MR ANAND.jpg

মুলকরাজ আনন্দ (জন্ম: ১২ ডিসেম্বর ১৯০৫, মৃত্যু ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৪): সনাতন ভারতীয় সমাজের অবহেলিত ও দরিদ্রতর শ্রেণীর জীবনসংগ্রাম সাহিত্যের উপজীব্য করে তোলা ইংরেজি লিখিয়ে ভারতীয় লেখকদের মধ্যে অগ্রগণ্য মুলকরাজ আনন্দ-এর প্রধান কীর্তি সম্ভবত, আর কে নারায়ণ ও রাজা রাও-এর সক্সেগ মিলিতভাবে ভারতীয় ইংরেজি কথাসাহিত্যকে বৈশ্বিক পরিম-লে স্থায়ী আসন দান।

অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে এক তাম্রকারের ঘরে জন্ম নেন মুলকরাজ আনন্দ। ১৯২৪ সালে লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে আরো পড়াশোনা করেন। ইউরোপে অবস্থানকালীন সময়েই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। কিছুকাল পর থেকেই উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন। Persian Painting (1930) Curries and Other Indian Dishes (1932), The Hindu View of Art (1933), The Indian Theatre (1950), Ges Seven Little-Known Birds of the Inner Eye (1978) এ সময়ের রচনা। ১৯৪৫ সালে বোম্বে (অধুনা মুম্বাই) নগরীতে ফিরে তিনি জাতীয় সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেন। 

বহুপ্রজ লেখক আনন্দ প্রথম কথাসাহিত্যিক হিসেবে পাঠকনন্দিত হন Untouchable (১৯৩৫) এবং Coolie (১৯৩৬) উপন্যাসের মাধ্যমে। দুটি উপন্যাসেই বর্ণবৈষম্যের শিকার দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের কথা উঠে এসেছে। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে The Village (1939), The Sword and the Sickle (1942),এবং The Big Heart  (১৯৪৫); পরিমার্জিত সংস্করণ, ১৯৮০)। দীর্ঘ ও কর্মময় জীবনে তিনি আরো অনেকগুলি উপন্যাস এবং ছোটগল্প সংকলন প্রকাশ করেছেন; ১৯৪৬-এ নিজের প্রতিষ্ঠিত কলাকৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক মার্গ-সহ অসংখ্য পত্রিকা ও জার্নাল সম্পাদনা করেছেন। শেষ দিকে Seven Ages of Man নামে সাত খণ্ডের এক আত্মজৈবনিক উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেন। নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে গেলেও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চারটি খণ্ড সম্পন্ন করে যেতে পেরেছেন। খণ্ড চারটি হলো : Seven Summers (1951), Morning Face (1968), Confession of a Lover (1976), এবং The Bubble (1984)| “A Pair of Mustachios” গল্পটির বাংলা অনুবাদ “গোঁফ”।

মূল : মুলকরাজ আনন্দ

অনুবাদ : মিয়া রাসিদুজ্জামান

আমার দেশের মানুষ সামাজিক শ্রেণী ও মানমর্যাদার সীমা বোঝাতে নানা রকমের গোঁফ রেখে থাকে। বাইরের লোকেরা হয়তো ঠোঁটের উপর এরকম কোন চিহ্নরেখা ফেলা বা জাগিয়ে তোলাকে বোকামি ভাবতে পারেন, কিন্তু আমরা আমাদের অদ্ভুতুড়ে পুরোনো প্রথা, গৌরব আর সংস্কার টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে তামাম দুনিয়ায় ভীষণ খ্যাতিমান, তা প্রায় আমেরিকান বা চীনাদের মতোই, বা ইংরেজদের মতো। যেভাবেই দেখি না কেন, গোঁফের মতো এমন পাকাপাকি সীমানাচিহ্ন গজাতে কেউ কেউ স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন কেননা গোঁফগুলিকে উজ্জ্বল ও চকচকে রাখতে শুধু একটু তেলমালিশের দরকার।  তুলনায় ফ্রক কোট, স্ট্রাইপের ট্রাউজার আর টপ হ্যাটের সাজ অনেক ঝামেলার, কারণ এগুলি কাচাধোয়া আর ইস্তিরি করার হ্যাপা রয়েছে। তার উপর, এসবের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগাতে গিয়ে ইউরোপের মাতবরশ্রেণী ইতিমধ্যে দেউলিয়া হবার পথে। তাদের মতে পরিচ্ছদ মানুষকে স¤পূর্ণ করে আর আমরা বলি, গোঁফ মানুষকে মানুষ করে। একারণেই  নানাশ্রেণীর মানুষের তফাৎ বোঝাতে আমরা নানান ঢঙের গোঁফ রাখতে পছন্দ করি। আর এগুলি অনন্য এবং কাব্যিক প্রতীকও বটে। যেমন দেখা যায় জাঁকালো রাজরাজড়া, নবাব আর ইংরেজ সেনাধ্যক্ষদের যারা রাজা-সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের জন্য খ্যাত মহান পর¤পরার প্রতীক ভয়জাগানিয়া ও উন্নতশির সুবিখ্যাত সিঙ্গি গোঁফ। তারপরে রয়েছে অসাধারণ সুক্ষ্মখ-িতাগ্র বাঘা গোঁফ । সামন্তপ্রভুদের অদম্য অপরিবর্তনীয় মানসিকতার উত্তরাধিকার যারা বয়ে চলেছে, অতীত গৌরবের সামান্য স্মারক, আপন মহত্বের গর্ব, সম্রাটের দেয়া তকমা, দু-চারটা সোনার টুকরো, যৎসামান্য উপহারসামগ্রী আর অল্পস্বল্প ভূ-স¤পত্তি ছাড়া যাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তাদের পরিধেয় হলো এই বাঘা গোঁফ। পরের ধাপে আছে ছাগুলে গোঁফ- একটা অনিশ্চিত ব্র্যান্ড- নব্যধনী নতুন বেনেবুর্জোয়া আর দোকানদারগোষ্ঠী, যারা আসলে কোন পর¤পরার সঙ্গে কোনগতিকে যুক্ত নয়, তাদের জন্য। একটা উদাস সরু সংক্ষিপ্ত রেখার মত একচিলতে গোঁফ এমনভাবে রাখা হয় যেন প্রয়োজন বা পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী এর আগা উঠানো বা নামানো যায়।  যেমন কুলির সামনে হম্বিতম্বি করার জন্য কিংবার ঋদ্ধিমান মক্কেলের সামনে বিনয়ে গলে পড়তে। আরো আছে নিম্নমধ্যবিত্ত, করণিক ও পেশাজীবীদের পরিধেয় আধখানা চার্লি চ্যাপলিন গোঁফ। বাবুরা কখনও নিশ্চিত ছিলেন না সাহেবরা তাদের গোঁফ রাখা আদৌ পছন্দ করেন কি না তাই পুরোদস্তুর গোঁফ আর সাহেব ব্যারিস্টারের পুরো চাঁছা কার্জন-কাট এ দুয়ের মাঝামাঝি ব্যবস্থা হিসেবে এই গোঁফের প্রচলন। এর পরে আছে কুলিকামিনের ভেড়ো গোঁফ আর চাষাদের ইঁদুরে গোঁফ । 

বস্তুত, নানাশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী গোঁফধারীদের জন্য উপযুক্ত অসংখ্য ধরণের গোঁফ দেখা যায়। ধরণগুলিকে এমনভাবে অনুসরণ করা হয় যে মনে হয় মহামান্য রাজামশাই বা মহামান্যা রানিমায়ের সাথে বিশেষ আলোচনাসাপেক্ষে ভারত সরকার এগুলিকে পেটেন্ট করে দিয়েছেন। এক শ্রেণীর পক্ষে লুকিয়ে অপর শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট গোঁফ রাখা নিষিদ্ধ আর আমার দেশে খুনের হার বেড়ে যাওয়া নিয়ে কিছু জ্ঞানবানের অভিমত এমন যে, এটা গোঁফের সুবিধা ও অধিকার বজায় রাখার স্বার্থে প্রত্যেক শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে বেড়ে চলা উগ্রতাকে নির্দেশ করে। অবশ্য বিশেষজ্ঞের এই মতামত অনেকখানিই বায়বীয় আর খুনের সব ঘটনাকেই এই কারণের আওতায় ফেলা সম্ভব না, তবু গোঁফের প্রতি মানুষজনের এহেন পক্ষপাত আমাদের ভূভাগে মেলা ঝামেলা তৈরী করছে ।

যেমন সেদিনই আমার নিজের গ্রামে একপ্রস্থ গোঁফ নিয়ে অশান্তি হয়েছে। ঘটনাটা ঘটেছিল এমন যে, সম্প্রতি গমের বাজারদর পড়ে যাওয়ার সুযোগে দুর্দশাগ্রস্ত চাষীদের কাছ থেকে মাঠের সব ফসল কম দামে কিনে তার দানা বেশী দামে বিক্রি করে ভালোরকম মুনাফার মালিক বনে যাওয়া আমাদের গ্রামের মুদি ও মহাজন শেঠ রামানন্দের মাথায় ঢুকল, সে তার ছাগুলে গোঁফের দু-প্রান্ত বাঘা গোঁফের মতো চাড়া দিয়ে উপরমুখো করে রাখবে।

এতে কেউই তেমন কিছু মনে করেনি, কেননা গ্রামের তাবৎ ইঁদুরে গোঁফধারী চাষাগুলো হয় ধার-কর্জ বা বন্ধকী গয়না কিংবা জমির কিস্তিবাবদ এই বেনের কাছে বাঁধা। তাছাড়া মুদি যথেষ্ট সতর্কভাবে তার গোঁফে চাড়া দেয় যাতে একে ঠিক ঠিক বাঘা গোঁফের মতো না দেখিয়ে কাছাকাছি রকমের দেখায় ।

কিন্তু আমাদের গ্রামের কাছাকাছি মোগল শৈলীর পুরোনো জরাজীর্ণ এক বাড়িতে থাকেন খান আযম খান নামের এক মুসলমান, যিনি দাবি করেন তিনি প্রাচীন আফগান বংশের উত্তরপুরুষ আর সেই বংশের প্রধানগণ একসময় মোগল দরবারের পারিষদ ও মন্ত্রক ছিলেন । মধ্যবয়সী খান আযম খান লম্বা, সুপুরুষ এবং অভিজাত ব্যক্তিত্ব ও ব্যাঘ্রগুম্ফধারী আর যদিও তার জমাজমির লেশমাত্রও আর অবশিষ্ট নেই, তবুও তিনি একটি সোনার কাজ করা ওয়েস্টকোটের ধূসর অবশেষ দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে রাখেন । 

কেউ কেউ, বিশেষ করে আমাদের গাঁয়ের জোতদার আর মহাজন রটিয়ে বেড়ায় যে, খান আযম খান একজন প্রতারক আর নিজের আভিজাত্য নিয়ে তার সব কথাবার্তা বদমাশ লোকের গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছু না। মন্দিরের পুরুতঠাকুরের মতো অন্য যারা আছে তাদের সিদ্ধান্ত হলো, তার পূর্বপুরুষ মোগল দরবারে নিশ্চয়ই যুক্ত ছিল তবে ঝাড়–দাররূপে। সে যা হোক, আসলে নিজেরা শূন্য থেকে উঠে আসার ফলে এই জোতদার, মহাজন আর ঠাকুরমশাই অন্য কারো বংশগৌরবে ঈর্ষা বোধ করে। খান সাহেবের আশেপাশে চারদিকে যে নিশ্চিত অবশেষগুলি রয়েছে, তা থেকে আপনিই বোঝা যায় একসময় তার আর তার পূর্বপুরুষদের কী প্রতিপত্তি ছিল।

খান আযম খানকে একদিন বিবির সোনার নথ পণে বাঁধা দিতে মহাজনের দোকানে যেতে হয়েছিল আর সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন রামানন্দের ওষ্ঠের উপরিভাগের চুলের গোছা উপরদিকে ঠেলে উঠেছে যাতে বেনের ছাগুলে গোঁফকে তার নিজের বাঘা গোঁফের মতই লাগছে। 

“তাহলে কবে থেকে ডালখেকো দোকানদারেরা বড় মানুষ হয়ে উঠলো ?” বিবির নথ বেনেকে দেখানোর আগেই তিনি তেরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন । 

রামানন্দ ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললো, “জানিনা আপনি কী বলতে চাইছেন, খান সাহেব।”

“তুমি ঠিকই জানো, গাধার বাচ্চা,” খান বললেন, “দেখ তুমি কেমন ভাবে তোমার গোঁফের আগা উপর দিকে তুলে দিয়েছ। একে প্রায় আমার বাঘা গোঁফের মতো দেখাচ্ছে। তোমার মতো ছাগলের জন্য যেরকম মানানসই সেভাবে গোঁফের আগা নামিয়ে রাখো। আজকাল বেনেদের কী ভাব হয়েছে !”

“আহা খান সাহেব চটছেন কেন?” মহাজন বললো। নম্রতা না থাকলে যার কানাকড়ির দামও হয় না সেই মহাজনের কাছে ব্যবসার মূলমন্ত্র ছিলো, খদ্দের যা বলে তা-ই ঠিক।

এদিকে খান আযম খান অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, “আমি বলছি, তোমার যদি প্রাণের মায়া থাকে তো গোঁফের আগা নামাও।”

“এইটুকু মাত্র সমস্যা ? তবে এই নিন” বলে রামানন্দ তার তেলচটচটে হাতের চিরুণি চালিয়ে গোঁফের একপ্রান্তকে মরা মাছির মতো শুইয়ে দিলো। “এবার সোনাগুলো দেখান তো। এগুলোর জন্য কত দাম চান ?”

এখন যেহেতু খান আযম খানের পৌরুষ শান্ত হয়েছে, বণিকের নিশ্চিত হাতের মুঠোয় তিনি একতাল নরম মোমের মতো। তার নিজের অভাব, তার পরিবারের খাদ্যের অভাব ছিল প্রচ-, তাই বেনে তার বিবির নথের জন্য যে দাম হাঁকলো, তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিলেন। কিন্তু কারবার সেরে ফেরার সময় তিনি খেয়াল করলেন, বেনে হাত লাগানোর পর যদিও তার গোঁফের একমাথা নত হয়েছে, আরেক মাথা তবু উপরমুখো হয়ে আছে।

“শুয়োর, আমার সাথে আজব চালাকি শুরু করেছ,” খান সাহেব বললেন।

“আপনার গয়নার জন্য এই এলাকার মহাজনদের মধ্যে সবচে ভালো দাম দিয়েছি,” বেনে সাফাই গাইলো, “বিশেষ করে তামাম দুনিয়ার সরকারেরা যখন স্বর্ণমান ত্যাগ করার হুমকি দিচ্ছে।”

“গয়নার কথা হচ্ছে না,” খান বললেন, “কিন্তু তোমার গোঁফের একমাথা এখনও আমার বাঘা গোঁফের মতো তোলা যদিও তুমি আরেক মাথা তোমার উপযুক্ত ছাগুলে গোঁফের মতো নামিয়ে নিয়েছ। অন্য মাথাও নামাও যাতে তোমার গোঁফ আমারটাকে নকল না করে।”

“শুনুন খান,” বেনে বললো, “আপনার সাথে কারবার করছি বলেই আপনার প্রতি নম্রতা দেখিয়েছি। আমার কাছে একটুকরো গয়না বন্ধক রাখছেন বলে আপনার সামনে সামান্য শুঁয়োপোকা হয়ে যাবো- এমন আশা আপনি করতে পারেন না। আরো দামি অলঙ্কার বাঁধা দিতে চাইলে হয়তো আপনার প্রতি আরেকটু অনুগত হবার কথা ভাবতাম । কোনভাবেই আমার এই সামান্য দুধচাটা গোঁফের রেখা আপনার জবরদস্ত বাঘা গোঁফের মতো দেখতে নয়।”

“গোঁফের ও-মাথাও নামাও,” হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন খান আযম খান, কারণ যতবার তিনি বেনের গোঁফের দিকে তাকাচ্ছিলেন, ততবার এটাকে তার নিজের গোঁফের অনুকরণের চেষ্টা বলে মনে হচ্ছিল ।

মহাজন নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে হাত নেড়ে বললো, “এখন একটু বুঝদার হন, খান সাহেব।”

খান বললেন, “বলছি গোঁফের আগা নামাও নয়তো ঘাড় মুচড়ে দেবো।”

“ঠিক আছে, পরেরবার যখন আমার সাথে কারবার করতে আসবেন তখন আমি গোঁফ নামাবো,” মহাজনের চতুর জবাব ।

দোকানের উল্টোপাশে গাছের ছায়ায় বসে থাকা গ্রামের জোতদার চৌধুরি ছোট্টু রাম বলে উঠলো, “হক কথা।”

“ঠিক! ঠিক!” কয়েকজন চাষা ভেড়ার মত ম্যা ম্যা করে সুর তুললো ।

কোনরকমে নিজের খুনে মনোবাঞ্ছা চাপা দিয়ে খান আযম খান সেখান থেকে চলে গেলেন। কিন্তু শান্ত  হলো না তার গর্ব, যে গর্ব ছিল তার চৌদ্দপুরুষের যারা নিজেদের উচ্চস্থানের চিহ্ন হিসেবে রাখতেন বাঘা গোঁফ। সম্মানের এই চিহ্ন এক বেনে নকল করছে- এ তার কাছে অসহ্য। তিনি বাড়ি গেলেন এবং ফিরে এলেন একছড়া কণ্ঠহার নিয়ে যা সাতপুরুষ ধরে তাদের পরিবারের স¤পত্তি। ওটা বেনের সামনে রেখে তিনি বললেন, “এখন তাহলে তোমার গোঁফের আরেক মাথা নামাও ।”

“অতি অবশ্য, খান,” বেনে বললো, “এখন দেখি হারটার ব্যাপারে কী করা যায়। আপনি এর জন্য কত চান?”

উত্তরে খান বললেন, “যেহেতু তুমি তোমার গোঁফের আগা নামাচ্ছ, তাই যে কোন দামই চলবে।”

“এখন খান সাহেব, আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করব।” কেনাবেচা সারার পর একথা বলে মহাজন উদযাপনের ভঙ্গিতে তার গোঁফের উত্থিত প্রান্ত আঁচড়ে নিচের দিকে নামালো।

আযম খান সন্তুষ্টচিত্তে ফিরে যাবার সময় যেভাবেই হোক তাঁর নজরে পড়ে গেল মুদির গোঁফের অপর প্রান্ত উপরের দিকে ঠেলে উঠে সন্দেহজনকভাবে তাঁর নিজের সমুন্নত ব্যাঘ্রগুম্ফসদৃশ দৃশ্যমান। তিনি পাই করে ঘুরে চেঁচিয়ে উঠলেন:

“আমি তোমায় মেরেই ফেলব যদি ওই গোঁফ তুমি ডালখেকো মুদির যোগ্য অবস্থানে নামিয়ে না আনো !”

“আহ খান, এখন একটু বোঝার চেষ্টা করেন। এটা তো শুধু আপনার বাঘা গোঁফের ছায়ামাত্র আর আপনার ঐ সাহসী ও চমৎকার অঙ্গশোভার কাছে এ কিছুই না।” তেলসিঞ্চিত কন্ঠে মহাজন বললো।

“কোনমতেই আমার শ্রেণীর মর্যাদাকে অসম্মান করতে তোমায় দেবো না,” চেঁচিয়ে উঠলেন খান, “গোঁফের ও-মাথা নামাও !”

“আপনার সব গয়নাগাটি আমার কাছে বাঁধা দিলেও আমি তা করতাম না।” মহাজনের জবাব।

“তোমার গোঁফের মাথা ঐরকম ঊর্ধ্বমুখী দেখার চেয়ে বরং আমার অবশিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি, আমার হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়-জামা, এমনকি আমার বাড়ি পর্যন্ত খোয়াতেও আমি রাজি।” তড়বড় করে বললেন আযম খান।

“আচ্ছা, যদি আপনার সয়-স¤পত্তির প্রতি দরদ এতই কম, তবে এগুলো আমার কাছে বিক্রি করে দিন আর তারপরই আমি আমার গোঁফের মাথা নিচের দিকে নামাবো,” মহাজন বললো, “একেবারে শুইয়ে দেবো। এতে চলবে ?”

অদূরে বৃক্ষতলে উপবেশন করে ভাতঘুমের আয়োজনে রত জোতদার বলে উঠল, “হক কথা !”

“কিন্তু আমি কিভাবে বুঝবো যে তুমি তোমার কথা রাখবে ?” আযম খান বললেন, “তোমরা পিচ্ছিল ডালখেকোরা কখনও কথা রাখো না।”

মহাজন জবাবে বললো, “এখানে, এখুনি একটা দলিল তৈরি করে তাতে ঐ গাছতলায় বসা পঞ্চায়েতের সই নিয়ে নেবো। এর চেয়ে বেশী আর কী আপনি চান?”

জোতদার যোগ করলো,“এখন আর কোনও ফাঁক রইলো না। যদি এর পরও মুদি বরাবর তার গোঁফ ছাগুলে ঢঙে না রাখে তাহলে আমি আর বাকি চার মুরুব্বি আপনার পক্ষে সাক্ষী হিসেবে কোর্টে যাবো।”

“কথা না রাখলে আমি তাকে ধর্মচ্যূত করবো,” চেঁচামেচি শুনে অকূস্থলে আসা পুরুতমশাই যোগ করলেন।

“আচ্ছা,” মেনে নিলেন আযম খান।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি গ্রামের পাঁচ মুরুব্বির উপস্থিতিতে গাছতলায় বসে হুক্কা পানরত দলিল লেখককে দিয়ে তার সকল সহায়-স¤পত্তি হস্তান্তরের দলিল তৈরি করালেন ও তাতে মোহর মারলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে মহাজন তার গোঁফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অগ্রভাগগুলোকে নামিয়ে নিজ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী  ছাগুলে ঢঙে সেঁটে রাখলো।

মাত্রই যখন খান আযম খান ফিরে যাবার জন্য ঘুরেছেন, তখন কাছাকাছি বসে থাকা চাষাদের দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করলো,“আমার বাপ সুলতান ছিল।”  

আর তারা আমোদিত হলো যখন দেখলো ফিরে যেতে যেতে খান নিজের প্রাচীন ও মহান বংশের শৌর্যমণ্ডিত প্রতীকের উন্নতশির বজায় রাখতে তার গোঁফে বিশেষ কায়দায় চাঁড়া দিলেন। যদিও, তিনি ইতোমধ্যে মিসকিনে পরিণত হয়েছেন।

মন্তব্য: