এক দিন পেরোলে সাঁকো

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এম.মনির-উজ-জামান

দুঃস্বপ্নে বিরক্তিকর ঘুম ভাঙ্গে। একটা সুখের জীবনে এহন বিভ্রান্তিকর অপরিচিত সকাল লিপনের বেশ ভাবিয়েই তোলে। এভাবেই উদাস হাঁটে অনেকটা পথ। পারনান্দুয়ালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে বাম হাতি এগোয় সে। ঘরে বসে থাকার সুখের মেজাজ হারিয়ে তখন, তার অবচেতন মন ক্রমশঃ একটা নতুন অভিজ্ঞতার দিকে নিয়ে যেতে চায়- যায়ও। সন্দেহের চোখ আরও বেশী তাড়িত হয়ে ওঠে। এ চলা অর্থহীন, অকারণ নাও হতে পারে। কলম্বাসি মেজাজে হাঁটে গ্রাম পারনান্দুয়ালীর এক গলি পথে। কাকের আর্তচিৎকারে থেমে যায় এক পুরোনো চুন-সুরকী খসা পোড়ো দালান বাড়ীর সামনে। প্রশ্ন চোখে তাকায় আগন্তুকের পানে। বেশ অবহেলায় পাশ কেটে চলে যায় আগন্তুক। উৎসাহি পায়ে গল্পের মেজাজ নিয়ে লিপনের অল্প পরিচিত বুড়ো গোছের লোকটা – হ্যাঁ ; সে তোমার অনেক পুরোনো ঘটনা। তারই কিছু ছিঁটে ফোঁটা আজকের এই কাকবাহিনী। অনেক আগে এই বাড়ীর একছেলে নাম তোমার নিশির যাত্রী। সে আর তোমার বলবো কী টকটকে সুন্দর তার চেহারা মনটা বুঝি তারও চেয়ে সুন্দর। একদিন হলো কী। গেল সে পাখি শিকারে। ঘটনাটা ঘটলো ঠিক সেদিনই তোমার। শিকারে যাওয়ার পথে এক ধানের চাতালের কাছে আচমকা ওমা বলে বন্দুক ছিটকে ফেলে দিয়েই তে-মাথা বসে পড়ে।

লিপন আঁতকে ওঠে – ক্যানো। চোখের আবার কী হলো।

কী আবার হবে। যা হবার তাই…ই হলো। ঐতো চাতালের বয়লার ফেঁটে; আর তা থেকে গরম পানি খানিকটা এসে তার চোখে লাগে। আর তারপর কয়েক মাস ঢাকা-মাদ্রাজ করে চোখ দু’টো অন্ধ হয়েই বাড়ী ফেরা। পয়লা; পয়লা সবাই দেখতে আসতো। খবর নিতো, সান্ত¦না দিতে চেষ্টা করতো কেউ কেউ। তারপর আত্মীয় প্রায় মানুষগুলো নেশার হাতে অসহায় বন্দী হয়ে যায় তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারনায়। হঠাৎ পাওয়া অবহেলায় কুঁকড়ে যায় নিশি। মানুষের প্রতি ধারণার বেলুন আকষ্মিক ফুঁটো হয়ে যায় তার।

কণ্ঠশুনেই টের পায় – কে? অশোক না? 

জ্বী, নিশি দা, আমি অশোক।

কীরে কেমন আছিস?

নিশি দা আমার একটু তাড়া আছে পরে না হয় দেখা হবে।

পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে আসে দূর কোথাও। নিরুৎসাহী ঘরে ফেরে নিশি।

হায়রে অশোক! ওমন নিশির নেওটা আর হয়না! কল্পনায় তলিয়ে যায় নিশির। নে- এখন বাড়ী যা – মা রাগ করবে। না; নিশিদা তুমি সেই গল্পটা বলই না। সে তোমার অনেক দিন…….। ………. গৃহস্থ। তার ছিল ……………. হাঁস। একদিন ……………. হাঁসটারে। হলোতো গল্পটা; নে এবার বাড়ী যা।

কী যে বলো নিশিদা! দুপুরে তো তোমার এখানে খেয়েই নিলাম! এখন আর বাড়ী গিয়ে কী হবে! পাগল ছেলে; মা খুঁজবে না? যা পরে না হয় ফের আসিস। এট্টুক অশোক একদিন প্রকৃতির নিয়মেই কত্তবড় হয়ে গেল। সামনে ইন্টার পরীক্ষা কিন্তু ফরম পূরণ করার প্রয়োজনীয় টাকা কড়ি জোগান দিতে গিয়ে বাঁধলো আসল ফ্যাঁকড়া। নিশির সব শুনে বললো; ভাবিস নে দেখি কিছু করা যায় কিনা। তার শখ ছিল গান শেখার। প্রিয় হারমোনিয়ামটা বিক্রি করে টাকাগুলো অশোকের হাতে তুলে দিয়ে একটা তৃপ্তিদায়ক নিঃশ্বাস নিয়ে ছিলো সেদিন। সে কথা কম বেশী সবাই জানে। তা সেই নিশির নেওটা এট্টুক অশোক আজ কিসের টানে কিসের প্রয়োজনে স্বার্থপরের মত করে স্বজন তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারে- যায়ও। শ্রাগ করে নিশির। আর একজনের কথা মনে পড়ে। সেও তো ভুলে গ্যাছে; প্রতিশ্রুতির শেকল ছিঁড়ে! কিন্তু এমন কী কথা ছিলো?

দেরাজ থেকে পুরোনো ফুলের গন্ধ নেয়। একদিন স্বপ্নহীন বাস্তবতায় একটা ফুল দিয়ে দার্শনিকতায় বলেছিলো আজ তবে এই রাখ দেবতার নৈবেদ্য হিসেবে। একদিন হয়তো ফুলের মত করে এই নিজেকে …………।

অপেক্ষা করতে হবে এই যা।

কাঁপা হাতে কতগুলো পুরোনো চিঠিপত্র তুলে নেয়। মেলে ধরতে চায় চোখের সামনে। কাগজ ছেঁড়ার শব্দ কানে ভেসে আসে।

ইতিহাস বিস্মৃত জাতি বাঙালী। তার পয়জন ঢুকে গ্যাছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। নিজে বড় না হলেও কিছু মানুষের বড় হওয়ার আয়োজনে মই হয়েছিল বটে। কিন্তু কাউকে মই করে নিজের ওঠা হয়ে ওঠেনি। ভুলটা যে কোথায় ছিলো-বুঝে আসেনা! ক্রমশঃ বাস্তবতা গ্রাস করতে থাকে। বাঙালী এক নতুন পথ খুঁজে নেয়। সাঁকো পার হলে আর পেছনে ফিরে না তাকানো। বাংলা ভাষায় কথা বলি; স্বাধীন দেশে বাস করি। তাতে কী হয়েছে? তাই বলে কী ইতিহাস মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে হবে? সবাইতো জানি পানির অপর নাম জীবন- তাতে কী কেউ পানির কলস মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াবে? যাকে বলে একেবারে হক কথা। নিশির যাত্রী ক্রমশঃ নিঃসঙ্গ জীবনে প্রবেশ করতে থাকে; বাস্তবতার দেয়াল ক্রমে ঘন থেকে ঘনতর হয়ে আসে। কষ্টের আঁচড় পড়ে মুখাবয়বে। বিপদে মানুষকে টাকাই দ্যাখে আজকাল। গচ্ছিত টাকা থেকে দু’খানা সাইকেল রিকসা করে নেয়। দিনান্তে রিক্সাঅলা অবশিষ্ট টাকা এবং গুড়-চিড়ে কিনে দিয়ে যায়। নিশির তার হারানো পৃথিবীটা কাকের ভেতর খুঁজে পেতে চায়। হঠাৎ অন্ধজীবনে ভাবে একটা উল্কা যেন আকাশ হতে ছিটকে মাটি স্পর্শ করার পরিবর্তে তার অস্তিত্ব হারালো। আচমকা তার নিজের পা’ছুঁয়ে দ্যাখে। না; পা ঠিকই মাটি ছুঁয়েইতো আছে। মনের অজান্তে মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি লেপ্টে থাকে। পরিচিত শব্দ ভেসে আসে কানে। ক্ব ক্ব করতে থাকে একটানা। পলেস্তরা খসা সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে যায়। কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেল নিশির। আজ আর কাকের জন্য কোনো খাবার রাখা হয়ে উঠেনি। মনেই ছিলনা বলতে গেলে। সে অবাক হয়; কাকের ভাষা যেন স্পষ্ট পরিচিত হয়ে ওঠে তার কাছে। নিশিদা তুমি অকারণেই ভেবে মরছো। আমরা ওমন স্বার্থপর তা ভাবলে কী করে। তুমি কেমন আছো সেটাই দেখতে এলাম। ইচ্ছে করেই বেশ দিন কয়েক খাবার দেয়া হয় না অথচ প্রতিদিন কাকগুলো আরও বেশী সন্ধির ভাব নিয়ে আসে। যাবার সময় কী যেন বলতে চায়, মনে হয়; নিশিদা ভাল থেকো; আবার দেখা হবে এই সব!! লিপন আজ খুব ছেলে মানুষি করে। তারপর; তারপর কী হলো? এভাবেই শুনলাম মারা গেছে সে। কে! কে মারা গেছে? কাকগুলো নাকী? না; তা হবে ক্যানো। ছেলেটাই মরলো একদিন কিন্তু মরলে কী হবে; কাকগুলো ঠিক নিয়মকরেই আসতে লাগলো। ক্রমশঃ আশ-পাশের লোকজন কাকের কর্কশ স্বরে অতিষ্ঠ হয়ে; কেউ কেউ নিস্তার পাবার আশায় ছাদে খাবার ছেটালো। ছেটালেই হল আর কি! যে কে সেই! কাকগুলো গলা বাঁকিয়ে সন্দেহে তাকায় তারপর পুরোনো চালে আবার ডাকতে থাকে, সেকী আজ থেকে! হেরিং বোন রাস্তায় শব্দ তুলে একটা অ্যাটো রিকসা চলে যায়; সম্বিৎ ফিরে পায় লিপন। কখন লোকটা চলে গ্যাছে অথচ খেয়ালই করেনি! সকালে কুড়িয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতায় ভর করে আনন্দ চোখে তাকায় কাকগুলো, এখন আর কুৎসিত দেখায় না মোটেই। মাতাল করা হাওয়া বয়ে যায় প্রকৃতি তার অবসাদ ঝেড়ে ফেলে। না; মরেনি নিশির। ঐতো ডাকছে, নিশিদা আর ঘুমিওনা, ওঠ-ওঠ। মেধাবী ডাকতে থাকে কাক গুলো- ওঠ-ওঠ। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে যাযাবর হাঁটতে থাকে। একপা দু’পা করে অনন্ত পা। ছেলে মানুষি ভিঁজে যায় লিপন। মেঘময় আকাশে লক্ষকোটি কাক ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় দূরের ভালোবাসা সীমাহীন তারার দেশে একদিন। এভাবেই বহুদিন।

                                                                [সমাপ্ত]

মন্তব্য: