সুমনের পাখি বন্ধু

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

লিটন ঘোষ জয়

বিকাল হলেই সুমনদের ঘরের পেছনে পেয়ারা গাছে ঝাঁকেঝাঁকে পাখি এসে বসে। তারপর কিচিরমিকির, কিচিরমিচির ডাকাডাকি করে। সুমন জানালা দিয়ে অপলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। ও বাইরে যেতে পারে না। অনেক দিন হলো অসুস্থ। মা সারাক্ষণ ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। বাবা সারাদিন গঞ্জের বাজারে মাছ বেচার পর রাতে বাড়ি এসে, সুমনের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বাবার চোখ দুটো তখন ছলছল করে ওঠে। মনে হয় বাবা কাঁদছে! কিন্তু কাঁদতে পারে না।

সেদিন সুমন বাবার এ দৃশ্য দেখে বলল, ‘বাবা তুমি কী কাঁদছো?’

বাবা তখন মলিন হেসে বলল, ‘কই সোনা! আমি কাঁদছি নাতো। তুমি কী রাতে খেয়েছো?’

‘না তোমার সাথে খাবো বলে, সেই কখন থেকে বসে আছি।’

সুমনের মা খাবার দিয়ে ডাকে- ‘কই খাবে তাড়াতাড়ি এসো।’

সুমন খেতে খেতে বাবাকে বললো, ‘আচ্ছা বাবা আমার কী অসুখ হয়েছে? আমি কী আর কোনদিন স্কুলে যেতে পারবো না, খেলতে পারবো না? এভাবে শুয়ে থাকতে, আমার আর ভালো লাগে না। বিকালে যখন জানালা দিয়ে দেখি কিবলু, পলাশ, রাজুরা মাঠে ফুটবল খেলছে। তখন আমার ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না।’ 

বাবা সুমনের কথা শোনার পর, ভাত মুখে ওঠে না। কেবল দু’চোখ জলে ভরে যায়। সুমনের মা তখন মুখে কাপড় টেনে কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে চলে যায়। বাবা সুমনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘তোমার কিছু হয়নি সোনা। আর ক’দিন পরেই তুমিও পলাশদের সাথে ফুটবল খেলতে পারবে, স্কুলে যেতে পারবে। এখন তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও তো।’

সুমন সারাদিন ঘরে বসে বসে গল্পের বই পড়ে। বাবা তার জন্য গঞ্জের বাজার থেকে শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার  আমীরুল ইসলামের- ‘আকাশ ভরা রূপকথা’ ‘কিশোর গল্পসমগ্র’ ও ‘ছড়া রচনাবলী’ কিনে এনে দিয়েছে। কেননা সুমনের সবচেয়ে প্রিয় লেখক হচ্ছে- আমীরুল ইসলাম। সুমনের সংগ্রহে আমীরুল ইসলামের আরো অনেক বই আছে। সুমন বড় হয়ে তার প্রিয় লেখক আমীরুল ইসলামের মতো শিশুসাহিত্যিক হতে চায়। মাঝে মধ্যে সুমন আমীরুল ইসলামকে স্বপ্নে দেখে। লোকটা সব সময় হাসি-খুশি, হাসতে হাসতে কথা বলে। চোখ দুটো মায়ায় ভরা। ছোটদের ভীষণ ভালোবাসেন। খুব সহজে সবাইকে আপন করে নেয়। তার বেশির ভাগ লেখা ছোটদের জন্য। সুমন তার প্রিয় লেখক আমীরুল ইসলামকে নিয়ে একটা ছড়া লিখেছে- ‘যার নাম বরিষণ তার নাম বিষ্টি/যার নাম চমচম, তার নাম মিষ্টি। যার নাম সঙ্গীত তার নাম ছন্দ/ যার নাম চাঁপাফুল তার নাম গন্ধ। যার নাম পাঠাগার তার নাম পড়া/ যার নাম আমীরুল তার নাম ছড়া।’

সারা গাছ পাখিতে ছেঁয়ে গেছে। গাছে অনেক পেয়ারা পেকে রয়েছে; পাখিগুলো তা ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে একের পর এক খাচ্ছে। সুমন মনে মনে বললো- সে ভালো হলে গাছে উঠে পেয়ারা পেরে খাবে। কয়েকদিন আগেও সে গাছে উঠে কত পেয়ারা খেয়েছে! হঠাৎ একটা হলুদ পাখি জানালার কাছে ছোট কদবেল গাছে বসলো। সুমন পাখিটার দিকে তাকিয়ে আছে এমন সময় পাখিটা বলল, ‘সুমন তুমি পেয়ারা খাবে?’

সুমন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। তাহলে তাকে পেয়ারা খাওয়ার কথা বললো কে!

আবারও পাখিটা বলল-‘সুমন একটা পাকা পেয়ারা খাবে?’

সুমন ভীষণ অবাক হলো পাখি কথা বলছে! তার নাম ধরে ডাকছে! সুমন এবার চোখ বড় বড় করে পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল। হলুদ পাখিটা তখন তার পুচ্ছ তুলে কুহু… কুহু…কুহু করে ডেকে উঠলো।

সুমন পাখিটাকে বললো, ‘আচ্ছা, তুমি আমার নাম জানলে কী করে?’

পাখিটা বলল, ‘কেন? আমি রোজই তো পেয়ারা গাছে বসে শুনি। তোমার মা বাবা তোমাকে সুমন, সুমন বলে ডাকে। তুমি যখন জানালা দিয়ে টলমল চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাক। তখন আমার খুব খারাপ লাগে। তোমার জন্য আমার কান্না পায়। সুমন তোমার কী মনে পড়ে? একদিন আমি ফাঁদে আটকা পড়েছিলাম। তুমি বন্ধুদের সাথে স্কুলে যাচ্ছিলে। আমি বাঁচার জন্য খুব ছটফট করছিলাম। তুমি আমাকে ফাঁদ থেকে বাঁচিয়ে ছিলে। তোমার বন্ধুরা বলেছিলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে। তুমি বলেছিলে- না, পাখিদের ধরেতে নেই। যারা পাখি শিকার করে তারা ভালো মানুষ না। পাখিরা আমাদের বন্ধু পোকা-মাকড় খেয়ে পরিবেশ রক্ষা করে। তারপর তুমি আমাকে ডানা মেলে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলে। সেদিনের পর থেকে তুমি আমার বন্ধু হয়ে গেছ।’

পাখিটার কথা শুনে সুমনের সব মনে পড়ে গেল। সমুন পাখিটাকে বলল, ‘হ্যাঁ বন্ধু, মনে পড়েছে। ইশ! কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। তা তুমি কেমন আছ?’

‘আমি ভালো নেই বন্ধু। তোমার অসুখ হলে আমি কী ভালো থাকতে পারি?’ 

সুমন বলল, ‘বন্ধু তুমি কোন চিন্তা করো না। বাবা বলেছে আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাব। তারপর আবার খেলতে পারবো, স্কুলে যেতে পারবো।’

‘তা তোমার কী হয়েছে?’

‘বাবাতো বলতে চান না, কিন্তু সেদিন আমি শুনেছি বাবা মাকে বলছিলো- আমার যে অসুখ হয়েছে তার নাম পোলিও। জানো! বন্ধু, আমার পা দুটো অবশ হয়ে আসে। তাই হাঁটতে পারি না। আমি যখন বাইরে যেতে জেদ ধরি তখন মা কোলে করে বাইরে নিয়ে যান। আচ্ছা, বন্ধু পোলিও কেন হয়?’

পাখিটা বলল, ‘শোন হাম, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাঁশি, হেপাটাইস-বি, টিটেনাস ও পোলিও এই সাতটা টিকা দেয়া প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজন। টিকাগুলো দেয়া থাকলে এই রোগগুলো হওয়ার সম্ভবনা থাকে না। সরকারিভাবে এই টিকাগুলো দেশের সব স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পৌরসভা, কমিনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে দেয়া হয়। তোমার মনে হয় টিকাগুলো দেয়া হয়নি! তাই পোলিও…’ 

পাখিটার কথা শেষ হবার আগেই সুমন কাঁদো কাঁদো চোখে বলল, ‘আমি কী তাহলে ভালো হবো না?’

পাখিটা সুমনের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে কুহু…কুহু…কুহু…করে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায়।

মন্তব্য: