‘আঙুলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রশস্ত নদী’: জর্জ সেফেরিস-এর কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

কুমার চক্রবর্তী

পৃথিবীর সব কবিতাই হয় ইলিয়াদ নয় অদিসি, এ বাক্যের দ্বারা আদি কবিতার মাহাত্ম্যকে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কবিতার ইতিহাস কোনো না কোনোভাবে এ দুটো মহাকাব্যে নিহিত আছে। কিন্তু এখানে তো মাত্র শুরু, গ্রিক নাটক, কাব্যতত্ত্ব, এমনকি দর্শন, সবকিছুই তো কবিতারই এক অপর অভিজ্ঞান রচনা করেছে যদিও আমরা কবিতা সম্পর্কে প্লাতোনের উক্তিকে ভুলে যাইনি। প্লাতোন সারাজীবন আপ্লুত ও অভিভূত ছিলেন কবিতায়, কিন্তু তিনিই বলে বসলেন কিনা কাব্য সত্য থেকে দূরে থাকে। তবে তিনি কবিতাকে গ্রহণ করতেও রাজি হয়েছিলেন যদি প্রমাণিত হয় যে কবিতা মানুষের মঙ্গল করে। তিনি তাঁর নগরনীতিতে বলেছিলেন, জন্ম থেকেই তিনি ভালোবাসেন হোমারকে, কারণ হোমার ট্র্যাজেডির সৌন্দর্যের প্রথম স্রষ্টা। যা-ই হোক, যদি বলা হয় গ্রিক সাহিত্য মূলত কাব্যসাহিত্য তবে অত্যুক্তি হয় না। কবিতাই গ্রিক সাহিত্যের দীপিত এলাকা। এটা বলা মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না যে গ্রিক ভাষায় উচ্চমানের গদ্যকার প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রিকদের নিকট কবিতাই ভাষা বা সাহিত্যের প্রধান মাধ্যম যা সমগ্র জাতির ভেতর প্রাণবান ও স্পন্দিত। কিন্তু গ্রিক সাহিত্যের এক নীরব দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম ছিল ধ্রুপদি গ্রিক ভাষার সাথে জনভাষার সংগ্রাম। আরও স্পষ্ট করে বললে ধ্রুপদি গ্রিক ভাষার অনুকরণে আদামানতিঅস কোরায়েস(১৭৪৮-১৮৫৭)-এর দ্বারা ধ্রুপদি আথেন্সের ভাষার পুননির্মাণে, তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাকরণ ও অন্বয়ের সাহায্যে যে কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষার জন্ম হলো কাথেরউঔসা নামে, তার সাথে জনভাষা ডেমোটিক গ্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ বা দেমোতিকে-র টানাপোড়েন এককথায় শুষে নিচ্ছিল বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের মুক্তমনা লেখকদের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি। এই সংগ্রামে শেষাবধি যদিও কবিতারই জয় হয়েছে তবু দীর্ঘসময় কবিতাকে এ-দুয়ের মাঝে অনিশ্চিতিতে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় থাকতে হয়েছে। শুদ্ধবাদীরা মনে করতেন  উঁচুদরের সাহিত্য করার জন্য দেমোতিকে অতি অভদ্র। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও দেখা যায় দেমোতিকে ধারার সাহিত্যের নজির গ্রিক ভাষায় ছিল: সম্ভবত এগারো শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত মহাকাব্য দিজেনিস আক্রিতাস (Digenis akritas) এই ভাষায় রচিত। একে জনপ্রিয় (আধুনিক গ্রিক) ভাষায় রচিত প্রথম রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  এছাড়াও ছিল লোকগান। তবে দেমোতিকের মধ্যে পুরোনো ভাষাকে মিশিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা  প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় বিখ্যাত কবি কাভাফির মধ্যে, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এই ধারার সমাপ্তি হয়ে যায়। দিজেনিস আক্রিতাস-এর পাশাপাশি ছিল ১৫৭০-১৬৬৭ সময়ে (১৬৬৯ সালে তুর্কিদের কাছে ক্রিতির পতন হয়) রচিত ক্রিতীয় সাহিত্য, বিশেষত এরোতোক্রতোস। ১৮৭০-১৮৮০ দশকে গ্রিক সাহিত্য ছিল মৃত, সেকেলে, রুদ্ধ, দাম্ভিকতাময় এবং পা-িত্যপূর্ণ। এটা ছিল ফাঁপা এক সময়। গ্রিকে রোমান্টিকতাও কোনো একটি মহৎ কীর্র্তি রেখে যেতে পারেনি। অনেকে ওই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে ইয়োআনিস কারাসাউতসাস (১৮২৪-৭৩)-এর কথা বলে থাকেন, কিন্তু তিনিও ছিলেন কষ্টকরভাবে কৃত্রিম, এবং  তাঁর বেদনাময় আত্মহত্যায় সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল এই প্রচেষ্টাও।

এই সময়ে লেখা দুটো ভালো উপন্যাস বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষার কারণে অনেকটা বাতিল হয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ ছিল কাথেরউঔসা ভাষার কৃত্রিম ব্যবহার। পাভলোস কাল্লিগাস (১৮১৪-১৮৯৬) ১৮৫৫ সালে লেখেন থানোস ভ্লেকাস নামের একটি সত্য উপন্যাস যা ছিল সাম্প্রতিক, অ্যান্টি-রোমান্টিক, তীক্ষ্ণ, ব্যাঙ্গাত্মক এবং যুগের  দুর্নীতি এবং অনিয়ম নিয়ে লেখা। কিন্তু ভাষার কারণে তা হয়ে দাঁড়ায় মৃত সন্তানের জন্মদানের মতো ব্যাপার, কারণ তা ছিল জমাটবদ্ধ। দোমেনিকে ভাষার উদ্দীপনায় লেখার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা ব্যর্থ হয় কৃত্রিমতার জন্য। এসময়ে একিলেস পারাসচোস(১৮৩৮-৯৫) দেমোতিকে ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেন। তবে সবচেয়ে বেশি এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় আয়োনীয় দ্বীপ থেকে আসা একদল কবিদের মধ্যে যাদেও অনেকেই আথেন্সে এসেছিল যখন ১৮৬৩ সালে দ্বীপগুলো  গ্রিসে যোগদান করে। এই ধারার কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন  দিয়োনোসিয়োস সোলোমোস (১৭৯৮-১৮৫৭) যিনি দেমোনিকে ভাষায় দেখার বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি প্রথমে ইতালীয় ভাষায় লিখতে শুরু করেন, তারপর গ্রিকে ফিরে আসেন। ১৮২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্য ডায়ালগ বা সংলাপ রচনাটি দেমোনিকে বিষয়ের উপর লেখা। এখানে তিনি বলেন যে জনভাষাকে পরিবর্তনের অধিকার কারও নেই। তাঁর প্রভাব ছাড়া বিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকের কবিতার উত্থান  ছিল অসম্ভব। তিনিই গ্রিক সাহিত্যের আধুনিকতার সূচনাকারী। তাঁর এপিগ্রামেটিক বা ছোটো শ্লেষাত্মক কবিতাগুলো ছিল প্রভাবসৃষ্টিকারী। এ সময়ের আরেকজন কবি ইয়ানিস সাইকারিস(১৮৫৪-১৯২৯) যিনি তার বদমেজাজ এবং ধ্বংসাত্মক প্রবণতার জন্য চিলেন আলোচিত। পার্নাসোস নামের প্রগতিশীল গোষ্ঠীর দ্বারা আয়োজিত এক নাট্য প্রতিযোগিতায় আমন্ত্রিত হয়ে দাখিলকৃত পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগীদের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, গ্রিসে কবিতা লেখা অসম্ভব। তাঁর রচনার নাম আমার ভ্রমণ যা ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর কাছে একিলেস পারাসচোস আর আরিসতোতল ভালাওরিতিস ছাড়া আর কেউ কবি ছিল না। দেমোতিকে ভাষায় লেখার প্রতি তাঁর ছিল দ্ব্যর্থহীন সমর্থন। তিনি বলেছিলেন, সবকিছুই, আগাপাশতলা, লিখতে হবে দেমোতিকে ভাষায়। তাঁর কাব্য মাই জার্নি-ও তারই নিদর্শন এবং তা পাঠধন্যও হয়। জনভাষায় লিখতে কবিদের কী সমস্যা তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেন, কারণ বিশুদ্ধ  কাথেরউঔসা কখনোই প্রয়োগসাধ্য নয়। অন্যদিকে দেমোতিকে-র সমস্যা ছিল অনিবার্য শব্দসম্ভারের অপ্রতুলতা, ফলে কবিদের নিজস্ব স্বরায়নের জন্য সে সময়ে অনেকে মিশ্র পদ্ধতির আশ্রয় নিতেন। ভাষার এই যুদ্ধ বহমান রইল। কৃত্রিম কাথেরউঔসার ভিত্তি ছিল কইনে(koiné) ভাষা যাতে প্রথম গ্রিক নিউ টেস্টামেন্ট  লেখা হয়। যারা ধ্রুপদি গ্রিক ভাষা জানে, তারাই তা পড়তে পারবে। কিন্তু অ্যাটিক থেকে এই যে প্রস্থান, তা নিয়ে ঘোরতোর আপত্তি ছিল। কোরায়েস এবং তাঁর সমর্থনকারীরা চাইলেন  কাথেরউঔসা নামীয় এমন এক সাহিত্যের ভাষার জন্ম দিতে যা হবে সোফোক্লেস-এর সাহিত্যের সমপর্যায়ের। কিন্তু তাঁরা বুঝতে চাইলেন না যে, সাহিত্যের ভাষা জনভাষার থেকে দূরত্বে থাকলে তা ব্যর্থ হয়। কোরায়েস গণতন্ত্রী ছিলেন , তিনি দেমোনিকে-র গুরুত্ব বুঝতেন, কিন্তু বুঝতেন না সাহিত্যের ভাষার আর জনভাষার সম্পর্কসূত্রটি, সাহিত্যের জন্য  কৃত্রিম ভাষার সৃষ্টি যে অবিশস্ততা তা বুঝতে পারলেন না। তিনি মনে করলেন, সাহিত্যের জনসম্পৃক্ততার ব্যাপরটি অপ্রয়োজনীয় বরং সাহিত্য হলো উচ্চাভিলাসী চিন্তাকে উপস্থাপনের জন্য। সোফোক্লেস এবং অন্যদের পাঠে তার ছিল বিভ্রান্তি, জীবনকে বোঝার প্রশ্নেও। দেমোতিকে উপভাষা, যা স্পষ্টতই ‘কইনে’ ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট, হলো বহির্মুখী, তা ব্যাপকভাবে ধারণ করতে পারে মানুষ ও চিন্তাকে যা কোনো কৃত্রিম ভাষার পক্ষে অসম্ভব। যা-ই হোক, দীর্ঘকাল ধরে গ্রিক কবিতায় ঘটেছে এ দুই ভাষার মিশেল যদিও দেমোনিকের প্রভাব ছিল বেশি। কোনায়েস ভাষার যে সাবেকীকরণ করেছিলেন তার অপরিপূর্ণতার দোষে  প্রাচীনপন্থিরা তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন আর তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রবর্তিত ভাষাকে করে তুলেছিলেন আরও বেশি দুর্জ্ঞেয় ও  পুরাগামী।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে গ্রিস তুরস্কের শাসনে চলে যায় যদিও গ্রিক গির্জা অনেকটা শক্তি ধরে রাখতে পেরেছিল, আর গ্রিস অভিজাততন্ত্র প্রশাসক শ্রেণি হিসেবে তার গুরুত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু ১৫৭০ সালে সাইপ্রাস এবং ক্রিতি ১৬৬৯ সালে তুর্কিদের অধীনে চলে যায় যা ছিল আসলে ভেনিসীয়দের। ১৬৮৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের অবনতিকাল, যখন  তুর্কিরা ভিয়েনা দখল করতে ব্যর্থ হলো, শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত গ্রিকরা কষ্ট ভোগ করতে লাগল। ১৮২৯ সালে কেবল এক গ্রিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পেল যা মূলত দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে গঠিত হলো। ১৮৬৩ সালে ব্রিটিশেরা আয়োনীয় দ্বীপগুলো হস্তান্তর করলে গিসের সীমানা বেড়ে গেল, ক্রিতি সরকারিভাবে পুনর্দখল হলো ১৯১৩ সালে। ১৯১৭ সাল থেকে গ্রিসের ইতিহাস ছিল জটিল। ১৯৪৬-৯ পর্যন্ত কমিউনিস্ট ও রয়ালিস্টদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয় যাতে কমিউনিস্টরা পরাজিত হয় অবশেষে।

১৮৮০ সালে রোয়দাস-এর প্রভাবে নিউ আথেনিয়ান স্কুল অব পোয়েট্রি প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কোস্টিস পালামাস( ১৮৫৯-১৯৪৩), জর্জ দ্রোসিনিস (১৮৫৯-১৯৫১) এবং জোয়ানিস পোলেমিস( ১৮৬২-১৯২৪)। তাঁরা সবাই কবিতার নতুন ভাষা বিনির্মাণে এবং জনভাষার গুরুত্ব অবধানে ভূমিকা রেখেছিলেন, তবে এঁদের মধ্যে পালামাস ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীনপন্থিদের সাথে তাঁর বিবাদ ছিল দৃষ্টান্তধর্মী। বাহ্যিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার সাথে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং পরাদৃষ্টিকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর কাজের মধ্যে আছে দেশের গান(১৮৮৬), কবর(১৮৯৮), একজন মানুষের মৃত্যু(১৮৯১),  নিত্য জীবন(১৯১৯) ইত্যাদি। পুনরুজ্জীবন ও পুনজন্মসংক্রান্ত অর্ফিক মতবাদে বিশ্বাসের কারণে তাঁর বেশ কিছু লেখা নষ্ট হয়ে যায়। ১৮৯৫-১৯০৩ সালের মধ্যে তিনি তাঁর ভালো লেখাগুলো লেখেন। তবে অনেকে তাঁকে ফাঁপানো গৌণ কবি বলে মনে করেন।

গ্রিক কবিতার ক্ষেত্রে  অবিস্মরণীয় যে নামটি তিনি কনস্তানতিন কাভাফি যিনি ১৮৬৩ সালের ২৯ এপ্রিল আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন সরকারি চাকুরে, ১৮৯২ সালে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে তিনি যে পদ পান এবং সেখানেই অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। একই সময়ে তিনি লেখালেখি করতে থাকেন, তাঁর প্রথম দিকের লেখালেখিতে গ্রিক ইতিহাস, পুরাণ, ধ্রুপদি ও হেলেনীয়,  বাইজানটীয় বিষয়বস্তুর প্রাধান্য ছিল। তিনি তাঁর মা হারিক্লেইয়া-র সাথে রাতের খাবার খেতেন আর তারপর অধিকাংশ সময়ে পালিয়ে শহরের সমকামী পল্লিতে ঢুকে যেতে। এই বিষয়টি তাঁর লেখাকে ঋদ্ধ করেছে। মানবকামের গূঢ়ৈষা তাঁর অভীপ্সিত  ছিল। আজীবন  ধুমপায়ী কাভাফি ফুসফুসের ক্যান্সারে ১৯৩২ সালে মারা যান। তাঁর সম্পর্কে  ই এম ফরস্টার বলেছিলেন:  ‘খড়ের টুপি মাথায় কিছুটা বাঁকা হয়ে একবারে স্থাণুবৎ  জগতে দাঁড়িয়ে থাকা এক গ্রিক ভদ্রলোক।’ কাভাফি ছিলেন একেবারে অনবদ্য এক আধুনিক। কাথেরউঔসাকে দেমোতিকের সাথে নিজের ইচ্ছামতো বিমিশ্রিত করেছেন। পুরোদস্তুর অভিজাত এবং শহুরে হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক জীবনের প্রতি তাঁর  এক গোপন ঘৃণা ছিল, ধ্রুপদি অতীতের প্রতি  ছিল তাঁর এক মোহ ও নস্টালজিয়া।  প্রাচীন বিশুদ্ধ ভাষা আর জনভাষাকে তিনি অতি শৈল্পিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর লেখায়। যেহেতু তাঁর স্বপ্নের জগৎ ছিল অতীতের জগৎ, তাই প্রাচীন ভাষার ব্যবহার তাঁর কবিতায় লক্ষ্যণীয় কিন্তু তা বোধগম্য এবং উপযোগীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। গোপনীয়তায় লেখালেখি করে গেছেন তিনি, চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর প্রতিভার আঁচ টের পাওয়া যায়নি। একান্ত ব্যক্তিগত সীমারেখায় তিনি কবিতা লিখে যেতেন, এবং ফরস্টার ও অল্পসংখ্যক তাঁর কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন। ১৯৩৫ সালের আগে তাঁর কবিতা প্রকাশ্যে বেরও হয়নি। তাঁর সমকামীবন্ধু  ফরস্টার ১৯২২ সালে তাঁর গাইড টু আলেকজান্দ্রিয়া বইয়ের মাধ্যমে তাঁকে সারাবিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেন যেখানে তাঁর কিছু কবিতার অনুবাদও ছিল। পেগানিজম এবং খ্রিস্টানত্বের সম্মিলন তাঁর লেখায় পরিলক্ষিত হয়। তাঁর প্রসিদ্ধ কাজগুলো হলো, ইথাকা, ওয়েটিং ফর দ্য বারবারিয়ানস, দ্য গড অ্যাবানডনস অ্যান্টনি। ‘শিল্পে এনেছি আমি’ কবিতায় তিনি বলেন:

বসে বসে ভাবছি। শিল্পে এনেছি আমি

অনুভূতি আর কাক্সক্ষাবোধ— আবছা আভাসিত কিছু

অবয়ব বা রেখা;  অপূর্ণ প্রেমের কিছু অনিশ্চিত স্মৃতিচিহ্ন।

একে আমি দিয়ে দিয়ে যাই।

তা জানে আকার নিতে মাধুর্যের রূপ;

প্রায় অগোচরে জীবন হয়ে চলে উথলিত,

একসাথে বিদ্ধ করে অভিব্যক্তি, একসাথে বিদ্ধ করে  দিনরাশি।

সপ্তম শতাব্দীর এক কবির বিষণœতার ভেতর থেকে তিনি লেখেন যিনি তাঁর যুগ এবং ধূসর সৌন্দর্যের সাথে একাত্ম হতে পারেন না: হে কাব্যশিল্প, আমি তোমার কাছে ফিরে আসি/ যেহেতু তোমার আছে নিদানের একধরনের জ্ঞান:/ ভাষা আর কল্পনার সুনিশ্চিত নিদ্রাবটিকা।

কাভাফির মতো না হলেও আঙ্গেলোস সিকেলিয়ানোস( ১৮৮৪-১৯৫১) অন্যতম প্রধান কবি যিনি মহাকাব্যের ধরনে বর্ননাত্মক কবিতা লেখার চেষ্টা চালান। তাঁর আরেকটি বিশেষত্ব হলো তিনি প্রাচীন দেলফিক উৎসবকে(১৯২৭-৩০) পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা চালান। দ্য ভিজানারি(১৯০৯), প্রোলোগ টু গড(১৯১৫-৪৭), মাদার অব গড(১৯১৭-১৯১৯) বিখ্যাত কাব্য। এ সময়ের আরও দু-একজন কবি আছেন যারা গ্রিক কবিতার বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন, যেমন কোসতাস ভারনালিস(১৮৮৩-১৯৭৪), জর্জ থেলেমিস (১৯০০-১৯৭৬) প্রমুখ। জর্জ থেলেমিসের কাছে কবিতা ছিল ‘আত্মজ্ঞানের এক পদ্ধতি’, তিনি অন্তর্গত প্রতিস্বের ইতিহাসকে জাগতিক ভ্রমণের দিকে সঞ্চারিত করেছিলেন যা তাঁকে আভভাসিক কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

কোনো কবি তাঁর একক অর্থে কোনো অর্থ বহন করতে পারেন না, তাঁর অর্থময়তা বা তাৎপর্য পূর্বসুরিদের কাজের পরিপ্রেক্ষিতে মিলিয়ে দেখতে হয়, মহৎ ঐতিহ্যের কাছে কবিকে সমর্পিত হতেই হয়, বলেছেন এলিঅট। গ্রিক ও আধুনিক ইয়োরোপীয় কবিতার প্রেক্ষাপট এবং কাব্যানুসৃতির ভেতর থেকেই আত্মপ্রকাশ করেছেন এলিঅটের অনুরাগী এবং অনুসারী জর্জ সেফেরিস।

দুই.

I regret having let a broad river slip through my fingers

Without drinking  a single drop.

Now I’m sinking into the stone.

A small pine tree in the red soil

Is all the company I have.

Whatever  I loved vanished with the houses

That were new last summer

And crumbled in the winds of autumn.

[এক বিন্দু জল পান না করেও

আঙুলের ভেতর দিয়ে যে প্রশস্ত নদীকে ঢুকিয়ে দিয়েছি

কষ্ট হয় তার জন্য আজ।

তলিয়ে  যাচ্ছি পাথরের গহিনে।

লাল মাটির ওপর দাঁড়ানো ছোট্ট  পাইন গাছটিই 

বলতে গেলে আমার সঙ্গী এখন।

যা কিছুই ভালোবেসেছি সব বিলীন হয়ে গেল সেই  বাড়িগুলোর মতো

গত গ্রীষ্মে যা ছিল নতুন

আর  শরতের ঝড়ে হলো ছিন্নভিন্ন।]

[ পুরাণেতিহাস: ১৮-সংখ্যক কবিতা]

জর্জ সেফেরিসের কবিতায় তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দ্বিধা, দেশের অবস্থা নিয়ে তাঁর  ভয় এবং ভীতি, নির্বাসন, হারানো, বঞ্চনা এবং অর্জন চিত্রকল্পে এবং অবয়বে এমন সূক্ষ্মভাবে  রূপান্তরিত যে যাকে বলা যায় তার ‘অবজেক্টিভ কোরেলেটিভ’  যা শুধু স্থূল জৈবনিক তথ্যাদি ছাড়া অন্যভাবে তাঁর প্রতিস্ব থেকে আলাদা করা যায় না। হয়তো এসবকিছুই তাঁর ঐতিহাসিক পারসোনা।  অভিজ্ঞতা ও নন্দন তাঁর কবিতায় এমনভাবে সন্ধি করে যে নৈর্ব্যক্তিকতা কোনো  শৈল্পিক পদ্ধতি নয় বরং এক বিশ্বাস যেখানে সমগ্র সবসময়ই আংশিক থেকে বড়ো আর ব্যক্তিক সচেতনতা তার আধেয়  থেকে কমই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বসাহিত্যের সাথে তাঁর কবিতা যেভাবেই সম্পর্কায়িত হোক  না কেন, জর্জ সেফেরিস আধুনিক গ্রিক সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, তাঁর  শ্রেষ্ঠত্ব গুণবাচক কেননা তা আধুনিক গ্রিক কবিতাকে নতুন আভিমুখ্য দিয়েছে , দিয়েছে আধুনিকের নতুন আত্মস্বর। তাঁর কবিতা গভীরভাবে প্রোথিত  রয়েছে স্মরণীয় গ্রিক  ঐতিহ্যে, ও ভাষায়। এর মানে হলো, তা শুধু গত দেড়শ বছরের আধুনিক গ্রিক কবিতার যে পুনর্জাগরণ তাতেই পরিতৃপ্ত থাকেনি, বরং এগিয়ে গেছে আরও আরও এদিক-ওদিক, তাৎপর্যপূর্ণ কালসূত্র নির্মাণে; পূর্বের উৎসগুলোকেও সাঙ্গীকৃত করেছে নতুন বিভাবে, এবং প্রতীকিতায়।  বিখ্যাত আধুনিক গ্রিক কবি সলোমোস, কালভোস, পালামাস, সিকেলিয়ানোস, কাভাফি, ইলাইতিস, ও রিতসোসদের কবিতার পাশাপাশি তিনি সৃষ্টি করেছেন অন্য এক জগৎ যা স্বতন্ত্র, দ্যুতিমান ও নিজস্ব নাদে অনুপম। প্রাচীন ও আধুনিক জগৎ তাঁর কবিতায় এক অভিন্ন রূপকে পরিণত হয়ে যায়। জাতির ভূ-প্রকৃতি, তার ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক অতীত তাঁর কবিতায় অসাধারণভাবে আত্মস্থ, এবং উন্মেষিত। যদি কলা হয় প্রাচীন গ্রিক কবিতার নতুন এক পুনরুত্থানের সূচনা ঘটে এই কবির হাতে, তাহলে তা হবে না অতিশাব্দিক  অতিশয়োক্তি। গ্রিক কবিতার আদি উৎসের অন্যতম ধারা হলো বালাদ এবং লোকসংগীত; এর প্রভাবশালী আঙ্গিক হলো দেকাপেনতাসিলাভোস (dekapentasyllavos) যা হলো পনেরো সিল্যেব্লের এক পঙ্ক্তি যার আট সিল্যেব্লের পর একটি বিরাম আর ছয় বা আট সিল্যেব্ল ও চোদ্দো সিলেবলের পর একটি করে শ্বাসাঘাত। এই আঙ্গিকই বাইজানটীয় সময় থেকে কিছুটা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে আজও গ্রিক কবিতায় অনুসৃত। সেফেরিসের প্রথম দিককার কবিতা, ‘এরোতিকোস লোগোস’, এই পরিবর্তনের এক অমোঘ উদাহরণ যেখানে সমসাময়িক সংবেদনকে ধরার জন্য দেকাপেনতাসিলাভস পঙ্ক্তির সার্থক ব্যবহার  হয়েছে। আরও একটি ধারার প্রভাব উন্নত  গ্রিক কবিতায় দেখা যায় যার উৎপত্তি হয়েছিল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দে ক্রিতি দ্বীপে। ক্রিতির নাট্যসাহিত্যের মধ্যে ছিল ধর্মীয়  নাটক আব্রাহামস সেক্রিফাইস আর ইরোফিলে যেখানে প্রধান সব চরিত্র একে অপরকে অথবা নিজেকে হত্যা করে। কিন্তু এই ধারার প্রধান কাজ হলো ভিৎজেনতোস কোরনারোস লিখিত ১০০৫২ পদ্যের কাহিনিমহাকাব্য এরোতোক্রিতোস যাতে রাজা আথেন্স-এর কন্যা আরেতোউসা আর সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে এরোতোক্রিতোস-এর প্রেমকাহিনিই উপজীব্য। এই মহাকাব্যটি গ্রিকবিশ্বে এমনই জনপ্রিয় হয়েছিল যে কখনও কখনও সাধারণ মহাকাব্যের ধরনে একে মুখস্থ আবৃত্তি করা হতো। এই ধরনের আবৃত্তি সেফেরিসের ব্যক্তিত্বকে কীভাবে তাড়িত করেছিল, তাঁর  প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়।  ‘এক বিদেশি কবিতার পঙ্ক্তিভাবনা’ কবিতায় তিনি বলেন:

আমার শৈশবের দেখা কিছু অভিজ্ঞ নাবিকের দল

যখন শীত আসছে হাওয়ায় হাওয়ায় তখন জালের ওপর ঝুঁকে

অশ্রুসজল চোখে আবৃত্তি করত এরোতোক্রিতোস;

মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে

আরেতৌসার যে দুর্ভাগ্য ঘটে তার কথা ভেবে ভেবে 

আমি ঘুমের মধ্যে শিউরে উঠতাম।

এরোতোক্রিতস-এর ওপরে সেরা সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখেন সেফেরিস যা তাঁর প্রবন্ধাবলি, আথেন্স, ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত। এর প্রভাবেই আধুনিক গ্রিক ভাষা, যাকে বলা হয় ডেমোটিক গ্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ বা দেমোতিকে বা জনভাষা, তার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়, তা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, এবং এর স্পষ্ট প্রমাণ সেফেরিসের ‘এরোতিকোস রোগোস’ নামীয় সিরিজ কবিতা। এখানে বলা দরকার, বিংশ শতাব্দীর আগে এই জনভাষা সাধারণভাবে গৃহীত হয়নি, তখন ছিল বিশুদ্ধ গ্রিক ভাষা যা কাথেরউঔসা (katharevousa)) নামে পরিচিত যার প্রতিষ্ঠাতা আদামানতিঅস কোরায়েস নামের এক ভাষাতাত্ত্বিক। সেফেরিস তাঁর ‘এরোতিকোস রোগোস’ কবিতায় পুরাণ থেকে গৃহীত বাগ্ধারাকে এমনভাবে  কবিতায় ব্যবহার করলেন যাতে একই সাথে তাঁর নিজস্ব রচনাভঙ্গি এবং প্রাচীন সাহিত্যের প্রাসঙ্গিক মুহূর্তের সাদৃশ্য বোধগম্য হয়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর ক্রিতীয়  সাহিত্য   এবং লোকঐতিহ্যই, বিশেষত  গ্রিক ভাষার তাদের সৃষ্টিশীল কার্যকারিতার বিবেচনায়, সেফেরিসের লেখার প্রধান স্থানিক উৎস।

তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, চরিত্র, চিত্রকল্প এবং  প্রাচীন গ্রিসীয় পুরাণের পুননির্মাণের বিবেচনায় সেফেরিস ও তাঁর পূর্বসূরিদের রচনা এ সমস্ত কবিতা থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে আলাদা। যেমন পালামাস যখন তুলনা করেন ‘পবিত্র স্মরণীয় মানুষেরা’ যারা মন্দির, জলপাইকুঞ্জ আর অ্যাটিক ভূপ্রকৃতির ভেতর শাসন করত, তাদের সাথে সাদা ফুলের ওপর শোঁয়োপোকার মন্থর  হামাগুড়ির মতো আধুনিক মানুষদের, তখন নতুন তাৎপর্যের পৃথক্করণের দিকটি ফুটে ওঠে যা আসলে রয়েছে শিকড়বদ্ধ ঐতিহ্যে। এই সুবিধা অন্যান্য আধুনিক কবিদের মতোই সেফেরিসেরও শক্তির উৎস, এবং ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার কবিদের থেকে গ্রিসের আধুনিকেরা এখানে খানিকটা এগিয়েও। এভাবেই প্রাচীনতার স্মৃতিসমুদ্রকে নিয়ে আধুনিক এক লেখক স্পর্শধন্য হন স্বকিয়তাকে শিরোধার্য করে। সেফেরিস এই পুরোনো আধেয়কে নিয়ে নতুন এক প্রকাশভঙ্গিকে উপস্থাপন করেন যা তাঁকে  স্বতন্ত্র হিসেবে চিনিয়ে দেয়। তিনি পুরাণের দিকে পাঠককে  দৃষ্টিবদ্ধ করার আগে এক কাব্যিক অভিমুখ ঠিক করে নেন যা   বাস্তব এবং সমসাময়িক এবং আধুনিক। এভাবে জীবনে আসে পুরাণ যথাযথভাবে, প্রাচীন ও আধুনিক জগৎ কোনোরকম অসতর্ক সংঘর্ষ বা অহেতুক সমস্যা সৃষ্টি করা ছাড়াই এক অভিন্ন রূপকে মিলেমিশে যায়। কালবিপর্যয় বা ধহধপযৎড়হরংস এখানে ঘটে না, যা একসময় ছিল তা আজও আছে, যা এখন আছে তা একসময়ও ছিল। আধুনিক ওদুসসেউসের ভ্রমণ থেকে  পেয়ে যান এমনকিছু যা  তাকে একই অভিজ্ঞতায় অন্বয়বদ্ধ করে: পরিত্যক্ত, স্থানচ্যুত, নীরস, পুনরাবৃত্তিময়। এভাবেই ওদুসসেউসের দীর্ঘ ভ্রমণ এবং দুর্ভাগ্য এক প্রতীকী ব্যঞ্জনা ও উপস্থাপনায় আধুনিক মানুষকে সামীপ্য করে। সেফেরিসের পুনঃপুন উল্লিখিত প্রকাশিত সমুদ্র  যেন ওদুসসেউসের নিরাশাময় সমুদ্র-দুর্বিপাককেই প্রতিভাসিত করে। ভ্রামণিকের উদ্দেশ্য বন্দরে ফেরা যেখানে সে পাবে চিরন্তন আনন্দ ও আশ্রয়, কিন্তু ওদুসসেউসের মতো আধুনিক জীবনও বঞ্চিত এই আশ্রয় থেকে। কবিতায় পৌরাণিক চরিত্রের এই ভূমিকা বিষয়ে বলতে গিয়ে সেফেরিস ‘লেটার অন থ্রাশ’-এ তাই বলেন:  পরিব্রাজনে এবং যুদ্ধে অসমঞ্জস মানুষ, যদিও মহত্ত্বে ও মূল্যবোধের বিচারে তারা ভিন্ন…একই দানো আর আকাক্সক্ষায় সর্বদা ঘুরপাক খাচ্ছে। সুতরাং পুরাণ যেসব চরিত্র আর প্রতীক আমাদের কাছে হাজির করেছে তাতে আমরা বিশ্বস্ত থাকি এই উপলব্ধি করে যে, আমাদের সময়ের চলিষ্ণুতা আর জগতের বিভিন্ন অবস্থায় এসব প্রতিভূস্থানীয় চরিত্ররা বদলে গেছে —যা আসলে ব্যক্তির প্রকাশের অন্বেষণ ছাড়া  কিছুই না। এজন্যই প্রাচীন পুরাণ তাঁর কবিতায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ  তা  প্রতীকায়নের এক ভিন্ন শক্তি জোগায়।  কিন্তু এটা ভাবা অপ্রতুল এবং অযথার্থ হবে যে সেফেরিসের কবিতা শুধু পুরাণের উদ্ভাস বা রূপান্তরও নয়, বরং তা আসলে গ্রিক ঐতিহ্যের সবকটি বিষয়  নিয়েই  পুননির্মিত। হোমার থেকে সমসাময়িক  গ্রিক কবিতার যে বিবর্তনান্তিক প্রবহণ, তা-ই কখনও উচ্চগ্রামে কখনও বা অধঃস্থতায় তাঁর কবিতায় ধারিত যা হয়তো গ্রিক না-জানা পাঠকদের নিকট কিছুটা অপরিবাহিত থেকে যেতে পারে। বোধ হয় সব কবিতার অনুবাদনিয়তিই এরকম। 

কবিতায় সেফেরিসের মেজাজ বা প্রতিস্ব বা বিশিষ্টতা বা সংবেদনশীলতা, তাঁর কথায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর অ্যাংলো-আমেরিকান এবং ইয়োরোপীয় কাব্য দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর  ভাবাদর্শে  গ্রিকীয়  স্বকীয়তায়  উপস্থাপিত, কিন্তু এই গ্রিক  ঐতিহ্যের বাইরে বেশ কজন কবির দ্বারা উন্মেষপর্বে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর লেখার বিকাশসময়ের প্রস্বর এবং শৈলীর পরীক্ষানিরীক্ষায়  সমসাময়িক ফরাসি কবিদের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য: বিশুদ্ধ কবিতা লেখার যে প্রচেষ্টা তাঁর মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল, তা ভালেরির অ্যাবসলিউট পোয়েট্রির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৩৫ সালে যখন তাঁর মিথিসতোরেমা বা পুরাণেতিহাস কাব্য প্রকাশিত হয়, তখন একটি ভিন্ন লেখনভঙ্গি চোখে পড়ে যায়, যা তিরিশের দশকের প্রথম দিকের পাউন্ড ও এলিয়টের কবিতার গভীর অনুধ্যানকে মনে করিয়ে দেয় এবং একইসাথে তাঁর নিজ প্রতিস্বের উদ্ভাসনকেও প্রতিফলিত করে যা প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল ১৯৩২ সালে প্রকাশিত কাব্য চৌবাচ্চা বা  দ্য সিসটার্ন থেকে, যেখানে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের এক শুদ্ধতার ছাপ দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠে। কিন্তু পুরাণেতিহাস বা  মিথিসতোরেমায় প্রথমবারের মতো তাঁর কাব্যভাষা বাঁক নেয় যা পরবর্তী সময়ে তাঁর সামগ্রিক কাব্যচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়ী হয়ে যায়। এই কাব্যে তিনি তাঁর আগেকার কবিতার গতানুগতিক ধরনকে ত্যাগ করে  অধিকতর মুক্ত এবং প্রাকৃতিক ভঙ্গির এবং গভীরতার এক রীতিকে আবিষ্কার করেন যা ভবিষ্যতে রচিত সকল পরিপক্ব কবিতার ক্ষেত্রেই বজায় থাকে। এই রীতিতে রয়েছে  যথাযথ  নিয়ন্ত্রিত এক শৈলী  যা অলংকারহীনতায় সুসজ্জিত এবং ছড়ানো-ছিটানো চিত্রকল্পে উদ্দীপিত। এই ধরনের পরিপক্ব কবিতায় সেফেরিস প্রথাগত আঙ্গিক ও ছন্দোস্পন্দের আধারে দৈনন্দিনতার বাচনকে উপস্থাপন করেছেন যা একাধারে নিবিড়তা ও বাক্সংযমে অনন্য, যাকে ইংরেজিতে পুরোপুরি আনা অসম্ভব, শুধু কৃত্রিমভাবে অনুকরণই করা যায় মাত্র। তাঁর কবিতার রচনাশৈলীর যে সুপ্রকাশ, তার মধ্যে বিদেশি উৎসের অনুসন্ধান করলে সহজেই বোঝা যাবে যে কবিতার মর্ম শুরু থেকেই দুর্মরভাবে  ব্যক্তিক। প্রতিটি অসাধারণ কবিতাই, যা ন্যূনতম পৌরাণিকতা বা ধ্রুপদিয়ানার কারণে পাশ্চাত্যের কাছে কিছুমাত্রায় অনধিগম্য, জীবনের মর্মন্তুদ সংবেদনশীলতায় ঋদ্ধ যা বস্তুত ইতিহাসের ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে সরাসরি আবির্ভূত, আসলে যা মানবীয় ভোগান্তির সাথে কবির প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা বা নিবিড় অবলোকনেরই উৎসারণ। তাঁর সত্তার কাব্যিক নির্বাসন এবং শৈশবের জন্মভূমি থেকে ১৯২২ সালে তুরস্কের কামাল পাশার সেনাবাহিনীর কাছে গ্রিকদের পরাজয়ের ভেতর দিয়ে যে প্রকৃত শারীরিক  নির্বাসন এবং কূটনৈতিক হিসেবে গ্রিস থেকে যে বাহ্যিক নির্বাসন, তা তাঁর কবিতাকে এক ধরনের রূপকাত্মক তাৎপর্য জুগিয়েছে।  ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা অন্তর্র্দৃষ্টিকে রূপকে পরিণত করার মাধ্যমে তিনি কবিতাকে ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় সিক্ত করেন যা তাঁর কবিতাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে এবং আমাদের সময়ের বলে মনে করিয়ে দেয়। এর উদাহরণ পাওয়া যাবে ‘বিবরণ’ কবিতায় সেই ‘প্রদর্শনীয় এবং প্রশান্ত মানুষটি’ যে  ‘কেঁদে কেঁদে হেঁটে বেড়ায়’ এবং ‘এক সীমাহীন ব্যথার যন্ত্রপাতি যা অবশেষে তার সকল তাৎপর্য হারায়’, অথবা ‘আমাদের সূর্য’ কবিতার সেই ‘নোংরা আর শ্বাসরোধী বার্তাবাহক’ যে আসে মুখ দিয়ে  ‘আমাদের সময় নাই’ এই বৌদ্ধিক কথা বলে মরে যেতে, বা ‘শেষ দিন’ কবিতার যুগল যারা  আলো জ্বালানোর জন্য ঘরে ফেরে কেননা গোধূলিতে হাঁটতে হাঁটতে তারা অসুস্থ হয়ে যায়। এ সকল কবিতাই  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে বা পরে লেখা হয়। এসবই রূপক যা ব্যক্তিক বা স্থানিক ইতিহাসের বাইরে সেফেরিসের পরাদৃষ্টিকে তুলে ধরে যা তাঁর সমসাময়িক ইয়োরোপীয় বা আমেরিকান সেরা কবিদের মতোই সুনির্দিষ্ট ও সর্বজনীন মনশ্চক্ষুর চিত্রকল্পকে ধারণ করে রাখে। কখনও কখনও  ব্যক্তিগত বা স্থানিক তাৎপর্যম-িত কোনো সাধারণ ঘটনা বা বিষয়, মানবিক অভিজ্ঞতার এক সরল প্রতিবেদন যা সত্য হিসেবে তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত হয়। এইসব প্রতিবেদন বা ডিসকোর্স কবির রূপকোদ্ভাসিত ভাবাভাস অপেক্ষা সরাসরি এবং কখনও বা অধিক যথাযথ। যেমন  ‘শেষ স্টপ’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবক যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কবির গ্রিসে ফেরার প্রাক্কালে রচিত, বা ‘হেলেন’ কবিতাটির সমাপ্তি অংশ যা ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে সাইপ্রাসের গ-গোল থেকে রচিত,  এ ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে রচিত:

ক.

আমাদের শেষ বন্দরে এখানে গত সন্ধ্যায়

বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা

অতীত ঋণের মতো, কঞ্জুস এক মানুষের 

সিন্দুকে পড়ে থাকা মুদ্রার মতো,

এখন এসেছে ঋণ পরিশোধের সময়

তুমি শুনতে পাচ্ছো টাকা-পয়সার ঝনঝনানি, শব্দ করে

পড়ছে টেবিলে,

এই এট্রুসকান গাঁয়ে, সালেরনো সমুদ্রের পেছনে

আমাদের ফেরার বন্দরের পেছনে, শরতের ঝড়ঝাপটার পেছনে

চাঁদ উঠেছিল মেঘকে সরিয়ে আর পাহাড়ের ঢালুর দিকে

ঘরবাড়িগুলো হয়ে উঠল এনামেলের মতো ফকফকে সাদা

চাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ নীরবতা

বন্ধুর মতো নিস্তব্ধ চাঁদ।

খ. 

অশ্রুমান পাখি

সমুদ্রস্পর্শিত সাইপ্রাসে

আমাকে স্বদেশের কথা মনে করিয়ে দিতে নিজেকে ঢেলে দিলে তুমি

এই গল্প নিয়ে নোঙর পেতেছি আমি এখানে

তা-ই যদি সত্য হয় যে এটা গল্পই

যদি সত্য হয় যে কিছুতেই মানুষ

দেবতাদের প্রাচীন ছলনাগুলোকে মানবে না আর;

যদি সত্য হয়

ভবিষ্যতে আরেক তেইক্রোস

বা কোনো এক আইয়াকস বা প্রিয়াম বা হেকাবে

অথবা অন্য এক অজানা মানুষ যে দেখে

মৃতদেহভরা স্কামান্দার নদী

তাদের যেন এমন নিয়তি না হয়

কোনো লোক এসে যেন না বলে

এতটা ভোগান্তি

অতল অন্ধকারে জীবনের অপচয়রাশি

সবকিছু  শূন্যতার জন্য

এক হেলেনের জন্য।

এখানে দেখতে পাচ্ছি এক সর্বজনীন সংবেদনশীলতা যা তাঁর কবিতাকে, তাঁর ইতিহাসবোধকে জারিত করছে। তাঁর প্রতিভার আরেকটি দিক হলো, তিনি ব্যক্তিগত ইতিহাস ও পুরাণের ভেতর থেকে এক স্থানিক রাজনীতিকে সূত্রবদ্ধ করেন যা সাধারণী প্রতিবেদন এবং রূপকে পরিণত হয়ে ওঠে। দ্বীপগুলোর নষ্ট কড়িকাঠে তাঁর যে ওদেসীয় ভ্রমণ, তার সাথে কিছুটা হলেও মিল আছে ইয়েটসের বাইজানটিয়ামের উদ্দেশে যাত্রার বা এলিঅটের ঊষর মরুভূমির ভেতর দিয়ে যাত্রার।  ভাব বা বিষয়বস্তুর দিক থেকে তিনি যদিও একজন জাতীয়তাবাদী কবির পর্যায়ে পড়েন তবু তাঁর রাজনীতিবোধ সাধারণ জাতীয়তাবাদীর  সংকীর্ণ বোধে কোনোভাবেই আবদ্ধ নয় যদিও তাঁর কবিতা বা তাঁর পরাদৃষ্টি অতীত ইতিহাসবোধ, পুরাণ, সাহিত্য, ভূপ্রকৃতিকে প্রায়শই ধারণ করে  প্রতিভাসিত। তাঁর রাজনৈতিক বীক্ষণ  শুধু সমসাময়িক ইতিহাসকে নিয়ে দাঁনা বাঁধে না বরং সেখানে এক স্পর্শকাতর মনের অভিসঞ্চার লক্ষণীয় যা এসবকে নতুনভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত করে। নিজ প্রজন্মের অনেক কবির মতোই তিনি যদিও ঐতিহ্যে ছিলেন আস্থাশীল এবং প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে তাঁর জাতির  রাজনৈতিক ব্যাকুলতায় ছিলেন উদ্দীপিত, কিন্তু কবি হিসেবে তাঁর পূর্ববোধ ও পরিপৃক্তি নিহিত আছে এক বিশাল কাব্যিক রূপকল্পে যা অন্তর্গতের উন্মোচনের মাধ্যমে সর্বজনীন সত্যের অন্বেষণে মানবীয় অস্তিত্বের নতুন নিশানাকে তুলে ধরে।

সেফেরিসের ওপর প্রভাব ছিল পাউন্ড এবং এলিঅটের, অনেকে বলেও থাকেন যে এঁদের দ্বারা তিনি অতি-প্রভাবিত ছিলেন। এটা বলা সংগত যে আধুনিক ইঙ্গ-ইয়োরোপীয় কবিতার একজাতীয় অন্তরঙ্গ এবং সার্থক দেশীয়করণ তাঁর হাত দিয়ে ঘটে যা তাঁকে মৌলিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কাভাফির লেখনরীতিতেও তিনি প্রভাবিত ছিলেন বলে অনেকে মনে করে থাকেন। ‘দ্য ডেমন ফরনিকেশন’ কবিতাটি এর অন্যতম প্রমাণ। এটা কাভাফির দ্বারা প্রভাবিত কবিতা।  ১৯৪০ সালে প্রকাশিত কাব্য দ্য বুক অব এক্সারসাইজ বা অনুশীলনের খাতায় পাউন্ডের প্রভাব স্পষ্ট এবং মিস্টার স্ত্রাতিস থালাসসিনোস-এর যে প্রতিস্ব অঙ্কিত তা অতি উদ্ভূত। ‘কুরেনিয়া জেলায়’ কবিতাটি এলিঅটের কবিতা দ্বারা অনুকৃত। লকবুক-৩ কাব্যের ‘হেলেন’ কবিতায়ও রয়েছে এলিঅটের প্রতিধ্বনি যেখানে  পোড়োজমির শেষের স্পন্দন অনুভবিত:

আর আমার ভাই?

নাইটিংগেল নাইটিংগেল নাইটিংগেল 

দেবতা কী? কী নয় দেবতা? আর তাদের মাঝে কী পার্থক্য?

এভাবেই তিনি বিশ্লেষণধর্মী কবিতার জন্ম দেন। অনেকে তাঁকে অতি-উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেও মনে করতেন। এ বিষয়টির অনুপূরণ হিসেবে তিনি লেখেন অন দ্য গ্রিক স্টাইল বইটি যা গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলে বিবেচিত। অনেকে আবার তাঁকে উৎকর্ষ  লিখনভঙ্গির অনুপম লেখক বলেও মনে করেন। সেফেরিস মূলত গ্রিক সাহিত্যে  উত্তর-প্রতীকবাদী কবিতার আত্ম-চরিতার্থতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন এবং পেরেছেনও। তাঁর শৈলী নিবিড়, সংযমী এবং অতি-উল্লেখবহুল। তাঁর কবিতায় প্রচ্ছন্নতা এবং প্রকাশ এমনভাবে ব্যবহৃত  যা প্রকারান্তরে  নৈঃশব্দ্য ও বাচনে বহুগুণিত হয়ে ওঠে। শূন্যতা ও সৌন্দর্যের মাঝে আবর্তন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁর কবিতাকে আত্মপ্রতিকৃতির উন্মোচনে সহায়তা করে।

কুয়াশায় অস্পষ্ট অঙ্গার

গোলাপেরা ছিল হৃদয়ে প্রোথিত

আর প্রতিদিন সকালে

ছাই ঢেকে দিয়ে যেত তোমার মুখ।

এক গ্রীষ্মকাল আগে চলে গেলে তুমি 

সাইপ্রেসের ছায়ারাশি কুড়াতে।

১৯০০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি  স্মিরনায় স্তেলিয়োস ও দেসপো সেফেরিয়াদিস-এর ঔরষে জর্জ সেফেরিস জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি তাঁর পরিবারের সাথে স্মিরনা থেকে অ্যাথেন্সে চলে আসেন এবং এখানেই তিনি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ সমাপ্ত করেন। ১৯১৮-২৪ পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি প্যারিসে অবস্থান করেন এবং আইনে ডিগ্রি নেন। ১৯২৬ সালে তিনি গ্রিক পররাষ্ট্র-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চাকরি নেন। এর পর নানা দেশে তিনি তাঁর কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭-৬২ পর্যন্ত ছিলেন গ্রেট ব্রিটেনে রাষ্ট্রদূত। ১৯৬০ সালে তিনি সাম্মানিক ডক্টর অব লিটারেচারে ভূষিত হন। ১৯৬২ সালে পান ফয়েল পুরস্কার। ১৯৬২ সালে তিনি কূটনৈতিক চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত হন এবং আথেন্সে বসবাস করতে থাকেন।  ১৯৬৩ সালে  তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, তিনিই প্রথম গ্রিক যিনি এ পুরস্কার পান। ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর  তিনি মারা যান। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অসংখ্য মানুষের সমাগম হয় যা অবশেষে স্বৈরশাসক পাপাদোপাউলোস-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রূপ নেয়। উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালের ২০ মার্চ স্বৈরশাসক পাপাদোপাউলোসকে নিন্দা জানিয়ে তিনি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতাগ্রন্থগুলো হলো: Mythistorema, Gymnopaidia, Book of Exercises, Logbook-1, Logbook-11, Logbook-111, Turning Point, The Cistern, The Thrush

পুরাণেতিহাস

১.

দেবদূত–

তিনটি বছর অপেক্ষায় ছিলাম আমরা, স্থিরনিবদ্ধ ছিল দৃষ্টি,

আগপাশ দেখছিলাম

বেলাভূমি, নক্ষত্র আর পাইনের সারি।

লাঙলের ফলা বা জাহাজের পাটাতন সহযোগে

পাওয়ার জন্য আরও একবার অন্বেষণ করছিলাম সেই প্রথম বীজ

যেন আবারও শুরু হতে পারে সময়-প্রাচীন নাটক।

ফিরে এলাম আমরা আমাদের ভেঙে-পড়া গৃহে,

অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হয়ে পড়েছে অক্ষম, মুখ 

লবনজল আর ছত্রাকের আক্রমণে ফেঁটে চৌচির।

ঘুম থেকে ওঠে আমরা উত্তরের দিকে ভ্রমণে গেলাম, আগন্তুক

হাঁস যারা করেছিল আঘাত আমাদের

তাদের অনিন্দ্য ডানার ঝাপটায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম কুয়াশায়।

শীতের রাতে পুব থেকে আসা সজোর হাওয়া

আমাদের পাগল করে তুলেছিল,

আর গ্রীষ্মে আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম 

মরে-না-যাওয়া দিনগুলোর যন্ত্রণায়।

ফিরিয়ে এনেছিলাম আমরা

এক অখ্যাত শিল্পের উৎকীর্ণ নকশা।

২.

গুহার ভেতরে আরও একটি কুয়ো তখনও।

যে সব বন্ধুরা তখনও রয়ে গিয়েছিল আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত

তাদের খুশি করতে আমাদের জন্য সহজ ছিল 

পুতুল আর গয়নাগুলো তুলে আনা।

ছিঁড়ে গেছে দড়ি; কেবল কুয়োর ঠোটে লেগে থাকা দীর্ঘ খাঁজগুলো

মনে করিয়ে দিয়েছিল আমাদের  অতীতের সুখ:

প্রান্তবেষ্টনীর ওপর আঙুলগুলো, কবি যা বসিয়ে দেন।

আঙুলগুলো কিছুটা অনুভব করে পাথরটির শীতলতা,

তারপর তার ওপর বিরাজমান থাকে শরীরের ¯œায়বিক উত্তেজনা

আর গুহা বাজি ধরে তার আত্মাকে আর  হেরে বসে

প্রতিটি মুহূর্ত, নৈঃশব্দ্যে ভরতি, আর জলবিন্দুহীন। 

৩.

মনে রেখো ¯œানাগারের কথা যেখানে তুমি খুন হয়েছিলে

এই মর্মর মস্তক দুহাতে নিয়ে আমি জেগে উঠলাম;

কনুই দুটো শক্তিহীন হয়ে উঠল আর  জানি না  কোথায় রাখতে হবে তা।

যখন আমি বেরিয়ে আসছিলাম স্বপ্ন থেকে তখনই মাথাটি পড়ে গেল স্বপ্নে

অতএব জীবন হয়ে গেল অভিন্ন আর তাকে আলাদা করা হবে 

কঠিন এক কাজ।

দেখি চোখের দিকে: না-খোলা না-বন্ধ

বলতে চেষ্টারত মুখটির সাথে আমি বলি

ফেটে যাওয়া ত্বকের গালদুটো ধরে আমি  কথা বলি।

এ-ই পারলাম আমি।

হাতদুটো আমার অদৃশ্য  হয়ে যায় আর বিকলাঙ্গ হয়ে 

আমার দিকেই ফিরে আসে।

৪.

আর আত্মা 

যদি নিজেকে জানতে চায়

তবে অবশ্যই তাকে তার

নিজ আত্মার দিকে তাকাতে হবে:

আগন্তুক আর শত্রু, আয়নায় তাকে দেখেছি আমরা।

ভালো ছিল সঙ্গীরা, কাজকর্ম, তৃষ্ণা বা তুষারপাত নিয়ে

তাদের কোনো অনুযোগ ছিল না,

তাদের আচরণ ছিল বাতাস আর বৃষ্টির মতো

সকল পরিবর্তনের মাঝে অপরিবর্তিত থেকে

রাত এবং সূর্যকে গ্রহণ করে নেয়।

ভালো ছিল তারা, সমস্ত দিন

নিচু চোখে দাঁড় বেয়ে ঘাম ঝরিয়েছে তারা

তালে তালে দম ফেলে

আর তাদের রক্ত নিরীহ ত্বককে করে তুলল লালাভ।

কখনও কখনও তারা নিচু চোখে গান গেয়ে উঠত,

আর আমরা যেন বুনো ডুমুরভরতি দূরের দ্বীপের পাশ দিয়ে

চলেছি পশ্চিমে, ঘেউ ঘেউ করা কুকুরদের অন্তরীপ ছাড়িয়ে।

তারা বলেছিল, যদি সে নিজেকে জানতে চায়

তাহলে তাকে তাকাতে হবে তার নিজের আত্মার দিকে, তারা বলেছিল 

আর আর দাঁড়গুলো গিয়ে আঘাত করল সূর্যাস্তের সমুদ্রের সোনাকে।

অতীতে আমরা গিয়েছিলাম অসংখ্য দ্বীপ, অন্তরীপ আর সমুদ্র ছাড়িয়ে 

সমুদ্রে, গাঙচিল আর সিল মাছেদের দেশে।

কখনও কখনও অসুখী নারীরা সন্তান হারানোর বেদনায় কেঁদে উঠত

আর কেউবা উদ্বেল মনে তীব্রভাবে খুঁজে ফিরছে মহান আলেকজান্দার আর

এশিয়ার গভীরে সমাধিস্থ গৌরবগাথা।

রাত্রিসুবাসে পূর্ণ সমুদ্রতীরে নোঙর ফেলেছি আমরা,

গাইছে পাখিরা,  জল হাতে রেখে যায় বিশাল সুখের স্মৃতি।

কিন্তু শেষ হয় না যাত্রা।

দাঁড় আর দাঁড়ের বাঁধনের সাথে 

জাঁকজমকপূর্ণ জাহাজের অগ্রভাগের চেহারার সাথে

জাহাজের হালের জেগে ওঠার সাথে

তাদের প্রতিচ্ছবিকে বেঙে দেওয়া জলের সাথে

তাদের আত্মা হয়ে গেল একাকার।

একে একে  নিমিলিত চোখে মরে গেল সঙ্গীরা।

সমুদ্রতীরে যেখানে তারা ঘুমিয়ে আছে 

তাদের বৈঠাগুলো আজ স্মৃতিচিহ্নিত করে রেখেছে সেই স্থান।

কেউ তাদের স্মরণ করে না। ন্যার্যতা।

পপলারের পাতা

অতএব তা কেঁপে ওঠে, বাতাসে তা দূরে চলে যায়,

এটা কেঁপে ওঠে, বাতাস তাকে আর দূরে সরিয়ে না দিয়ে কী করে

অদূরে

সমুদ্র

অদূরে

সূর্যালোকিত  দ্বীপ

আর হাতে জাপটে ধরছে দাঁড়

সে-প্রকাশে দৃশ্যময় হয়ে উঠল বন্দর

মুদ্রিত হলো চোখ

উজ্জ্বল আর ফুলের মতো সামুদ্রিক প্রাণীদের দ্যাখে।

অতএব এটা কেঁপে ওঠে

আমিও তাকে চাই অতিমাত্র

ইউক্যালিপটাস গাছে ঘেরা জলাধার

সমস্ত অরণ্যেজুড়ে

বসন্ত আর শরৎ নগ্ন

হায় ঈশ্বর আমি যে তাকেই চাই।

মন্তব্য: