মুহসীন মোসাদ্দেক
ম-লবাড়ির এ পুকুরের পানি বেশ টলটলে। সূর্য ঠিক মাথার ওপরে, দিনের মধ্যবেলা এখন। পুকুরের টলটলে পানিতে সূর্যটার পূর্ণ প্রতিবিম্ব পড়েছে। ছোট ছোট ঢেউয়ে প্রতিবিম্বটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। পুকুরের পানিতে সূর্যের পূর্ণ প্রতিবিম্বের কেঁপে কেঁপে ওঠার এমন খেলা দেখার আগ্রহ এ মুহূর্তে মণ্ডলপাড়ার কারো নেই। পুকুর পারের বিশাল মেহগনী গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে মান্নানকে। মণ্ডলপাড়াসহ এ গাঁয়ের ও পাড়া সে পাড়া এমনকি আশেপাশের আরো দু-চার গাঁয়ের উৎসুক জনতা এখন মান্নানকেই দেখছে। দেখার জন্য মান্নানই এখন সবচেয়ে উপভোগ্য উপকরণ।
উপর্যুপরি পেটানোর ফলে মান্নান একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর শক্তি তার নেই, বসিয়ে রেখে বাঁধা হয়েছে তাকে। মান্নানের মাথা নোয়ানো। কপালের মাঝখানটায় ফেটে গেছে। ডানপাশের চোখের কোণা দিয়ে কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে চিবুক বেয়ে মান্নানের গায়ের কাপড় রাঙিয়ে দিয়েছে। নাক, ঠোঁটও ফেটে রক্তাক্ত। কিল-ঘুষি-রড-বাটামের আঘাতে পুরো মুখই তার ক্ষত-বিক্ষত, রক্তে লাল। রক্তগুলো এখন শুকিয়ে জমাট বেঁধেছে। তাজা রক্তমাখা মুখ এক রকম বিভৎস, শুকিয়ে যাওয়া জমাট বাঁধা রক্তে সে মুখ আরেক রকম বিভৎস। এ বিভৎসতার কারণেই মান্নান হয়তো তার মাথা নুইয়ে রেখেছে!
মান্নানের দুপাশে দুই জোয়ান পুরুষ দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে কাঠের মোটাসোটা বাটাম, আরেকজনের হাতে লম্বা লোহার রড। একটু পর পরই দুজনে পালা করে মান্নানের ওপর চড়াও হচ্ছে। প্রথম প্রথম সে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠছিল, এখন কেবল একটু কঁকিয়ে উঠছে, একটু গোঙাচ্ছে- এর বেশি শক্তি তার এখন নেই।
মান্নানের সোজাসুজি হাত বিশেক দূরে মণ্ডল সাহেব আর পাঁচ গাঁয়ের পাঁচ মোড়ল চেয়ার পেতে বসে আছে। চতুর্পাশে উৎসুক জনতার ভিড়। মান্নানের থেকে অন্তত হাত দশেক তফাতে সবার অবস্থান। এক কদম এগোবে সে স্পর্ধা কারো নেই। মান্নানের ডানপাশে হাত দশেক দূরেই তার মা, বউ আর সাত বছরের ছেলে- তাদেরও স্পর্ধা নেই এক পা এগোবার। মান্নানের মা খানিক পর পরই মূর্ছা যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলেই আর্তনাদ করে উঠছে, ‘আমার পোলারে ছাইড়া দ্যাও, ওই কিছু করে নাই-’ আর্তনাদ করতে করতে আবার মূর্ছা যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরে আবার আর্তনাদ করছে, আবার মূর্ছা যাচ্ছে। মান্নানের বউ নির্বাক চেয়ে আছে স্বামীর দিকে। আর ছেলেটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে একবার বাবার দিকে, একবার দাদির দিকে, আরেকবার ম-ল-মোড়লদের দিকে তাকাচ্ছে। এখনো সে বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। বাবাকে যখন জোয়ান দুইটা মারছে তখন তার এক-আধবার মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে ওদের ঘাড়ের উপর চড়ে কান কামড়ে ধরে! কিন্তু, সে সাহস দেখানোর হিম্মত তার এখনো হয় নি!
‘মান্নান যে এই রকম কাম কইরবার পারে এইডা আমি কখনোই ভাবতে পারতাম না!’ আফসোস আর অবিশ্বাসের মিশ্রিত এক বিচিত্র ভঙ্গিতে বলে ইমতাজ মোড়ল।
‘আসলেই গো! কার মনের ভিত্রে যে কী প্যাঁচ আছে চেহারা দেইখা বুঝা মুশকিল!’ ইমতাজ মোড়লের সাথে সুর মেলায় সরফু মোড়ল।
‘তাই বইলা মান্নান! মান্নান এই কাম করবো! বিশ্বাসই যে হবার চায় না!’ মুখটা এমনভাবে বিকৃতি করে দেবু মোড়ল কথাটা বলে যেন এইমাত্র সে চিরতার মতো তিতকুটে কোনো কিছু গিলেছে!
ম-ল সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ‘বিশ্বাস হইতে না চাইলেও এইডাই সত্য।’
‘আসলেই কি মান্নান আছিল? ঠিক দেখছে?’ দেবু মোড়ল বিকৃত মুখেই সংশয় প্রকাশ করে।
জাহান মোড়ল দেবু মোড়লের সংশয়কে উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘মান্নান ছাড়া মণ্ডলপাড়ায় গভীর রাইতে বাইরে বাইর হওয়ার হিম্মত আর কার হইবো!’
‘এই মান্নানের ওপরে জান-মাল ছাইড়া দিয়া কতো রাইতই না নিশ্চিন্তে ঘুমাইছি।’ সরফু মোড়ল চোখজোড়া বড় বড় করে বলে।
‘আল্লাহ মেহেরবান! বড় কুনো ক্ষতি হওয়ার আগেই বিষয়টা ধরা পড়ছে!’ মোড়ল আক্কাস হাজি তসবি গুনতে গুনতে বলে।
মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, গভীর রাতে সে মণ্ডলবাড়ির বউয়ের ঘরে উঁকি দেয়। অভিযোগটা সয়ং মণ্ডলবাড়ির বউয়ের। মাত্র দুসপ্তা হলো ম-লের বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে। মণ্ডলের ছেলে শহরে চাকরি করে। বিয়ের একসপ্তা পরই সে শহরে চলে গেছে। নতুন বউকে এখনই শহরে পাঠাতে রাজি হয় নি মণ্ডল সাহেব। মাস খানেক পরে পাঠানো হবে। মণ্ডলবাড়ির বউয়ের অভিযোগ, স্বামী চলে যাবার পর থেকে প্রতিরাতেই মান্নান তার ঘরের জানালায় উঁকি দেয়। লজ্জায় সে এ কয়দিন কাউকে কিছু জানাতে পারে নি। আজ জানাতেই সাত সকালে নিজের ঘর থেকে পেটাতে পেটাতে তুলে আনা হয়েছে মান্নানকে।
অন্যকোনো বাড়ির বউয়ের ঘরে উঁকি দিলে যেভাবেই হোক হয়তো পার পেয়ে যেতো মান্নান। কিন্তু ম-লবাড়ির বউ বলে কথা! মণ্ডল সাহেবের দাদা এবং তার বাপ-দাদা জমিদার ছিল। আশেপাশের বিশ গ্রাম শাসন করতো। মণ্ডল বংশের নামেই গ্রামের এ পাড়ার নাম মণ্ডলপাড়া। এখন আর জমিদারির যুগ নেই, আশেপাশের বিশ গ্রামে এখন মোড়লেরও অভাব নেই। তবুও ম-লদের এখনো আলাদা ক্ষমতা আছে, দাপট আছে। আশেপাশের বিশ গ্রাম এখনো তাদের মান্য করে, তোঁয়াজ করে চলে। আর এ মণ্ডলবাড়ির বউয়ের ঘরে গভীর রাতে উঁকি দেয় মান্নান! সহজে সে তাই পার পাচ্ছে না।
মান্নানের এখন বিচার করা হবে। পাঁচ গ্রামের পাঁচ মোড়লকে নিয়ে তাই বসেছেন মণ্ডল সাহেব। উপস্থিত গ্রামবাসীর সামনেই বিচার করা হবে, শাস্তিও দেয়া হবে সবার সম্মুখে। এটাই মণ্ডলপাড়ার রেওয়াজ। মান্নানের বিচারের অবশ্য কিছু নেই। তার যে অপরাধ তাতে বিচার আর কি হবে! বিচারের জন্য সাক্ষী লাগে, প্রমাণ লাগে। মান্নানের এ অপরাধের জন্য এসব কিছু দরকার নেই। ম-লবাড়ির বউয়ের অভিযোগ বলে কথা! মান্নানের তাই এখন শাস্তি নির্ধারণ করা হবে। জনতার মতামত নিয়ে পাঁচ মোড়লের সিদ্ধান্তে নির্ধারণ করা হবে মান্নানের শাস্তি।
শাস্তির প্রক্রিয়া শুরুর আগে মান্নান সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
মণ্ডলপাড়াসহ আশেপাশের গ্রামে হঠাৎ করে চুরি বেড়ে গেলো। প্রতি রাতেই কোনো না কোনো বাড়িতে চুরি হওয়া শুরু হলো। কিন্তু চোর ধরা সম্ভব হচ্ছিল না। চুরি বেড়ে যাওয়ায় সব বাড়ির লোকজনই সতর্ক থাকতো। কিন্তু তবুও চোরের নাগাল মিলছিল না। যেন জাদুকর চোর- চুরি করে চলে যায়, ভোরের আগে কেউ টের পায় না! চোরের দশদিন গেরস্থের একদিন- এই সূত্র পর্যন্ত খাটছিল না। গ্রামের মানুষ প্রতি রাতেই আতঙ্কে থাকতো- আজ বুঝি আমার বাড়ির পালা!
মণ্ডল সাহেব ঠিক করলেন মণ্ডলপাড়ায় রাতে পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন, নাইট গার্ড রাখবেন। আর মণ্ডলপাড়ায় নাইট গার্ড প্রশ্নে দ্বিধাহীন উত্তর- মান্নান। মান্নান যেমন কর্মঠ তেমন সাহসী, সাহস তার যেমন দেহে বলও তেমন। বাঁশের একটা হালকা-পাতলা লাঠি হাতে মান্নান যদি পথ আগলে দাঁড়ায়, একসঙ্গে দশটা লোকও যদি লাগে, মান্নানকে হটায় এমন সাধ্য নেই! মান্নান সহসী-শক্তিশালী যেমন, বিনয়ী-ভদ্রও তেমন। মান্নানের বাবাও ছিল গ্রামের চৌকিদার। মারা গেছে সেই কবে! এখনো বিশ গাঁয়ের মানুষ তাকে মনে করে, বলে- ‘বড় ভালো লোক আছিল!’ বাবার যোগ্য উত্তরসূরি মান্নান। দশ গাঁয়ের মানুষ তার সম্পর্কে বলে- ‘সোনার টুকরা পোলা!’ মণ্ডল সাহেব তাই মান্নানকেই দিলেন মণ্ডলপাড়ার নৈশ নিরাপত্তার ভার। কাজও হলো ম্যাজিকের মতো! যে রাত থেকে ম-লপাড়ায় মান্নান নৈশপ্রহরী হিসেবে দাঁড়ালো সে রাত থেকে চুরি বন্ধ হয়ে গেলো! মান্নানের দায়িত্ব ছিল ম-লবাড়িকে কেন্দ্রে রেখে পুরো মণ্ডলপাড়ায়। অথচ আশেপাশের গ্রামগুলোতেও চোরেরা ঘেঁষতে সাহস পেলো না! রাতারাতি চোরের দল উধাও! আর মান্নান হয়ে গেলো মণ্ডলপাড়ার হিরো। মণ্ডল সাহেব রাস্তায় বের হলে লোকজনের কাছ থেকে যেমন সম্মান পেতো, মান্নানও সেরকম সম্মান পেতে লাগলো। এ গাঁয়ের এবং আশেপাশের গাঁয়ের বউ-ঝিয়েরা তাদের বাড়ির আঙিনায় ফলানো সবজি-ফল-ফলাদি মান্নানের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসতো। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো বাড়ি থেকে পিঠা-পুলি-পায়েসও আসতো। এমনকি হাটবারে হাটে গিয়েও তাকে বিশেষ কিছু কিনতে হতো না! আর ম-লবাড়িকে কেন্দ্রে রেখে যেহেতু মান্নান পাহারা দিতো মাস গেলে তাই ম-ল সাহেবের কাছ থেকে পেতো ভালো বেতন। পাড়ার মুরুব্বিরাও প্রায়ই হাতে দশ-বিশ টাকা গুঁজে দিতো। সব মিলিয়ে মানুষের কাছে মান্নান প্রিয় একজন, ভরসার একজনে পরিগণিত হতে লাগলো। আর কুকর্ম করার জন্য সুযোগ সন্ধানীদের কাছে ত্রাসের নাম হলো মান্নান। কুকুর যেমন বহুদূর থেকে ঘ্রাণ পায়, পায়ের শব্দ পায়, মান্নানের ক্ষেত্রেও হতো তেমন। আর তার চোখজোড়া ছিল শকুনের মতো তীক্ষ্ণ, এ চোখকে ফাঁকি দেয়া সহজ ছিল না। মান্নান পাহারায় দাঁড়ানোর পর ম-লপাড়ায় বাইরের কেউ কুমন্ত্র জপে ঢোকার সাহস পেতো না, আবার মণ্ডলপাড়ার কেউ বাইরে যেতে সাহস করতো না। মান্নানের ভরসাতেই মানুষেরা গরমে জানালা খুলে রেখে ঘুমাতে সাহস পেতো। স্বামী না থাকার পরেও হয়তো মান্নানের ভরসাতেই ঘরের জানালা খুলে ঘুমাতো মণ্ডলবাড়ির বউ। আর এ সুযোগেই নাকি সে গভীর রাতে জানালা দিয়ে মণ্ডলবাড়ির বউয়ের ঘরে উঁকি দিতো! যে মান্নানের ওপর জান-মালের ভার সঁপে দিয়ে গাঁয়ের মানুষ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতো, সে মান্নান গাঁয়ের বউ-ঝিদের ইজ্জতের দিকে নজর দেয়! বিষয়টা যখন জানাজানি হলো অনেকেই তখন বিশ্বাস করে নি। কিন্তু মণ্ডলবাড়ির বউয়ের অভিযোগ, যে বউ মাত্র দুসপ্তা হলো গাঁয়ে এসেছে, সে বউ কি আর মিথ্যে বলবে! মান্নানের সাথে তার তো আর শত্রুতা নেই! শত্রুতা বা বন্ধুতা হতে যে সময় ও সুযোগ লাগে তা তো এখনো পাওয়া হয় নি মণ্ডলবাড়ির বউয়ের! গাঁয়ের মানুষের বিশ্বাস হতে তাই খুব বেশি সময় লাগলো না। মণ্ডল সাহেবের জোয়ানরা যখন বাড়ি থেকে মান্নানকে বের করে এনে পেটাতে পেটাতে মণ্ডলবাড়ির পুকুর পারে নিয়ে আসছিল- মণ্ডল সাহেবের মাপে যে মান্নানকে সম্মান দিতো, সেই মান্নানকেই তখন ইচ্ছেমতো কিল-ঘুষি-লাথি দিতে ছাড়লো না গাঁয়ের মানুষ! গাঁয়ের ছেলে-ছোকরাগুলোও এ সুযোগ ছাড়লো না! হাতি গর্তে পড়লে পিঁপড়েও যেমন লাথি মারে আর কি!
‘বেলা যে বয়ে যাইতেছে, মান্নানের শাস্তির বিষয়ে মোড়ল সাহেবেরা কি ভাবলেন?’
মণ্ডল সাহেবের কথায় মোড়লেরা একটু নড়েচড়ে বসলো।
সরফু মোড়ল বললো, ‘ভাবলাম তো অনেক কিছু। তয় জনতা কি কয় সেইটা আগে শুনি?’
মণ্ডল সাহেব জনতার উদ্দেশে বললো, ‘কি মিয়ারা, তোমরা কও মান্নানের কি শাস্তি হওয়া উচিত?’
জনতার ভেতর থেকে অনেকের অনেক কথা শোনা গেলো। কারো কণ্ঠে শোনা গেলো, ‘মান্নানরে গ্রাম থেইকা বাইর কইরা দ্যান।’ কেউ বললো, ‘একঘরে কইরা দ্যান।’ কেউ বললো, ‘হাত-পা ভাইঙ্গা দ্যান।’ কেউ কেউ আবার এমনো বললো, ‘ন্যাংটা কইরা পাঁচ গেরাম ঘুরান।’ অন্যের বউয়ের ঘরে উঁকি দেয়ার বিষয় যেহেতু, কেউ কেউ মান্নানের বউকে নিয়ে আজেবাজে শাস্তির কথাও বললো!
সব ছাপিয়ে মোড়লদের কাছাকাছি বসে থাকা এক বুড়ি মা বললো, ‘বাপজিরা, এইডা আমগো গেরামের বউ-ঝিয়ের ইজ্জতের মামলা। এমুন শাস্তি দ্যাও য্যান সবার সেইডা মনে থাকে, আর কেউ য্যান এই রকম কাম কইরবার সাহস না পায়। সবতে য্যান ডর খায়!’ জনতা হই হই করে বুড়ি মাকে সমর্থন দিলো।
‘চোখ তুইলা ফ্যালান!’ ইমতাজ মোড়ল গম্ভীর হয়ে বললো।
প্রথমে কেউ ভালো করে শুনতে পায় নি, মণ্ডল সাহেব তাই বললো, ‘কি কইলেন?’
‘চোখ তুইলা ফ্যালান। এইডাই সবচেয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হইবো।’ বেশ জোর গলায় বললো ইমতাজ মোড়ল।
ম-ল সাহেব জনতার উদ্দেশে বললো, ‘কি মিয়ারা, তোমরা কি কও?’
‘হ, হ, চোখ তুইলা ফ্যালান, চোখ তুইলা ফ্যালান!’ সমস্বরে জনতা সমর্থন দিলো।
কোনো মোড়লও দ্বিমত করলো না। কেবল শোনা গেলো মান্নানের মায়ের আর্তনাদ।
ম-ল সাহেব ঘোষণা দিলো- বাদ আসর মান্নানের চোখ তুলে ফেলা হবে।
দুপুর হয়ে গেছে। মোড়লেরা সব চলে গেলো। একে একে লোকজনও সব চলে গেলো। শুধু মান্নানকে পাহারা দেয়ার জন্য থাকলো দুই জোয়ান। আর থাকলো মান্নানের মা-বউ-ছেলে। সবাই চলে গেলে জোয়ান দুইজন একটু তফাতে গিয়ে বসলো। এই সুযোগে মান্নানের মা মান্নানের কাছে গেলো। মান্নানকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এইডা তুই কি করলি বাপ, এইডা তুই কি করলি!’
হঠাৎ যেন শক্তি পেয়ে যায় মান্নান, আর্তনাদ করে বলে, ‘ আমি কিছু করি নাই মা, আমি কিচ্ছু করি নাই! সব মিছা কথা। আমারে বাঁচা মা, আমারে তুই বাঁচা!’
ছেলের আর্তনাদে আবার মূর্ছা গেলো মান্নানের মা। জোয়ার দুইজন এসে গালি দিতে লাগলো, তাড়িয়ে দিলো সেখান থেকে। মান্নানের বউ আর ছেলে কোনো রকমে টেনে-হেঁচড়ে মান্নানের মাকে বাড়িতে নিয়ে আসলো। আর জোয়ান দুইজন মান্নানকে পিটিয়ে হঠাৎ জ্বলে ওঠা তেজ দমিয়ে দিলো।
দুপুরে মান্নানকে কিছু খেতে দেয়া হলো না, এক ফোঁটা পানিও না!
আসরের একটু আগে থেকে আবার জনতার ভিড় জমতে থাকলো। মোড়লেরা এলো আসরের পর। সব আয়োজন শেষ করতে একটু সময় লাগলো। মাগরিবের ঠিক আগে আগে, পৃথিবীর এ ভাগে যখন আঁধার নামার প্রস্তুতি চলছিল, মান্নানের পুরো পৃথিবী তখন চিরজীবনের জন্য আঁধার হয়ে গেলো।
মান্নানের চোখ তুলে নাইলনের দড়িতে বেঁধে মেহগনী গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হলো, মানুষজন যাতে চোখ দুটো দেখে শিক্ষা পায়, গাঁয়ের বউ-ঝিদের দিকে কুদৃষ্টি দিতে ডরায়!
চোখ তুলে ফেলার সময় সেখানে মান্নানের মা-বউ-ছেলে কেউ উপস্থিত ছিল না। মা একেবারে নেতিয়ে পড়ে বিছানাগত। বউ বারান্দায় বসে নির্বাক চেয়ে রইলো উঠোনের দিকে। আর ছেলেটা ছুটে বেড়ালো এ পাড়া ও পাড়ায়, সে কি করবে কিছুতেই তা যেন স্থির করতে পারলো না!
পরিশিষ্ট
রাত এখন গভীর। মণ্ডলপাড়ায় আজ কোনো প্রহরী নেই। গাঁয়ের কুকুরগুলোও টহল দিচ্ছে না। কোনো এক অভিমানে তারা নিরুদ্দেশ। সুনসান নীরব চারদিক, কিসের যেন হাহাকার ভাসছে বাতাসে। অন্যদিনের চেয়ে মণ্ডলপাড়া যেন আজ একটু বেশিই অন্ধকার। এমন সময় মণ্ডলবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ঘোমটা দেয়া কমবয়সি এক মহিলা। মহিলাটি এদিক-ওদিক তেমন চাইলো না। প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলো উত্তরপাড়ার ঘন বাঁশ ঝাড়ের দিকে। সেখানে অপেক্ষারত পুরুষ মানুষটি মহিলার বিয়ের আগের প্রেমিক। সে প্রেমিকের হাত ধরে অন্ধকারে যাত্রা করলো মণ্ডলবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ঘোমটা দেয়া কমবয়সি মহিলা। মান্নানের তীক্ষ্ণ চোখজোড়া প্রহরায় থাকলে এ যাত্রা হয়তো কখনোই সফল হতো না!
সকালে মণ্ডলবাড়িতে হাহাকার পড়লো, ঘরে নেই মণ্ডলবাড়ির বউ!