্ছিল। মোচওয়াল পুলিশটি গর্জে উঠলো। “কুত্তার বাচ্চা কোথাকার, তুই জানিস্ তোর স্টেশনে আসা মানা? তুই চুরি করতে আসিস্? আমি তোর পেটের মধ্যে এই বেয়োনেটটা সেঁধিয়ে দেব, হ্যাঁ এই বেয়োনেটা?  ছেলেটি ভয়ে কুঁকড়ে গেল। এক সময় সে কান্না থামালো। মোচওয়ালা ও সে অবাক হলো এই ভেবে: কেন মোটকা কোন কথা বলছে না?

“তোর বোন কী করে রে?” মোটকা পুলিশটি ধীরে সুস্থে জিজ্ঞাসা করে। 

“ও রেললাইনে কয়লা কুড়োয়।” “কুত্তার বাচ্চা, যদি ও রেললাইনে আবার যায় তবে আমরা ওর পা দুটো কেটে নেব। তুই জানিস না তোদের রেললাইনে ঘোরাফেরা করা বারণ?” মোটকা পরে আর কী আদেশ করে তা শোনার অপেক্ষায়  তারা থাকে।

“এক দৌড়ে বাড়ি গিয়ে বোনকে সাথে করে একটা থলি নিয়ে আয়। তোর বোন থলি ভরবে। থলি ভরা গম তুই একা নিয়ে যেতে পারবি নে। ”

এক থলি গম বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে এ আশায় ছেলেটি বাড়ির দিকে দৌড় লাগালো। স্টেশনের বাইরের বড় ব্রীজটির নিচে বস্তিটির কাছে সে হাজির হলো। আঁধার ঘনিয়ে আসছে। এক লাফে ড্রেনটা পার হয়ে সে বস্তিতে পৌঁছালো।

মা কুঁড়ে ঘরের মেঝেয় শুয়ে আছে, তার ভাঙ্গা পায়ে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। ব্যান্ডেজের উপর মাছি ভন ভন করছে। বোন তিনটে ইট দিয়ে তৈরি চুলো ধরানোর চেষ্টা করছে।

“কিছু এনেছিস্? মা কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো। “আনিস্ নি, সারাদিন কী করছিলি, বেজম্মা? ছাওয়ালপলের সাথে খেলা করছিলি? তুই কি জানিস্নে আমি দু’দিন কিছুই খাই নি?”

একপায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে বসে সাড়াশী দিয়ে ধরার মত ছেলেটির কব্জি আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে টেনে ধরে মা তাকে মারতে শুরু করলো।

মেয়েটি চুলোর কাছ থেকে দৌড়ে এসে ভাইটিকে মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। মা তার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে চললো,“তুইও একটা কুত্তার বাচ্চা, তোর সাথেও কোন কথা নেই। তুইও ওর মতই খারাপ। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকিস্, এক টুকরো কয়লা নিয়েও আসতে পারিস্ না।”

পা ভাঙ্গার আগে মা কয়লা কুড়াতে যেত। ট্রেনের চাকায় একটা পা কাটা যাওয়ার পর তার বোনই কয়লা কুড়াতে যায়। কয়লা বেচে সামান্য যে টাকা পায় তা দিয়ে লবণ -মরিচ টরিচ কেনে।

“আমি শ’বার বলেছি যে পুলিশরা এখন কাউকে রেললাইনের ধারে কাছে ঘেষতে দেয় না।” বালিকাটি মায়ের কথায় প্রতিবাদ করে বলে। 

সে সময় পুলিশের বলা কথাগুলো ছেলেটির মনে পড়ায় সে মায়ে বলে: “মা!”

“কী বলছিস?”

“ওকে আমার সাথে গোডাউনে পাঠাও।”

“কেন?”

“সেখানকার পুলিশটি বলেছে যে সে আমাকে এক থলি গম দেবে যদি আমি আমার বোনকে সাথে করে ওখানে নিয়ে যাই।” কথাটি শুনে মা নীরবে ছেলে ও মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। তার চোখ দুটো তার মেয়েটির সারা শরীরের প্রতি অংশকে যেন জরিপ করে।  মেয়েটির বয়স বার বছর, তবুও এখনো তার শরীরে নারীত্বের কোন চিহ্ন নেই। তবু সে তাকে পাঠাবে না। তারপর সে ভেবে দেখলো এখন তাকে ভাইয়ের সাথে পাঠালে খারাপ কিছু ঘটতে পারে এমন কোন কারণ দেখছে না। মেয়েটির বয়স বাড়লে আগামীতে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। 

“মুখ পরিষ্কার করে একটা থলি সাথে নিয়ে ভাইয়ের সাথে যা।”

মেয়েটি বাইরের ট্যাপের জলে মুখটা পরিষ্কার করলো। 

ভাইটি একটা থলি নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলে মা বালিকাটিকে বললো: “শোন, বেশি চিৎকার চেচামেচি ও কান্নাকাটি করবি নে।”

“কেন আমি কান্নাকাটি করতে যাব?”

“তবে এবার যাও!” মা তার পিঠটা কাত করে শুয়ে পড়লো।

বাচ্চা দুটো এক দৌড়ে গোডাউনের কাছে হাজির হলে মোটকা পুলিশটি ছেলেটিকে কাছে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“তুই কি লুচি-পুরী  খেতে পছন্দ করিস্?”

ছেলেটি হ্যাঁ বলতে ভয় পেল। সে ভাবলো, আজ এ পুলিশ দুটোর কী হয়েছে? মোটকা কয়েকটা কয়েন ছেলেটির হাতে দিল। 

“যা ছেলে, স্টেশনে গিয়ে লুচি-পুরী খেয়ে আয়।”

ছেলেটি তার হাত থেকে কয়েনগুলো নিয়ে একটা কুকুর একটা রুটি পেলে যে ভাবে দৌড়ায় সেভাবে স্টেশনের দিকে দৌড় লাগালো। বালিকাটি মোচওয়ালা পুলিশটির  কাছে দাঁড়িয়ে রইলো।

“উস্তাদ, এ যে একবারেই বাচ্চা।”

“ভাবনার কোন কারণ নেই। ওর স্বাদ কাঁচা আমের মতো হবে।”

“একেবারেরই  বাচ্চা। ও কি সহ্য করতে পারবে?”

“একটু অপেক্ষা করো। আমি ওকে ভেতরে নিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে বড় করে আনছি।”

মোটকা মেয়েটির হাত ধরার সময় মালগাড়ির ইঞ্জিনটি গোডাইনের কাছে সান্টিং দেবার শব্দ শোনা গেল। আর সব শব্দ সান্টিং ও হুইশেলের শব্দের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল।

ছেলেটি স্টেশন থেকে ফিরে এসে দেখলো গোডাউনের বাইরে মোটকা দড়ির খাটিয়ায় বসে বিড়ি টানতেছে। মোচওয়ালা পুলিশটিকে চোখে না পড়ায় সে ভাবলো, সে তাহলে কোথায় গেছে।

“এদিকে এসো, বিড়ি খাও,” মোটকা তার হাতের জ্বলন্ত বিড়িটা ছেলেটির হাতে দিল। সে আয়েশ করে বিড়িতে টান দিল।

মোচওয়ালা বের হয়ে এলো। তাকে সব সময়ই রাগী রাগী ভাব মনে হয়। কিন্তু এবার তাকে খোশমেজাজী বলে মনে হলো।

“ওস্তাদ, বড়ই আমোদের ব্যাপার স্যাপার।”

“আর কোন কথা না। ওর থলিটা ভরে দাও।” মোচ্ছাল ছেলেটিকে নিয়ে গোডাউনের ভেতরে গেল। ছেলেটি তার বোনকে মেঝের উপর শুয়ে থাকতে দেখলো। বোনের উপর তার রাগ হলো। বোন গমগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করলে সে ওগুলো সহজেই নিয়ে যেতে পারতো। এখন তাকেই সব কিছুই করতে হবে।

ছেলেটি তার ছোট হাতটি দিয়ে গম জড়ো করতে লাগলো। মোচ্ছাল তাকে থামিয়ে দিয়ে তার বন্দুকের বেয়োনেটের ফলা একটা গমের বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। সে বেয়োনেটটা বের করে আনলো। মোচ্ছাল একটা ছোট ছিদ্র দিয়ে ট্যাপের জলের ক্ষীণ স্রোতের মত গম বের হয়ে আসতে শুরু করলে মোচ্ছাল তার নিচে থলিটা ধরলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে থলেটা ভরে গেল।

ছেলেটি দেখলো বোনটা তখন বাইরের দিকে আছে। তারা বাড়ির দিকে রওনা হলো।

“তাড়াতাড়ি হাঁট,” ছেলেটি বললো।

হাঁটতে মেয়েটির কষ্ট হচ্ছিল। সে পা টেনে টেনে হাঁটছিল। অন্য দিকে ছেলেটি আগে আগে চলায় বোনটা পেছনে পড়ে যাওয়ায় সে তার বোনের জন্য অপেক্ষা করতে  লাগলো।

“তুই তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারছিস্ না।”

ভাইয়ের কথা শুনে মেয়েটি তার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে সে তার ভাইয়ের মুখে একটা চড় মারলো। ছেলেটি ভয় পেয়ে কেঁদে উঠতেও ভুলে গেল।

বালিকাটি বস্তির ভেতরে গিয়ে কাটা গাছের মত আছড়ে পড়লো। সে তার পা দু’খানা এক করে গুঁঙিয়ে উঠলো। মা তাকে চুলার কাছে টেনে নিয়ে এসে একটা কাঠ দিয়ে চুলার গরম ইট বের করে আনলো। সে ওটা টেনে নিয়ে মেয়েটির কাছে নিয়ে গিয়ে একটুকরো কাপড় দিয়ে ইটটাকে জড়িয়ে সেটা মেয়েটির দু’পায়ের মাঝে রেখে বার বার সেক দিল। মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। এ দৃশ্য দেখে ভাইটি রেগে গিয়ে ভাবলো মা পাগল হয়ে গেছে। গরম ইটের ছ্যাকায় অবশ্যই বোনের পায়ে ঘা হয়ে যাবে।

থলের গম দু’দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। মেয়েটি সারাদিনই মাটিতে পড়ে রইল। মা ছেলের হাতে থলেটা ধরিয়ে বললো,

“গম আনতে গোডাউনে যা।

“আমি একা  যেতে পারবো না। আমার সাথে বোনটাকে পাঠাও।

“চুপ র্ক। এক দৌড়ে যেয়ে গম নিয়ে আয়্।”

“আমি যেতে পারবো না। যদি আমি একা যাই তবে পুলিশরা আমাকে মারবে। আমার সাথে ওকেও পাঠাও। ও যখন পুলিশদের কাছে ছিল তখন পুলিশরা আমাকে লুচি-পুরী  খাবার জন্য টাকা দিয়েছিল ”

ছেলেটি বস্তির দরজায় দিকে দৌড় লাগালো। সে জানে তার খোড়া মা দৌড়ে এসে তাকে মারতে পারবে না। মা মাথা খাটিয়ে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।

“শোন্, তোর বোন অসুস্থ। ও উঠে দাঁড়াতে পারছে না। পুলিশদের বলিস্, বোন ভাল হয়ে উঠলেই আবার তোর সাথে আসবে।”

মায়ের কথায় ছেলেটি বুঝলো যে তার বোন দু’এক দিন উঠে বসতে পারবে না।

সে গোডাউনে পৌঁছালে মোচ্ছাল তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো। “তোর বোন কি মারা গেছে? তবে কেন ও তোর সাথে আসে নি?”

“সে অসুস্থ।”

“মাদারচোদ–তুই মিছে কথা বলছিস্।” মোচ্ছাল তাকে গালি দেবার পর তাকে থাপ্পর মারতে উদ্যত হলে মোটকা তাকে থামালো।

“ও সত্যি কথাই বলছে। সে অবশ্যই অসুস্থ হতে পারে। তুমি তার সাথে আনাড়ীর মত কাজ করেছিলে।”

মোটকার কথায় ছেলেটির ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো।

“মা বলেছে যে বোন আমার সাথে আসবে একটু ভাল হলেই।”

তিনজনের কারো মুখে কোন কথা নেই। মোচ্ছালের চোখ দুটো যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠলো। তার শরীর কাঁপতে লাগলো। সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।

“কেন, তুমি এত উতলা হয়ে উঠছো?” মোটকা আস্তে করে মোচ্ছালকে জিজ্ঞাসা করলো।

উদভ্রান্ত মোচ্ছাল জবাবে বললো, “হ্যাঁ, উতলাই হয়েছি। আজ এই ছেলেটির স্বাদ নিতে হবে। মোচ্ছালের শরীর গরম হয়ে পেল। “শুকরটার গায়ে দুর্গন্ধ।” “ওহ আমার রুচিশীল ইংরেজ! একটা সাবান এনে ছেলেটিকে দাও। ও ভাল করে গোসল করে আসুক।”

মোচ্ছাল একখানা গায়ে মাখা সাবান নিয়ে এসে ছেলেটিকে বললো, “বাছা, এই সাবান দিয়ে কল থেকে গোছল করে আয়।” ছেলেটি তার জামাকাপড় খুলে কলের নিচে বসলো। মোটকা নলকূপের হ্যান্ডল চেপে ছেলেটিকে গোছল করানোর সময় ছেলেটির পোশাকের দিকে চোখ পড়ায় তার চোখদুটো মোচ্ছালের দিকে ইঙ্গিত করলো। মোচ্ছাল কাপড়গুলো হাতে তুলে নিয়ে ছেলেটিকে সাথে করে গোডাউনের ভেতরে গেল। সে চারদিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে লাগলো।

“আমার কাপড়চোপড়?”

“গোডাউনের ভেতরে গিয়ে ওগুলো পরিস্।” ছেলেটি গোডাউনের ভেতরে গেল। দু’জন পুলিশই তাকে অনুসরণ করলো। তারপর তারা দরজা বন্ধ করে দিল।

মোটকা ছেলেটির গলা চেপে ধরে তাকে নিচু করলো। মোচ্ছাল তার হাতদুটো একটা বস্তার ভেতরে ভরলো। তারা ছেলেটিকে একটা জন্তুর মত চার পায়ে দাঁড় করালো। গোডাউনটি আগুনের চুল্লির মত গরম। প্রচন্ড তাপ ও ভয়ের কারণ ছেলেটি জিবে বের করে হাঁপাতে থাকায়  তাকে জীবে বের করে হাঁপাতে থাকা কুকুরের মত লাগছিল । বাইরের দিকে অন্যান্য দিনের মত মালগাড়ি হুইশেল বাজিয়ে ইঞ্জিনে সান্টিং দেবার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

মন্তব্য: