সত্যিটা তোমরাই বলো

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

ইব্রাহিম আলী মোনাল

যে মনের আঙ্গিনা হতে সর্বদাই দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভাবা হতো, দেশসেবার কাজে নিবেদিত থাকতো যে মানুষটি, আজ সেই কিনা সবার দৃষ্টিতে একজন খারাপ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হলো। সৎ পথে জীবন যাপন তাহলে কি অন্যায়? অসৎ পথই কি তাহলে সৎ হয়ে গেল? এমন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই প্রাণহীন পথচলা। উদ্ভ্রান্ত গতিতে। কোথায় নিশ্চিত গন্তব্য; কোথায় শেক্ড় সন্ধান জানা নেই নঈমের। সামনে কেবলই হতাশার পাহাড়। আলো নেই। নেই সবুজের অবাদ, নয়নাভিরাম দৃশ্যের লুটোপুটি। কোথায় যাচ্ছে সে, কোন গন্তব্যে মিলবে সঠিক প্রশ্নের সমাধান, কিছুই জানা নেই তার। শুধু চলতে হবে। অনেক পথ এগুতে হবে তাকে। ব্যস্ত রাজপথে জোর কদমে হাঁটছে নঈম। অন্যদিন সে নিজের ডান-বাম পাশ দেখে পথ হাঁটে। সতর্কতার সাথে পার হয় রাস্তা। আজ সব কিছুই উল্টো নিয়মে নঈমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোন এক অদৃশ্য আত্মা। নাকি নঈম নিজেই হাঁটছে। নির্ণয় করে বলতে বা ভাবতে পারছে না সে। সৎ পথে থাকা, সৎ চিন্তা করা এটা সত্যিকি অন্যায়ের মধ্যে পড়ে? কারো কারো দৃষ্টিতে সৎ কাজ করাটাও অন্যায়ের মধ্যে পড়ে। নঈমও সৎ কাজ করতে গিয়ে অসৎ কাজের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছে। এজন্য চাকরিটা হারাতে হয়েছে তাকে। তিলতিল করে প্রতিষ্ঠিত করা সত্যের পাহাড়টিতে আজ ময়লা আবর্জনায় ঢেকে গেছে। মনের সুন্দরতম জায়গাটিও আজ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। না ঢেকে যায় নি। ঢেকে দেয়া হয়েছে। অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের যোগসাজসে আজ তার এতবড় অপমান মুখ বুজে সইতে হলো। এসব অসাধু ব্যক্তিদের সামনে লিজার  মতো মেয়ের কাছে শুনতে হলো নানা বিরূপ মন্তব্য। তার মন্তব্যে হিংসা, ঘৃণা, অবজ্ঞা আর অবহেলা ছাড়া প্রাণ সঞ্চার হওয়ার মত বাক্য বের হয় নি। অবশ্য মালিকের সামনে নঈমকে এসব কথা যদি সে না বলতো তাহলে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তো। তাই বাধ্য হয়েই ভালোবাসার মানুষটি আজ চরম অপমান করে চাকরি থেকে বিদায় করে দিয়েছে। কিন্তু এটি না করে যে তারও কোন পথ খোলা ছিল না। অশ্রুভরা চোখে নঈম যখন অফিস থেকে বের হয়ে আসছিল তখন বড় আঘাতটাই পেয়েছিল লিজা। কারণ তার কথাতেই চাকরি হারাতে হয়েছে তাকে। কোন্ অফিসে ঘুষ, দূর্নীতি হচ্ছে না, কোন্ প্রতিষ্ঠান এ সবের উর্দ্ধে, নঈম বা লিজার কারো জানা নেই। জানা নেই অন্যদেরও।

নঈমের চেয়ে পদবীতে লিজার অবস্থান একটু উপরে সে কারণে বসের পরের সিদ্ধান্তটা তাকে নিতে হয়, নঈমও জানে। এটা লিজার মনের কথা নয়। চাকরি এবং বড় পদবীর কারণেই এটা বলতে হয়েছে তাকে। আর কিছুই ভাবতে পারছিল না নঈম। পথ চলতে চলতে এসব কথাই ভাবছিল সে। এভাবে চাকরি হারানো এবং লিজার অসম্ভব রকম নীতিকথা তাকে আরো উদ্ভ্রান্তের মতো পথ চলতে উষ্কানি দিচ্ছিল। কখোন নঈম ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে বলতে পারে না। দু’দিন অফিস বন্ধ থাকার পর রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। তাই রাস্তায় জানজট অন্যদিনের চেয়ে বেশী। কোনোদিকে খেয়াল নেই তার। রাস্তা পার হবে, নাকি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবে এতটুকু বোধও আজ তার মধ্যে কাজ করছিল না। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটি যাত্রীবাহী বাস তাকে ধাক্কা দেয়। মুহুর্তেই প্রায় আট-দশ হাত সামনে ছিটকে পড়ে নঈম। আর কিছুই বলতে পারেনা সে। জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালের বেড়ে আবিষ্কার করে সে। কারা তাকে এখানে এনেছে, কারা উদ্ধার করেছে, কিছু বলতে পারেনা নঈম। হাসপাতালের বেডে শুয়ে কর্মজীবন, অফিস থেকে বেরিয়ে আসা সবই মনে পড়ছিল তার। সৎ পথে জীবনযাপন, সৎ কর্মে অংশগ্রহন, কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ কামনা এসব তাহলে মিথ্যে! অসৎ মানুষগুলোই কি তাহলে সৎ, যোগ্য? এমন নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল তার মনে। শরীরে বেশ যন্ত্রণা করছে। ডান হাতটা মাঝামাঝি থেকে ভেঙ্গে গেছে। ডাক্তার, নার্স সবাই যেন তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করছে। বেডে শুয়েই ব্যস্ত রাস্তার গাড়ীর শব্দ কানে আসছিল। একটু উঠে বসার চেষ্টা করেও পারে না নঈম। অনেক কষ্টে উঠে বসে। শত যন্ত্রণার মধ্যেও কেন জানি লিজার কথাটা বারবার মনে পড়ছে তার। এ সময় যদি লিজা পাশে থাকতো তাহলে মনটা হালকা লাগতো। বড় ভালো মেয়ে লিজা। আজ অফিসে তার অগ্নিমূর্তি চেহারা দেখে সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। লিজার মতো শান্ত প্রকৃতির একটি মেয়ের মুখে এমন নিয়মতান্ত্রিক কথা শুনে প্রথমে ভড়কে গেলেও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনভিত্তিক কথাগুলো অবাক করে দিয়েছিল তাকে। তা নাহলে কোন দিনই লিজা তাকে এসব কথা বলতে পারতো না। কারণ নিজের জীবনের চেয়ে নঈমকে সে বেশী ভালোবাসে। সংকোচহীনভাবে সৎ কথা বলা, সৎ কর্মজীবন পালনকারী নঈমকে তাই প্রথমেই ভালো লেগেছিল তার। দীর্ঘ আট বছরের কর্মজীবনে বিন্দু বিন্দু করে নঈমের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে লিজার। অনেকবারই তারা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছে। কিন্তু কেন হয়নি, কোন্ অশুভ কারণে সুখময় দিনটিকে রঙিন করে তুলতে পারেনি তারা, জানা নেই। সরলরেখায় মিলিত হবার জন্য উভয়ের মধ্যে যে সমিকরণ তা এতটাই মজবুত, এতটাই অটুট যা দীর্ঘ আট বছরে একটি বারের জন্যও চিড় ধরে নি। বরং প্রেম-জ্যামিতিক সমিকরণ তাদের ভালোবাসার প্রাচীরটাকে দীর্ঘ মেয়াদ দিয়েছে। যা বাতাসে দোলে, ঘ্রাণ ছড়ায়, কিন্তু ফাঁটল ধরিয়ে দু’পথে দু’জনকে সরিয়ে দেয় না। উভয় পরিবারের বিষয়ে দু’জনই জানে, বোঝে। কয়েক বছর আগে অফিসের বস হেদায়েত উল্লাহ খানের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল তারা। সেদিন তিনি কিন্তু কিছুই বলেন নি, শুধু মুচকি হেসে চলে গিয়েছিলেন। পরদিন অফিসের মিটিংরুমে সবাইকে ডেকে তাদের সম্পর্কের কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সবার উদ্দেশ্যে হেদায়েত উল্লাহ খান বলেছিলেন লাইলী-মজনুর প্রেমকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন জানালাম। সেই সাথে তাদের সুখী-সমৃদ্ধ জীবন পরিপূর্ণতায় ভরে উঠুক এটা প্রত্যাশা। নঈমকে নিয়ে সাজানো একটি মিথ্যে ঘটনায় হেদায়েত উল্লাহ খান কিছু বললেন না। এ বিষয়টি নঈমকে বেশী অবাক করেছে। তিনি অফিসের বস। বলার কথা ছিল তার-ই। কিন্তু তিনি কী কারণে কিছু বললেন না এটাই বুঝতে পারছে না সে। এভাবে হাসপাতালের বেডে কেটে যায় দু’দিন। অফিস থেকে অশ্রুসজল চোখে নঈমের বেরিয়ে যাবার পর থেকে লিজাও ভালো নেই। বাসায় ফিরে রাতে ঘুমোতে পারেনি সে। নঈমের অসহায় মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। রাতে কিছুই খাওয়া হয় নি। বিষয়টি লিজা তার মাকে জানিয়েছে। মাও তাকে যথাসম্ভব শান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে সুফল না মিললেও মিলেছে নঈমের সাথে কিছু সুখস্মৃতির গল্পকথা আর চোখের লোনাজল। অনেকবার এ দিনটির কথা ভুলতে গিয়েও পারে নি। দেয়াল ঘড়িটা এরই মধ্যে ভোর পাঁচটা বাজার সংকেত জানিয়ে আবার টিকটিক করে নিজ চলার পথে ঘুরতে শুরু করে। লিজার মনের ঘড়িতে কিন্তু কোন শব্দ শুনতে পারছে না। কয়েকবার বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেও পারে নি। নঈমের প্রতি এই ব্যবহারের জন্য মনের মধ্যে কি ঘটে চলেছে তা কেবল লিজাই জানে। এ ঘটনায় কি-ই বা করার আছে তার। কি করার ছিল নঈমের পক্ষ নিয়ে কথা বলার। সবার দৃষ্টিতে আজ সে অফিসের একজন অসাধু কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত। তার পক্ষে কিছু বলতে যাওয়ার অর্থ সে বোঝে। তাই নিষ্ঠুরতম এ কথাগুলো তাকে বলতে হয়েছে। প্রচ- ঝড়ে বা তীব্র বাতাসে যখন পথের ধূলো বা প্রকৃতির অনেক সম্পদ ল-ভ- হয়ে যায় ঠিকানাহীন গন্তব্যের পথে, ঠিক তেমনি নঈমকে অফিস থেকে বের হওয়ার কথা বলার পর লিজার মনে সে রকম ঝড় বইতে শুরু করেছিল। সে ঝড়ে নঈমের সাথে সম্পর্কের অনেক সুখগাঁথা স্মৃতি বেলা-অবেলায় গানের কথামালা খসে পড়েছে বিরতিহীনভাবে তারই মনের সাজানো বনবিথিতে। যে সৌরভ ভরা পুষ্পভূমি থেকে হাওয়া দোল দিয়ে যেত, সে পুষ্পবনে আজ বইছে ঝড়ো হাওয়া। সে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার ভালোবসার ঘর। তাই লিজা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেও চাকরি ছেড়ে দেবে। রাতেই এ কথা সে বসকে জানিয়ে দিয়েছে। অফিসের বস হেদায়েত উল্লাহ খান অনেক বুঝিয়েও চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারেনি লিজাকে। অবশেষে লিজার সিদ্ধান্তকে টলাতে না পেরে হেদায়েত উল্লাহ খান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেভাবেই হোক, যেমন করেই হোক নঈমকে তিনি চাকরিতে ফিরিয়ে আনবেন বলে মুঠোফোনের সুইচ বন্ধ করে দেন। বসের আশার বাণীতে মন ভরেনি লিজার। সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে বরাবরই সে অটল। আজ সারাদিন সে রাজধানীর বড় বড় কয়েকটি হাসপাতালে নঈমকে খুঁজে ফিরেছে। কোথাও পায়নি তাকে। ভোর হলেই সে নঈমকে খুজতে বেরিয়ে পড়বে। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় লিজা। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি রাখে। ততক্ষণে চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে। আর দেরি করে না সে। দ্রুত তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। একটি রিকসা ডেকে তাতে উঠে বসে। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ব্যর্থ মনে পথ হাঁটছিল লিজা। আজ অফিসে যাবার তাড়া নেই। কথাটা আগেই সে বসকে জানিয়ে দিয়েছে। যতক্ষণই লাগুক আর যতদিনই যাক সে নঈমকে খুঁজে বের করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিশ্রাম নেই। এভাবে শহরময় ঘুরতে ঘুরতে একসময় ক্লান্তি তার পুরো শরীর জুড়ে ভর করে। এভাবে কখন সূর্য ডুবে রাত হয়েছে বলতে পারে না লিজা। বাসা থেকে বের হবার আগেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নঈমকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত বাসায় ফিরবে না। যে কথা সেই কাজ, হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারটা চল্লিশ মিনিট। এত রাতে কোথায় যাবে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না সে। অবশেষে সামনেই বড় একটি বাজার তার চোখে পড়ে। ক্লান্ত পায়ে সেদিকেই এগিয়ে যায় লিজা। একটি চায়ের দোকান চোখে পড়ে তার। এগিয়ে গিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়ায়। চায়ের দোকানটিতে নানা বয়সী খরিদ্দার চা পানে ব্যস্ত। হঠাৎই অচেনা এ আগন্তুককে দেখে নড়েচড়ে বসে তারা। নানাজনের নানা দৃষ্টি পড়ে তার উপর। ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ মুখে গরম চা ঢালতে গিয়েও তাকায় মেয়েটির দিকে। তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে অশুভ রঙের প্রলেপ। ইশারায় সে লিজাকে পাশে বসার মৃদু আহ্বান জানিয়ে ডানপাশে একটু সরে বসে দ্বিতীয়বার আহ্বান জানায় লিজাকে। নানা প্রশ্ন উঁকি মারে মনের ভেতর। একাকী এত রাতে এভাবে বাইরে থাকা কতটা নিরাপদ সেটাই ভাবছিল লিজা। এখানে যারা বসে চা পান করছে তাদের সবারই চোখ তার দিকে। একবার ওদের আর একবার নিজের দিকে তাকিয়ে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল তার। এখন এতসব ভাববার সময় নেই। আবার ফিরে যাবারও উপায় নেই। বাকি রাতটা যেভাবেই হোক এদের মধ্যে থেকেই কাটিয়ে দিতে হবে ভেবে লোকটার পাশে গিয়ে বসে লিজা। অনেক খরিদ্দারেরই নজর তার উপর থেকে সরে নি। অনেকক্ষণ হয় কেউ তাকে কোন প্রশ্ন করে নি। চোখের  তারায় নানা রঙের আলপনা এঁকে অনেকেই তাকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে নিজ নিজ আসন থেকে। হয়তোবা চা পানের প্রয়োজন নেই, তবুও অর্ডার করা হচ্ছে দোকানীকে। বয়স্ক লোকটি চায়ের কাপটি দোকানীকে ধরিয়ে দিয়ে বাম পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে তাতে অগ্নি সংযোগ করে লম্বা একটি টান দেয় আর বাতাসে ছড়িয়ে দেয় ধোঁয়া। আড়চোখে লিজা এ দৃশ্য অবলোকন করে অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। জীবনে এমন পরিবেশে কোনোদিন পড়েনি সে। আর সিগারেটের ধোঁয়া এ তার একেবারেই অসহ্য লাগে। এ সবই সে সহ্য করছে শুধুমাত্র নঈমের জন্য। আজ নঈমের চাকরিটা যদি না হারাতো, তাহলে এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতো না। রাত যতই বাড়ছে ততই ভয় তার মনে দানা বেঁধে উঠছে। এখানকার কেউই এখন পর্যন্ত তার সাথে অশালীন আচরণ করে নি। যদি না করে তাহলে ভালো। আর যদি করে তাহলে এর মাত্রা কেমন হবে, কিভাবে সে বিষয়টির মোকাবেলা করবে এসবই ভাবছিল সে। এমন সময় তার পাশে বসা বৃদ্ধ লোকটি তার একেবারে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলে- ‘এত রাইতে ভদ্র ঘরের মাইয়া হইয়া এইখানে কি করতে আইছো মা?!’ আচমকা বৃদ্ধের এমন আচরণে চমকে ওঠে লিজা। বৃদ্ধটি আবার বলে- ‘আমি তোমারে কিছু জিগাইছি শুননাই?’ ভয়ে ভয়ে আড়ষ্ঠ কণ্ঠে লিজা উত্তর দেয়- ‘জ্বী শুনেছি।’ ‘স্বামীর সাথে রাগ কইরা ঘর ছাড়ছো? আইজকাল যে কি হইছে সংসারে। কথায় কথায় ঘর ছাড়া। দেইখা তো মনে হয় ভালো ঘরের মাইয়া। এত রাইতে এইখানে কি করতে আইছো?’ বৃদ্ধের এত প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। আর এমন প্রশ্ন কেউ করবে তা ভাবতেও পারেনি সে। ‘রাইতের শহর খুব একটা ভালা না মা। ধারে কাছে বাসা হইলে ঘরে ফিরা যাও।’ আবার সিগারেটে টান দেয় বৃদ্ধ। বৃদ্ধ লোকটির মুখে ‘মা’ ডাক শুনে অনেকটাই প্রাণ আসে দেহে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে বসে লিজা। তাহলে খারাপ কিছু ঘটার সম্ভবনা অন্তত নেই। এই বৃদ্ধ লোকটি যতক্ষণ তার পাশে আছে। আস্তে আস্তে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে থাকে সে। দোকানদারের দিকে চোখ দিয়ে বলে- ‘চা বিস্কুট দে।’ দোকানী তার দিকে তাকিয়ে বললো- ‘এইমাত্রই না চা খাইলা?’ ‘হ খাইছি, তোর অসুবিধা আছে?’ দোকানী আর কোনো কথা না বলে দুইটা বিস্কিট বৃদ্ধের হাতে দিতে দিতে বলে- ‘চাচা এই বয়সেও তুমি তাজা হইতে চাও!’ সাথে সাথে উত্তর দেয় বৃদ্ধ- ‘না তোগো মতন বুইড়া খাটাস হইতে কস আমারে?’ হাতের বিস্কিট লিজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে- ‘নাও মা, খাইয়া এককাপ লাল চা খাও ভালো লাগবো। মুখের চেহারা কইতাছে সারাদিনে মুখে কিছু পড়েনি। নাও খাইয়া নাও।’ ‘না না চাচা আমি কিছু খাবো না। আমার খিদে নেই।’ অগত্যা বৃদ্ধের চাপাচাপিতে খেতে হল বিস্কিট এবং চা।

বৃদ্ধ লোকটি আবারও লিজার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে- ‘কোন ভয় নেই মা। আমারে সব খুইলা কও। দেখি তোমার জন্য কি করবার পারি।’ একটি নিরাপদ আশ্রয় যেন খুঁজে পেল লিজা। এতক্ষণে মনের কোণায় যে ভয় দানা বেঁধে উঠেছিল তা অনেকটাই কমতে শুরু করেছে। ‘এখানে বলতে অসুবিধা হইলে ঐপাশে চল’, বলে উঠে যায় বৃদ্ধ লোকটি। মুহূর্তেই  রোবটের মত পিছু হাঁটতে শুরু করে লিজা। এক সময় বৃদ্ধ লোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। শহরের ব্যস্ত কোলাহলমুখর পরিবেশ নিঃস্তব্ধ হয়েছে অনেক আগেই। যান চলাচল করছে হালকা। বৃদ্ধ লোকটি লিজার কথাগুলো শোনার ফাঁকে আরো একটি সিগারেটে আগুন জ্বালায়। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। লিজা ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুখছে মুছতে বলে- ‘সবইতো শুনলেন, এছাড়া আমার কিই-বা করার আছে। মানুষটি সত্যি বড় অসহায়।

একটিা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বৃদ্ধ লোকটি বলে- ‘সত্যি মা এই যুগে এমন ভালা মানুষের খুব দরকার। তুমি কোন চিন্তা কইরো না, সবই ঠিক হইয়া যাইবো। এত রাইতে তোমারে কই রাখি, কি খাইতে দেই। আমিও যে খুব অসহায় মা। সকাল হইলে তোমার লগে মানুষটারে আমিও খুঁজতে যামু মা, চল বাকি রাইতটা চায়ের দোকানেই গল্প কইরা পার কইরা দেই।’ পা বাড়াতে গিয়েও দাড়িয়ে যায় বৃদ্ধ লোকটি। ‘মারে তোমার কথা অনুযায়ী এই ধরণের একটা মানুষ এই বাজারের পাশে একসিডেন্ট করছিল। তারে এলাকার সবাই পাশের হাসপাতালে রাইখা আসছে। তোমার বর্ণনা যদি সত্যি হয় তাইলে ওইখানে খোঁজ করলে পাইলেও পাইতে পারো মানুষটারে।’ ইতোমধ্যে আঁধার কেটে সূর্যটা বেশ আলো ছড়িয়েছে। বৃদ্ধ লোকটির পুনঃ পুনঃ অনুরোধে সকালের নাস্তা খেতে হয়েছে লিজাকে। লিজার ব্যাগ থেকে একটি টাকাও খরচ করতে দেয়নি সে। এবার লিজা বলল- ‘বেলা অনেকটা হয়েছে এবার বের হতে হবে। আর দেরি নয় চাচা।’ ‘হ্যা, মা চল’। লিজার কথার ছোট্ট উত্তর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে তারা। বৃদ্ধ লোকটিসহ লিজা প্রথমেই পাশের হাসপাতালে যায়। রেজিস্টারে যে নামটি খুঁজে পাওয়া যায় তাতে লিজার স্পন্দন আরো বেড়ে যায়। হাসপাতাল থেকে জানানো হয় গতকাল রাতে ওই রোগীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে লিজার মাথায়। সারা দিন-রাত এখানে ওখানে বেড়িয়ে অবশেষে হাতের কাছে থাকা মানুষটাকে খুঁজে নিতে পারলো না লিজা। কি এক অজনা আশঙ্কায় বুকটা ভারি হয়ে গেল তার। যত ধরণের খারাপ চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। বৃদ্ধ লোকটিকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিক ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় লিজা। চোখের লোনাজলে বারবার প্রিয় মানুষটিকে হারাবার ভয় হচ্ছে তার মনে। জোরপায়ে পথ হাঁটছে তারা। এমন সময় সামনে অনেক মানুষের ভীড় চোখে পড়ে তাদের। একটু দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ লোকটিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে লিজা। ওখানে একটি একসিডেন্ট হয়েছে, তাই এত লোক। ‘চাচা আমার মনটা কেমন করছে। চলুন গিয়ে দেখি’। ‘হ্যা মা চল’। সামনে এগিয়ে তারা দেখতে পায় অনেক লোকের ভীড়। লোকজন চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এত ভিড়ের মধ্যে মানুষ চেনা বড় দায়। কিন্তু লিজার একি হলো বুকের মধ্যে হঠাৎ করে এত ঝড় বইতে শুরু করলো কেন? তাহলে নঈমের কি কিছু হলো? এই কি শেষ দেখা? নানা অশুভ কথা ভাবছিল সে। বৃদ্ধ লোকটির ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সে। ‘যাও মা, ঐ রাস্তার মাঝখানে একটা মানুষ একসিডেন্ট কইরা মইরা পইড়া আছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘটনাটা ঘটেছে। দেখ, চিনবার পারো কিনা।’

বৃদ্ধ লোকটির কথায় কোন উত্তর না দিয়ে ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায় লিজা। দূর থেকে  চেনার উপায় নেই মানুষটিকে। আরো কাছে এগিয়ে যায় লিজা। রাস্তায় পড়ে থাকা লাশটির একেবারে কাছে। আরো কাছে এগিয়ে যায় লিজা। তারপর যা চোখে দেখে তা বর্ণনাতীত। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সে। মুখ দিয়ে কেবল একটি শব্দ উচ্চারিত হয়। ন-ঈম। আরো কিছু বলার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লিজার দেহ। এমন ঘটনায় উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যায়। বৃদ্ধ লোকটির আর বুঝতে বাকি থাকে না এখানে কিসের খেলা সংগঠিত  হলো। বৃদ্ধ লোকটি গিয়ে লিজার দেহটি তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ‘এ তুই কি করলি মা। একজন ভালো মানুষের খুঁজতে আইসা শ্যাষে নিজেই …। এইডা কি হইল। তুইতো কিছুই কইয়া গেলি না। আমি কারে কি কমু। কেডায় আমারে কি কইবো। এই মানুষ তোমরাই কও …’

মন্তব্য: