মণিপুরি গল্প

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) কথাসাহিত্যের শক্তিমান লেখক স্মৃতিকুমার সিংহের জন্ম ১৯৫৯ খৃস্টাব্দের ৭ অক্টোবর আসামের কাছাড় জেলার নরসিংহপুর অঞ্চলের বেকীরপার গ্রামে। মণিপুরিদের হারানো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আবিষ্কার, টান, যন্ত্রণা, মিথ ও লোকাচর এবং অভিবাসনের কাহিনীকে সরল আখ্যানের বিষয়বস্তু করে গল্প তৈরি করেন। তীব্র বয়ানের মধ্য দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলেন গদ্যের শরীর। বিভিন্ন ছোটকাগজে নিয়মিত লিখছেন। গত্ নেই ফুল, বাপক যেবাকা কাঠগড়ায়, মন্দিলার তিরাস, গাস্ মাটির সল, না মরিল হজক বিছারেয়া তার আলোচিত গল্প। একই সাথে নিñিদ্র ডিটেইল্স্ এবং আবেদনের তীব্রতা স্মৃতিকুমারের গল্পকে অনন্য করে তোলে। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। উল্যেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ : সাড়ে তিন হাত হপন, না মরিল হজক বিছারেযা

এক পাতার মহাভারত

স্মৃতিকুমার সিংহ

মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষা থেকে অনুবাদ 

শুভাশিস সিনহা 

রবিবারের সকাল। নরেন্দ্র চোখের চশমা মুছতে মুছতে বেডরুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িংরুমে, টিভির সামনে ঠিকঠাক হয়ে বসল। 

স্ত্রী সুরবালা কিচেন থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই, শুরু হয়েছে?’

‘না।’

সুরবালা ব্রেকফাস্ট রেডি করতে হন্যে। একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘শুরু হলো?’

‘না। শুরু হলে তো ডাকবই। মিউজিক তো ওখান থেকেই শুনতে পাবে। ’

এমন সময় একটা স্কুটার তাদের বাসার গেটে এসে দাঁড়ালো। নরেন্দ্র জানালার পর্দা একটু সরিয়ে ওদিকে তাকিয়ে দেখল। 

‘এই, কোথায় তুমি, শুনছো? সুরেন্দ্ররা এসেছে।’ বলতে বলতে সে গিয়ে দরজা খুলে সুরেন্দ্র আর সুনন্দাকে অভ্যর্থনা জানাল। 

‘আজ কি তবে সূর্য পশ্চিমদিকে উঠেছিল?’

ওদিকে সুরবালা হুট করে আরও দুই কাপ পানি কেটলিতে ঢেলে দিল এবং ঝটপট একটা ওমলেটের ব্যবস্থা করল। সুরেন্দ্র বারান্দায় পা দিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘শুরু হয়ে গেছে ?’

‘না। এক্ষুণি শুরু হবে। আমরাও ঘড়ি ধরে আছি। আহ্।’

সুরেন্দ্র ড্রয়িংরুমে বসল, আর সুনন্দা সুরবালার খুঁজে কিচেনের দিকে গেল। একটু পরে তারা চা ওমলেট ইত্যাদি নিয়ে ড্রয়িংরুমে এল। 

‘আজ কি দাদা পথ ভুলে নাকি ?’ সুরবালা সুরেন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলে। 

‘নাহ্। এই আসব আসব করে আসা হয় না। নতুন বাড়ি করেছো, ভাবলাম একবার দেখাসাক্ষাৎ করে যাই। আর ‘মহাভারত’টাও এখানে এসে যাতে ধরতে পারি… আজ তো মনে হয় কৃষ্ণের জন্মের কাহিনীটা হবে। নাকি?’

‘এত শিগ্গির হবে নাকি ! মাত্র তো চার নম্বর বাচ্চাটার জন্ম হলো।’

টিভির কাছে রাখা বনসাঁই গাছটা সুনন্দার চোখে পড়ল। গাছটার কাছে গিয়ে সে সুরবালাকে জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি, এ বনসাঁই গাছটা কোত্থেকে এনেছো?’

‘ঐ যে জুরোডে একটা হর্টিকালচারের ফার্ম আছে না, ওখান থেকে।’

‘যে সুন্দর হয়েছে। জট-টট ধরে একেবারে মহাভৈরব মন্দিরের পাশের অশ্বত্থ গাছটার মতো।’ সবাই হেসে ওঠে। আকাশছোঁয়া অশ্বত্থগাছে, মানুষ তার শিকড় কেটে দিল বলে, টিভির টেবিলটা পর্যন্ত ধরতে না পেরে, আজ মানুষের হাসির পাত্র হলো। 

মহাভারত সিরিয়ালের আজকের পর্ব শুরু হলো। সবাই চুপচাপ। প্রথমে গত পর্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো আবার দেখানো হলো। গত পর্বে দৈবকীর চার নম্বর শিশুটির জন্ম হয়েছিল। শিশুটির জন্মের খবর যাতে পাহারাদাররা জানতে না পারে দৈবকী তার আকুল চেষ্টা করে। ওদিকে একজন গুপ্তচর কীভাবে যেন জেনে ফেলে খবরটা কংসের কাছে পাঠায়। আজ তার পর থেকে…

কংসের ফটকের বেড়ার একটা ছিদ্র দিয়ে সকালের আলো ঢুকে ঘরখানি আলোকিত করে তুলল। পাখপাখালির আওয়াজও শোনা যায় ঘরটি থেকে। রাত্রিজাগরণে বাসুদেব আর দৈবকী। আলো দেখে দৈবকী আরও বেশি শঙ্কিত হয়। এদিকে পিতা বাসুদেব সব ভুলে সদ্যজাত শিশুটির রাঙা চরণ দুটিতে হাত বোলাতে বোলাতে বিভোর হয়ে আছে। দৈবকী অস্থির হয়ে ওঠে। শিশুটিকে কোথায় রাখবে, কোথায় লুকিয়ে বাঁচাবে ঠাহর করতে পারে না। এক্ষূণি সিপাইরা আসবে। ওর ভাই কংস জানতে পারলে এ শিশুটিকেও…

‘কিছু একটা করি প্রাণনাথ। সকাল হয়ে এল। কোথায় লুকাব-’

বাসুদেব যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। একবার শিশুটিকে দেখে, আরেকবার দৈবকীর দিকে চেয়ে অসহ্য এক জ্বালায় শিকলে বাঁধা হাত দুটো তুলে, ঊর্ধ্বে, বেড়ার ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যের আলোকে প্রণাম করে চেয়ে থাকে। দৈববাণীমতে অষ্টম শিশুটিই তাদেরকে এবং এ জগৎকে উদ্ধার করবে। দেবতার বাণী বৃথা যাবে না। কিন্তু, মা-বাবার কাছে প্রথম অষ্টম সব সমান। 

‘হে প্রভু, এ কী কঠিন পরীক্ষায় আমাকে ফেলেছো প্রভু-’ 

বাসুদেব শূন্যপানে হাতজোড়ে প্রণাম করতে করতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা এক খ- আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। 

এমন সময়, দরজায় দাঁড়ানো এক প্রহরী উচ্চস্বরে ঘোষণা করে, ‘রাজাধিরাজ, মথুরারাজ, মহারাজ কংস আ-সি-তে-ছে-ন…’

দৈবকী তার শিশুটিকে রক্ষা করার আপ্রাণ তাগিদে কারাকক্ষের এদিক-সেদিক বৃথা ছুটোছুটি শুরু করে। শিকলের টানে তার কোমর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। নিরূপায় হয়ে মা দৈবকী মাটিতে একটু কাৎ হয়ে শিশুটিকে স্তন্যদান করে আঁচল দিয়ে তাকে নিজের বুকে চেপে ধরে অন্যদিকে মুখ করে পড়ে থাকে। 

কংস আসে। দৈবকীকে বলে, ‘কই, দৈবকী, বাচ্চাটাকে দাও।’

‘নেই। দাদা, নেই।’

‘লুকাবার চেষ্টা করো না। আমি খবর পেয়েই এসেছি।’

‘দাদার পায়ে পড়ি, নিরপরাধ শিশুটিকে… এ আমার আকুল ভিক্ষা…’

‘জীবন ভিক্ষা ?’ তার পা জড়িয়ে অনুনয়কাতর আদরের বোনের দিকে চেয়ে একটুক্ষণ থেমে থাকে কংস, পরক্ষণেই মনে মনে বলে,

‘না, হবে না। আমাকে বেঁচে থাকতে হলে দৈবকীর বাচ্চাকে মরতে হবে। নাহ্ পাপ নেই। কোনো পাপ নেই।’ ভাবল সে। দৈবকীর সব অনুরোধ অনুযোগ উপেক্ষা করে কংস বীভৎস হাসি হেসে তার কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারার জন্য প্রস্তুত।

…দেয়াল থেকে গড়িয়ে রক্তের ধারা নামছে।

এরপরেই কমার্শিয়াল ব্রেক। টিভির ভলিউম অফ। ড্রয়িংরুম এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ নীরব। দেয়ালঘড়িতে টিক টিক টিক টিক…

‘ছি, দেখতে ইচ্ছে করে না।’ সুনন্দা বলে। 

‘আসলেই, মহাভারতে কংসের মতো নির্দয় নিষ্ঠুর চরিত্র আর নেই।’ সুরবালা যোগ দেয়।

টিভিতে, দেখা যাচ্ছে গুজরাটের হাজার হাজার মেয়ের বয়ে আনা গরুর দুধ, সেটা থেকে কীভাবে আমুল চকলেট উৎপাদন করা হয় তার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে বাছুরের গল্প নেই। ড্রয়িংরুমে কাটাচামচ ও প্লেটের ধাতব মাটির বেসুরো আলাপ।

‘একেবারে সেডিসটিক কারেকটার, বুঝলে ?’ কাটাচামচ দিয়ে ওমলেটের টুকরো মুখে পুরে নরেন বলে, ‘নিজের মরণের ভয়ে নিষ্পাপ শিশুদের… এরকম চরিত্রের কল্পনা করানিই ভয়ংকর।’

‘ডিরেক্টর রক্তের ছাপ নিয়ে সিমবলিকেলি দৃশ্যটা দেখিয়ে খুব ভাল কাজ করেছে।’

‘একেবারে ব্যালান্সড শট।’

‘রাখো, ওমলেটটা কিন্তু দারুণ হয়েছে। ফার্মের ডিম মনে হয় না।’

‘হ্যাঁ। ঘরে মোরগ-মুরগী এক জোড়া পালাচ্ছি। ঘরে তো আমরা এখন মাত্র দুজনই। হয়ে যায়।’

কমার্শিয়েল ব্রেক শেষ হলো। রিমোট কন্ট্রোলের আদেশে টিভি আবার জেগে উঠল। পর্দায় ফুটে উঠল কংসের ফটক। হৃদয়চেরা কান্নায় অচৈতন্যের সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে মা দৈবকী। তার মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিলাপ করছে নিরূপায় বাসুদেব…

এমন করেই মহাভারতের আজকের পর্ব শেষ হয়ে গেল। সুরেন্দ্ররা কংসের চরিত্র নিয়ে আরও কিছুদূর আলোচনা এগিয়ে নিল।

‘আরে, উঠছো কেন, বসো না। আজ এক সাথে এক বেলা খাই না।’

নরেন্দ্র বলে।

‘আজ থাক। আরেকদিন। আজ ডাক্তারের কাছে এপয়েন্টমেন্ট নেয়া আছে। ভাল করে একবার আয়োজন করো। নতুন বাড়ি হলো। আমরা আসব।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ছুটির কোনো দিন করি, নাকি?’

‘রাখো রাখো। ডাক্তারের ওখানেও তো গিয়ে বসে থাকব। বাড়িটা একটু ভালমতো ঘুরে দেখে যাই। সামনে আমাদেরও তো লাগবে।’ বলে সুনন্দা।

‘ও, এসো এসো। ’

বেডরুম, ডাইনিং রুম, কিচেন, দেবতার ছোট্ট মন্দির সব তারা ঘুরে দ্যাখে। রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তির সামনে ঝুড়ি ভরে সকালে কুড়ানো তাজা ফুল, গলায় না-ফোটা কাঁচা কুঁড়ির মু-মালা, গালে চোখের পানির ছাট। তারা প্রণাম করল।

বাড়ির নানা পরিকল্পনার কথা বলতে বলতে তারা চারজন পেছনের শাকসবজির ক্ষেতে গেল। নরেন আর সুরবালার মুখে ও কথায় অভিজ্ঞতার দস্তাবেজ। সুরেন আর সুনন্দার চোখে স্বপ্ন। শাকসব্জির ক্ষেতের অদূরে ভিটার পেছনের দেয়াল ঘেঁষে থাকা তৃপ্তিমার্কা তেলের টিনে চাল দেয়া দ্বিচালা মুরগীর ঘর। তারের জালির ভিতরে খইয়ের মতো এক জোড়া মোরগ-মুরগী। নরেনরা শাকসবজি দেখতে দেখতে ঘরটির দিকে এগিয়ে গেল। আজ একটা নয় দুইটা নয় চার চারটা জীবন্ত মানুষ একসাথে তাদের দিকে এগিয়ে আাসছে দেখে মুরগীটা পাখা ঝাপ্টাতে ঝাপ্টাতে ছোট্ট কোঠাটির এমাথা ওমাথা উড়তে শুরু করল। ডানার পালক খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। মোরগটাকে গুতো মেরে মানুষদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করালো মুরগীটা। কী করব ভাবতে ভাবতে মুরগীটা এইমাত্র পাড়া ডিমটির চারদিকে কয়েকবার ঘুরে সেটি বুকে আগলে চুপ হয়ে বসে পড়ল। অন্যান্য দিনের মতো মোরগটা আজও তার জালিটার একটি ছিদ্র দিয়ে ঠোঁট বের করে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। তাকিয়ে রইল শ্যাওলাধরা ইটের দেয়ালের উপরে জিন্স কাপড়ের ছেঁড়া টুকরোর মতো নীল আকাশের দিকে, এখনও যদি আচমকা একটা দৈববাণী  ভেসে আসে, – এ আশা নিয়ে।

মন্তব্য: