অনুবাদের কালিঝুলি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শহীদ ইকবাল

প্রথম অনুবাদে আকৃষ্ট হই বুদ্ধদেব বসুর কাছে। বই মেঘদূত। এটি আশ্চর্য বই। মন্দাক্রান্তা ছন্দে অপূর্ব কাব্যভাষার প্রয়োগ আর প্রেমের অকুণ্ঠ অনদ্যান্ত প্রয়াসেই এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। তারপর আরও অবিশ্বাস্যরূপে ওই বয়সে আমাদের সম্মুখে উন্মোচন হয় ইডিপাস নাটক। তাতে সফোক্লিসকে এদেশের করে পাওয়া গিয়েছিল। বলি, কেমন তা! সফোক্লিস বলেন, ইডিপাস বাবাকে হত্যা করেছে, মাকে বিয়ে করেছে ইত্যাদি ভয়ঙ্কর সব কথা। আর বয়সটা তখন যা তাতে তার হারানোর কোনো উপায় নেই। এক অদ্ভুত রকমের আকর্ষণে তখন পড়ে ফেলি সৈয়দ আলী আহসান অনূদিত ইডিপাস নাটক! বেশ আকর্ষক পুস্তক সেটি। এবং আনন্দদায়ী ও উপভোগ্য পাঠও বটে। ডেলফির মন্দির, রাজা লেয়াস, ইডিপাস যেন চক্ষু-আলোড়িত চরিত্র। পরে যদিও বুঝতে পারি, ওটা সৈয়দ আলীর ‘কবিতা’ মতোন কিছু। নিজস্ব সৃষ্টি। কবি সৈয়দ আলীর সৃষ্টি। ‘ট্রান্সেলেটর ইজ অ্যা ট্রেটর’ কথাটা ক্লাসে শুনি আর সৈয়দ আলীর ইডিপাসকে তখন মেলাই। আমি তো গ্রিক জানি না! বলতে গেলে ইংরেজিও না। ফলে ইডিপাসের যে স্বাদ কবি আলী আহসান আমাদের মুখে তুলে দিলেন- তা আর কম কীসে? সত্যিই এখনও তা আনন্দ জাগায়। রোমাঞ্চ অনুভব করি। যদিও শিশির কুমার দাশের অনুবাদের দাম এখন মনে হয় বেশ বেশি। পেছনের কারণ, শিশিরবাবু নাকি গ্রিক ভাষাটা বোঝেন। এইতো গেল ইডিপাস বিষয়ক কথা। এর গল্প আর অনুবাদ নিয়ে পরে বলছি। এরপর ঘনিষ্ঠ হই গিরিশ ঘোষের ম্যাকবেথ পড়ে। শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ উঠে আসে গৈরিশ ছন্দে। গৈরিশ ছন্দ সে বয়সে খুব একটা টানেনি। আর শেক্সপীয়রও আকর্ষক হয়নি। গিরিশ বাবুর ভাষা কঠিন মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন বেশ উপাদেয় মনে হয়। ফলে তখন শেক্সপীয়র পড়া হয়, ওই বাজারি কিছু বই থেকে। ঠিক কার অনুবাদ- তা মনে নেই। একটা শক্তি তো আছেই শেক্সপীয়ারে। ওই শক্তির টানে ম্যাকবেথও পড়া হয়ে যায়। একসময় প্রিয় হয়। এগুলো অনুবাদ-পঠনের প্রাথমিক ঘটনা। কিন্তু অনুবাদ আসলে কী? সত্যিই সাহিত্যপঠনের কাজটা কী কোনো অনুবাদে সম্ভব! যদি না করি তবে বলতে হয়- ‘ওটা পরের ঝাল খাওয়ার কাহিনি’। তবুও অনুবাদ কেন টিকে আছে তবে! আর তা থাকবেও কী, চিরকাল। অনুবাদ-স্টাডিজ নামে কোর্স কিংবা ডিসিপ্লিন আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা খুব বাজে কাজ নয়। এবং আরও বলি, অনুবাদ ছাড়া রুশ সাহিত্য, স্পেনিশ সাহিত্য কিছুই পড়া সম্ভব নয়। অনুবাদের কারণেই, মার্কেজ, রুলফো, অ্যচিবি এখন পড়া যায়। দূরে হোক, তবুও তাঁরা কাছের। দূরের সাহিত্য হয়েছে যেন নিকট। সবরকম সাহিত্যে সবরকম স্বাদই আমরা পাচ্ছি, এমন অনুবাদের কাজের ভেতর দিয়ে। এমনকি মানুষ মানুষকেও চিনতে পারছে- ওই অনুবাদের কারণেই। যা হোক, এ কথাগুলো নতুন কিছু নয়। কিন্তু অনুবাদ কেমন? তার সাফল্য আমাদের দেশে বা বাংলা সাহিত্যে কতোটুকু। বিশেষ করে এই বাংলাদেশে এখন অনুবাদের অবস্থা কী? আদৌ কি অনুবাদ হচ্ছে? হলে তা কেমন। বিশেষ করে, যখন দেখি নোবেল পাওয়া কারো বই এক রাতেই অনুবাদ হয়ে বেরিয়ে যায়, তাতে কী মিলছে? অনুবাদ কী এতোই সহজ কোনো কারিকুরি? ওসব বুঝি নিছক ব্যবসা? খুব তাৎপর্য নিয়ে পড়ি আমাদের বন্ধু জিএইচ হাবীবের শতবর্ষের নির্জনতা কিংবা লেখকের মৃত্যু গ্রন্থটি। তিনি বলেন, এসব করতে তার বেশ সময় লাগে। খুব ভালো অনুবাদ। আর আজকাল মানবেন্দ্র রায় প্রায় সবার হাতে। বিশেষ করে, ল্যাতিন আমেরিকান সাহিত্যের টেস্ট আমরা তার হাতেই প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে চলেছি। তাঁর কাজও ফলপ্রসূ। এর বাইরে হরহামেশাই পাই ভালো অনুবাদের কাজ। মাসরুর আরেফিন ইলিয়াদের কাজটি করেছেন- যা বেশ আকর্ষণীয়। এসব মিলিয়ে এখনকার গুণগত অনুবাদের দশা এরকম। আর অন্যসব? সেসব নিয়ে কিছু বলার নেই। তবে এই প্রযুক্তির কল্যাণে অনুবাদের দাম বাড়ছে, আরও, অনেকভাবে- আমরা সেটার ভিত্তি বা কার্যকারিতা কীভাবে গ্রহণ করবো সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। অবশ্য ‘রুচি’র ভেতর দিয়ে সবকিছু যেখানে দেখা- সে দেখাতেও তারতম্য মিলবে অবশ্যই, নিশ্চয়ই।

বেশ আগে কোনো এক ফেব্রুয়ারির দিনে, বাংলা একাডেমির মঞ্চে, কবীর চৌধুরী মহাশয় ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির অনুবাদ করছিলেন। ইংরেজিতে। পরে আরও অন্য আলোচকগণের কেউ কেউ ওই একই কবিতার ইংরেজি করেন। আমাকে তখন কবীর চৌধুরীর অনুবাদটি ভালো লাগে। [হতে পারে সেটি কবীর চৌধুরীর কারণেই] পরে অন্যজনের অনুবাদ আর তেমন ভালো লাগেনি। কিন্তু সে ব্যক্তিটিও অনুবাদের কাজ ও ভিত্তি নিয়ে বেশ মূল্যবান আলোচনা করেছিলেন। তখন আমি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘অনুবাদ’ গ্রন্থটি কিনে ফেলি। এটি গ্রন্থমালা সিরিজের গ্রন্থ। বেশ দারুণ বই। তাতে অনুবাদের কাজ ও পরিবেশ, দর্শন ও দৃষ্টি নিয়ে অনেককিছু আছে। তাঁর এই জানাটা আমাকে অনুবাদের কাজের প্রতি দারুণ আগ্রহ তৈরি করে। আরও একটি বিষয় বলতে হয়, আমাদের নিকটতম ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইংরেজির অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন অনুবাদের ওপর কাজ করছেন দীর্ঘদিন। তিনি বেপরোয়াভাবে পড়াশোনা করেন এবং তা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনও বড় ডিগ্রিটি তার হাতের নাগালে আসেনি (এটা তার অপরগতা বা মেধার অযোগ্যতা নয়। বিস্তর পড়াশোনার কারণেই আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জনের প্রতিবন্ধকতাও বলা চলে)। যা হোক, তিনি একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যেরও প্রবল অনুরাগী। ট্রান্সেলেশন স্টাডিজের পঠন-পাঠনের ফলে তিনি রবীন্দ্রনাথের কিছু অনুবাদের কাজও পড়েন। তাতে করে যে জিনিসটি খেয়াল করি, অনুবাদ কম্মটি সহজ বা সাধারণ বিষয় নয়। তা বেশ আগ্রহের যেমন তেমনি জটিল ও দায়িত্বশীলতারও নামান্তর। এভাবে অনুবাদশ্লিষ্ট হয়ে উঠলে আমি এক সময় জীবনানন্দের ‘ওম’, ‘হায়’ শব্দের অনুবাদ বা ‘শিশিরের শব্দে’, ‘রাঙা রাজকন্যা’ এগুলোর প্রতিষ্ঠিত ও নির্ধারিত অনুবাদ ইংরেজিতে বা অন্য ভাষায় কেমন হতে পারে তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ি। এ বিভ্রান্তি থেকে জন্ম নেয় আরও আবেগ, অনুরণন, অনুভূতি, বাস্তবতা, দায়বোধ- ওই অনুষঙ্গি শব্দের ভেতরের এসেন্সকে কীভাবে যথাস্থানে নিয়ে যাবে বা পাঠককে পৌঁছে দেবে, তা নিয়ে ভাবতে থাকি। এসব ব্যাপারে ভূতগ্রস্ত থেকে এক সময় মনে হয় সত্যিই সব অনুবাদকই ‘বিশ্বাসঘাতক’। এবং কোনো অনুবাদই প্রকৃত লেখককে ধরতে সক্ষম নন। ফলে এক পর্যায়ে বেশ দম্ভের সাথে অনুবাদের গ্রন্থ সযতনে দূরে সরিয়ে রাখি। এবং তা আর আগ্রহযোগ্য মনে হয় না, বিশেষ করে যে কোনো অনূদিত গ্রন্থকে। ফলে আজতক, অনুবাদ দেখলেই এমনটা মনে হয়। কিন্তু অনুবাদ ছাড়া গতি কোথায়? ‘পেদ্রে পারামো’ আমি পড়বো কীভাবে? তাই এখন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ- এই উপন্যাস নিয়ে পড়ে আছি। আর এর যোগ্যতা নিয়ে এখনকার এই অনুবাদ-বিষয়ক লেখাটার কথা সাথে সাথে ভাবছি।

যা হোক, যেমনটা আগেই বলেছি, অনুবাদ সহজ নয়। এর পেছনে প্রয়োজন হয় বিশিষ্ট বোধ বা চিন্তনপ্রসূত পঠন-পাঠন। এডিটিংও তাতে বিশেষ প্রয়োজন। তবে অনুবাদ ছাড়া অন্য ভাষার সাহিত্যেও স্বাদ আস্বাদন করা প্রায় অসম্ভব। এক সময় ইডিপাসের অনুবাদ সৈয়দ আলী আহসানেরটি পড়ে আমরা আনন্দিত হতাম। বেশ কাব্যময় তার ভাষা। নাটকীয় আন্তঃযোগও বেশ আগ্রহসৃষ্টিকারী। ইডিপাস নিজের জীবনের প্রতি একসময় হতাশ হয়ে পড়ে। সে তখন বাঁচতে চায় না। বেঁচে থাকাকেও অভিশপ্ত মনে করে। ‘মৃত্যুর পরিবর্তে যে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে সে অভিশপ্ত হোক’। এই অভিশপ্ততা জীবনের গ্লানি। এক পর্যায়ে গিয়ে মানুষের সমস্ত অভিলাষ নিস্পন্দ হয়ে যায়। সে শুধু নিজেকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু তবুও যেন আগ্রহ শেষ নয়। কৌতূহল শেষ হয় না। মানুষ বিপুলভাবে যেন কৌতূহল-উন্মত্ত- তার তার অবস্থান দেখেই চেনা যায়। এই উন্মত্ততায় ইডিপাস নিজের জীবন নিয়ে বিস্তর সিদ্ধান্তের প্রতিকূলতায় কিছু অনুকূলপ্রবাহ তৈরি করেন। এ আনুকূল্য এক অর্থে মানুষের শেষ পরিণতি। খড়কুটোয় বাঁচার প্রচেষ্টা। প্রচ- ক্রিয়াশীল তার রাগ-অনুরাগ ও অনুভব। দ্বন্দ্ব তার ভেতরে। টেনশন মজ্জায়। চিন্তা তার সম্মানের, আত্মমর্যাদার। বিভা তার মস্তিষ্কে। ফলে সে আরও অধিক উন্নত-অবনত দ্বন্দ্বে মত্ত হয়ে ওঠে। ইডিপাস সর্বমুখি হয়। রাজ্য, রাজত্ব, দৈব-আঘাত, পিতৃপুরুষের পাপএমন অনেক ক্রিয়াশীলতার ভেতরে ইডিপাস স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। সে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পাঠক নিজের সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করেন। নিজেকে নিরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেন। অভিশাপ তার চেতনার সমস্ত স্তর অধিকার করলেও সে সহানুভূতি অর্জন করে ফেলে। সহানুভূতির শ্রেষ্ঠত্বের সম্ভ্রমে ইডিপাস সকল মানুষের হয়ে ওঠে। সকলকে গ্রহণ করে। ভূগোল বা অঞ্চল পেরিয়ে সে অধিকতর হয়ে ওঠে। গোটা বিশ্বেও হয়। তখন এটি কার অনুবাদ, কে মূল লেখক, কোন অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে সে গড়ে উঠেছে- এসব আর থাকে না। ইডিপাস আমাদেরই হয়ে যায়। গ্রীস দেশের নিয়তি আমাদের নিয়তির সাথে যেন বাধা পড়ে। গ্রীক সাহিত্য আমাদের সাহিত্যে রূপ নেয়। এ রূপান্তর কাউকে পৃথক করে না। এক করে। প্রসিদ্ধি অনুবাদকের কারণে। কখনো আনমনে তা হয়ে যায় সৈয়দ আলীর লেখা। মদ্যযুগের সেই কৃত্তিবাস ওঝার মতো। তাঁর অনূদিত মহাভারত সকলেই ধর্মগ্রন্থ মনে করে। অথচ, কৃত্তিবাম কবি, কবির গুণে কাব্য গুণান্বিত। মহাভারতও তাই। অনুবাদ যেন বড় কবির হাতে কোথায় চলে গেছে। কাশিদাসী মহাভারত দেখলেও তা মনে হয়। সেই সফোক্লিস হারিয়ে যান যেন। আড়ালে চাপা পড়ে যায় সব। তবে অনুবাদের পার্থক্য বা মূলানুগ নির্ভরতা অনেকটা বোধ ও বুদ্ধির ওপরও নির্ভর করে। সেখানে শিশির কুমার দাশ, সৈয়দ আলী আহসান বা সফোক্লিস কে কতোটা কাছাকাছি তা গুরুত্বশীল নয়। তখন লেখকের মৃত্যু বা অনুবাদকের মৃত্যু এসব মনেও থাকে না। কে কতোটা কাছাকাছি তাও ভুলে যায়। তবে আবার বিপরীত ঘটনাও ঘটে। পাঠকের কাছে তা দণ্ডিতও হয়, পাঠ-মূল্যবোধের নিরিখে। ম্যাকবেথ, ইলিয়াড, মেঘদূত এমন তাবৎ ক্লাসিক সাহিত্য এরকম বোধের আওতায় আসে। সাহিত্য পড়তে গেলে অনুবাদ প্রয়োজন, বিকল্পও নেই কিন্তু তা কতোটা মূলানুগ সেটি গুরুত্বহীন হয় না। নইলে মূল রচনা, অনুবাদকের বিশ্বাসঘাতকতায় যে বাধা পড়ে! জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বেশ আগে শেক্সপীয়রের সনেট অনুবাদ করেছেন। ইডিপাস গ্রিক থেকে ইংরেজি অতঃপর বাংলায় অনূদিত হয়েছে কিন্তু শেক্সপীয়রের সনেট ইংরেজি থেকে বাংলায়; তারপরও জিল্লুর রহমান ইংরেজির অধ্যাপক এবং বাংলা ভাষাতেও তিনি অদক্ষ নন ফলে শেক্সপীয়র বেশ কাছের ও বিশ্বস্ত রূপায়ণ বলা যায়, তাঁর কাছে। এ বিশ্বস্ততা আরও নির্ভরতা পায় কবির ছন্দার্থ সুচারুরূপে হওয়ার কারণে। সনেটের কাঠামো এতে দারুণভাবে রক্ষিত হয়েছে। তবে আবার ওই বোধের কাঠামো- যা মানুষে মানুষে ভিন্নতা আনবে, এক হবে না। হয় না। বোধও এক নয়। ফলে এসব মেনেই সনেট মোটামুটি শিরোধার্য, অন্তত সিদ্দিকীর অনুবাদে। এমন আরও অনেককিছুর উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু মূল কথা, অনুবাদকের নির্ধারিত পাঠ সম্পর্কে দায়িত্বশীলতা। কখনোবা এই দায়িত্বশীলতাকে ছাপিয়ে যায়, বাচ্যার্থ ও ব্যাঙ্গার্থের রূপ। তবে সেটি ভাষার রূপান্তরে সম্পূর্ণতার সামর্থ অর্জন করা সহজ নয়। কঠিন। সেটিও মানুষে মানুষে একরকম নয়। ভিন্ন ভিন্ন বা ভালো-মন্দের অভিপ্রায় দোষে দুষ্টও হতে পারে। তবে কয়েকটি ভাষার যোগ্যতা, শব্দার্থের অনুভব, বাক্যার্থের আসত্তি ও প্রকোপ ইত্যাদিও বিস্তররূপে অনুবাদককে স্মরণে রাখতে হয়। এ স্মরণযোগ্যতার পাদপীঠে ইতিহাস, ঐতিহ্যধারণাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন এলিয়টের ‘ফোর কোয়াট্রেটস’ অনুবাদ করলে জল-আগুন-বাতাস-পরিবেশ (মানুষ) সবটুকু সম্পর্কেরই সজাগ থাকতে হয়। এ সজাগত্ব শুধু ইতিহাস,পুরাণ, নৃজ্ঞান দৃষ্টি ধারণার অনুগামী হলেও ঠিকঠাক চলে না, সৃষ্টির দীক্ষাটি তাতে প্রয়োজন। এজন্য শিল্পীমনের কালোয়াতি বিচার্য। যোগ্যতারও স্তম্ভ বটে। এই যোগ্যতার আখরে অনুবাদ গ্রহণীয়তা পায়। শ্রেষ্ঠত্বও অর্জন করে।

এবার শেষে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ নিয়ে কিছু বলি। গীতাঞ্জলির অনুবাদ নিজেই করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ১০৩টি গানের অনুবাদ। যা ইয়েটসকে দিয়েছিলেন। পরে নোবেল একাডেমি একে বিবেচনায় নিয়েছিল। এ বিবেচনা কেমন? রবীন্দ্রনাথ তৃপ্তিকর অনুবাদ করেছিলেন। কারো শরণাপন্ন হননি। হয়তো অনুবাদ জটিলতার কারণেই। বা অনুবাদকের প্রতি অনাস্থাবশত। আর গীতাঞ্জলির মতো কাব্যের অনুবাদ সহজ নয়, সেটা রবীন্দ্রনাথ জানতেন। আমরা জানি, রবীন্দ্রসাহিত্যের অনেক দিক। এর যে অভিমুখ, তার শেষ নেই। এই অশেষ সাহিত্য-দিগন্ত নোবেল একাডেমি ছুঁয়েও দেখেনি। সে সময় বা অবস্থায়ও ওই সময় তাদের ছিল না। কিন্তু বিপরীতে মাত্র কিয়ৎ গীতাঞ্জলি তাদের মুগ্ধ করলো। এই মুগ্ধতা যে কতো ক্ষীণ-অংশমাত্র এবং পরিমাণে কতো অল্প তা ইউরোপীয়দেও তেমন বিবেচ্য হয়নি, অন্তত মাত্র ১০৩টি গানের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করার পরে। যাই হোক, তাতেই আশ্চর্য হতে হয়, কতো নিপুণ অনুবাদ ছিল ওই গীতাঞ্জলির। পরে অনুবাদ নিয়ে বেশ প্রবন্ধ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এবং নিজের কিছু অনুবাদের কাজও করেছেন। সবকিছু মিলে অনুবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের যে কনশাস্, তা অনস্বীকার্য। এবং অনুবাদ সম্পর্কে তিনি সৃষ্টিশীল ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন, সন্দেহ নেই। প্রসঙ্গত, যে কোনো বড় লেখকেরই তা করে থাকে। আজকে আমরা যখন পুশকিন, দস্তভস্কি, টলস্টয় পড়ি কিংবা মঞ্চে যখন মলিয়ের, ব্রেখট বা শেক্সপীয়র দেখি তখন যতো পার্থক্যই থাক, এর একটা স্বাদ আমাদের নিকট ধরা পড়ে। এই স্বাদ সকলের নিকট তৃপ্তিকর নাও হতে পারে কিন্তু তৃপ্তিশীলতার যে অভিমুখ রচিত হয় তা বস্তুত আমাদের সকলেরই জানা। আর এটাই তো সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। এই সমৃদ্ধি বাংলা ভাষার জন্য সমৃদ্ধিজ্ঞাপক অনেক কিছু বয়ে আনে, তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং অনুবাদ অবশ্যই হওয়া উচিত। অনুবাদের পাঠ একদম অমূলক তা বলা যাবে না। যুগে যুগে অনুবাদ আমাদের মাঝে নবতর দিক উন্মোচন করে চলেছে। আমাদের চিন্তা ও বুদ্ধিও পথ করেছে প্রশস্ত। ফলে অনুবাদ, গ্রহণীয় শিল্প-পদবাচ্য। তবে অনুবাদের ক্রাইম সম্পর্কে আগে বলেছি। এই ক্রাইমকে মেনে নেওয়া কঠিন। তা পাঠককে ধোকা দেয়। নিছক বাণিজ্যবৃত্তি ছাড়া আর কিছু জানে না। এ নিয়ে সাবধানতার প্রয়োজন রয়েছে। অনুবাদবিশ্ব প্রসারিত হোক, বিশুদ্ধ অনুবাদের জয় কামনা করি।

মন্তব্য: