আলো, ঠিক যেন জলের মতো

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

অনুবাদ: মিলন আশরাফ

ঠিক বড়দিনের সময় বালকেরা পুনরায় আবদার জানাল বাইচের নৌকার জন্য। তাদের বাবা বললেন, ‘কারতাহেনায় ফিরে যাবার বেলায় আমরা ওটা কিনবো।’ বড় ছেলে তোতো। বয়স নয়। ছোটটা ছয় বছরের হোয়েল। মা-বাবার চিন্তারও বাইরে গিয়ে তারা গোঁ ধরে বসল। সমস্বরে বলল, ‘না, আমাদের এটা এখানেই এবং এক্ষুণি চাই।’

প্রথমে মা বললেন, ‘এখানে শাওয়ার থেকে যে জল আসে, সেটা নৌকা চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়।’ তিনি এবং তার স্বামী বলছিলেন, তাদের কারতাহেনা ‘দে ইন্দিয়াস’ বাড়িটার সামনে আছে বড় উঠোন, তারই সংলগ্ন উপসাগরের কূলে একটি জাহাজ ঘাট। বড় একটা নৌ ছাউনি, যেখানে দু’দুটো বড় নৌযান রাখা সম্ভব। অথচ এখানে এই মাদ্রিদে, ‘৪৭ দে লা কাস্তেয়ানার’ ছয় তলাতে কেমন গাদাগাদি করে আছে তারা। শেষ পর্যন্ত মা-বাবা কেউই বাইচের নৌকা দেওয়া বিষয়টা উড়িয়ে দিতে পারলেন না। কারণ তারা কথা দিয়েছিলেন, যদি বাচ্চারা শ্রেণি পরীক্ষায় পুরস্কার পায়, তাহলে দিগনির্ণয় যন্ত্র লাগানো বাইচের নৌকা উপহার দিবে তাদের। বাচ্চারা কথা রেখেছে, এখন মা-বাবার পালা। সুতরাং বাবা চুপিচুপি মাকে না জানিয়েই বাইচের নৌকা কিনে আনলো। মাকে জানালে, বাধা দিতো কারণ বাবার জুয়া খেলার টাকাটাও মাকে শোধ করতে হতো নিয়মিত। জলের সোনালি দাগ দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের সুন্দর একটি নৌকা আনা হল বাড়িতে।

দুপুরে খাবার টেবিলে বাবা জানালেন, ‘নৌকাটা গ্যারেজে। সমস্যা হল, ওটা কোনোভাবেই সিঁড়ি কিংবা লিফট দিয়ে উপরে আনা গেল না। গ্যারেজেও আর তেমন কোনো খালি জায়গা নেই।’

পরবর্তি শনিবারের বিকেলে বাচ্চারা সহপাঠিদের খবর দিল। তারা হইহই করতে করতে নৌকাটি টেনে চাকরানির রুম পর্যন্ত নিয়ে আসল।

বাবা বললেন, ‘অভিনন্দন, তো এরপর কী করবে তোমরা ?’

বাচ্চারা জবাবে বলল, ‘কিছুই না। আমরা শুধু চাচ্ছিলাম নৌকাটা রুমে থাকুক। এবং অবশেষে সেটা আমরা আনতে পেরেছি।’

তোতো ও হোয়েলের মা-বাবা প্রত্যেক বুধবার সিনেমা দেখতে যেতেন। এ বুধবারও গেলেন। ফাঁকা বাড়িতে তারাই এখন রাজা। লাফ দিয়ে উঠে প্রথমে দরজা জানালা বন্ধ করল, তারপর বসার ঘরে গিয়ে জ্বলন্ত বাল্বটা পেড়ে ভেঙে ফেলল। সোনালি আলোর ফোয়ারা ঠাণ্ডা জলের মতো জ্বলন্ত বাল্বের ভেতর থেকে স্রােতের বেগে তেড়ে আসছিল। কমপক্ষে তিন ফুট পর্যন্ত এটাকে বাড়তে দিল তারা। এরপর কারেন্ট অফ করে বাইচের নৌকাটা বের করল। বাড়িটাকে দ্বীপ ভেবে মনের খুশিতে নৌকা চালাতে নেমে পড়ল তোতো ও হোয়েল।

গৃহস্থালি সামগ্রী কাব্যের উপর সেমিনারে অংশগ্রহণ কালে, এক ছেলেমানুষি মন্তব্যের ফলে এই অবিশ্বাস্য অভিযাত্রার মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাকে। তোতো আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে বাতি জ্বলে ওঠে ?’ এটা নিয়ে দ্বিতীয় বার ভাবতে আমার সাহসে কুলালো না। জবাবে আমি বলেছিলাম,‘আলো জলের মতো। ট্যাপ ঘুরালেই এটা বের হয়।’ 

বিরতিহীনভাবে প্রতি বুধবার রাতে মা-বাবা আসার আগ পর্যন্ত কম্পাস ব্যবহার করে তারা নৌকা বাওয়া শিখে ফেলল। সিনেমা দেখে ঘরে ফিরে মা-বাবা দেখলেন, শুকনো মাটিতে ঘুমিয়ে আছে যেন দুজন ছোট্ট দেবদূত। খেলাটাকে আরো দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে মাস কয়েক পরে আরেক আবদার ধরল তারা। জলের নিচে ভ্রমণের জন্য তাদের এখন লাগবে মুখোশ, ডানা, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ও কমপ্রেসড এয়ার রাইফেল।

বাবা বললেন, ‘বাইচের নৌকাটি চাকরানির রুমে ফেলে রেখে এমনিতেই তোমরা যথেষ্ট খারাপ কাজ করেছো, আবার এখন ডুব দেওয়ার জন্য সাজসরঞ্জাম চাইছো।’

হোয়েল বলল, ‘যদি আমরা প্রথম সেমিস্টারে গোল্ড গার্ডেনিয়া পুরস্কার জিতি ? তবুও না।’ 

মা ঝনঝন করে উঠলেন, ‘না, যথেষ্ট হয়েছে।’ 

এতোটা নির্দয় হবার কারণে মাকে সামান্য একটু বকলেন বাবা। 

মা বললেন, ‘ছেলেগুলো দরকারের সময় কোনকিছুই জিততে পারে না, কণামাত্রও না। আবার যখন তারা কোনো কিছু চাইবে সেটার বিপরীতে যা করতে বলা হবে তখন তাতে ঠিকই জয়ী হবে, এমনকি শিক্ষকের আসনটাও ছিনিয়ে নিতে পিছপা হবে না তারা।’ 

মা-বাবা হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না অবশেষে। কিন্তু জুলাই মাসে তোতো ও হোয়েল প্রধান শিক্ষকের স্বীকৃতিসহ ঠিকই গোল্ড গার্ডেনিয়া পুরস্কার পেয়ে গেল। ওই একই দুপুরে না চাইতেই শোবার ঘরে মোড়কবন্দি ডুবুরির সাজসরঞ্জাম দেখতে পেল তোতো ও হোয়েল।

পরের বুধবার তাদের মা-বাবারা যখন সিনেমা হলে বসে ‘লাস্ট ট্যাংগো ইন প্যারিস’ দেখছিল ঠিক তখন দুইবাঁও জলে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ভরিয়ে ফেলেছিল বাচ্চারা। এরপর তার ভেতরে নির্দোষ পোষা হাঙরের মতো সাঁতার কাটছিল তারা। কখনো আসবাবের নিচে আবার কখনো খাটের তলায় আলো আঁধারের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বহু বছরের পুরানো নষ্ট হওয়া জিনিসপত্র উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তোতো ও হোয়েল।  

বার্ষিক পুরস্কার বিতরণি অনুষ্ঠানে পুরো স্কুলের আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হল দুই ভাইয়ের নাম। এ জন্যে তারা একটি প্রশংসাপত্রও পেল। এবার মা-বাবার কাছে আর কিছুই চাইতে হল না তাদের। বরং তারাই জিজ্ঞেস করল তাদের কিছু চাই কি না ? বন্ধুদের নিয়ে তারা একটা পার্টি দিতে চায়, যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে বলল মা-বাবাকে।

বাবা মাকে একাকী কানে কানে বললেন, ‘এটাতে প্রমাণিত হয় যে, ওরা বড় হচ্ছে।’ মা বললেন, ‘তোমার কথা যেন ঈশ্বর শুনতে পান।’

বুধবারে আবারও তাদের মা-বাবা যখন ‘দি ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ সিনেমাটা দেখছিলেন, তখন পথচারিরা পাসেও দে লা কাস্তেয়ানার একটি গাছে ঢাকা পুরানো বিল্ডিং থেকে জলপ্রপাতের মতো আলো ঝরতে দেখল। বারান্দা ঠেলে আলোর ঢল সদর দরজা পেরিয়ে স্রোতের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে প্রধান অ্যাভিনিউতে। সোনালি আলোয় ঝকমক করে উঠছে গুয়াদারারামাসহ পুরো শহর।

খবর পেয়ে দায়িত্ববান দমকল বাহিনীরা জোর করে দরোজা ভেঙে ছয় তলায় রুমে ঢুকে দেখে, আলো ঝলমল করে উঠে গেছে ছাদ পর্যন্ত। বসার ঘরে ভাসছে চিতা বাঘের চামড়ার কভারের সোফা ও ইজি চেয়ার। ঘরের সবচেয়ে উঁচুতে মদের বোতল আর একদম নিচে গ্রান্ড পিয়ানো। জলে ভাসছে পিয়ানোর ঢাকনা ও অ্যামব্রয়েডারির কাজ করা সিল্কের শাল। ঘরসংসারের টুকিটাকি জিনিসগুলো কাব্যিক পরিপূর্ণতায় নিজেদের ডানায় ভর করে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে পালাতে চাচ্ছিল দূর আকাশে। বাচ্চাদের নাচের মার্চিং ব্যান্ডের বাদ্যযন্ত্রগুলো মায়ের অ্যাকুয়ারিয়াম থেকে বের হওয়া উজ্জ্বল রঙের মাছেদের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল। বিশাল এই জলাভূমিতে মাছগুলোই ছিল জীবিত ও সুখি। সবার টুথব্রাশ ভাসছিল বাথরুমে, সঙ্গে বাবার কনডম, মায়ের ক্রিমের কৌটা ও নকল দাঁত। প্রধান শোবার ঘরে টেলিভিশনটা চালু অবস্থায় কাত হয়ে ভাসছিল। মাঝরাতে প্রাপ্ত বয়স্কদের সিনেমা তখনো সেখানে দৃশ্যমান।

হলঘরের শেষ মাথা। মুখোশ পরে বন্দরে পৌঁছানোর মতো অক্সিজেন নিয়ে স্রোতের মধ্যে দাঁড় বাইছে তোতো। নৌকার পেছন দিকে বসে দাঁড় টানতে টানতে বাতিঘরের খোঁজ করছে সে। নৌকার সামনে বসে হোয়েল কম্পাস দিয়ে ধ্রুবতারার দূরত্ব মাপায় ব্যস্ত। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ৩৭ জন সহপাঠি। তারাও সারা রুমে আনন্দে ভাসছিল। জিরেইনিয়াম ফুল গাছের টবে মূত্রত্যাগ করছিল কেউ কেউ। বাবার বোতল থেকে এক ক্লাস ব্রান্ডি মেরে, চুমুক দিয়ে স্কুলের প্রার্থনাসংগীতের শব্দ পাল্টিয়ে প্রধান শিক্ষককে জড়িয়ে প্যারোডি গাইছিল তারা। এসব ঘটনাগুলো যেন চিরস্থায়ী মুহূর্তের জন্ম দিচ্ছিল। তারা একসঙ্গে সবগুলো বাতি জ্বালানোর ফলে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ভাসছিল আলোয় আলোয়। সন্তু জুলিয়ান হোসপিটালার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটো শ্রেণিকক্ষ পুরো ডুবে গেল ‘৪৭ দে লা কাস্তেয়ানার’ ছয় তলাতে। শহর থেকে দূরে স্পেনের মাদ্রিদ। গ্রীষ্মকালীন সময়ে সেখান গনগনে আগুন আবার শীতে বরফশীতল আবহাওয়া। মরুভূমি কিংবা নদী কোনটাই সেখানে নেই। ওখানকার স্বদেশীয় জনগণের পক্ষে, বিজ্ঞানের এই আলোক ধারায় পথ কেটে কেটে নৌ চালানোর বিদ্যা কোনোদিনই শেখা হয়ে ওঠেনি।  

ডিসেম্বর, ১৯৭৮।

পুনশ্চ: গল্পটি Strange Pilgrims গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। যেটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন Edith Grossman.

মন্তব্য: