গল্পে গল্পে সারাবেলা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এম মনির উজ-জামান

আচরণটা ওর কাছে হয়তো ছেলেমিই মনে হলো। আমি খানিকটা আচার খাওয়ার আবদারে বললাম- ‘আর একটু বসে যাওনা লক্ষ্মীটি।’ সে ভ্রু কুঁচকে আমার চোখের দিকে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টির ভাঁজ ফেললো। একটা নিরব কৈফিয়ত চাইল যেন!  আমি কখোনও মাথার ভেতর সাজানো উত্তর খুঁজে পাই না দ্রুত। সিলেবাসের অতি সহজ প্রশ্নগুলো একটু-আধটু সাজিয়ে পাশ মার্ক অর্জন করার অক্ষমতা আমার চিরকালের। আর জীবনের প্রশ্ন সেতো জটিল এবং ততোধিক কঠিন। তারও পর সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থাকে না কোথাও। সহসা সে উত্তর করা আমার কাছে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। ফলাফল, ঘরে নিশ্চুপতার বরফ জমতে থাকে ক্রমশঃ। কি যেন বলবে বলে ডেকে ছিলে?  বেঁচে থাকার সমস্ত আয়োজন ফুরিয়ে যায়। মরা বিকেল পেরিয়ে রাত আসে; মৃত্যুর কালো হাত ডাকে হিম ইশারায়। তখন ইচ্ছের পায়ের তলার মাটি নরম হয় বৈকী। এখন শুধু কেরোসিন ফুরোনো কুপির সলতে উঁচিয়ে জীবনের সীমানায় পৌঁছনো। ধপ করেই নিভে যাবে শেষ আলো…। একটা জ্বরো এমাজ নিয়ে ঘুমিয়েছি দিন ছয় সাত। বিছানায় পড়লেই ওকে নিয়ে ভেবে ফেলি কীসব ঘর-গেরস্থালি। হয়তো ওর শান্ত শুভ্র হাত কপালে রেখে বলবে- ‘দেখে নিও ঠিক পর পরই ভাল হয়ে যাবে।’ পিছু রেখে বিছানা নিঃস্বঙ্গ একাকী শরীর ঝেড়ে উঠতেই হয় এক সময়। বাস্তবতার পরাকাষ্ঠায় মেপে নিই নিজেকে। মোনালিসার রহস্য জড়ানো হাসি নিয়ে, শব্দহীন পাগুলে কথা-বার্তায়। এক আঁজলা জল মুখে ঝাপটা দিই কলঘরে। যাকে নিয়ে এত ভাবনা, এত আয়োজন, এত স্বপ্ন-সাধ, তার এতে কোন তাপ-উত্তাপ নেই। যাকে বলে নির্ভেজাল উদাসীনতা। সন্তানের সাথে মায়ের নাড়ীর যোগ থাকে। অথচ সেই শিশুকে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে, মানুষ হওয়ার আয়োজনে নিঃঠুর হাতে সেই বন্ধন ছিন্ন করতে হয় একদিন। নিত্য জীবনের এই সংকীর্ণ ও সংকুচিত বলয়ের বাইরের প্রকৃতি ও বৃহৎ মানবতার সাথে আমাদের কারো মনের খুব একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এখন আর নেই, থাকে না। কিন্তু এই আমরাই বহুদূরের ছেলেবেলায় অপরের উপকারে অপরের প্রয়োজনে উদ্বিগ্নে দুদ্দাড় হয়েছি। তখন ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি অপরের পোড়া ঘরে আলু পুড়িয়ে খাবার কথা। অপরের দুঃখ-যন্ত্রণা, ক্ষয়-ক্ষতি দেখে ক্রুর হাসি হাসা। অথচ সামান্য স্বার্থ ত্যাগের ব্যর্থতার কারণে ভালবাসার খোলস ছাড়ে আজ অনেকে। ভালবাসা কি রোগ বিশেষ, যে সেরে যাবে একদিন!? প্রেম, ভালবাসা চলমান প্রক্রিয়া, তবু ভালবাসার ঘোড়দৌড়ে মাঝ পথেই থেমে যায় সবাই। যেন ভালবাসার ভূত পালালেই বাঁচি। হা-হা-হা…

আয়নার সামনে গিয়ে হোঁচট খেলাম খানিকটা। মানুষের চেহারা বদলাতে বদলাতে তো অল্প কিছু থেকে যায় এ যেন সেটুকুই শুধু থাকা কেবল। অনেক দিন পর আয়না দেখার প্রাথমিক আড়ষ্ঠতা কেটে গেলে, ফিরে এলাম রাস্তার দিককার বারান্দায়। ‘অ্যাই পাগলী’, ডাকতেই সুচিত্রা নামের মেয়েটি আড়চোখে তাকায়। তেরছা আর আড়চোখে চাউনি কেন যেন নষ্টা মেয়ের চালচিত্র বলে মনে হয়। কিন্তু ঐ চাউনিই অনুভূতিতে সিঁদ কাটে। ভূতের মতো উল্টো হাঁটি কিছু দূর। জানি অবহেলা করতে পারবে না আমার আহ্বান। কিছুটা অভিযোগের সুরেই বলি- ‘কোথায় ছিলে এতদিন?’ ওর উত্তর দেবার কিছুই নেই। একটু হাসল শুধু। হাসি দিয়েই যেন, এই বে-আইনি অনুপস্থিতিটা ঢাকলো কিংবা ঢাকতে চেষ্টা করলো খানিকটা। ‘এমন নির্ভেজাল উদাসীনতা দেখালে অথচ আমি বেশ কয়দিন নিদারুণ জ্বরে…’ মুখের কথা কেড়ে নিয়েই বললো- ‘জানি, কিন্তু আমিও সুস্থ ছিলাম না।’ কী যেন কী সব মিলে যায় দু’জনার। সুখ-দুঃখ চলমান জীবন, তাইতো বলি, অমন দস্যি মেয়ে এমন জবুথবু কেন! মুখ দেখে বোঝা যায় সে জ্বর এখনও ছেড়ে যায় নি। ‘এই যে ম্যাডাম এমন ওপরসা ওপরসা আর কত দিন?’ ব্যাজার মুখে খানিক দোনোমোনো হয়েই বললো- ‘মেয়ে হলেই বুঝতে।’ সেই পুরাতন কথা। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো- ‘এই দ্যাখ তোমার চিন্তায় আমার শরীর অর্ধেক…।’ আমার গর্বের জায়গায় হাত পড়ায় রাগের মেজাজ ডানা মেলে নিরুদ্দেশ। যন্ত্রণার বরফ গললো কিছুটা। আমি হাতটা আঁকড়ে ধরি হাতের ভেতর। মনের অসম্পূর্ণতা কেটে যায়। এ চিজ-ই হৃদয়ের চোর, কুঠিরে করে ক্যানসারের মত বসবাস। তবু যেন দু’জনার মাঝে দুস্তর ব্যবধান। কোথায়  যেন একটা ছাড়ছাড় ভাব রয়েই যায়। এ যেন একটা সর্ম্পক রহিত সর্ম্পক। ভালবাসা পরবর্তী সামাজিক স্বীকৃতি কিছুতেই নাগালে আসে না। আসবে না হয়তো কোনোদিন। এখন শুধু বুদ্ধিমানের মতো স্বাভাবিক ধৈর্য নিয়ে প্রতীক্ষা করা। সে প্রতীক্ষার রাত কখনও ভোর হয় না; তাতে অনুভূতির চামড়া একটু একটু করে মোটা হয়ে যায় শুধু। কোন কদর্য অভীষ্টসিদ্ধির অভিপ্রায়ে না, হারিয়ে যাবে সেই ভয়েই ওর  হাত চেপে ধরি হাতের মুঠোয়। অনেকটা সাগরে ভেসে যাওয়ার মুখে খড়কুটো ধরবার মতো করে।

কমলার কোষের মতোই গোলাপী ওই ঠোঁট। জানি ও ঠোঁটেই আলাদীনের জাদুকরী প্রদীপ। তবু হয়নি নির্জন ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ধোঁয়াসে দৈত্যটা দেখা। হয়নি কখনও জলখাবার নামে কোন ষোড়শীর সাথে এঁটো প্রেম, ভালবাসা। নিরাশার নিরেট পাথরসময় এক ফোঁটাও জল সঞ্চয় করিনি বিষণœ এ চাতক ঠোঁটে। অথচ সূচী ভালবাসার ক্ষেত্রে মেনে নিয়েছে পারিবারিক কার্ফ্যু জারী। কী জানি হয়তো ভাঙচুর হয়ে গেছে ওর  মনে; বুঝেছে ভালবাসার বদগুণ (সত্যি বদ নাকী!)। আমাদের ভালবাসার কিছুই চরিতার্থ হচ্ছে না তাই ওকে নিয়ে আর ভাববো না, এই ধরণের একটা গোয়ার্তমি নিয়েই দিন গড়াতে থাকে। কিন্তু ওকে দেখলেই সব অভিযোগ, সব কষ্ট কেমন ওলট-পালট হয়ে যায়। না ডেকে পারি না কিছুতেই। বিজ্ঞাপনি ঢঙে ও আসে আমার দিকে; আমি শেষ সিঁড়িতে পা রেখে যতটুকুন পারি হাত বাড়িয়ে ওর  হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসি। মাঝখানে টেবিল রেখে দু’জন দু’পাশে বসে পড়ি; পায়ে পায়ে ঠোকা-ঠুকি হয়ে একখণ্ড ভালবাসা অদলবদল হয়ে যায়। আমাকে নিয়ে আর কতদিন এমনি করে ভালবাসার পুতুল পুতুল খেলবে। সুচিকে উদাসীনতা পেয়ে বসে। কী জানি আমাদের কথাই ভাবছে, নাকি নতুন কোন ভাবনায় প্রবেশ? ওর মুদে আসা চোখের কার্নিশ বেয়ে মুক্তোর মত বিন্দু বিন্দু জল গড়াতে দেখে, আমি ভড়কে যাই। ঐ অশ্রু আমার বুকে-পিঠে চাবুক হয়ে নেমে আসে সহসা। জল মুছ্বার ছলে আমার মুখ ঘঁষে নিলাম ওর তুলতুলে মুখে। সুচি ঘুম কাতুরে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো- ‘পাগল’। আমি বললাম- ‘পাগল বলো আর যাই বলো, পাগলামীতে বাঁধ সেধ না।’ ওর তুলো নরম বুকে হাত দিয়ে বলেছিলাম- ‘বেশী পাগল হলে এই পাগলাগারদে রেখে দিও চিরকাল।’ এমন পরিবেশে সুচিই পারে এমন বিবেকহীন বিদায় নিতে। 

‘তোমার অনেক কাজ আছে; আজ আসি।’ শব্দটার সমস্ত দেহ জুড়ে অপমান। আমাকে দূরে রাখার বিদ্যেটা বেশ রপ্ত করেছে ইদানিং। রহস্যময় পর্দাটা সরে যাওয়ার আগের মুহূর্তে এই নির্মম বিদায়। চলে যাবার সময় আমি প্রতিশ্রুতি চাইলাম- ‘বল আবার কবে আসবে?’ আমাকে শান্ত করবার জন্যই যেন বলল- ‘কাল’। আহ! সত্য কী বিচ্ছিরি! তারও চেয়ে বিচ্ছিরি সুচি’র এই ‘কাল আসব’ কথাটার ভঙ্গিমা। জীবনের সত্য বড় ঘন ঘন বদলায়। সেদিন ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় সুচি বললো- ‘ঠিক আছে তবে কপালে’। কিছুতেই ঠোঁটে চুমু দিতে দেবে না। আমার কী হলো, আমি ওকে ছেড়ে দিলাম, পরে কী এক অদৃশ্য কারণে যেন চিড়ে ভিজলো। সুচি আগ্রহভরে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে একটা সংক্ষিপ্ত চুমু এঁকে দিল। নির্ভেজাল কিছু পাওয়া এই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। সুচি’র হয় না সময় আমাকে বুঝবার, আর বুঝে শুনেই ভালবাসবার। কী যেন ছাই, মানুষগুলো কী ছাই পাশ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে সব সময়! ভালবাসা কি লুকোছাপা ব্যাপার? এতেও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ। আমার জন্য নাকি জেনে গ্যাছে সবে। পাড়ায় একটা সন্দেহের আবহাওয়া এখন। এখন ওর কাছে চোরের মত সবাইকে পুলিশ বলে মনে হয়। এই যে কাল আসবে বলে গেল, আমি জানি সুচি আর এক মাসেও আমার সাথে দেখা করতে পারবে না সমাজের শ্যেন দৃষ্টির কারণে। পারিবারিক ১৪৪ ধারা মেনে নিয়েছে নিঃসংকোচে, নির্দ্বিধায়। আমার অজান্তেই কখোন দূরে সরে গেছে। মনে মনে পিছু হটছে। আমরা কিছুতেই একান্তের হতে পারছি না। নিশ্চয় ওর চেষ্টাগুলো এত পলকা, সে সামান্য ঝড়েও সহ্য করার মতো নয় অবস্থা।

সুচির আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা হলেই আমার দিকে একটা অপছন্দের দৃষ্টি রেখে যাবেই। তার সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বললে, যদি কেউ কিছু ভেবে বসে তাই দেখা হলে একটা ছাড়ছাড় ভাব দেখাতে হয়। তখন মনে হয় দুনিয়ার আর কিছুই নেই; কষ্টটাই শুধু আছে। ওফ্ কি যে কষ্ট! একটা সময় পর্যন্ত সম্পর্ক ছিল ভালো; তারপর যে কোন কারণেই আমার প্রতি ওর টান শূন্যের কোঠায় এসে পড়েছে। যদি তেমন কিছু হয়ও তবে এতে তার কোনই কৃতিত্ব বা সফলতা থাকবে না; আমারই পাতা জালে সে শুধু শিকার হয়েছে মাত্র। দুঃখ আমার এখানেই; খাঁচার পাখিকে নয়, বনের পাখিকে আপন করার মধ্যেই তো স্বার্থকতা। কিন্তু বনের পাখি অতটা বুনো হলে বিপদই বটে। 

পরের দুঃখে যারা কষ্ট পায়; তাদের দুঃখ কোনোদিন ঘোচে না; ঘুচতে পারে না; কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছে সুচি; খুবই বিবেচনার কথা; তাই ভাদ্রের নরম এঁটেল মাটি চৈত্রের রুক্ষতায় যেমন ইস্পাত-কঠিন হয়। ও তেমনই পাল্টে গেল। এখন পথেঘাটে দেখা হলে কেমন আছি-ভাল আছির সম্পর্ক শুধু, তাও কদাচিৎ। এই ভালবাসা বস্তুটা হয়তো সৃষ্টিকর্তা কিছু মানুষের পৃথিবীতে শাস্তি দেবার জন্যই মনে ঠাঁই দিয়েছেন। সেই কিছু মানুষের মাঝেই আমার জন্ম। সবুজ প্রান্ত ছুঁয়ে ধুলি উড়া মেঠোপথ, পথিক একলা আমি; চিরায়ত এ পরিবেশে ডেকে যায় বসন্তের দূত, তবুও হৃদয়ের চোর কুঠিরে ক্যানসারের ক্ষত বাড়তেই থাকে। স্বার্থের সুতোয় বাঁধা পৃথিবী, কোকিল আসে না বসন্ত ছেড়ে আর বর্ষা ফেলে সোনা ব্যাঙ! মানুষ যে কেন এত স্বার্থপর, আমার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তার কোনো সমাধানের খোঁজ পাইনি আজও। ‘গড়ান জিনিস টাকা গড়িয়ে চলে খাদে, মানুষ হয়ে জন্মে কী আর শকুন হওয়া সাজে?’ টাকাকে উপকরণ হিসেবেই মনে হয়েছে; সেই উপকরণের বিনিময়ে মানুষের জীবনধারণের সমস্যা শুধু মিটুক। উপকরণটাই আসল হয়ে উঠুক এটা আমি চাই নি। মানুষ হতে চাওয়ার এই এক যন্ত্রণা। অথচ সেই অর্থ স্রোতের অভাবে ক্রমশঃ পলি জমে যায় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের। মানুষ এখন ভুলে গ্যাছে মানুষের পেশা দিয়ে মানুষের মনুষ্যত্বের বিচার চলে না। পশুকেও হার মানাবার মতো ঘটনা এখন মনুষ্য সমাজে অহরহ। 

সুচির আধখাওয়া পানি কাছে পেলে নিজেকে ধন্য মনে হতো; তখন সুচি রাজত্বের একমাত্র রাজা আমি। আজ উপলদ্ধি করি সে ছিল নকল রাজা। যাত্রা থিয়েটারের ন্যায় জরি আর বেল বেটমের জামা পরা নকল এক রাজা। আমি নিজেকে ভেঙ্গে চুরে অভিনেতা হতে পারবো না আর কোনোদিন। কোন্ সে কালেও। তবু কোন্ বিষণœ গোধুলির অলস বিকেলে স্নেহপিয়াসী মন যখন দূর-অতীতের দিকে ফিরে চায় তখন মনে হয়- এখনও সম্পর্ক নেই, হয় নি।

কিসের এক অচ্ছেদ্য আকর্ষণে, সম্পর্ক রহিত একটা সর্ম্পক রয়েই গেছে। আমার ওপর সুচির সমস্ত অধিকার বর্তমান আছে; আমি তার সমস্ত অধিকার হারালেও। জীবনের বহু সময় তখন পিছন ফেলে এসেছি। অন্যান্য মানুষের সুখ-দুঃখের স্রোতের সাথে একরকম ভেসেই চলেছি। নিজের আশা-আকাক্সক্ষার কথা কোন প্রকার মনেই হয় নি। তার পরই এলো সুচি। অনেক দিন কিছুটা বিস্ময় কিছুটা ভাল-লাগায় ওর দিকে তাকিয়ে এসেছি। লজ্জা মেশানো একটু গর্বিত হাসি ছড়িয়ে দিয়ে একদিন বলে ছিলাম- ‘তোমাকে নিয়েই আমার ভেবে কাটে সারাবেলা’। প্রতিকূলতাকে জয় করতে ভালবাসার অসম সাহসে তখন এগিয়ে। সে দিনের অনুভূতি বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। নিদারুণ ভাললাগা মেশানো একটা ভয় আমাকে পেয়ে বসলো; অচেনা বিজাতীয় অনুভূতিতে ছেঁয়ে গেল মন। সুচি লজ্জা মেশানো স্বর্গীয় এক ভঙ্গিমায় বললো- ‘আপনার সাথে আমার…’। এও কী সম্ভব! তবু ফিরতে হয়নি আমাকে। 

এলো সুচি। আর সুচিকে ঘিরেই আমার ভালবাসা। সেই ভালবাসার গেরো খুলতে গিয়েই কলঙ্ক এলো আমার। এসেছে তা মহাসমারোহে প্রথম প্রবেশেই সে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি পুষিয়ে দিয়েছে। তারপর সূর্য আবার উঠেছে। আঁধারে একা রেখে নিয়ম করেই সূর্য আবার বিদায়ও নিয়েছে। চন্দ্র-সূর্যের পালাবদল বারবার হয়েছে। তবু সুচি’র আসবো কথাটা সত্য হয় নি। হয়তো আর কোনদিন সত্য হবেও না। সত্যের সূর্য যেখানে অস্তমিত হয় আমি এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে। জীবনের বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে ভালবাসার মাস্তুল আর অবশিষ্ট নেই এখন। মানুষ খুঁজে নিয়েছে তার স্বার্থের ঠিকানা। মানবিক গুণে হিংস্র পশুর খাঁচা খুলে দিলে কী হয়; আমারও তাই হলো। অকারণেই গা ছমছম করে। নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার হয়তো বিধাতা সবাইকেই দিয়েছেন। কিন্তু অপরের জীবন দুর্বিষহ করার অধিকার কে কাকে দিল? নীতিগত ভাবেইতো তা অনুচিত। অথচ একরাতে যখন সুচিকে পথে দেখা গেল; আমি চমকে গেলাম বেশ। আমার ভালবাসার অহংবোধ নিয়েই সেদিন জানতে চেয়েছিলাম- ‘কী ব্যাপার! এত রাতে তুমি!! তাও আবার একা! কোথায় কার কাছে গিয়েছিলে?’ সেদিন আমার ঘুম হয় নি; এমনি করেই অনেক রাত। অথচ খানিকটা অবহেলার সাথে সুচি বলেছিলো- ‘এই এমনি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।’ ‘কেন; কী হয়েছে?’ ‘না, কিছুই হয়নি।’ তবু… এই তবু’র কাঁটাটা আমার বুক থেকে হারিয়ে যায় নি। যে ত্যাগের মহিমা অনুভব করেছিলাম, তা তাহলে মিথ্যে হয়ে গেল। ভালবাসা নিলাম হয়ে যায় স্বার্থের হাট-বাজারে। আঁধারে যৌবন শাসনে রাখতে পারে না এমন অধৈর্য বন্ধুদের কেউ কেউ দৈহিক প্রশ্রয় দেয়। তখন তাদের ঘৃণা ছাড়া আর কিইবা প্রাপ্তির থাকে। সুচি আমার কাছ থেকে নির্লোভের সনদপত্র পায় নি। এমন একটা পরিবেশে মানুষের মনে তো সন্দেহের আঁচড় কাটতেই পারে। অসহায় মানুষের স্বপ্নটাই  তো আসল। যাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখি। একটা কঠিন শাসনেও গড়ে ওঠেছিল হৃদ্যতা। অথচ এ কী! ভালবাসার কোন ছাপই সুচির কাছে চিরস্থায়ী হয় নি। তাই দেখা হলে দু’জনার মাঝে ভালবাসা বিষয়ক ঝগড়া লেগেই থাকতো। গন্তব্যহীন একটা অগোছালো পায়ে তাই এগুতে থাকি। জীবনের পদ্মপাতার জল শত মিনতিতেও যেন আটকে রাখা ভার। তাই সবকিছু জেনেও বিশেষ এক আদর্শে নিবেদিত হয়ে প্রতিনিয়ত বাঁচার শক্তি খুঁজে পাই। বেঁচে থাকি… 

তবু বেঁচে থাকি

পাথুরে এ শহর

অনুর্বর পথ আর মানুষ বহুরূপী।

মন্তব্য: