চাকরিটা রাতের

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

জওনিতা মালা। জন্ম ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯০। জন্ম মাটি উইগান্ডা, আফ্রিকার পূর্ব সীমা প্রায়। বেড়ে ওঠা রাজধানী কাম্পালাতেই। পেশায় ব্যাংকার। আদতে বইয়ের পোকা। লেখেন মূলত ছোটোগল্প। বংশ কিংবা ভাষাসূত্রে আফ্রিকান-ফ্রেঞ্চ হলেও তার রচনার ভাষা ইংরেজি। উইগান্ডার তরুণ লেখকদের অন্যতম জরনিতা মাত্র তেইশ বছর বয়সে ধরা দেন একজন সফল গল্পকার হিসেবে। রচনার প্রেক্ষাপট মূলত সমাজবাস্তবতা।

মূল: জওনিতা মালা

বাংলাকরণ: আমিনা শেলী

জীবন আমাকে বেছে নিয়েছে। আমি এ জীবন বেছে নেইনি, কথাটি বুঝতে হবে। আমার জীবিকাকে যদি চাকরি বলা যায় তাহলে বলব আমার শৈশব আমাকে এ চাকরির জন্য কোনো না কোনো ভাবে গড়ে তুলেছে। আমার মা একই পেশাতে ছিলেন। তার আগে তার মা। আমিও বৃত্ত ভেঙে বেরুতে পারিনি। 

আজকের সন্ধ্যাটি অনেক শীতল। ঠান্ডা লাগছে। সাতটা বাজে। আজ বৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। বৃষ্টি মানে ব্যবসার বারোটা। শূন্য। ঝড়-বৃষ্টিতে রাস্তার আশেপাশে মানুষজন পাওয়া মুশকিল। আজকের আকাশ ঘন নীল। মেঘে ঢাকা নয়। আকাশভরা না হলেও এই শহুরে রাতে কিছু তারা চোখে পড়ছে। আমি তাই নিশ্চিত আজ বৃষ্টি হবে না। ছোটোকালে শুনেছি- যে আকাশের তারা চোখে দেখা যায়, সে আকাশ সহনশীল হয়। যেন তা-ই হয়!

সাদা জামা পরেছি। এ জামাতে আমার কোমরের বাঁকটা স্পষ্ট বোঝা যায়। অন্যান্য মেয়েদের ভিড়ে সাদারঙ আলাদা হয়ে ফোটে। আর গায়ের রঙ যদি আমার মতো কালো হয় তাহলে তো আর কথা নেই। সেই হিসেবে সাদা একটি চমৎকার রঙ। তার ওপর মেকআপও করেছি। আমাকে শুদ্ধ মেকআপ আমার মা শিখিয়েছেন। খয়েরি-লাল ঠোঁট (কড়া লাল ফর্সাদের জন্যে)। একটু আইশ্যাডো। এই। হালকার মধ্যে বেশ। পায়ে ছয় ইঞ্চি উঁচু পেনসিল। সৌন্দর্যের জন্যে নয় ঠিক, দৃষ্ট হওয়ার জন্যে; আমি মাত্র পাঁচ ফুট এক। আমার মতো খাটো মেয়েরা এখানে আছে তবে সংখ্যায় কম। মজার ঘটনা হলো, আমি নিচে কিছু পরিনি। এতদিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল শিখে গেছি। সেটা হলো, লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে ছোট্ট একটি ক্ষণিকের প্রদর্শনী ক্রেতা পাওয়ার জন্যে খুবই উপকারী।

ইউসুফ লালা রোডের গোলচত্তরের একটু আগেই বার্টন স্ট্রিট। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে। আমার আগে অনেক মেয়েরাই এখানে পৌঁছে গেছে। বার্টন স্ট্রিটে কোনো পথবাতি নেই। এটি আমার কাছে ইতিবাচক মনে হয় কারণ এ পথ দিয়ে কোনো আলোর প্রবেশ মানেই সম্ভাব্য ক্রেতা।

এই সড়কের দুপাশে এক সময় ঘর-বাড়ি ছিল। মানুষের আবাস। সে ঘরগুলোকে অফিসে পরিণত করা হয়েছে। বিশাল বিশাল উঁচু উঁচু গেইট আর বড়ো বড়ো সাইনবোর্ড দিয়ে দরজাগুলো সাজানো। সন্ধ্যার পর এখানে কোনো সাড়াশব্দ নেই।

আলো! আমি দ্রুত ফুটপাথের কিনারে এগুই। ড্রাইভারকে ছোট্ট প্রদর্শনীসূচক ইঙ্গিত। শরীরটা একটু বাঁকা করে মুখটাও দেখালাম। মুখে মুচকি হাসি। আমার হাসিতেই বোঝা যায় যে এ কাজে আমার অভিজ্ঞতা আছে। করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। হাসতে হলে মনে আনন্দ থাকার প্রয়োজন বোধ করি না আর। কারো অফারের হালকা ইশারাতেই আমি সাজানো গোছানো একটি সুন্দর হাসি বিনিময় দিতে পারি। আর এ লাইনে এটা অবশ্যকও বটে। 

একটি সাদা টয়োটা করোনা ধীরগতিতে এসে আমার পাশে থামে। গাড়ি দেখে বুঝতে পারি মুনাফা বেশি হবে না। তারপরও ক্রেতা ফেরাতে নেই। বাছাই করতে গেলে রাত খালি যেতে পারে। শূন্য। ক্ষুধার্ত।

কালো অন্ধকার এক চেহারা গাড়ির ভেতর থেকে আমাকে দেখে। আমি শুধু লোকটার বড়ো বড়ো চোখ আর চকচকে সউজ্জ্বল দাঁত দেখতে পাই।

“ভেতরে আসো,” সে আমাকে ডাকে। কণ্ঠে অধিরতা। আমি জানি কেউ দেখার আগে তার এই জায়গা থেকে সরতে হবে। আমিও টপ করে ঢুকে পড়ি। গাড়ি চলে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। আমি শুধু আমার দাম-দর জানি।

“বেশি না কম?” চোখের ব্রু উঁচু করে জোরেসোরেই পশ্নটা করি। ব্যবসায় এটা সব সময় করে থাকি।

“বেশি। কতো?” 

কাজটা কঠিন। কষ্টের। মনে মনে একটু ভাবলাম। তারপর বললাম, “পঞ্চাশ হাজার।”

“অকে!” বলে সে গাড়িটা চালাতে থাকে। আমরা সম্ভবত নিনডা এলাকায় ঢুকছি। সেখান থেকে আমার বাসা ফিরতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমার বাসা নালিয়া-তে। কাছাকাছিই। ম্যাক্স মোটেল-এ এসে গাড়ি থামে। নিনডা-র সব ক্রেতাই এই মোটেলটা ব্যবহার করে।

আমরা গাড়ি থেকে বের হই। সে দ্রুতই মোটেলের দরজামুখো হাঁটে। অবহেলিত পোষা কুকুরের মতো আমিও হাঁটতে থাকি তার পেছনে। ওরা, মানে আমার ক্রেতারা, সব সময়ই প্রথমে এরকম আচরণ দেখায়। যেন আমার কোনো উপকার করছে। খারাপ লাগে খুব।

রুমে ঢুকতেই সে আর সময় নষ্ট করে না। গায়ের কাপড় খুলে ফেলে মোটা বিছানায় গোছানো বাদামি চাদরের উপর নিজের নগ্ন শরীরটা আয়েশ করে রাখে। এই মোটেলের সবকিছুই কেমন যেন ধূসর। যাচ্ছেতাই বাদামি পর্দা, চাদরের সঙ্গে ম্যাচ করা। অফহোয়াইট দেয়াল। সাদামাটা আসবাবপত্র। এক নজরে মনে হয় যেন কোনো প্রাইমারি স্কুল থেকে এ সব জিনিস কেউ ছিনিয়ে এনেছে।

ম্যাক্স মোটেলের সবই একঘেয়ে। তবে মানুষজনের মধ্যে নতুনত্ব আছে। আমার ক্রেতাগণের কথা বলছি। এরা প্রত্যহই ব্যতিক্রম। কেউ এক্কেবারে নিম্ন আয়ের, যেমন একজন টমটমচালক দিনের পুরো কামাই নিয়ে ছুটে আসে নিজের জন্য কিছুক্ষণের আনন্দ কিনে নিতে আবার কেউ কেউ শহরের নামিদামি ধনাঢ্য কাতারের। পয়সাওয়ালারা তাদের চলনবলনে সতর্কতা দেখায়; চুপে আসে চুপে যায় যেন কেউ চিনতে না পারে। 

যাক! কাজে ধ্যান দেই। বিছানায় পড়া লোকটাকে দেখছি। শরীরটা সুন্দর। পুষ্ট বাহু। আমার অন্যান্য ক্রেতাদের চাইতে অনেক ভালো। সেও আমাকে দেখছে। কীসের যেন অপেক্ষায় আছি। এই অংশটাও আমার খুব ঘেন্না লাগে। শুরুটা। 

আমি জামা খুলতে লাগি। আর ভাবি, সে বেশিক্ষণের টাকা দিচ্ছে কিন্তু আমি তাকে বেশি দেবো না, কমই দেবো। কেন জানি আজ ভাল্লাগছে না। ভাবছি এ-কে এমন করে মজিয়ে দেবো যে সে কম-বেশির তফাৎ ভুলে যাবে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা সে মুহূর্তে পৌঁছাই। এ সময়টা আমার ওতোটা খারাপ লাগে না; আমি তাদের আনন্দ দেই। সবগুলোকেই। 

বিছানা কাঁপছে। ঝাঁকুনির শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুপাশের রুমগুলো থেকে একই শব্দ শুনতে পাচ্ছি। একই সংগীতে যেন নৃত্যমগন সকলেই। লোকটার চেহারা মোচড়ে যাচ্ছে প্রায়। আমি বুঝতে পারি সে ব্যথা পাচ্ছে। তার মানে আমার কাজটি আমি ঠিকমতোই করছি। আমি নিশ্চিত এই লোকটার এই পথে আসা আজ প্রথম; সে টাকার কথা জিজ্ঞাস করেছিল। নিয়োমিত যারা, তারা দাম-দর পুঁছে না। ওদের সব জানা থাকে।

আজকের অধ্যায় শেষ। সম্পূর্ণ দৃশ্যটা মনে মনে দেখছি আর ভাবছি এখনকার এই মুহূর্তটি আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। নিজেকেই ঘৃণ্য মনে হয়। এই মুহূর্তে আমার পুরনো সব স্মৃতি মনে পড়ে আর আমি সবকিছুর জন্য আমার মা-কে দায়ি করি। সেইসব ভিন্ন ভিন্ন ভদ্রলোকদের, মা যাদেরকে ঘরে নিয়ে আসত! মনে আছে মা প্রতি রাতেই কান্না করত, ওরা চলে যাওয়ার পর। মা-র যথেষ্ট টাকা থাকত আমাদের দুজনের ভরণপোষণের জন্য। মা হিসেবে আমার মা অনেক ভালো। এসব আগে বুঝতাম না, এখন বুঝি।

“টাকা দে!” আমি ধমকের সুরে বলি। এখন আর হাসছি না। টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে না হাসাটা কাজে লাগে।

“কিন্তু তোমার রেট অনেক বেশি।”

এখন তো বেশি লাগবেই, কাজ যে হয়ে গেছে। এখন টাকার বাড়ি মাথায় পড়বে। এ-ই স্বাভাবিক।

আমি কিছুই বলি না। এদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ হয় না আমার জানা আছে। আমি শুধু তার দিকে তাকাই। চোখ বাঁকা করে তাকাই। সে তার পকেট থেকে অগোছালোভাবে ভাঁজ করে রাখা একটি নোট বের করে করে দেয়। পঞ্চাশ হাজার শিলিঙ। পুরনো। আগের নোট। সাইজে মোটা। রঙমরা। আমি চট করে নোটটা তার হাত থেকে কেড়েই নেই। ব্রা-র ভেতরে গুঁজে রাখি। সে ফ্রেশ হওয়ার জন্যে ম্যাক্সের ছোট্ট বাথরুমে ঢুকে।

আজ আসলেই তার প্রথম!

আমি মোটেও সময় ব্যয় করি না। তড়িৎ তার প্যান্টের সব পকেট চেক করি। কিছুই নেই! শার্ট চেক করি। ওয়ালেট। কয়েকটি দশ হাজার শিলিঙয়ের নোট, এলোমেলো। নোটগুলো নিয়ে আমি দ্রুত পালাই।

এই মোটেলটা, সুবিধাজনকভাবে হোক আর অসুবিধাজনকভাবে হোক, মেইন রোড থেকে বেশ দূরে। অর্থাৎ আমাকে বাসায় ফেরার জন্যে টমটম ডাকতে হবে। বেশ! ডাকলাম।

আমি ঘরে। পথেই পা থেকে কোমর পর্যন্ত টাইটস পরে নিয়েছি। মাঝেমাঝে বিস্মিত হই এই ভেবে, টাইটস আসার আগে মেয়েরা কীভাবে চলাফেরা করত? যাক! দরজা খুললে মা-কে দেখি। মায়ের মুখে হাসি। সে জানে তার জন্যে কিছু টাকা নিয়ে এসেছি। মা অনেক আগেই ভদ্রলোকদের ঘরে আনা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের বয়স পঞ্চাশ পেরুলে বডি আর পয়সা দেয় না। তো জেনেশুনে আমি এই পথে কীভাবে নামলাম? আমি নিজেই জানি না। হয়ত আমার বাবার পর আমার আরও অনেক বাবা ছিল তাই। হয়ত আমাকে দুবেলা খাওয়ানোর জন্যে মা প্রতিদিন মেকআপ করত তাই। হয়ত যে বাক্য দিয়ে আমাকে গড়ে তোলা হয়েছে তাই: “শরীরের যত্ন নিয়ো, কখন যে কাজে আসে!” হয়ত এই একটি কথাই আমাকে এ পথে নামার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছে।

মা জানে আমি একটি প্রতিষ্ঠানে রিসিপশনিস্ট-এর চাকরি করি। তাকে তো তা-ই বলি। টাকাগুলো সেখান থেকেই আনি। মা হয়ত বিশ্বাস করে। হয়ত করে না। আমি ঠিক জানি না। মা তার কোমল একটি হাত আমার দিকে বাড়ায়। টাকার জন্যে। পঞ্চাশের ঘোরেও তাকে দেখতে অনেক ভালো লাগে। তবে আগের মতো সুন্দর লাগে না। মায়ের পেশাই মায়ের সৌন্দর্য হনন করেছে। তার প্রতিটি হাসির পেছনে অনুশোচনার ছায়া। চাকরিটা রাতের ছিল বলেই হয়ত তার এই অবস্থা। আমি তাই বেশিদিন এ কাজ করব না। সত্যি! বন্ধ করে দেবো সিগ্রই। কোনো এক দিন।

পঞ্চাশ হাজারের নোটটি মা-কে দেই। সে আমাকে আদর করে আর হাসিমুখে আমার প্রশংসা করতে থাকে। আর আমি নিশ্চিত হই, চব্বিশ ঘন্টার এ সময়টাই আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। মায়ের ভালোবাসা পেতে ঘেন্না লাগে সবচাইতে বেশি।

চুপচাপ রুমে যাই। আমার রুম। আগামীকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমার ভার্সিটি পরিক্ষা আছে। সমাজবিজ্ঞান।

মন্তব্য: