রাশেদ রহমান
বাসন্তী, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস; তাের এ গল্প আমি লিখতে চাইনি। আমি বিশ্বাস করি গল্পাচ্ছলেও সবার সবকথা বলে দেয়া ঠিক না। কিন্তু জুব্বার ছাড়লাে না যে…। ওকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে হবে। বহুদিন ধরেই জোরজবরদস্তি করছে। এই, আজ লিখবাে, কাল লিখবাে করে করে ১০/১২ বছর পার করেছি। আর পারছি না। সেদিন, অনেকদিন
পর, বাসটার্মিনালে এক চায়ের স্টলে জুব্বারের সাথে দেখা। জুব্বার চা খাচ্ছে। আমারও
চায়ের তেষ্টা পেয়েছে…। আমাকে দেখে জুব্বার হৈ চৈ করে উঠলাে। ‘আরে সুমিত যে।
কতদিন পর দেখা! তা কেমন আছিস, দোস্ত…।’
আমি জুব্বারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। ও শক্ত হাতে চাপ দিল আমার হাতে।
বললাম, ‘আমি ভালােই। তুই কেমন আছিস?’
‘আমাদের আর থাকা? দিন চলে যাচ্ছে। হাওয়ার গাড়ি চালাই। যেকোনাে দিন তাের ভাবী বিধবা হতে পারে….।’
চমকে উঠলাম জুব্বারের কথা শুনে। অবশ্য চমকানাের কিছু নেই। বাস-ট্রাক চালানাে খুবই রিস্কি কাজ। ইদানীং এ্যাক্সিডেন্ট বেড়েছেও খুব…। ক’দিন আগে পত্রিকায় পড়লাম”মৃত্যুফাঁদ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক…তিন মাসে দুর্ঘটনায় ৪০ জন নিহত; আহত…।’
জুব্বার চায়ের অর্ডার দিল। সাথে সিগারেট…।
জুববারের মুখােমুখি বসেছি। অনেকদিন পর আমাদের দেখা। জুব্বার বেশ উচ্ছসিত। কিন্তু আমি ওর মুখের দিকে ভালাে করে তাকাতে পারছি না। কেমন একটা সংকোচ; শামুক যেভাবে দু’ঠোটে খাদ্য চেপে ধরে; ঠিক সেভাবে চেপে ধরছে। ওকে নিয়ে একটি গল্প লিখবাে কথা দিয়েছিলাম কিন্তু গল্পটা এখনাে লেখা হয়নি। বলা ভালাে লিখিনি…।
আজ যদি জুব্বার প্রসঙ্গটি আবার তােলে!
চায়ে কেবল এক চুমুক দিয়েছি। জুব্বার বললাে, ‘সুমিত, মরতে তাে একদিন হবেই। আবিদ মরলাে অকালে, শহীদ মরলাে অকালে; আমরাও যেকোনাে মুহর্তে মরতে পারি। মরতে আমি ভয় পাই না। কিন্তু একটা কষ্ট নিয়ে মরতে হবে…।
কষ্ট! হ্যা-বাসন্তীকে না পাওয়ার কষ্টতাে আছেই জুব্বারের। কৈশােরের প্রেমিকাকে কেউ কোনদিনই ভুলতে পারে না।
জুবার বাসন্তীকে ভালােবাসতাে। বাসন্তী পাত্তা দেয়নি জুব্বারকে।
আবিদ রুম্পাকে ভালােবাসতাে। আবিদকে পাত্তা দেয়নি রুম্পা।
শহীদ ভালােবাসতাে শিউলীকে। শিউলী সিনেমা দেখতে যেতাে মামাতাে ভাই আজাদের সাথে।
ওদের ভালােবাসার কষ্ট দেখে আমি কোনােদিন বলতে পারিনি-আমিও একটি মেয়েকে ভালােবাসি; মেয়েটির নাম…।
আমি জুকারের মুখের দিকে তাকালাম। ওর মুখে শ্রাবণের মেঘ। হয়তাে এখনই ঢল নামবে…।
‘সুমিত, তুই না হয় বড় লেখক হয়েছিস। তাের অনেক নামডাক। কিন্তু আমরা তো নেংটাকালের বন্ধু- একসাথে বসন্তর বাগানে আম চুরি করেছি; একসাথে ঘুঘুর বাচ্চা ধরেছি: একসাথে আমাদের দু’জনের ঠ্যাং ভেঙেছিল; একসাথে সাঁতার কাটতে কাটতে বড় হয়েছি-তুই আমার একটা কথা রাখলি না, সুমিত? বাসড্রাইভার বলে…
কেঁদে ফেললাে জুব্বার। আমার ভয় ছিল জুব্বার প্রসঙ্গটি তুলতে পারে; কিন্তু এতটা ভেঙে পড়বে- তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। আমি জুব্বার জড়িয়ে ধরলাম।
‘ওস্তাদ, টাইম শ্যাষ। মাস্টারে বকাবকি করতাছে…।’
উঠে দাঁড়ালাে জুব্বার। ‘সুমিত, ভাল থাকিস। বেঁচে থাকলে দেখা তাে হবেই..’
আমি জানি, জুব্বারকে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে- বাসন্তি, তাের গল্প এসে যাবেই। এড়ানাে যাবে না…। তুই তাে শেওড়াডালে ঝুলে বেঁচে গেলি; কিন্তু কী বিচ্ছিরি কর্থাবার্তা যে আমরা শুনেছি; তােকে নিয়ে…। তাের নাকি…. । জুব্বার তাে প্ল্যান করেছিল- আজিম ভাইকে খুন করবে; ইয়ে কেটে দেবে ফণির, নিয়ামতের…।
আমরাই ওকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শান্ত করেছি। ‘তাের বাসন্তী যখন নেই-তবে কেন আর খুন- খারাবি করে এই কিশাের বয়সে জেলে যাওয়া?’
আজিম ভাইকে খুন করবে, ফণি-নিয়ামতের ইয়ে কেটে দেবে-জুব্বার একটা সেভেন গিয়ারের চাকু কিনেছিল। ৪০ টাকা দাম। তখন ৪০ টাকা অনেক টাকা। জুব্বার কীভাবে এত টাকা জোগাড় করেছিল, জানি না। চাকুটি হাতে নিলে আমারও মনে হতাে-মানুষ খুন করা কঠিন কোনাে কাজ না…।
আমরা বসেছিলাম টোকে, নলখাগড়ার ঝােপের আড়ালে। ওখানে আমি, জুব্বার, আবিদ, শহীদ মাঝে-মধ্যেই বসি। বসে বসে সিগারেট খাই। জুব্বার ওর নতুন কেনা চাকু দিয়ে তিন-চারটি নলখাগড়া কুটি কুটি করে কাটলাে। তারপর হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে বললাে, ‘ওই কুত্তার বাচ্চাদের জন্যই তাে…’
জুব্বারের কান্না দেখে আমাদের চোখেও পানি আসে। বাসন্তীকে ও পাগলের মতাে ভালবাসে…. ।
আমাদের মধ্যে জুব্বার সবার চে বড়। বয়সে, শরীরে; মনেও…। জুব্বারের গড়ন একহারা; লম্বাটে। আমার চে অন্তত ৭/৮ ইঞ্চি লম্বা। ও যখন মাঠে, গােলমুখে ছােটে বল নিয়ে-সে দৃশ্য দেখার মতাে… । আমরা ওকে পেলে নামে ডাকি।
‘সুমিত, জুব্বারের পায়ে বল গেলে আমার বুক কাপে।’ বলে আমিনা।
আমিনা আমাদের সহপাঠি। জুব্বারের পায়ে বল গেলে কেন ওর বুক কাপে তা আমি জানি কিন্তু জুববারের তাে বুক কাঁপে বাসন্তীকে দেখলে। বেচারি আমিনা! বেচারা জুব্বার!
মেয়েদের মধ্যে বাসপ্তী বড়। ইদানীং ও লাউডগার মতাে তড়তড়িয়ে বাড়ছে। ওর বুকের দিকে সরাসরি তাকাতে পারি না। চুরি করে দেখি। মনে হয়-ওর বুকে একজোড়া
জামরুল..। বুকের মধ্যে জামরুল এটা জুব্বারের আবিষ্কার।
একদিন, টিফিন পিরিয়ডে; আমি আর জুব্বার স্কুলের পেছনে, পুকুরপাড়ে জারুল গাছের ছায়ায় বসে সিগারেট খাচ্ছি। আবিদ-শহীদ নেই। ওদেরই দু’জনেরই পক্স উঠেছে। ওয়াটার পক্স। ক’দিন আগে রুম্পার উঠেছিল। পক্স উঠছে চারিদিকে,.. ।
জারুল গাছের ডালে ডালে হালকা নীল ফুল; যেন নীল তারা উঠেছে আকাশে,..।
একগােছা ফুল যদি মেয়েটির খোঁপায় গুঁজে দিতে পারতাম…।
জুব্বার চুপচাপ সিগারেট টানছিল। ও এমনিতে উচ্ছল-হৈচৈ করে সবসময়; কিন্তু সিগারেট খাওয়ার সময় সন্ন্যাসী বনে যায়। ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী!
হঠাৎ ধ্যান ছেড়ে জুব্বার বললাে, ‘সুমিত, একটা কথা বলবাে।’
‘বল। কী কথা?’
‘কিন্তু তােকে বলে তাে সুখ পাওয়া যায় না। তুই কিছু বুঝবি না… ।’
জুব্বার আমাদের চে কিছুটা বড়- বয়সেও, শরীরেও…। তাই বলে এতটা তাচ্ছিল্য?
রাগ হলাে আমার। রাগতস্বরেই বললাম, ‘বলেই দ্যাখ না! বুঝি কী বুঝি না! সবকিছুই তুই বুঝিস?’
‘তাের নাইটপ্রেসার হয়? মেয়েদের বুক দেখলে তাের বুক কাঁপে? ক্ষুধা জাগে শরীরে?’
মেয়েদের বুক দেখলে আমারও বুক কাঁপে। কিন্তু নাইটপ্রেসার হয়নি কখনাে। না হােক-জিদ চেপে গেল আমার- মিথ্যে করে বললাম, ‘হবে না কেন? হয়…’
জুব্বারের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলাে। বলল- ‘বাসন্তির আজ মিনস হয়েছে।’
মিনস! শব্দটি আমার কাছে অপরিচিত। এবার বােধ হয় ধরা পড়ে যাবাে। ভাবলাম-ছেলেদের নাইটপ্রেসারের মতাে মেয়েদেরও হয়তাে কিছু একটা হয়। আন্দাজে
টিল ছুঁড়লাম। বললাম- ‘বুঝলি কী করে?
‘দেখেছি।’
‘দেখেছিস!’
‘স্কুল ছুটির পর খেয়াল করিস- বাসন্তীর সালােয়ারে রক্ত…’
রাতে আমার বড় হওয়ার সাধ জাগলাে। কবে বড়াে হবাে? মেয়েদের বুক দেখলে কবে শরীরে ক্ষুধা জাগবে? ঘুমের মধ্যে, মেয়েটির সরােবরে সাঁতার কাটতে কাটতে; এক সময় অসাড় হয়ে গেল আমার হাত-পা। আমি ডুবে যেতে থাকলাম… ।
স্কুল ছুটি। সামার ভ্যাকেশন। এবার ভ্যাকেশন শুরু হয়েছে অনেক আগে। ছুটি না দিয়ে হেউস্যারের উপায় ছিল না। ছাত্রছাত্রী আসে না স্কুলে। না খেয়ে কে পড়তে আসে! গ্রামের কারাে ঘরে খাবার নাই…। আমাদের যে বড়ােবাড়ি; আমার দাদা সাবেক ইউপি মেম্বার-আমরাও খাই চিনার ভাত; কাউনের জাও ….। কোনােদিন ভাত রান্না হলে মা আমার জন্য মাড় তুলে রাখে-এটা দাদার নির্দেশ; ভাতের মাড়ে প্রচুর ভিটামিন … ।
স্কুল ছুটি তাে লেখাপড়ার চাপ কম। আমরা প্রায় বেকার। আমি, আবিদ, জুব্বার-আমরা প্রায় সারাদিন বসন্তবাড়ির বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াই…। কচি আম পেড়ে খাই; আমের পাতা, পেয়ারার পাতা চিবাই…
দেশে আকাল পড়েছে বলে রােদ বেশি। রােদের তাপ বেশি। শরীর পুড়ে যায়: ফোস্কা পড়ে। আমরা দুপুরে বসন্তবাড়ির ঝাকড়া গাবতলা শুয়ে থাকি। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। জুব্বার বলে-বাড়িতে গেলেই ক্ষুধা লাগে, তারচে’ এখানেই ভালাে…।
স্কুল বন্ধ থাকলে ভালাে লাগে না আমার। স্কুলে কত হেচে, আনন্দ; দূর থেকে মেয়েটিকে দেখা,..। আবিদের কেমন লাগে জানি না। ও কথা বলে কম। রুম্পার জন্য ওর মন কেমন করে কী? জুব্বারের ছটফটানি টের পাই। ও গাবতলা শুয়ে শুয়ে বলে-আর ভালাে লাগে না
রে সুমিত।
‘কী ভালাে লাগে না?’
‘এই যে স্কুল বন্ধ…।’
আমি জানি জুব্বারের কেন ভালাে লাগে না। তবুও একটু খোঁচানাের জন্য বললাম- কেন? স্কুল বন্ধ তাে ভালােই। লেখাপড়ার ঝামেলা নাই। সারাদিন ঘুরে বেড়ানাে…।
‘ধুর, বাসন্তীকে দেখি না কতদিন। ওকে একদিন না দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে…’
‘চল, একদিন ওদের বাড়িতে যাই।’
‘না।’
‘কেন?’
‘যদি কথা না বলে, বসতে না বলে। ওর মা যদি কিছু মনে করে….।’
আমার বলতে ইচ্ছে করলাে- যে মেয়েটি তােকে পাত্তাই দেয় না তাকে তুই ভালােবাসিস কেন? ওর জন্য তাের দমবন্ধ হবে কেন! কিন্তু আমি ওসবের ধারে-কাছেও গেলাম না। আমারও তাে মেয়েটিকে না-দেখলে বুকটা ভেঙে যায়…।
আবিদ বললাে, ‘বাসন্তী গালার হাটে যায়, বৈল্লার হাটে যায়…’
‘জানি। তাতে কী?’
‘আমরা চকের পথে একদিন ওর সামনে দাঁড়াই। তুই কথা বলবি।’
‘গর্ধব। বাসন্তী হাটে যায় সুবলকাকার সাথে। কাকাকে তুই চিনিস না। মুচিবাড়ির কুত্তার মতাে করে আমাদের ছিড়ে খাবে…. ।’
বাড়ির মুরগির ডিম, কাচকলা, ঝােপজঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কচুর লতা বিক্রি করতে হাটে যায় বাসন্তী। আমাদের গায়ের- ওর মতাে গায়ে-গতরে বড় আর কোন মেয়ে হাটে যায় না। ওর না গিয়ে উপায় নেই। মাধবকাকার পায়ে বাতাস লেগেছে; হাঁটতে পারে না। আকাল লাগার শুরুতেই বাসন্তির বড় ভাই সাধন বউ নিয়ে পালিয়েছে…। এখন বাড়িতে ওরা তিন বােন, এক ভাই; বাসন্তী সবার বড়। হাটে ডিম-কলা বেচে ও তেলটা-নুনটা কিনে আনে। কাকিমা খুঁদ-কুড়া সংগ্রহ করে গ্রামের বড় বড় গেরস্থ বাড়ি থেকে…।
আবিদের প্রস্তাবটা আমার পছন্দ হয়েছিল। সুবলকাকা কানে কম শােনে; চোখেও কম দেখে-সুযােগটা আমরা নিতে পারতাম। বাসন্তী আমাদের চেয়ে ম্যাচিউর্ড; আর যাই হােক ও হয়তাে কোন সিনক্রিয়েট করতাে না। কিন্তু জব্বার প্রস্তাবটা বাতিল করে দিল।
আমরা প্রতিদিনই বসন্তবাড়ির জঙ্গলে গাবতলা বসি। পাতার বিড়ি টানি…। আগে আমি বাবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা দু’টো বকমার্কা সিগারেট চুরি করতাম। এখন বাবার পকেটে সিগারেট থাকে না। থাকবে কী করে? দাম যা বেড়েছে। বাবা পাতার বিড়ি খাওয়া শুরু করেছে। আমি দু’তিনটে করে বিড়ি চুড়ি করি…।
জুব্বার বিড়ির ধোঁয়ার চমৎকার রিং বানাতে পারে। আমি চেষ্টা করেছি; কিন্তু ব্যর্থ- হয় না।
জুব্বার কী জাদু জানে, কে জানে! একদিন, জুব্বার ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বললাে, ‘সুমিত, দ্যাখ দ্যাখ…’
আমি জুব্বারের মুখের দিকে তাকালাম। কী দেখবাে?
‘ঐ যে যৌয়ায় রিং উড়ে যাচ্ছে, দ্যাখ, রিংয়ের মধ্যে বাসন্তীর মুখ… ।’
জুব্বার বাসন্তীকে ভালােবাসে। ও কল্পনায় ধোঁয়ার রিংয়ের মধ্যে বাসন্তীর মুখ দেখতে পারে। সেই মুখ তাে অন্য কারাে চোখে পড়বে না। আমি দেখলাম ধোঁয়ার রিং উড়তে উড়তে শূন্যে মিলিয়ে গেল…।
‘কীরে, দেখতে পেলি?’
আমি এমনভাবে মাথা নাড়লাম, যার কোন অর্থ নেই। মজনু হতে আর বেশিদিন দেরি নাই, জুব্বারের….।
ক’দিন আগে আমরা রওশন টকিজে লাইলী-মজনু সিনেমা দেখেছি। কী প্রেম দু’জনের। মজনু মরুভূমিতে ‘লাইলী, লাইলী বলে মাথা ঠুকছে পাথরে; মেঘ ফুঁড়ে নেমে আসছে লাইলী..। পেছনে অশ্বারােহীর দল, লাইলীকে নামতে দেবে না। লাইলী যে রাজকন্যা!
আড়চোখে তাকালাম জুব্বারের চোখের দিকে। ওর চোখের জল পদ্মপাতার জলের মতাে টলমল করছে; যে কোন মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে…।
আরেকদিন দুপুরবেলা। আকাশ গলে পড়ছে রােদে। আমি আর জুব্বার গাবতলা বসে বসে বিড়ি খাচ্ছি। কী কারণে যেন আবিদ আসেনি। ওর মায়ের সূতিকা বােধহয় বেড়েছে। ছােট বােন দু’টোকে সামলাচ্ছে আবিদ। জুব্বার বললাে, ‘খেয়াল করেছিস সুমিত, বাসন্তীর জামরুল দু’টো না হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে..।’
জুব্বার দুধ বা স্তন বলে না; বলে জামরুল।
আমি বললাম, খেয়াল করবাে কীভাবে? স্কুল তাে বন্ধ। পথে-ঘাটে কোথাও দেখা হয় না। তা তুই দেখলি কেমন করে?
‘স্বপ্নে।’
হ্যা, স্বপ্নে দেখলাম-বাসন্তী কলার ঢাকি মাথায় হাটে যাচ্ছে। ওর কামিজটা বুকের কাছে। একটু ছেড়া। গামছার একটা টুকরাে আছে বুকে। কিন্তু জামরুল দু’টো গামছার বাধা উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসতে চাইছে….
আমাদের বাড়িতে, বারবাড়ি; জামতলা; দুপুরে পাড়ার মহিলাদের আড্ডা বসে। দাদি আড্ডার মধ্যমণি। নানা রসালাে গল্প করে দাদি। আকালে আড্ডার সৌন্দর্য কিছুটা নষ্ট হয়েছে, তবে বন্ধ হয়নি। কেউ কেউ এখনাে প্রতিদিনই আসে। একদিন বাইরে বেরুনাের সময় শুনলাম- দাদি বলছে- আকালের সময় বাচ্চার মায়েদের শরীরের সাথে স্তনও শুকিয়ে যায়; বাচ্চারা দুধ পায় না; কিন্তু যুবতী মেয়ের শরীর শুকিয়ে গেলেও স্তন বাড়ে… ।
‘হ দাদি, ঠিক কথাই কইছেন; এই যে দ্যাহেন, আমার বুকে একফোটা দুধও নাই…।’
পাশের বাড়ির আমিরের বউয়ের কথা কানে আসলাে আমার।
স্তনও শরীরের অংশ। শরীর শুকিয়ে গেলে কীভাবে স্তন বাড়ে তা আমার মাথায় ঢুকলাে। দাদির কথা সত্য না মিথ্যা, নাকি তার কথায় কোনাে রহস্য আছে তাও জানি না। রহস্য থাকলে থাকতেও পারে। পাড়ার কে না জানে, দাদির কথার মারপ্যাচ সবাই ধরতে পারে না। যাই হােক- সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ আমি জুব্বারকে বললাম ‘আকাল বাড়ছে তাে ভাই বাসন্তীর স্তন বেড়েছে…।’
‘কী রকম?’
আমি দাদির কথাটা ব্যাখ্যা করলাম। বললাম, ‘যুবতী মেয়েরা ঠিকমতাে খেতে না পেলে তাদের স্তন বাড়ে… ।’
জুব্বার আমার মুখের দিকে শিশুর মতাে তাকিয়ে রইলাে। বুঝলাম, ওর মাথায় কিছুই ঢোকেনি।
কিছুক্ষণ পর জুব্বার বললাে ‘আকাল যাবে কবে?’
আকাল যাবে কবে তা কেউ জানে না- আমার জানার তাে প্রশ্নই ওঠে না। আমরা তবুও চিনার ভাত, কাউনের জাও, আলুর চুকা খেতে পাই- কোনাে কোনাে বাড়িতে তাে দু’তিনদিন চুলাই জুলে না। চারদিক থেকে খবর আসছেনা খেয়ে মরছে মানুষ…। নানা আকথা-কুকথাও ভাসে বাতাসে। কথাগুলাে দাদির কথার মতােই রহস্যময়। আমার মাথায় কিছুই ঢােকে না। আমাদের গ্রামেই, মধ্যপাড়া কদমের বাড়িতে, আব্দুলের বাড়িতে, জুলুর বাড়িতে -রাতে নাকি অচেনা মানুষ আসে…। অন্য সময় হলে এ নিয়ে গাঁয়ে বিচার- সালিশ বসতাে; আকালের জন্যে এখন কেউ কিছু বলছে না…। সবাই চোখ বুজে আছে। বেঁচে থাকাটাই বড় কথা….।
আমি জানি না, কেউ জানে না-আকাল কবে যাবে; তবুও জুব্বারকে শান্ত করার জন্য বললাম-ধান কাটলে তবেই আকাল যাবে…।
‘ধান কাটলে?’ জুব্বার যেন আকাশ থেকে পড়লাে। বললাে, খরায় আউশধান পুড়ে যাচ্ছে, বন্যায় যদি আমনধান গতবারের মতােই ভেসে যায়…তাহলে?
‘তাহলে আর কী?’ এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
আমার দাদি দিলদরিয়া মানুষ। পাশের বাড়ির কেউ না খেয়ে আছে- এটা জানলে; দাদির হাড়িতে আলুর চুকা, খুদের ভাত-যাই থাক, তাকে ডেকে এনে খাওয়াবে! নিজে না খেয়ে…।
একদিন দুপুরবেলা- দাদা বড় ঘরের বারান্দায় বসে তামাক খাচ্ছে। হুঁকোর ভিতরে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে মেঘ ডাকার মতাে। ঘোমটা দিয়ে মাথা ঢেকে উঠোন পার হয়ে গেল বেহারাবাড়ির সুরেনের মা। তার আঁচলের নিচে মাটির সানকিতে পান্তাভাত…।
সুরেনের মা গেরস্থবাড়ি ধান ভেনে, ডাল পিষে কোনােমতে সংসার চালাতাে এখন কারো বাড়িতে ধান নাই, ডাল নাই- সুরেনের মা বেকার; ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অথই সাগয়ে পড়েছে…। সুরেনের বাবা বেঁচে নেই। যুদ্ধের বছর আত্মহত্যা করেছে; কেন- ঈশ্বর ছাড়া
কেউ জানে না। দারুণ পলাে বানাতাে সুরেশকাকা। দাদা এখনাে বলে- সুরেশের পলো নিয়ে বিলে নামলে মাছ পড়বেই..। বেশ আয়-রােজগার ছিল সুরেশকাকার। কিন্তু তার বেচে থাকতে ভালাে লাগলাে না। আত্মহত্যা করলােবাড়ির পিছে, তেঁতুলগাছের ডাগে
ঝুলে…।
নাদুকাকা, আমাদের বাড়ির বছরচুক্তি কামলা- গাঁয়ের সববাড়ির হাড়ির খবর তার জানা;। এই যে আব্দুলের ঘরে, জুলুর ঘরে রাতে অচেনা মানুষ আসে- এই খবরও নাদুকাকা আমাদের দিয়েছে; সুযােগ পেলেই সে বলার চেষ্টা করে- সুরেশকাকা যে তার সুন্দরী স্ত্রী, চার পুত্রকন্যা রেখে আত্মহত্যা করেছে; এর মধ্যেও নাকি দারুণ গল্প আছে- কাকার মনে নাকি শান্তি ছিল না …।
আমাদের এই গল্পে সুরেশকাকার গল্প অনাবশ্যক। এটি আপাতত দূরেই থাক…।
আমার দাদা যে হাড়কৃপণ মানুষ, তা না। গায়ের মানুষের বিপদে-আপদে সবার আগেই এগিয়ে যায়: কিন্তু এখন যে সময় অন্যেরকম; নিদারুণ আকাল- তাকেও খুবই হিসেব করে চলতে হচ্ছে…।
‘সুমুর দাদি, হুইনা যাও ছে…।’
দাদা-দাদি আমাকে সুমু বলে ডাকে। সুমিত বলতে গেলে নাকি দাঁতে জিহ্বা কোটে যায়। দাদি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দাদার সামনে এসে দাঁড়ালাে। সে জানে, দাদা কী বলবে… ।
‘সুরেশের বউ গেলাে না?’
‘সানকিতে কী?’
‘চাইরডা পান্তাভাত।’
দাদি ভেবেছিল দাদা কড়া কথা শােনাবে। বলবে-ক’দিন পর তাে আমাদেরই না খেয়ে থাকতে হবে। দান-খয়রাত বন্ধ কর। কিন্তু কেন জানি দাদা ওসবের ধারে-কাছেও গেল না। বললাে- ‘ঠিক আছে, যাও… ।’
দাদি চোখের পানি মুছতে মুছতে রান্নাঘরে চলে গেল।
আমরা হয়তাে ঠিক সেভাবে টের পাই না; কিন্তু আকাল গাঁয়ের সবকিছু কেমন বদলে দিচ্ছে। ঘরে ঘরে অসুখ-কাদেরের দাদা-দাদি মারা গেল দু’দিনের ব্যবধানে, পেটের অসুখ করে…। কচু-ঘেচু খেয়ে পেটে অসুখ করছে। গাঁয়ের কারাে মুখের দিকে তাকানাে যায় না; সবার চোখে-মুখেই একটা অজানা ভয়, আতঙ্ক…। আকালের রােগ কার ঘরে ঢোকে, কে জানে!
রাতে বাড়ির কুকুরগুলাে ডুকরে ডুকরে কাঁদে…।
একদিন সকালে, আমি তখনাে পড়ছি; স্কুল বন্ধ থাকলেও আমি রাতে আর সকালে রুটিনমাফিক পড়তে বসি- জুব্বার আর আবিদ এসে হাজির। ওরা দু’জনেই উত্তেজিত। ঘুঘুর নতুন বাসার সন্ধান পেলে আমরা তিনজনেই যেরকম উত্তেজিত হইঠিক তেমনি।
জুব্বার বলে, ‘সুমিত, চল বাইরে যাই; কথা আছে।’
ওদের উত্তেজনা আমার ভিতরেও সঞ্চারিত হয়েছে। বই গােছাতে গােছাতে জিজ্ঞেস করলাম- ‘নতুন বাসার সন্ধান পেয়েছিস?’
‘আরে না। ও-রকম কিছু না। খারাপ খবর… ।’
‘খারাপ খবর!’
আমরা, আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে বাঁশঝাড়ে গিয়ে বসলাম। ওখানে আমাদের বসার জায়গা আছে…।
জুব্বার বললাে, ‘জানিস সুমিত, মধ্যপাড়ার জুলুর বউ রাতে কার সাথে জানি ভেগে গেছে।’
‘কেন? ভাগতে গেল কেন?’
‘ঘরে যে খাবার নাই।’
নাদুকাকার মুখে শুনেছি- ‘রাতে ওদের ঘরে অচেনা মানুষ আসে। তাই বলে স্বামী-সন্তান ফেলে ঘর ছেড়ে চলে গেল?
আমি জুববারের মুখের দিকে তাকালাম জুববার দার্শনিকের মতাে বললাে, ‘সুমিত, আরো অনেকের বউ-মেয়ে ঘর ছেড়ে পালাবে- পৃথিবীতে না খেয়ে থাকার মতাে কষ্ট আর কিছুতেই নাই…’
আবিদ চুপচাপ বসেছিল। ও বললাে, ‘চল, বসন্তবাড়ি যাই, এখানে তাে বিড়ি ধরানাে যাবে না…।’
বৈশাখে দু’দিন খুলিঝড় আর একদিন ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে। জ্যৈষ্ঠে একফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। আকাশে মেঘ করেছে; ভাসে বেরিয়েছে কালােমেঘ; কিন্তু সেই মেঘ ঢল হয়ে নামেনি। জ্যৈষ্ঠের মেঘ দেখে গাঁয়ের মানুষ ভেবেছে, বৃষ্টি হবে আষাঢ়ে; গােদার সাতবউ সাতদিন কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুড়বাড়ি যাবে; আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হলেও কিছু আউশধান উঠবে ঘরে-কেটে যাবে আকাল। কিন্তু বৃষ্টি নামলাে না। গােদার সাতবউ হাসতে হাসতে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল…।
দীর্ঘদিন বৃষ্টি নেই। পাকা তুলার মতাে ফেটে চৌচির হচ্ছে মাঠঘাট। ঘরে খাবার নেই। মানুষ খাচ্ছে কচুঘেচু… । গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পেটের অসুখ…। ওমরের মা, সিরাজের বউ, মেঘাপাল, গঙ্গারামের নাতীটা মরলাে, এই ক’দিনে! ডাক্তার ডাকতে পারেনি কেউ…। খাওয়ার জোগাড়ই কেউ করতে পারে না; ডাক্তার ডাকার উপায় কী।
আমাদের বয়স কম। কারাে মৃত্যু ঠেকানাের পথ আমাদের জানা নেই। কিন্ত প্রত্যেকটি মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে, শােকাকুল করে; আমাদের মা-বাবা, ভাই-বােন, দাদা-দাদি; কেউ না কেউ তাে এই আকালে মরতে পারে …। আমাদের মনে পড়ে, স্কুলের বহয়ে পড়া পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা…। লাখ লাখ মানুষ মরেছে, সেই মম্বন্তরে… সুযােগ পেলেই, একজন ক্ষুধার্ত মানুষ অন্য মানুষের শরীরের মাংস ছিড়ে খেয়েছে…। যদি আমাদের গ্রামেও সেরকম কিছু হয়!
বসন্তবাড়ির জঙ্গলে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে আমাদের তিনজনের চোখই ঝাপসা হয়ে আসে।
জুব্বার হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
‘কীরে, কাঁদছিস কেন?’
‘বাসন্তীর বাবা বাঁচবে না।’
‘তুই জানলি কী করে।’
‘কাল রাতে আমি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।’
‘একা? আমাদের কিছু না বলে?’
‘বাসন্তী খবর দিয়েছিল… ।’
বাসন্তীর বাবা গুরুতর অসুস্থ, যেকোনাে সময় মারা যেতে পারে; খবরটা শুনে আমারও বুক ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু জুব্বারের কথা শুনে, এই কষ্টের মধ্যেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলাে আমার মুখে। আমি বললাম, ‘তাই নাকি? এতদিনে মন গললাে নায়িকার…।
‘আমার হাত চেপে ধরে বাসন্তীর সে কী কান্না! গােটা দশেক টাকা জোগাড় করে দিতে সলালাওর বাবার চিকিৎসা করাবে। আমি টাকা কোথায় পাবাে, সুমিত?’
গাবপাতার ফাক-ফোকর গলে রূপার গুড়াের মতাে রােদ পড়ছে আমাদের মাথায়। আমাদের মুখমণ্ডলের ছায়া মাটিতে। আমি জুব্বারের মুখের দিকে তাকালাম না। তাকালাম এর মুখের ছায়ার দিকে। বিষণ্ন, বিধ্বস্ত। আমি জানি, বাসন্তীর হাতে দশটি টাকা তুলে দিতে পারলে জুব্বার যে সুখ পাবে, পৃথিবীটা ওর নামে লিখে দিলেও সেই সুখ পারে না।
আমি ওর পিঠ চাপড়ে বললাম, ‘নাে টেনশন, বন্ধু; টাকা আমি তােকে ম্যানেজ করে দেব…’
আমার মাটির ব্যাংক ভাঙলে দশ টাকার কম হবে না…।
দু’দিন পর মারা গেল বাসন্তীর বাবা। বাসন্তির সাথে আমরাও কাঁদলাম…।
ক’দিন পর বর্ষা এলাে দেশে। আমাদের খালের জলের ডাক অনেকদূর থেকেও শােনা যায়। স্কুল খুলেছে। আমরা বিকেলে বাসন্তীদের বাড়ির সামনে খালপাড়ে বসে আড্ডা দেই। আকাল যেন রাতারাতি আমাদের সবারই বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে…। একটা ডােন্ট কেয়ার ভাব। বাসন্তী কথা বলে কম। জুব্বারের মুখে কথার খই ফোটে…।
একদিন বাসন্তী বলে, ‘জুব্বার, তুই যখন বল নিয়ে গােলমুখে ছুটিস তখন আমার বুক
কাঁপে। যদি…।’
বাসন্তীর কথা শুনে আমার আমিনার কথা মনে পড়ে। আমিনাও বলতাে…। আহারে! বেচারির বিয়ে হয়ে গেল অল্প বয়সে,..।
খালে উপচেপড়া জল। জলভরা মাছ। গেরস্থবাড়ির উঠানে উঠেছে আউশধান। আকাল কেটে যাচ্ছে…। আমরা লেখাপড়ায় মন দিয়েছি। এই সময় খবরটা দিল নাদুকাকা…। খবরটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমার মনে হলাে এইমাত্র বিনামেঘে ধারে-কাছে কোথাও যেন বজ্রপাত হলাে!
‘বলাে কী নাদুকাকা?’
‘একবিন্দু মিছাকথা না। আমার নিজের চোখে দ্যাহা- আজিম, নিয়ামত, ফণি…। নিয়ামত আর ফণি একলগেই যায়, আজিম আলাদা, ওরা য্যান ট্যার না পায়….।’
আমি তাে এখন বড় হয়েছি। রাতে সাঁতার কাটি সরােবরে। আমার মনে হলাে, বাসন্তীর কপােলে যে একটা ক্ষতচিহ্ন- ওটা কি কামড়ের দাগ? আজিম ভাই বা নিয়ামত-ফণি কারাে দাত বসে গিয়েছিল! আমি নাদুকাকার দু’হাত চেপে ধরিকাকা, আর কারাে কাছে কিন্তু একথা বলাে না…. ।
‘না, না, এইডা কি জনে জনে কওনের মতাে কথা? ম্যায়াডা তােমার লগে পড়ে, তাই তােমারে কইলাম….।’
আমি মনে মনে বাসন্তীর শরীর দেখতে থাকি; খুব কি বেশি পরিবর্তন এসেছে শরীরে- কপােলের ক্ষতচিহ্ন ছাড়া? ওর স্তন দু’টো তাে এমনিতেই একটু বড়; এখন
পুরুষ মানুষের হাতের স্পর্শ পেয়ে কি আরাে বড় হয়েছে? জুব্বারের প্রতিক্রিয়া কী হবে যদি খবরটা শােনে?
ঘুটঘুটে অদ্ধকার রাত। অমাবস্যা কিনা জানি না। সন্ধ্যা থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। কাদাযুক্ত পিচ্ছিল পথ। খালপাড় দিয়ে যাচ্ছি- পা পিছলে গেলেই খালে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা…। সাপেও কামড়াতে পারে…. ।
আনৃদাজে টিল ছুঁড়ে, বাসন্তী যে ঘরে থাকে; ঘরের দরােজায় তিনবার টোকা দিলাম। আমি ধরেই নিয়েছি-আজিম ভাই, নিয়ামত-ফণি- ওরা এসে ঘরের দরােজায় তিনবার টোকা দেয়; বাসন্তী দরােজা খুলে বেরিয়ে আসে!
‘তুই, সুমিত, এতরাতে?’ বাসন্তি দরােজা খুলে বেরিয়ে এসেছে।
‘কেন, খুব অবাক হয়েছিস?’
‘অবাক হবাে না? এই বৃষ্টির রাতে, কী মনে করে, তুই?’
‘তাের সাথে একটা বােঝাপড়া করতে এসেছি….।’
ঢল বৃষ্টি নামলাে। আমরা বসলাম ঘরের বারান্দায়। আমি, এর আগে কোনদিন এতরাতে বাড়ির বাইরে যাইনি। …আজ, এখন বাসন্তীদের বাড়িতে। আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগলাে। যদি আজিম ভাই বা ওরা কউ এখন এসে পড়ে! বাসন্তী আমার সামনেই
বসেছে, টুলেএকটা কাছলি আর ছায়াপরা। হাতে কুপিবাতি। ও কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে…।
‘কীরে, কান্নাকাটি শুরু করলি যে…’
আমি কী বােঝাপড়া করতে এসেছি; বাসন্তী তা জানে- কাঁদতে কাঁদতেই আমার হাত চেপে ধরলাে, বললাে- ‘সুমিত, আমার কোন উপায় ছিল না। বাবা মরণাপন্ন, মা আর ভাইবােনদের দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হয়…।’
‘তখন না-হয় উপায় ছিল না। এখন?’
‘ওরা ভয় দেখায়, দুর্নাম রটাবে…।’
‘জুব্বার যে তােকে ভালােবাসে… ।’
আমার হাত দু’টো বাসন্তীর হাতের মুঠোর মধ্যেই ছিল। ও আমার হাত দু’টো নিয়ে ওর স্তনের ওপরে চেপে ধরলাে। এর আগে, আমি জীবনে কোনােদিন মেয়েদের স্তন স্পর্শ করিনি; স্তন যে এতটা আগুনের মতাে আকর্ষক হাত পুড়ে যায় কিন্তু টান দেয়া যায় না; তা আমি জানতাম না- আমার হাত পুড়ে যেতে থাকল…।
বাসন্তী বললাে, ‘সুমিত, আমার স্তনের দিব্বি, বল জুব্বারের কাছে কথাটা কোনােদিন বলবি না। বল…’
নাদুকাকার মতােই আমার বলতে ইচ্ছে করলাে- এটা বলার মতাে কোন কথা, বাসন্তী?
সকালে নাদুকাকাই খবরটা দিল-বাসন্তী আত্মহত্যা করেছে; বাড়ির পেছনে শেওড়া গাছের ডালে ঝুলে….।