চন্দন আনোয়ার

কানু কাফন চোর।  

লাশের শরীর থেকে সাদা ধবধবে কাফনের কাপড় পাঁচশ টাকার নোটের মতো হাতের মুঠোয় নিয়ে যখন বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় বিকারহীন কানু তখন নিজেকে একটি মৃত লাশ-ই মনে করে। শরীরজুড়ে তার মরা মানুষের প্রাচীন গন্ধ। উঠোনে পা ফেলতেই আর একজন জীবিত মানুষ এসে সামনে দাঁড়ায়। তখন তার সম্বিৎ ফেরে।

কানু উঠোনে পা ফেলা পর্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করে শিউলি। ননস্টপ বিড়বিড় করে আল্লাহ-রসুলের নাম জপে, পাঁচ কলমা পড়ে বুকে থু-ফু দিয়ে ভয় দূর করে, স্বামীর হেফাজতের প্রার্থনা জানায়। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো পাথরের মতো বুকে চেপে থাকে। একটি টানা শ্বাস ফেলার মধ্য দিয়ে বুক থেকে পাথর ফেলে ভারমুক্ত হয়, যখন উঠোনের খিড়কির অন্ধকারে ভূতের মতো মানুষের ছায়া পড়ে।

আইছো গো!- বলে শিউলি অন্ধকারে নেমে আসে। কানুর হাত থেকে কাফনের কাপড়টি নিয়ে ঘরে ফেরে। ঘর থেকে সাবান লুঙি নিয়ে কলতলায় যায়। শিউলি কল চাপে, নিশ্বাস বন্ধ করে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে শরীরে পানি ঢালে কানু। ধীরে ধীরে দু-জনের নিশ্বাস নরমাল হয়ে আসে। জীবিত হয়ে আসে। কল চাপের উঠানামার শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে এই ক-টা বাক্য না বললে শিউলির মন শান্তি পায় না। 

ছাড়ো! এই কাম ছাড়ো গো তুমি। দেইখবা, পথেই একদিন মরবা নে। রাইত-বিরাতে কত কি জিনিস থাকে।

কলের পিচ্ছিল হাতলের উপরে শরীরের সমস্ত ক্রোধকে চাপিয়ে এই ক-টা কথা বলা শিউলির যেমন রুটিনওয়ার্ক, কানুর তেমনি দায়িত্ব নিঃশব্দে হজম করা। শুধু মন যেদিন বিষিয়ে উঠে সেদিন সিঁধেল চোর বাবা রুস্তম আলির নাম ধরে খিস্তি খেউড় করে। কোন কাজ-ই শেখায়নি নিজের বিদ্যাটা ছাড়া।

 ঝমঝমিয়া গ্রাম, পাশের দাপুনিয়া গ্রাম, তার পাশের ঝাইঠিনসহ আশেপাশের দশগ্রামের লোকেরা দেখেছে কানুর বাবার দাপট। গৃহস্থবাড়ির পাহারার ফাঁক গলিয়ে কানুর বাবার অনুপ্রবেশ কীভাবে ঘটেছে সেই কিংবদন্তি ওই তিন গ্রামে কে না জানে। গ্রামে এখন বিদ্যুৎ। পাকা রাস্তা। মানুষগুলোও চালাকি ধরেছে। টাকা-পয়সা, গহনা-পাত্তি ব্যাংকে রাখে। দুইটা পয়সা হলে ইটের বাড়ি করে। হুটহাট করে কতগুলো যুবক বিদেশে গিয়ে টাকা কামাচ্ছে।

জন্মাবধি কানুর কাছে দিন হচ্ছে রাত, রাত হচ্ছে দিন। দিনের কাজ সে কিছুই শিখেনি। উত্তর-দক্ষিণ জানা নেই। চেনা নেই কিছুই। ও শুধু জানে, দশ গ্রামে কার ঘরের কোন চিপায় কি লুকানো আছে। কার বউয়ের কানের দুল, গলার চেন, হাতের চুরি সোনার তৈরি, ওটা রাখে কোথায়। কে কখন ঘুমায়। বউয়ের পেট, নিজের পেট, আধ-মরা মা-র পেট ত্রি-পেটের দায়িত্ব যার কাঁধে, সে এখন কী করে? দিনে ঘুমানো অভ্যাস, দিনটা কাটে ভালই। সন্ধ্যার ঘোর না হতেই ফুটফাট বাতি জ্বলে। কানুর ভেতরে কেঁপে ওঠে। সে অন্ধকার দাবি করে, সুনামির মতো অন্ধকার নেমে আসুক, যেনো এই সামান্য বাতির আলো সেই অন্ধকারে নাই হয়ে  যায়। কানু প্রচণ্ড একটি ভূমিকম্প প্রার্থনা করে, যেন দালানগুলো মাটিতে মিশে যায়। 

কানুর বেঁচে থাকার রসদ দরকার। কিছু একটা করতে হবে বেঁচে থাকতে হলে। করবে কী বা যাবে কার কাছেএই ভাবনায় যখন কাহিল, তখনিই নতুন রুজির পথ পায়। যিনি পেট দিয়েছেন আহারের পথ তিনি-ই করেন। তাই, কানুর ভিতরে কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না। বেঁচে থাকার ধর্ম পালন করছে সে। এই ধর্মই দুনিয়ার সেরা ধর্ম। 

একদিনেই ওর ভিতরের সন্ত্রস্ত ভাব কেটে যায়। কাজটি সিঁধ কাটার চেয়ে সহজ ও নিরাপদ। অন্তত একশো টাকার রুজির ব্যবস্থা দুই একদিন বিরতিতে। বেচা-বিক্রির কোনও চিন্তা নেই। চুরির মাল কেনার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে হাসেম দফাদার। যা পায় তাই কিনে। দশ টাকার জিনিস এক টাকায়। 

বিদ্যুতের আলোর সামনে দিয়ে বুক চেতিয়ে কানু যেতে পারে কাজে। সেখানে ওর সামনে মানুষের ভয় নেই। তবে প্রতিপক্ষ শেয়ালের সাথে সমঝোতায় আসতে হয়েছে। দুই দলীয় ঐক্যজোট বলা যায়। ওর কাজ যতক্ষণ চলে শেয়ালেরা কিছুটা দূরে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে।

 কাঁচা বাঁশের ফালির উপরে ঝরঝরে আলগা মাটিতে শাবলের দুই কোপ বসালেই ভিতরে প্রবেশের মতো জায়গা হয়ে যায়। একহাতে টর্চ টিপে আর এক হাতে কাফন গুছিয়ে বেরিয়ে আসতে বড়োজোর পাঁচ মিনিট সময় নেয়। এই সময় কানুর নিশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, চোখে অন্ধাকার নেমে আসে, আল্লাহ-রসুলের নাম বোবাপ্রাণির মতো গোঙানির শব্দ হয়ে বেরোয়। কাজ শেষে লম্বা এক শ্বাস ফেলে। তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে ছাড়ে কর্মস্থল ।  

টানা সাতদিন ধরে কানুর শরীরে জ্বর চলছে। দফাদারের লোক দু-দিন করে তাগাদা দিয়ে গেছে। এই শরীর নিয়ে কানু বেরুতে চায় না। কিন্তু কোনমতে কাজ দু-টা করে দিতে পারলে দুশো টাকা। সপ্তাহ ধরে রুজি নেই। শরীরের দিকে তাকালে পেট তো মানবে না। শিউলি যে বাধা দিবে সেই শক্তিও নেই। ঘর আহার শূন্য। 

ঘর থেকে বেরুতে যাবে এমন সময় শিউলি ফোঁৎ করে কেঁদে ওঠে। কানুর শরীর ভেঙে পড়ছে। জিরো মনোবল। এই কাজে একচুল সাহস হারালে আর রক্ষে নেই। ঘাড় মটকায়ের রক্ত চুষে খেতে কত কিছু যে ওঁৎ পেতে থাকে। কানুর মনোবলের কাছে ওরা পাত্তা পায় না। এরমধ্যে বউ দিয়েছে ফোঁৎ করে কেঁদে। কানু কি করবে? বাইরের অন্ধকারের দিকে মুখ করে বলে, কান্দিস না বউ! খবরদার কান্দিস না! দেখিস না, পেটের খবর কেউ লয় না। হারামি দফাদার এক টেকাও অগ্রিম দেয় না।

বেরুবার জন্য সামনে পা ফেলতেই দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে পিছনে ফেরে কানুর ডান পা। 

শিউলি ক্যাক করে ওঠে।তুমি যাইয়ো না গো। মনডা মানছে না। বাইরে দোজখের নাহান আন্ধার। তোমার কোনো বিপদ-আপদ অইলে আমার …। আঁচলে মুখ ঢেকে ভূতের মতো নাকে নাকে কাঁদে শিউলি। 

বিপদ-আপদ! কানুর জ্বরমুখো শুকনো ঠোঁটে শ্লেষের হাসি। এই নিয়া তো জন্মাইছি। আমরার জন্মডাই তো বিপদ রে!

আরো দাঁড়ালে আরো বিপদ। বাইরের ঘন অন্ধকারে সাঁতার দেবার মতো করে হামলে পড়ে কানু। আঁকা-বাঁকা আল ধরে হেঁটে সোজা পাকা রাস্তায় ওঠে। কিন্তু রাস্তায় পা ফেলেই তাজ্জব হয়ে গেল। কালো- ডোরা কাটা একজোড়া গরু ধুমসে খেয়ে সাবার করে দিচ্ছে নাজির আলি হাজির পাকা ধানক্ষেত। হাজির এতো বড় ক্ষতি কে করে? এই গরু দু-টা কার! এইরকম তাজা, এই রঙের গরু তো এই তল্লাটে কারো নেই! কানু ভীষণ দ্বিধায় পড়ে গেল। এতো রাতে! গরুগুলোকে তাড়তে গিয়ে যদি উল্টো বিপদ ঘটে। তার চেয়ে, হাজির ক্ষেত খাচ্ছে খাক। বিড়বিড় করে হাজিকেই বরং গালি দিল, শালা কুঞ্জুসের ধান খাচ্ছে ভাল-ই করছে। 

চোখ কচলে সামনে হাঁটে কানু। কিছুদূর গিয়ে যা দেখল তা আরো ভয়ানক। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। এবার একটা দুইটা না, বারো-চৌদ্দটা মহিষ কাদের মোল্লার আখক্ষেত দুমড়ে-মুচড়ে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলছে! রাতে কাজ করে বলে ছেলেবেলা থেকেই কানুর বহু কিছু দেখার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এই রকম সর্বনাশ দেখেনি। কাদের মোল্লা সকালে ওঠে কি যে চিক্কুর দিবে আল্লামালুম! এমন ভাল মানুষের এতো বড় ক্ষতি কে করছে? কে এতো বড়ো দুশমন? আর দুশমন হলেই কি ক্ষেতের ফসল এভাবে ধ্বংস করে দিতে হবে? এ কি মানুষের কাজ! কানু ভাবে, এই কাজের চাইতে ও যে কাজটি করতে যাচ্ছে সেটি অনেক ভাল। বুকে-থু ফু দিয়ে ফের হাঁটা ধরে।

এবার আর কোনদিকে তাকাচ্ছে না। ঘাড়গুঁজে সোজা হাঁটছে। সাত্তার  বেপারির বাড়ি বরাবর আসতেই কানু অ্যা বলে পিছু হঠে। লাঠির উপরে ভর দিয়ে তিন মাথা হয়ে দুই পা প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে এক মাওলানা। তার সফেদ দাড়ি, মাথায় কালো পাগড়ি, শরীরে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি অন্ধকারে ঝিলিক দিচ্ছে। মাওলানাকে পাশ কাটিয়ে যতবারই যেতে চাচ্ছে কানু, হা-ডু-ডু খেলোয়াড়ের মতো পা বাড়িয়ে দিচ্ছে সে। ডানে-বামে যেদিকেই যেতে চাচ্ছে সেদিকে পা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেখতে না দেখতে মাওলানার দুই পা বেড়ে এতো লম্বা হয়ে গেল যে, ঘাড় উঁচু করেও মুখ আর দেখতে পারছে না। ভয়ে ভিতরটা শুকিয়ে আসে। কানুকে ঘায়েল করার জন্য শয়তানের ক্যারিকেচার এইসব! কানু ভাবে।

শালা, মাইনষের ঘরে ঘরে খাও তো, শরীরে চর্বি জমছে, না? রাইত-বেরাতে ডর দেহায়া বেড়াও, অ্যা! বাগে পাইয়া লই একদিন। আজ শরীরডা খারাপ। এর লাগি ছাইড়া দিলাম। নাইলে শাবালডা বসাই দিতাম বুকের ভিত্রে, কইলজাডার মইধ্যে। 

কানুর দুর্বল শরীর আরো দুর্বল হয়ে গেল। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। হাঁপিয়ে ধাতস্থ হয়ে হাঁটছে। টালমাতাল শরীর। পা হড়কে পড়ে যায় যায় করে। গুটি গুটি পা ফেলে সামনে চলছে। খুব বেশিদূর যেতে পারে না। আর এক বাধার সামনে পড়ে। নয়াবাড়ির বাঁশঝাড়ের পথে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা কাঁচা বাঁশ। কানু ক্রোধে হিস করে ওঠে। 

আমার শরীরডা চলছে না। নইলে জ্বিন-ভূতের বাপের গুষ্ঠিসুদ্ধা ঠাপাইতাম। 

কানু মাথা নিচু করতেই বাঁশটাও নিচু হয়ে আসে। উপর দিয়ে যাওয়াই যাবে না। ছিটকে ওকে নিয়ে যে কোন দেশে ফেলবে কে জানে। বাধ্য হয়ে বাঁশ ঝাড়ের পিছনের ক্ষেত দিয়ে নেমে পাথালে হাঁটা ধরে কানু। ওর শরীরের কন্ট্রোল ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ছে। সামনে কয়েক ধাপ পথ। এখান থেকে ফেরা চলে না? সাপ-খোপের ভয় আছে। আল্লা-রসুলের নাম নিয়ে বুকে থুথু ছিটাচ্ছে আর পা টিপে টিপে সামনে এগুচ্ছে। 

পরিত্যক্ত এক ডোবার ধারে আসতেই কানুর শরীর হুমড়ি খেয়ে ওঠে। কারা যেনো একটা লাশ কবরে না পাঠিয়ে ডোবার কিনারে ফেলে গেছে! ভয়ে গলা শুকিয়ে খটখটে, বুকে থুথু ছিটালেও থুথু আসছে না আর। হাঁটু গিঁট দিয়ে বসে কিছুক্ষণ ভাবল কানু-কী করা যায়? শেয়ালে টের পেলে তো সর্বনাশ করে ফেলবে। মানুষের কী হয়েছে? জীবনটা যার জন্যে ব্যয় করে গেল, মরবার পরে সে এভাবে ফেলে যেতে পারে কী করে? কানু লম্বা শ্বাস টানে। মানুষের এই জীবন? এই নিয়ে কত্ত কিছু করে? কার লাশ হবে? এই লাশটা কোথা থেকে এলো? নাকি কবর থেকে কেউ তুলে এখানে ফেলে গেছে? লাশ কি নিজেই উঠে আসল? না আদতেই মরেনি, জ্যান্ত মানুষকে-ই কাফন পরিয়ে কবর দিয়েছিল, সে নিজেই এতোদূর পর্যন্ত উঠে এসেছে! কিন্তু কাপড়ে এমনভাবে জড়ানো-প্যাঁচানো যে, হামাগুড়ি দিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই। কাফন চকচকা নতুন। সামান্য মাটির দাগও নেই। 

এই লাশের কাফন খসালে কবরে রেখে আসতে হবে। কানুর একার পক্ষে অসম্ভব। এরিমধ্যে কানুর কান ফাটিয়ে শেয়ালবাহিনি হুক্কা হুয়া শ্লোগান ধরেছে। তারা আর সময় দিতে চায় না। 

শালারাও আজ তেজ দেহাচ্ছে! মাইনষে না খাইয়া মরতাছে! এইসব মরা খাইয়া শালারা শুয়োরের মতন শইল বানাইছে! 

কোনদিন কানুকেই না পেটে চালান করে দেয়। একদিন তো দিবেই।

শরীরের ছন্দ ঠিক রাখতে পায়ের বুড়ো আঙুল টিপে লাশটার দিকে হাঁটছে কানু। এক পা এক পা করে যতটুকু এগুচ্ছে লাশটাও লাফিয়ে লাফিয়ে ততটুকুই পিছনে সরে যাচ্ছে। কানু চিৎকার করেকেডা আপনে? কেডা? আপনেরে এইভাবে ফাইলায়া গেছে কেডায়? আপনের কি কেউ নাই? যার লগে জীবনডা কাডাইলেন, হে নাই? ছেলে নাই? ভাই নাই? আত্মীয় নাই? ওরা কি মানুষ না পশু? এইভাবে মরা কুত্তার মতো ফালাইয়া গেল? চিৎকার যে কণ্ঠনালিতে আটকে যাচ্ছে কানুর বুঝতে বাকি নেই। যেই করে হোক, টেনেহিঁচড়ে হলেও লাশটাকে কোন একটা কবরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। একজন মানুষ একটা কবর পাবে না, খোলা আকাশের নিচে গরু-ছাগলের মতো শিয়াল-শকুনে খাবে! রাতে চাঁদ-তারারা দেখবে, দিনে সূর্য দেখবে, এই পথ দিয়ে যারা কাজে যাবে তারা দেখবে শকুন-শিয়ালে খাবলে খাওয়া উচ্ছ্বিষ্ট মানুষটাকে। মানুষের এই ভাগ্য! মানুষের এই অপমান! 

কাফনে মোড়ানো অচেনা মানুষটিকে কানু চিনে না। অবলীলায় পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কানুও একজন মানুষ। সে জীবিত আছে। তাই দায়িত্বটুকু তার উপরে-ই বর্তায়। লাশটাকে কবরে পাঠাতে সাংঘাতিক চেষ্টায় মেতে ওঠে। কানু সামনে যায়, লাশ পিছনে যায়। কানু দৌড়ায়, লাশও দৌড়ায়। এই করে কানুর শরীরের শক্তির সবটুকু নিঃশেষ হবার জো হলে লাশ হঠাৎ উধাও। পরাজিত কানু হু হু করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু সেই কান্নাও শক্তিহীন, দুর্বল। বুকের খাঁচার ভিতরে হুগলাচ্ছে। হাত-পা বিছিয়ে ডোবাটার পাড়ে নিজেই লাশ হয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারল না। আকাশের ঘোমট কেটে গেছে। কানু তাকিয়ে দেখে- মাথার উপরে সাদা কাফনে মোড়ানো চাঁদ বেদম দৌঁড়াচ্ছে।  

শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে কানু যখন কবরস্থানে পা রাখল তখন দু-জন মানুষের ফিসফিসানির কানে ঠেকল। কানু ঘোরের মধ্যেও এটুকু হুঁশ আছে, এই ফিসফিসানি জ্যান্ত মানুষের। এবার মরণ ছাড়া উপায় নেই। কানু ভাবল, লাশের পাহারাদার নাকি? নাকি তার অনুপস্থিতির কারণে দফেদার নতুন লোক সেট করে ফেলেছে ? 

শালা অকৃতজ্ঞ বেঈমানের বাচ্চা! তোর গুষ্ঠিসুদ্ধ কবরের না আনলে আমি কানু মাইনষের পয়দাই না। সকালে সব ফাঁস করে দিবো। মৃত মানুষের নিস্তব্ধ কবরগুলোকে স্বাক্ষী রেখে দফাদারকে উদ্দেশ্য করে কানু অকথিত ভাষায় গালিগালাজ করে। ফিরে যাবে ভাবে। কিন্তু কাদের সেট করেছে, একবার দেখে না গেলে সকালে কার নাম বলবে। তাই, বিপদ জেনেও সামনে এগিয়ে গেল।

ঐ কে? কেডা? কেডায়ও? কানু চিৎকার করে বললেও অতি সামান্য-ই শব্দ হল।  

দু-টি যুবকের কণ্ঠস্বর সমবেতভাবে আক্রমণ করে কানুকে। ঐ কে? কে ঢুকলো এখানে?

পাটের ক্ষেতে অপেক্ষমান অধৈর্য শেয়ালগুলোর কর্কশ চিৎকার ও যুবক দুটোর কণ্ঠস্বর একই রকম শুনাচ্ছে। 

কানু আতঙ্কিত হল। কিন্তু ভিতরে জেদের আগুন জ্বলে ওঠে। সে সামনে এগিয়ে গেল, ওরাও এগিয়ে আসে। তিনজন মুখোমুখি দাঁড়াল। অভাবিত এক দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কানুর কাহিল শরীর কাঁপছে, কিন্তু অপর দু-জনের মুখে ভর করেছে মৃত্যু আতঙ্ক। কাফন খসিয়ে নিলে মৃত মানুষ যেমন মুখ হা করে চোখ খুলে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে, যুবক দু-টির মুখের স্থাপনাও তাই হয়েছে। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদের যে পরমিাণ আলো পড়ছে, সেই আলোতে কানু লক্ষ্য করল, পেছনে আরো একজন দাঁড়িয়ে আছে। 

যুবক দু-জনকে আড়াল করে পেছনের জন এসে কানুর সামনে দাঁড়াল। দিনের আলো হলে কানু সাহস পেত না, নিতান্তই গভীর রাত ও নিজের কর্মক্ষেত্র বলে সাহস করে বলে ফেলল, আপনে! ছার আপনে? আপনে রে টিভিতে দেখছি। গোরস্থানে পালাইছেন কে রে? পুলিশে… 

 মানুষটি শাপের মতো হিস্ শব্দ করে আঙুল দিয়ে টিপে ধরে কানুর ঠোঁট। পাঞ্জাবির পকেটে হাত চালিয়ে পাঁচশো টাকার নোট যে কয়টা হাতে উঠল, সে কয়টা কানুর হাতে দিয়ে পেছনে সরে গেল। এবার এক যুবক সামনে আসল।

এই টাকা শেষ হলে আসবে। কাক-পঙ্খি জানলেও লিডার কিন্তু… বলে  জিন্সের পকেট থেকে ছোট্ট পিস্তল বের করে কানুর থুতনিতে ঠেকাল।

কানু যখন রাস্তায় উঠে আসল ততক্ষণে দিনের সাদাটে আলো গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। জ্বরের ঘোর কেটে গিয়েছে। নয়াবাড়ির বাঁশঝাড়ের বাঁশটি শান্ত-সুবোধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোজা। কাদের আলির আখক্ষেতের কাছে এসে আরো চমকালো কানু- একটি আখগাছও ভাঙা নেই! হাজির ধানক্ষেতও সেই রকমই আছে! কানু যখন বাড়ি পৌঁছাল তখন সকালের সোনারোদ উঠানে পা ফেলতে শুরু করেছে। 

কানুর জীবনে একটি রাত কেটে গেল জ্বরের ঘোরে। আজেবাজে  যেসব দেখেছে সবই মিথ্যা। চোখের ভুল। অবচেতন মনের খেয়াল। শুধু সত্য হয়ে রইল পাঁচশো টাকার নোটগুলো।

মন্তব্য: