আত্মজীবনীমূলক সাহিত্য

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

ড. রাশিদ আসকারী

‘অটোবায়োগ্রাফি’ শব্দটি ড. উইলিয়াম টেইলর কর্তৃক ১৭৯৭ সালে ইংরেজি সাময়িকী The Monthly Review তে প্রথম ব্যবহৃত হলেও ‘আত্মজীবনী’ সাহিত্যরীতি হিসেবে বেশ পুরানো এবং প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল অব্দি এর ধারাবাহিক প্রচলন অব্যাহত রয়েছে। তবে টেইলর আত্মজীবনীকে একটি সঙ্কর শব্দ হিসেবে দাবি করে এই রচনারীতিকে ‘পা-িত্যাভিমানী’ বলে নিন্দে করেছেন। তাই আধুনিক অর্থে আত্মজীবনী ব্যবহারের কৃতিত্ব দেয়া যায় ইংরেজি রোমান্টিক ‘হ্রদ কবি’ রবার্ট সাউদিকে যিনি ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রাচীনকালে এ জাতীয় রচনা ‘অ্যাপলজিয়া’ অর্থাৎ ‘আত্মপক্ষ সমর্থক বাচন’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রোমক-ইহুদি ঐতিহাসিক ফ্লেভিয়াস জোসেফাস ৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আত্মজীবনী Josephi vita প্রকাশ করেন যা মূলত আত্মস্তুতি এবং গ্যালিলির দ্রোহী অধিনায়ক হিসেবে আত্মকর্ম সমর্থনের খতিয়ান। ৩৯৭ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সন্ত অগাস্টিন তাঁর আত্মজীবনী ‘কনফেশন্স’ প্রকাশ করেন, যা প্রথম পশ্চিমা আত্মজীবনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং মধ্যযুগের খ্রিস্টান লেখকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মুসলিম সমাজের প্রথম আত্মজীবনীমূলক রচনা ১১ শতকের শেষ পাদে গ্রানাডার শেষ জিরিদ রাজা আবদুল্লাহ ইবনে বুলুগিন কর্তৃক রচিত হয়। ১৪৯৩ থেকে ১৫২৯-এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবুর কর্তৃক রচিত ‘বাবুরনামা’ একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা। ১৫৫৬ থেকে ১৫৫৮-এর মধ্যে প্রখ্যাত রেনেসাঁ-ভাস্কর স্বর্ণকার বেনভেনুতো চিলিনি (১৫০০-১৫৭১) কর্তৃক রচিত আত্মজীবনীমূলক রচনা Vita রেনেসাঁ যুগের প্রথম আত্মজীবনী। চিলিনি কেবলমাত্র আত্মজীবনী লিখেই ক্ষান্ত থাকেননি এর স্বরূপ-প্রকৃতি এবং আত্মজীবনীকারের বয়স নিয়েও চমৎকার তত্ত্ব দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়:

No matter what sort he is, everyone who has to his credit what are or really seem great achievements, if he cares for truth and goodness, ought to write the story of his own life in his own hand;  but no one should venture on such a splendid undertaking before he is over forty.1 

চিলিনি প্রদত্ত আত্মজৈবনিক রচনার এই শর্তাবলি অদ্যাবধি আত্মজীবনীকারেরা মোটমুটি নিষ্ঠার সাথেই পালন করে আসছেন এবং অটোবায়োগ্রাফি অর্থাৎ পরিপূর্ণ জীবনকাহিনী এবং মেমোয়ার অর্থাৎ আংশিক স্মৃতিকথা হিসেবে দু ধরণের  আত্নজৈবনিক রচনা চর্চা করছেন। এই জাতীয় রচনা সাহিত্যে নন-ফিকশন ধারা হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উত্তরাধুনিক এ যুগে সাহিত্যের আধার ও আধেয় নিয়ে এন্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও আত্মজীবনীমূলক রচনা এতটুকু গুরুত্বও হারায়নি। আজও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের আত্মজীবনী, মার্ক টোয়েনের আত্মজীবনী, হেমিংওয়ের A Moveable feast, অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি, নেলসন ম্যান্ডেলার Long walk to freedom, মহাত্মাগান্ধীর My Experiment with Truth এমনকি হিটলারের Mein kampf  আমাদের প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। 

বাংলা সাহিত্যে আত্মকথা লেখার রেওয়াজ নেই বলে প্রমথ চৌধুরী তাঁর আত্মকথার ভূমিকায় ঘোষণা দিলেও এবং বঙ্কিম চ্যাটার্জির মতো বড় মাপের সাহিত্যিক আত্মজীবনী লেখায় হাত না দিলেও, ‘…উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুরু করে অতি আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলা ভাষা সাহিত্যচর্চায় উদ্যোগী বঙ্গদেশীয় প্রায় প্রত্যেক মনীষীই তাঁদের জীবনকাহিনী লিখে যেতে প্রয়াস পেয়েছেন। … কেউ হয়তো আত্মমানসের বিচিত্র বিবর্তনের উপর বেশী জোর দিয়েছেন। কেউ কর্মযোগী সামাজিক দৃষ্টি নিয়ে পরিচিত পরিবার ও পরিবেশের বিশদ চিত্র তাঁর সঙ্গে যুক্ত করেছেন।২ আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বাংলা একাডেমী ঢাকা ১ম সংস্করণ ১৯৮৪, পৃ.৮৮-৮৯ ডিসেম্বর] রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড়ো মাপের সাহিত্যিক পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী না লিখে জীবনস্মৃতি এবং ছেলেবেলা নামে দুটো মেমোয়ার লিখেই ক্ষান্ত থেকেছেন কেন সে ভাবনাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী না হলেও এই মেমোয়ার দুটোতে কিশোর রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালের যে মনোজ্ঞ চিত্র পাওয়া যায় তা যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক এবং পাঠকদের আত্মজীবনী পাঠের আনন্দ দিতে সক্ষম। ছেলেবেলার ভৃত্য-পরিবেষ্টিত কঠোর অনুশাসন এবং শৃঙ্খলানির্ভর জীবনও যে সরসভাবে উপস্থাপিত হতে পারে, তার প্রমাণ এই মেমোয়ার দুটি। রবীন্দ্রনাথ যদি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লিখতেন তবে তা বাঙালিদের কাছে যে প্রবলভাবে সমাদৃত হতো তাতে সন্দেহ নেই। 

বাংলা আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যে তিনটি ধরন লক্ষ্যণীয় – পারিবারিক-সামাজিক আত্মজীবনী, সাহিত্যিক আত্মজীবনী এবং রাজনৈতিক আত্মজীবনী। তবে আত্মজীবনীকারেরা নিজেদের লেখকী স্বাধীনতা বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময় শ্রেণিবিভাজনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেননি। যার ফলে একটি মিশ্র ধারা আত্মজৈবনিক সাহিত্য সর্বদা বিদ্যমান থেকেছে। 

বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী নিয়ে আসেন পাবনার রাসসুন্দরী দেবী (১৮১০-১৯০০)। শুধু বাংলার নয়, তাঁকে ভারতের প্রথম নারী আত্মজীবনীকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায়। তাঁর আত্মজীবনী আমার জীবন ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয়। বইটির চমৎকার ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রকাশভঙ্গির সরল মাধুর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। গ্রন্থটির ভূমিকায় তিনি লেখেন :

এ গ্রন্থখানি একজন রমণীর লেখা। শুধু তাহা নহে ৮৮ বছরের একজন বর্ষীয়সী প্রাচীনা রমণীর লেখা। তাই বিশেষ কৌতূহলী হইয়া আমি এই গ্রন্থপাঠে প্রবৃত্ত হই। মনে করিয়াছিলাম যেখানে কোন ভাল কথা পাইব সেইখানে পেন্সিলের দাগ দিব। পড়িতে পড়িতে দেখি পেন্সিলের দাগে গ্রন্থ-কলেবর ভরিয়া গেল। বস্তুত, ইহার জীবনের ঘটনাবলী এমন বিস্ময়জনক এবং ইহার লেখায় এমন এক সরল মাধুর্য আছে যে, গ্রন্থখানি পড়িতে বসিয়া শেষ না করিয়া থাকা যায় না।৩

প্রখ্যাত লেখক গবেষক লোকবিজ্ঞানী দীনেশ চন্দ্র সেন রাসসুন্দরীর গদ্যকে ‘বিগত যুগের সরল গদ্য রচনার প্রতীক’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।৪ গ্রন্থটির আরেক ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘এই জীবনখানি ব্যক্তিগত কথা বলিয়া উপেক্ষা করা চলে না। ইহা প্রাচীন হিন্দু রমণীর একটি খাঁটি নক্সা। যিনি নিজের কথা সরলভাবে কহিয়া থাকেন, তিনি অলক্ষিতে সামাজিক চিত্র অংকন করিয়া যান।’ তিনি আরও লিখেছেন : 

আমার জীবন পুস্তকখানি শুধু রাসসুন্দরীর কথা নহে, উহা সেকালের হিন্দু রমণীগণের সকলের কথা; এই চিত্রের মত যথাযথ ও অকপট মহিলা চিত্র আমাদের বাঙ্গালা সাহিত্যে আর নাই। এখন মনে হয়, এই পুস্তকখানি লিখিত না হইলে বাঙ্গালা সাহিত্যের একটি অধ্যায় অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইতো।৫ 

প্রথাপীড়িত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠা বাল্যবিবাহের নির্মম স্বীকার পালকি চড়ে শশুরবাড়িযাত্রী রাসসুন্দরী দেবীর মনস্তাপ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে: 

যখন দুর্গোৎসবে কি শ্যামা পূজায় পাঁঠা বলি দিতে লইয়া যায়, সে সময় পাঁঠা যেমন প্রাণের আশা ত্যাগ করিয়া হতজ্ঞান     হইয়া মা মা বলিয়া ডাকিতে থাকে আমার মনের ভাবও তখন ঠিক সেই প্রকার হইয়া ছিল। আমি আমার পরিবারগণকে না দেখিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া মা মা বলিয়া কাঁদিতে লাগলাম, আর মনের মধ্যে একান্ত মনে কেবল পরমেশ্বরকে ডাকিতে     লাগিলাম।৬ 

অপরিণত বয়সে সংসার জীবনে প্রবেশকে তিনি বন্দিদশা বলে অভিহিত করেন,‘লোকে আমাদ করিয়া পাখি পিঞ্জরে বন্ধ করিয়া রাখিয়া থাকে, আমার যেন সেই দশা ঘটিয়াছে। আমি ঐ পিঞ্জরে জন্মের মত বন্দী হইলাম, আমার জীবদ্দশাতে আর মুক্তি নাই।’৭ 

উনিশ শতকের শুরুতে বাঙালি নারীর মনোদৈহিক অবস্থার এক প্রামাণ্য দলিল রাসসুন্দরীর আত্মজীবনী। নারীবাদ, উত্তর নারীবাদ কিংবা গায়ত্রী স্পিভাকের কথা বলতে পারা-না-পারার তত্ত্বালোকে এই বর্ষীয়সী নারীর আত্মজীবনীর পুনর্পাঠ একটি জরুরি সাহিত্যসমালোচনার অনুষঙ্গ হতে পারে। তবে রাসসুন্দরী দাসীর সঙ্গে উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বিস্তৃত এই সময়-পরিসরের প্রতিষ্ঠিত লেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, নবীন সেন, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখের আত্মজীবনী বিশেষ গুরুত্ব আকর্ষণের দাবি রাখে এবং এই সময়কালকে ‘বাংলা ভাষায় আত্মজীবনী প্রকাশের সুবর্ণ যুগ বলা যেতে পারে।’৮ 

কালানুক্রমিক বিচারে বিদ্যাসাগর চরিত বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় আত্মচরিত হিসেবে পরিচিত হলেও শিল্পমূল্য বিবেচনায় : 

বাংলার সার্থক আত্মজীবনীমূলক রচনার সূচনা বিদ্যাসাগর থেকে। এমনকি এরকম মনে করাও অসঙ্গত হবে না যে, যদি বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ করে যেতে পারতেন, তাহলে হয়তো এই বইটি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী বলে ইতিহাসে স্থায়ী মর্যাদা লাভ করত।৯ 

যে বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যে পণ্ডিতি ধারার প্রধান লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, সেই বিদ্যাসাগরই আত্মজীবনী রচনায় একবারে ‘ইউ টানর্’ নিয়ে সরল-সাবলীল ধারা বেছে নিয়েছেন। আত্মচরিতের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- বিদ্যাসাগরের প্রগাঢ় ‘সেন্স অব হিউমার’ এবং সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি। এ দুইয়ের মিশেলে আধুনিক, প্রগতিশীল, সংস্কারবাদী এবং প্রচ- সৃষ্টিশীল বিদ্যাসাগর-মানস গঠনে ক্রিয়াশীল পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং প্রেরণার কথাই তিনি ‘দুর্লভ সরসতার সঙ্গে’১০ বর্ণনা করেছেন। প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম পৃষ্ঠায় সে হাস্যরসের প্রমাণ মেলে :

     জন্ম সময়ে পিতামহদেব পরিহাস করিয়া এঁড়ে বাছুর বলিয়াছিলেন, জ্যোতিষ শাস্ত্রের গণনা অনুসারে বৃষরাশিতে আমার জন্ম হইয়াছিল; আর, সময়ে সময়ে কার্য্য দ্বারাও, এঁড়ে গরুর পূর্বোক্ত (এক     গুঁইয়া) লক্ষণ, আমার আচরণে বিলক্ষণ আবির্ভূত হইত।১১ 

এভাবে সরস সৃষ্টিশীল বর্ণনায় তিনি তার অন্তর্গত মানস-প্রবণতার পরিচয় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তার নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এরকম এক বর্ণনা মেলে :

আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয় সে নির্দেশ অসঙ্গত নহে যে ব্যক্তি র্ইামনির স্নেহ, দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং ঐ সমস্ত সদ্গুণের     ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামার     ভূমণ্ডলে নাই।১২ 

আঙ্গিক, ভাষা ও ভাববস্তু বিচারে বিদ্যসাগরের আত্মচরিত অনন্য।

বিশ শতকের গোড়ার দিকের আত্মজীবনীসমূহের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনের বারো খণ্ডে প্রকাশিত আমার জীবনী (১৯০৮-১০) প্রণিধানযোগ্য। একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী রচনার পরিকল্পনা নিয়েই তিনি তাঁর আত্মজীবনী লেখায় হাত দেন। তাঁর ভাষায় :

    জীবনের আদি অন্ত ঘটনা শুনাইব। কম নহে, বাল্য জীবন হইতে গত ৬৫ বছরের ঘটনা শুনাইব। সঙ্গে সঙ্গে বর্ত্তমান সময়ের ঘটনাও, সময় সময় প্রকাশ করিব। হয়ত যেদিন আমার জীবনের শেষ অঙ্কের যবনিকা পতন হইবে, জীবনীর ইতিও সেদিন হইবে।১৩ 

স্মৃতি ও শ্রুতিনির্ভর মশাররফের আত্মজীবনী তাঁর পূর্বপুরুষদের কাহিনী বিশেষ করে তাঁর পিতামহের চিত্তাকর্ষক জীবনকাহিনী, তাঁর ছাত্রজীবনের আকর্ষণীয় বিবরণ এবং তাঁর মর্মস্পশী বিবাহিত জীবন পরম বিশ্বস্ততা এবং সুনিপুণ বয়ানে বিধৃত করেছে। এই আত্মজীবনীর প্রধান বৈশিষ্ট্য রচয়িতার সরল স্বীকারোক্তি এবং অকপট সত্যভাষণ। নিজের এবং পিতার চারিত্রিক স্খলনের বিবরণ তিনি দিয়েছেন এক অনুপম সাহসিকতায়। চরিত্রহীন পিতার অর্থ কর্জ করে পরনারীকে অলংকার কিনে দেবার কথা ফাঁস করে দিয়েছেন, এমনকি পিতৃ-অবহেলার কারণে যে তাঁর মাতার অকালমৃত্যু হয়েছে, সে-কথা জানাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। শুধু তাই নয়, আপন চরিত্রহীনতার কথাও তিনি অকপটে স্বীকার করেন, ‘দাসী-বান্দী কর্তৃকই আমার চরিত্র প্রথম কলঙ্ক-রেখায় কলুষিত হয়।’১৪ একজন বিশ্বস্ত আত্মজীবনীকার হিসেবে মশাররফের এই স্বীকারোক্তি তাঁকে লিও তলস্তয়ের উচ্চতায় নিয়ে যায়। তলস্তয়ও তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের পরিচারিকা-আসক্তির কথা স্বীকার করেছেন। তবে আপন চারিত্রিক স্খলনের কথা প্রকাশ করে মশাররফ তাঁর পাঠকদের সর্তক করার প্রয়াস পান। তাঁর ভাষায়: 

আমার জীবনে শত শত ত্রুটী, শত শত জাহেলী এবং অবিবেচনার কার্য্য হইয়াছে। তাহার ফলও হাতে     হাতে পাইয়াছি। সেই সকল বিষয় প্রকাশ হইলে ভবিষ্যতে একটি মানবসন্তানও যদি সাবধানে সতর্কে     জগতে চলিতে পারেন, তাহা হইলে আমার জীবন সার্থক ও সহস্র লাভ মনে করিব।১৫ 

মশাররফের আত্মজীবনী সম্পর্কে পাঠক-সমালোচকেরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছেন। ‘চিত্তাকর্ষক রচনা’ বলে স্বীকৃত হলেও এই আত্মজীবনী রক্ষণশীল, বিজ্ঞানবিরোধী, প্রগলভ, স্থুল, স্ববিরোধী, পুনরুক্তি-ভাষা ও ব্যাকরণদুষ্ট হিসেবেও নিন্দিত হয়েছে’।১৬ আত্মজীবনীতে মশাররফ, ‘মনের কথা খুলে বলবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন বটে, কিন্তু আমরা পাঠশেষে প্রশ্ন না করে পারিনা: সত্য সত্য কি ‘মনের কথা’ প্রকাশ লাভ করেছে?… রচনাকার হয়ত সত্য-কথনে কুন্ঠিত নন। নিজের চিত্ত ও কর্ম ব্যাখ্যা করার মানসিকতাও হয়তো তাঁর আছে। কিন্তু সত্তার সার প্রকাশ করা, নিপুণভাবে তাকে ব্যক্ত করা শিল্পকর্ম হিসেবেই ক্ষমতা সাপেক্ষ।’১৭ এই ক্ষমতার সেই পরিচয় মশাররফ তাঁর আত্মজীবনীতে কতটুকু দিতে পেরেছেন তা নিয়ে সমালোচকের এই সংশয়ের যাথার্থ্য অস্বীকার করা যায় না। 

তবে লেখকের প্রাতিস্বিক জীবন, সমাজ এবং সংস্কৃতির ওপর একটি নৈর্ব্যক্তিক অনুসন্ধানের জন্য তাঁর উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৯০৯), গাজী মিয়ার বস্তানী (১৯০৯), আমার জীবনী (১৯১০) ও বিবি কুলসুম (১৯১০) শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক রচনাসমূহের নব্য ইতিহাসবাদী (New historicist) পঠন এবং মূল্যায়ন দরকার। স্টেফেন গ্রিনব্লাটের সাহিত্য-সমালোচনার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং মিশেল ফুকোর দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত যুগপৎ লেখকের এবং সমালোচকের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে মশাররফের আত্মজীবনীমূলক রচনাসমূহ।

মওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০)-এর আত্মজীবনী বাংলা আত্মজীবনীর ভুবনে এক ব্যতিক্রমী সংযোজন। তিনি ‘তৎকালীন পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারার শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের বিপরীতে [প্রতিষ্ঠিত]… মুসলিম ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রতিনিধি।’১৮ কিন্তু তাই বলে কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা উগ্রবাদ তার ধর্মজীবন কিংবা ধর্মবোধকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তাঁর আত্মজীবনীর এক নিবিড় পঠন এবং তার ওপর পরিচালিত এক বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় শামসুজ্জামান খান দেখিয়ে দেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রথাগত শিক্ষায় ইসলামপন্থী হলেও প্রথার প্রাচীর ডিঙিয়ে তিনি সেই সকল মানুষের এক অগ্রসর প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন যাঁদের ‘মধ্যে অনেকেই চিন্তাবিদ, বাগ্মী, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন… [এবং যাঁদের] মধ্যে মৌলিক চিন্তন-প্রক্রিয়া, পাণ্ডিত্য, গভীরতর মানবিক বোধ, স্বাধীনতাপ্রীতি, সৌন্দর্যবুদ্ধি বিকশিত হয়েছিলো।১৯ মাওলানা এছালামাবাদী আত্মজীবনী সমর্থিত ধর্মজীবনের অন্তর্নিহিত প্রাগ্রসরতার স্বরূপ তুলে ধরতে গিয়ে গবেষক সম্পাদক শামসুজ্জামান খান বলেন,‘ধর্ম তাঁর (মওলানা এছলামাবাদী) কাছে ছিল জীবনের গভীরতর অনুভব উপলব্ধির মাধ্যম এবং সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও স্বাধীনচিত্ততার মূর্ত প্রতীক। বোধের এই মৌলিক গভীরতার জন্যই প্রবল ধর্মনিষ্ঠ হয়েও ভূগোল ও ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতীয়তাবাদী হতে তাঁর কোন অসুবিধা হয়নি।২০ মওলানা এছলামাবাদী যে একজন প্রথাপীড়িত চিরায়ত মওলানা শ্রেণির প্রতিনিধি থেকে একজন প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী মানুষের স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন তার সমর্থনে অসংখ্য ভাষ্য রয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে। তাঁর ভাষায়, ‘আমার পাঠ্য জীবনে এবং তৎপরে কিছুকাল পর্যন্ত আরবী মাদ্রাসার সাধারণ মৌলভী ছাহেবদের ধারণা ও বিশ্বাসের অতিরিক্ত কিছু শিখিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম না। অবশ্য আমার স্বাভাবিক রুচি অনুসারে মোল্লাগিরির প্রতি ঘৃণা পোষণ করিতাম ও কোনরূপ স্বাধীন ব্যবসা অবলম্বনে জীবিকা নির্বাহ করা উচিৎ মনে করিতাম…পাঞ্জাবের উর্দু সংবাদপত্র পাঠে আমার অনেকটা ভাবান্তর উপস্থিত হইল। দেশসেবা ও সমাজসেবা একান্ত কর্তব্যকার্য্য তাহা ক্রমে বুঝিতে পাইলাম।’২১ 

সমকালীন আলেম সমাজের সাথে নিজের পার্থক্য প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি সচরাচর আমাদের দেশের আলেম সমাজ যেভাবে জীবিকার্জন করেন অর্থাৎ জানাজার নামাজ পড়িয়া, কবর জেয়ারত করিয়া রুহু শেফাতের জন্য কোরআন পাঠ করিয়া অথবা মৌলুদ পাঠ ওয়াজ করিয়া পারিশ্রমিক গ্রহণ করা প্রভৃতি-আমি স্বাভাবিকভাবে ইহার বিরোধী ছিলাম… মাদ্রাছার শিক্ষকগণের সহিত সর্ব্বদাই আমি ঐ বিষয় আলোচনা করিতাম, তাহাদিগকে স্বমতে আকৃষ্ট করিবার প্রয়াস পাইতাম।’২২ পদ্যে আত্মজীবনী রচনা করে মওলানা এছলামাবাদী বাংলা আত্মজীবনী রচনায় এক অভিনব মাত্রা যুক্ত করেন। জীবন সন্ধ্যায়-২ শীর্ষক ১৪ অক্ষর চরণবিশিষ্ট পয়ার ছন্দে লিখিত তাঁর পদ্যে আত্মজীবনীর একাংশ নিম্নরূপ:

জীবন সন্ধ্যায়-২

ষাটের উপর, আরও দশ বছর,/বৃথা কাটিয়া গিয়াছে আমার ওমর/দেশ-বিদেশ ভ্রমণে, সমাজ সেবায়,/রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য চর্চায়/ধর্ম প্রচার কাজে, আর শিক্ষা বিস্তার/সময় এসব কাজে কেটেছে আমার।/কিন্তু হায়! জন্মস্থান নিজ বাসভূমে,/সৎ কর্ম করি নাই নিজ পল্লীধামে,/সংকল্প করিয়াছি জীবন সন্ধ্যায়,/অবশিষ্ট জীবন করিব এখানে ব্যয়/কোরআনের শিক্ষা দিব জনসাধারণে-,/আধ্যাত্মিক দীক্ষা মন্ত্র দিব জনগণে,/দেশ-বিদেশের রোগাক্রান্ত লোকজন /আল্লাহর আদেশে করবে আরোগ্য অর্জন।/সুছি [ংরপ] দরবেশ মোরশেদ-কিছুই নাই,/বহু দরবেশের মাজারে গেছি মুই।২৩

মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর উদারনৈতিক ধর্মবোধ, দেশাত্মবোধ এবং যুক্তিবাদী মননঋদ্ধ আত্মজীবনীর নতুন পঠন-পাঠন এবং মূল্যায়ন আজকের ধর্মীয় উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস উপদ্রƒত সমাজে নবজাগৃতির উপকরণ যোগাতে পারে। 

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বাংলা আত্মজীবনীমূলক রচনার জগতে এক ভিন্ন মাত্রিকতা যুক্ত করেছে। আত্মজীবনিক অবয়বে এক অসামান্য রাজনৈতিক ভাষ্য এই গ্রন্থ লেখকের দীর্ঘ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার অনন্য ফসল। এটি নিছকই একটি আত্মজীবনী নয়, বরং বাঙালি জাতির সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। গ্রন্থটির অধ্যায়-বিন্যাস ও অভিনব ফিরিস্তি শীর্ষক সূচিপত্র ত্রিশটি অধ্যায় সম্বলিত।‘পয়লা অধ্যায়ঃ রাজনীতির কখ; দুসরা অধ্যায়ঃ খিলাফত ও অসহযোগ; তেরসা অধ্যায়ঃ বেংগল প্যাক্ট; চৌথা অধ্যায়ঃ প্রজা-সমিতি প্রতিষ্ঠা; পাঁচই অধ্যায়ঃ ময়মনসিংহে সংগঠন; ছয়ই অধ্যায় প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল; সাতই অধ্যায়ঃ প্রজা আন্দোলনের শক্তি; আটই অধ্যায়ঃ আইন পরিষদে প্রজা পার্টি; নয়ই অধ্যায়ঃ নির্বচন যুদ্ধ; দশই অধ্যায়ঃ হক মন্ত্রিসভা গঠন; এগারই অধ্যায়ঃ কালতামামি; বারই অধ্যায়ঃ কৃষক-প্রজা পার্টির ভূমিকা; তেরই অধ্যায় পকিস্তানী আন্দোলন; চৌদ্দই অধ্যায়ঃ পাকিস্তান হাসিল; পনরেই অধ্যায়ঃ কলিকাতার শেষ  দিনগুলি; ষোলই অধ্যায়ঃ কালতামামি; সতরেই অধ্যায়ঃ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা; আঠারই অধ্যায়ঃ যুক্ত ফ্রন্টের ভূমিকা; উনিশ অধ্যায়ঃ পাপ ও শান্তি; বিশ অধ্যায়ঃ ঐতিহাসিক মারি- প্যাকট; একইশা অধ্যায়ঃ আত্মঘাতী ওয়াদা খেলাফ; বাইশা অধ্যায়ঃ ওযারতি প্রান্তি; তেইশা অধ্যায়ঃ ওযারতি শুরু; চব্বিশা অধ্যায়ঃ ভারত সফর; পঁচিশা অধ্যায়ঃ কত অজানারে; ছাব্বিশা অধ্যায়ঃ ওযারতির বেলা; সাতাইশা অধ্যায়ঃ ওযারতি লস্ট; আটাইশা অধ্যায়ঃ ঘনঘটা; উনত্রিশা অধ্যায়ঃ ঝড়ে তছনছ ; ত্রিশা অধ্যায়ঃ কালতামানি।” এ সকল অধ্যায় ছাড়াও রযেছে- পুনশ্চ নামধেয় ৫১ পৃষ্ঠায় এক বিবরণ এবং নয়া অধ্যায় শীর্ষক স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ উপ- অধ্যায়।” উপাধ্যায় একঃ প্রথম জাতীয় সাধারণ  নির্বচান; উপাধ্যায় দুইঃ নয়া যমানার পদ ধ্বনি; উপাধ্যায় তিনঃ পৃথক পথে যাত্রা শুরু; উপাধ্যায় চারঃ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক; উপাধ্যায় পাঁচঃ মুক্তি-যুদ্ধ-জন-যুদ্ধ; উপাধ্যায় ছয়ঃ মুজিবহীন বাংলাদেশ; উপাধ্যায় সাতঃ নৌকার  হাইলে মুজিব; উপাধ্যায় আটঃ সংবিধান রচনা; উপাধ্যায় নয়ঃ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম নির্বাচন; উপাধ্যায় দশঃ কালতামামি।’২৪

আবুল মনসুর আহমদের আত্মজীবনীর মূল সুর ব্যঙ্গ, আর এই ব্যঙ্গধর্মিতাকে যাথার্থ্য দেবার জন্যে তিনি এন্তার আরবি-ফারসি শব্দের সহযোগে এক মজার ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন যা বিধৃত ঘটনাবলীর একটা তীর্যক বিশ্লেষণের সুযোগ সৃষ্টি করে আত্মজীবনীটিকে অনবদ্য করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনীতির পঞ্চাশ বছরের নিবিড় পর্যবেক্ষণনির্ভর এই আত্মজীবনী সাহিত্যানুরাগী এবং রাজনীতিপ্রেমী উভয় পাঠকের জন্য এক মহাগ্রন্থ। গ্রন্থটির নিবিড় পঠন এবং সমকালীন সাহিত্যকর্মের সঙ্গে সমান্তরাল পঠন – নয়া হিস্টরিসিস্ট সমালোচকদের জন্য এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার খোরাক যোগাবে। 

আবুল মনসুর আহমদের আরেকটি আত্মজীবনীমূলক রচনা আত্মকথা বাংলাসাহিত্যের একটি কালজয়ী রচনা। এখানেও তিনি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে ব্যক্তিজীবন তুলে ধরেছেন অসংকোচে অথচ সুনিয়ন্ত্রিত সংযমে। বিদগ্ধ লেখক তাঁর আত্মকথা-য় ‘‘তাঁর বিচিত্র জীবনের যে ছবি তুলে ধরেছেন তাতে তাঁর কুশলী কলম …নির্মম সত্যবাদিতা, ক্ষুরধার বুদ্ধিবৃত্তি ও সেই সঙ্গে পশ্চাদপদ সমাজের জন্য মায়া প্রকাশ পায়।’২৫ সাত খণ্ডে বিন্যস্ত এই আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডে রচনার পটভূমি অর্থাৎ লেখকের বংশ পরিচয় এবং জন্ম ও শৈশব, দ্বিতীয় খণ্ডে শিক্ষাজীবন তৃতীয় খণ্ডে ধর্ম-জীবন, চতুর্থ খণ্ডে সাহিত্যিক জীবন মামুলি, পঞ্চম খণ্ডে সাহিত্যিক জীবন (গরমামুলি) ষষ্ঠ খণ্ডে সাংবাদিক জীবন, এবং সপ্তম খণ্ডে অর্থাৎ শেষ খণ্ডে সংসার জীবন বিধৃত হয়েছে। আত্মকথার বিষয়বস্তু ও ঘটনাবলী সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য, ‘পুস্তকে বর্ণিত ঘটনাবলীর বিবরণী স্পষ্টতরই স্মৃতিকথা। ব্যক্তিগত ঘটনার প্রায় সবটুকুই এই শ্রেণীর কিন্তু যে সব ঘটনার সাথে নেতৃবৃন্দ ও বন্ধুবান্ধবদের সম্পর্ক আছে সেগুলো যথা সম্ভব পুরাতন কাগজ-পত্র, সংবাদপত্রের কাটিং অথবা পকেট ডায়েরী বা নোট বই হইতে নেওয়া হইয়াছে।’২৬ 

আত্মকথা-য় লেখক কেবল আত্মজীবনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং আত্মজীবনী এবং আত্মজীবনীকারদের নিয়ে রীতিমত তত্ত্ব করেছেন। ইনডিভিজুয়ালিটি এবং পারসোনালিটির মধ্যে পার্থক্য সনাক্ত করে আত্মজীবনী লেখার জন্য দরকারী ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘প্রায় সকল আত্মজীবনী লেখকের মধ্যে যে দুটি গুণ থাকিতেই হয়, তার একটা নির্ভয়ে ও অসংকোচে সত্য কথা বলার অভ্যাস; আর অপরটা বাপ-দাদার প্রতি বিবেকবান শ্রদ্ধা।… এই দুইটা অত্যাবশ্যক গুণের মূল [হলো] ব্যক্তিত্ব। … আত্মজীবনীকারের যে ব্যক্তিত্বের কথা আমি বলিতেছি সেটা ইন্ডিভিজুয়ালিটি নয়, সেটা পারসোনালিটি। ইন্ডিভিজুয়ালিটি সাধারণ; আর পার্সোনালিটি অসাধারণ।…[সাধারণ] জীবন লইয়া জীবন্তিকা হইতে পারে, জীবনী হইতে পারে না, আত্মজীবনী তো নয়ই।’২৭ বঙ্গবন্ধুর মতো আবুল মনসুর আহমদও ১৯৫৮ সালের আক্টোবরে আইউব শাহীর কারাগারে বসে তাঁর আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন এবং দীর্ঘ দশ বছরে শেষ করেন। তাঁর আত্মজীবনীর রাজনৈতিক দিকটা প্রকাশকদের পরামর্শে আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর নামে প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। 

বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদি শাসনামলে কারারুদ্ধ ইতালিয় তাত্ত্বিক এবং রাজনীতিক এন্টোনিও গ্রামসি যেমন জেলখানায় বসে তাঁর নোটবুকস লেখেন কিংবা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যেমন কারাগারের রুদ্ধ প্রকোষ্ঠে বসে মেয়ে ইন্দিরার কাছে জগত ও জীবনের বিচিত্র বিষয় নিয়ে পত্র লেখেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে তাঁর আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন। বস্তুত বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের অনুরোধ এবং সহধর্মিনীর প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু জেলখানার নিরানন্দ সময় কাটাবার জন্য লেখায় হাত দেন। তাঁর ভাষায়,‘‘বন্ধু-বান্ধবরা বলে, ‘তোমার জীবনী লেখ’’। সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে’। ‘আমার সহধর্মিনী একদিন জেল গেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’’ বললাম, ‘লিখতে যে পারিনা’, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়।… হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভাল না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কি? সময় তো কিছু কাটবে।… তাই খাতাটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম। আমার অনেক কিছুই মনে আছে। স্মরণশক্তিও কিছুটা আছে। দিন তারিখ সামান্য এদিক ওদিক হতে পারে, তবে ঘটনাগুলি ঠিক হবে বলে আশা করি।’’২৮ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের আত্মজীবনী ভরে যেমন আছে আমেরিকার স্বপ্নের কথা, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর পরতে পরতে তেমনি খুঁজে পাওয়া যাবে এক সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নগাথা।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এর ভূমিকা লিখেছেন তাঁরই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তা লেখা হয়েছে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে কারাবন্দি অবস্থায়। ঢাকা শেরে বাংলা নগরের একটি সাব জেলে বসে শেখ হাসিনা এই ভূমিকা লেখেন এবং ধূসর পাণ্ডুলিপি থেকে একটি সুপাঠ্য আত্মজীবনী হয়ে ওঠার কাহিনী বর্ণনা করেন। গ্রন্থটির সুখপাঠ্যতা এবং আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন:

এই লেখাগুলো বারবার পড়লেও যেন শেষ হয় না। আবার পড়তে ইচ্ছে হয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য     একজন মানুষ কিভাবে কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন, জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে পারেন – তা জানা যায়। জীবনের সুখ-স্বস্তি, আরাম, আয়েশ, মোহ, ধনদৌলত সবকিছু ত্যাগ করার এক মহান ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু সাধারণ গরিব দুঃখী মানুষের কল্যাণ চেয়ে কিভাবে তিনি নিজের সব চাওয়া বিসর্জন দিয়েছেন তা একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করা যাবে।২৯ 

অসমাপ্ত আত্মজীবনী অসমাপ্ত হলেও এর আবেদন অপরিসীম। বাংলাদেশের সকল কালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিকের সংগ্রামী জীবনের একাংশ এবং তাঁর আদর্শ এখানে সহজ সাবলীল আত্মকথনের মধ্য দিয়ে বিধৃত হয়েছে। এটি মূলে ও অনুবাদে যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে তাতে বইটি অতি শীঘ্রই বাঙালির রাজনৈতিক জীবনাচরণের বাইবেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। ১৯৭৩ সালের ৩০ এপ্রিল তারিখে স্বাক্ষরিত বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী বাণীতে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বৃহত্তর মানবসমস্যা সম্পর্কিত উদ্বেগ, অভূতদৃষ্ট বাঙালিপ্রীতি এবং বাঙালিপ্রেমই যে তাঁর স্ব-অস্তিত্ব ও স্ব-রাজনীতিকে অর্থবহ প্রেরণা দিয়েছে তার স্বীকৃতি :

As a man what concerns mankind concerns me. As a Bangalee, I am deeply involved in all that concerns Bangalees. This abiding involvement is born of     and nourished by love, enduring love which gives meaning to my politics     and to my very being.30  

কী অসাধারণ উপলব্ধি- বাঙালির সকল ভাব-ভাষা-ভাবনাকে আত্মীকৃত করে বিশ্বমানবের সকল সংবেদনশীলতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার উপলব্ধি! তাঁর এই বিশ্বমানবদৃষ্টির জন্ম এবং পুষ্টিসাধন কেবল অনিঃশেষ ভালোবাসার দ্বারা সাধিত হয়েছে এবং জীবন ও রাজনীতিকে অর্থবহ করে তুলেছে। এই জীবনবোধ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীকে বার্ট্রান্ড রাসেলের (১৮৭২-১৯৭০) আত্মজীবনীর প্রস্তাবনা অংশের সেই অমর বাণীর কথা মনে করিয়ে দেয়,

ÔThree passions, simple but overwhelmingly strong, have governed my life : the longing for love, the search for knowledge, and unbearable pity for the suffering of mankind.31

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনী সমাপ্ত করে যেতে পারলে হয়তো বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের আরও বহু অনালোকিত ও অনাবিষ্কৃত বিষয় উদ্ভাসিত হতো – কিন্তু তারপরও অযতেœ সংরক্ষিত, আকস্মিকভাবে প্রাপ্ত জীর্ণ পা-ুলিপি থেকে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সীমিত পরিসরে, ‘… লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ… (দেশভাগোত্তর) সময় থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি পূর্ববাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ [ষড়যন্ত্র] বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা।’৩২ [ দ্র. অসমাপ্ত আত্মজীবনী ] অসাধু লেখকদের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে এক নিখাদ দলিল হিসেবে সাক্ষ্য দেবে। সকল অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সৎ ও শ্রেয়োবোধের রাজনীতির প্রেরণা যোগাবে। আর ঠিক সেখানেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী-এর যথার্থ তাৎপর্য নিহিত।

বন্ধুবান্ধবদের চাপ বাংলা আত্মজীবনীকারদের অন্যতম প্রধান নোদনা হিসেবে কাজ করেছে এবং স্মৃতিনির্ভরতা কাজ করেছে রচনাকর্মের প্রধান উৎস হিসেবে। আত্মজীবনীকার আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮)-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। লেখকের স্বীকারোক্তি, ‘আমার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক বন্ধুরা গত কয়েক বছর আমাকে অনবরত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, এ-বিবরণ ভবিষ্যদ্বংশীয়দের চোখে তুলে ধরা আমার নাকি এক অপরিহার্য দায়িত্ব…বন্ধুদের কথা শিরোধার্য করে আমাকে এ কাজে অগ্রসর হতেই হ‘ল…’৩৩ 

আবুল কালাম শামসুদ্দীনের অতীত দিনের স্মৃতি ১৯৬৮ সালে গ্রন্থ’াকারে প্রকাশিত হলেও ষাটের দশকের গোড়ার দিকে রচিত হয়েছিলো এবং তৎকালীন ‘দৈনিক পাকিস্তান, (বর্তমানে দৈনিক বাংলা) পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। মূলত স্মৃতিনির্ভর রচনা হলেও এই আত্মজীবনীতে সন-তারিখের উলে¬খ ও ঘটনার বিবরণে কোন বড় রকম বিভ্রাট ঘটেনি।’৩৪ তবে একেবারে যে কোথাও কোনো স্মৃতিবিভ্রাট ঘটেনি তাও নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘বায়ান্নোর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে…. ঘটনাক্রমে তিনি শহীদ মিনার উদ্বোধনের কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন।”৩৫  আত্মজীবনীতে ‘বিগত অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী (বিশ শতকের প্রথমার্ধ) এদেশের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার বিকাশ ও অগ্রগতির ইতিহাসের বিচিত্র বিবরণী কিছু কিছু… তুলে ধরার চেষ্টা [করা হয়েছে]।’৩৬ এই স্মৃতিচারণ মুখ্যত স্মৃতিনির্ভর হলেও ‘ঘটনাবহুল এবং উপমহাদেশের রাজনীতি, সমাজ-সং¯কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতা ইত্যাদি সংক্রান্ত নানা ঘটনা ও আন্দোলনের ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ।৩৭  বস্তুত গ্রন্থটি ‘লেখকের স্মৃতিচারণ এবং আত্মজীবনীই মাত্র নয়, উপমহাদেশের বিশেষ করে মুসলিম জনসমাজের নবজাগরণ আন্দোলনের ইতিহাসও বটে।’৩৮ 

আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মজীবনীর ভূমিকা লেখাকে স¦য়ং শওকত ওসমান ধৃষ্টাতা জ্ঞান করেছেন। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশে সাংবাদিক-সাহিত্যিক রূপে তাঁর (আবু জাফর শামসুদ্দীন) মতো পরিচিত নামের পূর্ণপরিচয়… হ্যারিকেনের সাহায্যে কাউকে সূর্য দেখানোর মতো… হাস্যকর’।৩৯ শওকত ওসমান আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মজৈবনিক রচনা আত্মস্মৃতির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘এই আত্নজীবনী কোন একক ব্যক্তির কাহিনী নয়। সমাজ ও মানুষ উন্নয়ন স¤পর্কে সদা-কৌতূহলী [লেখক] এই পুস্তকেও তাঁর অনন্য স্বাক্ষর রেখে গেছেন।…নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে এই পুস্তক পথের হদিস দানে সক্ষম হবে।’৪০ আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি প্রথম দুই খণ্ডে প্রকাশিত হলেও পরে একখণ্ডে পুনঃপ্রকাশিত হয়। প্রথম তিনখ- তিন অধ্যায়ে বিন্যস্ত: আমার পাঠশালার দিনগুলি; বৃহত্তর ভারতে; এবং পাকিস্তানে এবং দ্বিতীয় খণ্ডে সংগ্রাম ও জয় শীর্ষক একটি বড়ো অধ্যায় রয়েছে। আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মজীবনী তথ্য, তত্ত্ব ও দার্শনিকতায় ঠাঁসা। শুরুতেই তিনি নজরুলের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে যুগপৎ অতীতের সাথে বর্তমানের, সেকালের সাথে একালের পার্থক্য এবং আন্তনির্ভরতার এক বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ভাষায় : ‘…. সেদিন জীবনের উষালগ্নে কুঁড়ির কোল ছেড়ে যখন সংসারের কোলে স্থান করে নিয়েছিলাম তখনকার দৃষ্টি এবং আজকের দৃষ্টি তো এক নয়। … পরিবেশ বদলে গেছে। প্রতিবর্তী ক্রিয়ার প্রভাব পড়েছে মন ও মস্তিষ্কের ওপর। সেদিন আমি যে মানুষটি ছিলাম আজ আর সে মানুষটি নেই। ফটোগ্রাফে প্রতিকৃতি হয়; কিন্তু রচনায় মানবজীবনকে অবিকল প্রতিফলিত করা যায় না। অতীতকে স্মরণ করতে গেলে বর্তমানের প্রভাব তার ওপর পড়বেই। যে ঘটনা এইমাত্র ঘটলো পরমুহূর্তেও তার অবিকল বর্ণনা দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।’৪১ গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস সম্ভবত একই উপলব্ধি থেকে বলেছিলেন যে কোনো মানুষ একই নদীতে দু’বার নামতে পারে না, কারণ নদীটি একই থাকে না আবার মানুষটিও। আত্মজীবনীকার আবু জাফর শামসুদ্দীন অতীত-বর্তমানের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করতে গিয়ে বাইনারির পর বাইনারি সাজিয়েছেন, ‘আজ সুন্দরের পাশাপাশি অসুন্দরকেও দেখতে পাচ্ছি; আনন্দের পাশাপাশি নিরানন্দ। তখনকার বহু সত্য আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। একই জীবনে এই যে দৃষ্টি, চিন্তা, অনুভূতি এবং পরিবেশের পার্থক্য তার চাপ স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে স্মৃতিচারণের মধ্যে।’৪২ 

বাংলা আত্মজীবনীকারদের মধ্যে নিরহংকার বিনয় একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবে লক্ষ্যণীয়। প্রায় সবাই দাবি করেছেন, তাঁরা আত্মজীবনীর যোগ্য প্রতিপাদ্য নন। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানও সবিনয়ে বলেন:, ‘আত্মজীবনী লিখব, এমন কোনো কামনা কখনো মনে লালন করিনি। কারণ আমার জীবন এমন কিছু অসাধারণ বর্ণাঢ্য কিংবা রোমাঞ্চকর নয় যা সাতকাহন কথা বলে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। শামসুর রাহমান কালের ধুলোয় লেখা৪৩ আত্মজীবনীতে বিধৃত বিষয়ের বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং নিজেও বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ভাষায়: ‘জীবন স্মৃতি উপন্যাস নয়। তাই, এখানে কল্পকাহিনীর অবকাশ নেই। যদিও কেউ কেউ ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচুর মিথ্যের মিশেল দিয়ে আত্মকথা প্রকাশ করেন। সেটি উপন্যাস হিসাবে আর্কষণীয় হতে পারে, কিন্তু আত্মজীবনীর দাবিদার হতে পারে না। এ কথা আমি সবসময় মনে রেখেছি। জীবনের যেখানে কিছু রঙ লেগেছে শুধূ তাই বর্ণনা করেছি, অতিরিক্ত রঙ চাপানো থেকে বিরত থেকেছি। বড় মাপের লেখকদের কাছ থেকে শিখেছি, সত্য প্রকাশ এবং আত্মানুসন্ধানই হলো লেখকের প্রধান কর্তব্য।’৪৪ এভাবে আত্মজীবনীর পূর্বলেখে লেখক উপন্যাস ও আত্মজীবনীর পার্থক্য, আত্মজীবনীকারের কর্তব্য ও পরিমিতিবোধ তুলে ধরেছেন, এর লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং এভাবে ভবিষ্যত আত্মজীবনীকারদের জন্য চমৎকার রেসিপি উপস্থাপন করেছেন। অধিকন্তু, আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে এক গভীর জীবনদর্শন তুলে ধরেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষের জীবনই একটি ওডেসি। কারও ওডেসি ঘটনাবহুল, বৈচিত্র্যময়, বর্ণাঢ্য, কারও সেই পরিমাণ নয়,৪৫ এবং আত্মজীবনী লেখার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন,‘পাঁচ দশক জুড়ে জীবন যাপন করার ফলে মনে কিছু কথা জমেছে। বলা যেতে পারে সময়ের এক ধরনের ভার বয়ে চলেছি। এটা (আত্মজীবনী) ভারমুক্ত হওয়ার চেষ্টা মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।’৪৬ আবুল মনসুর আহমদের আত্মজীবনীতে যেমন সমাজ ও রাজনীতি অধিক মনোযোগ পেয়েছে, শামসুর রাহমানের আত্মজীবনীতে তেমনি, সঙ্গত কারণেই, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি বেশি মনোযোগ লক্ষ্য করা গেছে। সমকালীন সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক বাতাবরণের ভেতর দিয়ে লেখকের আপন কাব্যসত্তা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে সমকালের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় কীভাবে তাঁর অর্ন্তগত কাব্যপ্রতিভার স্ফূরণ ঘটেছে এসবের এক অন্তরঙ্গ বয়ান তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। সত্য প্রকাশে অকাপট্য এবং নিরাভরণ স্বীকারোক্তি বাংলা ভাষায় সত্যাশ্রয়ী আত্মজীবনী লেখার একটি শক্তিশালী প্রবণতার সূচনা করবে বলে ধরে নেয়া অসঙ্গত হবে না। 

অনেকের মতো আনিসুজ্জামানও আটঘাট বেঁধে আত্মজীবনী রচনায় না নামলেও তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনাগুলো মানোত্তীর্ণ এবং কালোত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে রায় দেয়া যায়। বস্তুত সম্পাদক-প্রকাশকদের অনুরোধে বিভিন্ন সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে লেখার মধ্য দিয়েই পরিণতি পায় আনিসুজ্জামানের একাধিক আত্মজীবনী গ্রন্থ। তাঁর স্মৃতিকথার প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাঠকের কাছে যদি আমার স্মৃতিকথার কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তা এই জন্য যে, আমি প্রচুর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এবং বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সাহচর্যধন্য। যে-পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিতে আমি ‘হয়ে’ উঠেছি, সে-সম্পর্কে জানবার সঙ্গে সঙ্গে তাই আমি অন্য অনেকের এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নানান ঘটনার কথা বলতে চেয়েছি।’৪৭ প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আনিসুজ্জামানের আত্মচরিত কাল নিরবধি শুরু হয়, ‘জন্মের আগে’ শিরোনামে পূর্বপুরুষদের কাহিনী দিয়ে, ‘আমি এই আখ্যান শুরু করতে যাচ্ছি নিজের জন্মের অনেক আগের কথা দিয়ে।’৪৮ তবে একটু ভেতরে ঢুকলেই দেখা যায় কি গভীর পর্যবেক্ষণ, অন্তর্দৃষ্টি এবং বিশ্লেষণ নিয়ে তিনি মামুলি পারিবারিক উপাখ্যানকে সংলগ্ন করেছেন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক- রাজনৈতিক আখ্যানের সঙ্গে। তারপর ‘জেগে উঠিলাম’, ‘অন্য কোনখানে’, ‘আলো ভুবনভরা’, ‘বিচিত্র চিত্র’, ‘প্রথম প্রবাস’, ‘সমাজ-সংসার’, এবং ‘নতুন ঠিকানা’ নামে সর্বমোট আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করে রচিত এই আত্মজীবনীতে স্থান পেয়েছে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনকাহিনী – বাল্যজীবন, শিক্ষাজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক’ রাজনৈতিক জীবন- পরিধি বিবেচনায় দেশভাগপূর্ব কাল থেকে দেশভাগোত্তর স্বাধিকার চেতনাদীপ্ত সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন পর্যন্ত। তিনি ইতিহাস দেখেছেন নিজের চোখে, ইতিহাসের অংশ হয়েছেন সচেতন-সক্রিয়ভাবে এবং ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্ততায়, পরিমিত গদ্যশৈলীতে। তাই তাঁর আত্মজীবনী নিছক স্মৃতি কথার চৌহদ্দি ডিঙিয়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের এক অনুপম ভাষ্য হয়ে উঠেছে।

বিপুলা পৃথিবী (২০১৫) আনিসুজ্জামানের আরেক সুবৃহৎ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। এটিও লেখকের বর্ণিল স্মৃতির আলোকে রচিত। বস্তুত আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথার একটা ট্রিলজি আছে। কাল নিরবধি, আমার একাত্তর এবং বিপুলা পৃথিবী। কাল নিরবধি (২০০৩) শুরু হয় পূর্ব পুরুষদের কথা দিয়ে এবং শেষ হয় একাত্তরের (১৯৭১) ২৬ মার্চের ঘটনায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিকথা দিয়ে রচিত আমার একাত্তর প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরবর্তী জীবনের কাহিনী নিয়ে রচিত হয় বিপুলা পৃথিবী এই স্মৃতিকথার বিস্তার গত সহস্রাব্দের শেষ বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্ত । বিপুলা পৃথিবী পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত: ‘নতুন যুগের ভোরে’, ‘অস্তাচলের পানে’, ‘হননের কাল’, ‘কাছে-দূরে’ এবং ‘হালখাতা’। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু দুলর্ভ আলোকচিত্র এবং একটি স্বাস্থ্যবান নির্ঘণ্ট। আনিসুজ্জামান একজন জাত গবেষক। আত্মজীবনী লিখতে এসে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নান্দনিক শিল্পবোধ। ‘সারল্য, মাধুর্য ও কৌতুকের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের অন্তরঙ্গ ঘরোয়া গল্পকথার মধ্য দিয়ে তিনি মেলে ধরেন স্বদেশ ও স্ব-সমাজের বিশাল পরিধি… ফলে তাঁর রচনা নিছক স্মৃতিগ্রন্থ হয়ে থাকে নি, হয়েছে এক মহাগ্রন্থ নিজেদের জানা ও চেনার।’৪৯ নিজেদের চোখে নিজেদের দেখবার এই বৌদ্ধিক প্রয়াসই বস্তুত উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস চর্চার প্রধান হাতিয়ার। সালমান রুশদি কথিত Ôwriting backÕ -এর পর্যাপ্ত অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যাবে আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনীর পাতায় পাতায়।

আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধে কেবলমাত্র নয় জনের আত্মজীবনীর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের সুবিস্তৃত আত্মজীবনীর অঙ্গনে বেশ কিছু আত্মজীবনী আলোচনার দাবি রাখে। এসবের মধ্যে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের আত্মজীবন, বিনোদিনী দাসীর আমার কথা, ইব্রাহিম খাঁর বাতায়ন, কবি জসীম উদ্দীনের জীবনকথা, আব্বাসউদ্দীনের আমার শিল্পী জীবনের কথা, খাঁন বাহাদুর আহসানউল্লাহর জীবনস্মৃতি, মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহর যুগবিচিত্রা, আবুল হোসেনের আমার এই ছোট ভুবন, বদরুদ্দীন উমরের আমার জীবন, জসীম ম-লের জীবনের রেলগাড়ি, আবদুল আহাদের আসা-যাওয়ার পথের ধারে, কলিম শরাফীর স্মৃতি অমৃত, শেখ লুৎফর রহমানের জীবনের গান গাই, হবিবর রহমান সাহিত্যরতেœর আমার সাহিত্যজীবন, এ আর মল্লিকের আমার জীবনকথা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, সৈয়দ মুর্তাজা আলীর আমাদের কালের কথা, আবুল ফজলের রেখাচিত্র, আতাউর রহমান খানের ওজারতির দুই বছর, সৈয়দ মোস্তফা আলী আত্মকথা, কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিকথা, চৌধুরী শামসুর রহমানের বছর পঁচিশ, সনজীদা খাতুনের অতীত দিনের স্মৃতি, জোবাইদা মীর্জার সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি, সুফিয়া কামালের একালে আমাদের কাল, নীরদ সি চৌধুরীর আমার দেবোত্তর সম্পত্তি, মোহাম্মদ মোদাব্বেরের আত্মজীবনী, আবুল হাশিম, আবদুস শহীদের আত্মজীবনী, রিজিয়া রহমানের আত্মজীবনী নদী নিরবধি উল্লেখযোগ্য।

তত্ত্ব-বিস্ফোরণের এ যুগে শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন এলাকার মতো আত্মজীবনী-তত্ত্বও এক বহুল আলোচিত ক্ষেত্র হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বস্তুত, ‘অধুনা আত্মজীবনীর কেবল রকমারি তত্ত্বই নেই, সে সকল তত্ত্বের আবার ক্রমবর্ধিষ্ণু তত্ত্ব রয়েছে।’৫০ ১৯৮০-এর দশক থেকে প্রচলিত সাহিত্য সন্দর্শন জায়মান সমালোচনার বিকল্প ধারাগুলোকে স্বাগত জানাতে শুরু করলে আত্মজৈবনিক সাহিত্য-সমালোচনার ধারাও একটি সঙ্কর সমালোচনা রীতি হিসেবে ব্যক্তিগত ন্যারেটিভ, রিডার রেসপন্স এবং গ্রন্থিক বিশ্লেষণকে অন্তর্ভুক্ত করে এক নতুন পথের সন্ধান দেয়, যার মাধ্যমে সাহিত্য মানবজীবনের ধনাত্মক পরিবর্তনগুলো বিকশিত, প্রতিফলিত এবং সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। বাংলা আত্মজীবনীর দীর্ঘ পরম্পরায়- রাসসুন্দরী দাসী থেকে তসলিমা নাসরিন, বিদ্যাসাগর থেকে মোনায়েম সরকার পর্যন্ত

আত্মজীবনীকারদের রচনাবলি প্রাসঙ্গিক সাহিত্য-সমালোচনা তত্ত্বের আলোকে পঠিত/পুনর্পঠিত/বিনির্মিত হলে বাংলা আত্মজীবনীমূলক রচনা এক বৈশ্বিক উচ্চতায় পৌঁছুবে এবং এর পঠন এক যুগোপযোগী পোলেমিক্স তৈরি করবে।

উল্লেখপঞ্জি

১. Cellini Benevento tr. George Bull, The Autobiography. London 1966 p. 15

২. মুনীর চৌধুরী রচনাবলী [তৃতীয় খ-] আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বাংলা একাডেমী ঢাকা ১ম সংস্করণ ১৯৮৪, পৃ.৮৮-৮৯ ডিসেম্বর

৩.  দ্র. https://en.wikipedia.org/wik:/Rassundari_Devi

৪. দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, সংখ্যা-২ ক্যালকাটা ১৯১৪

৫.  lbid ৬. lbid ৭. [lbid ৮. মুনীর চৌধুরীর রচনাবলী [তৃতীয় খ-] 

৯.  lbid, পৃ.৯১ ১০.  lbid ১১. lbid ১২. lbid, পৃ.৯১-৯২

১৩.  আবুল আহসান চৌধুরী, মীর মশাররফ হোসেন : সাহিত্যকর্ম ও সমাজচিন্তা, বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৯৬

১৪. lbid ১৫. lbid ১৬. lbid ১৭. মুনীর চৌধুরী রচনাবলী [তৃতীয় খ-], পৃ.১৩৮

১৮. শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী, পাঠক সমাবেশ, ২০০৪ পৃ. ১

১৯. lbid, পৃ. ১২ ২০. lbid ২১. lbid, পৃ. ৪৮ ২২. lbid, পৃ. ৫০ ২৩. lbid, পৃ. ১২১

২৪. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চশ বছর , খোশরোজ কিতাব মহল, পুনর্মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০১৩

২৫. lbid, ১ম ফ্ল্যাপ ২৬. ঐ, আত্মকথা , পৃ. ১১ ২৭. lbid, পৃ. ৮ 

২৮. শেখ মুজিবুর রহমান, প্রাগুক্ত

২৯. lbid ৩০. lbid

৩১. Bertrand Russel, The Prologue to Bertrand Russel’s Autobiography 

৩২. শেখ মুজিবুর রহমান, প্রাগুক্ত

৩৩. আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতি, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৬৮, পৃ. ৯

৩৪. lbid, পৃ. ১৪ ৩৫. lbid  ৩৬. lbid পৃ. ৯ ৩৭. lbid, পৃ. ১৩

৩৮. lbid 

৩৯. আবু জাফর শামসুদ্দীন, আত্মস্মৃতি,  সাহিত্য প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৫, উদ্বৃত্ত ভূমিকা

৪০. lbid ৪১. lbid, পৃ. ১১ ৪২. lbid

৪৩. শামসুর রাহমান, কালের ধুলোয় লেখা, অন্যপ্রকাশ, একুশের বইমেলা, ২০০৪, পূর্বলেখ

৪৪. lbid ৪৫. lbid ৪৬. lbid 

৪৭. আনিসুজ্জামান, কাল নিরবধি, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ফেব্রুয়ারী ২০০৩, পূর্বাভাষ

৪৮. lbid, পৃ. ১৩ ৪৯. lbid, ব্যাক ফ্ল্যাপ

৫০. স্মিথ রবার্ট, দেরিদা অ্যান্ড অটোবায়োগ্রাফি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৫

মন্তব্য: