আহসান হাবীবের- প্রেমের কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সাগর জামান

আহসান হাবীব চল্লিশ দশকের খ্যাতিমান কবি। তাঁর কবিতার পরিমণ্ডল বিষয় বৈচিত্রে বিস্তৃত। বিষয়ের বহুতা লৈখিক রীতির ভিন্নতা সাবলীল ভাষা বিন্যাস ইত্যাদি অনুষঙ্গে আত্ম-উপলব্ধি থেকে উৎসারিত বিভিন্ন বােধ তিনি কবিতায় ব্যক্ত করেন। তাঁর কবিতায়

প্রেম নানাভাবে এসেছে। বহু বিষয়ের মধ্যে তিনি নানা রঙের প্রেমের বাণী অবমুক্ত করেন। হৃদয়াবেগ, ভালবাসার খুনসুটি মাখা প্রেমানুভূতির আদিঅন্ত তিনি কবিতায় উপস্থিত করেছেন। সৃষ্টির আদি থেকে প্রবাহমান প্রেম প্রবণতাকে তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন নিদারুণ দক্ষতায়। আহসান হাবীবের কবিসত্ত্বা মানুষের প্রেমের নানা আকুতি স্পর্শ করতে

উদ্দিপক ছিল। তিনি প্রেমের প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজে পেতে প্রেম বন্দনায় ব্রতি হয়েছেন।

কখনাে কৈশােরিক আবেগকে প্রশ্রয় দিযেছেন। স্মৃতির কাছে নিজেকে সমর্পন করেছেন। প্রেমের নিভৃত অনুভবকে তিনি নিবিড়ভাবে কবিতায় চিত্রায়িত করেন। প্রেমের মধ্যে আনন্দ ও বেদনার পরস্পর নৈকট্যের গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল তিনি কবিতায় পরিস্ফুটিত করেছেন। হৃদয় আপ্লুত করা প্রেমের প্রাণবন্ত কবিতা আহসান হাবীবের কবিতা জগতের আলােকিত ব্যাপ্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। প্রতিবেশীর প্রতি পারস্পরিক প্রেমবােধ তিনি কথােপকথনের মাধ্যমে কবিতায় তুলে ধরেছেন। দোতলার ল্যান্ডিং, মুখােমুখি ফ্লাট, একজন সিঁড়িতে অন্য একজন দরজায় শীর্ষক কবিতার উদ্ধতি দেয়া যেতে পারে-

আপনারা চলে যাচ্ছেন বুঝি?

চলে যাচ্ছি মালপত্র উঠে গেছে সব

বছর দু’য়েক হলাে তাই নয়?

তারাে বেশী। আপনার ডাক নাম শানু ভাল নাম?

শাহানা আপনার?

মাবু।

জানি।

মাহবুব হােসেন

আপনি খুব ভালাে সেলাই জানেন।

কে বলেছে। আপনারতাে অনার্স ফাইনাল তাই নয়?

এবার ফাইন্যাল

ফিজিক্সে অনার্স

কি আশচর্য আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?

মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে…

সে যাকগে। পা সেরেছে?

কি করে জানলেন?

এই আর কি সেরে গেছে।

ও কিছু না প্যাসেজটা পিছল ছিল মানে…

সত্যি নয় উচু থেকে পড়ে গিয়ে

ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রােজ মাকে অতাে জ্বালানাে কি ভালাে?

মা বলেছে?

শুনতে পাই। বছর দুয়েক হলাে তাই নয়?

আহসান হাবীব ব্যতিক্রমী রীতিতে কবিতা চর্চা করেছেন। আলাদা আলাদা অনুভূতিকে তিনি পরিমিলন করে কবিতায় উন্মীলিত করেছেন। পাশাপাশি বসবাস, এক অপরের প্রতি প্রেমের জাগরণ। প্রকাশর দ্বিধায় দুলতে থাকা যুগলের আকস্মিক দেখা প্রেমের আবেদনময় কথােপকথন সুন্দরভাবে তিনি কবিতায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন। আহসান হাবীবের কবিতায় প্রেম চেতনা তাঁকে অলাদা আলােয় উদ্ভাসিত করেছে। তাঁর কবিতার ভুবন ভালবাসার কলতানে মুখরিত। তিনি প্রথা ভেঙ্গে প্রেমের কবিতায় দিগন্তপ্লাাবিত ধারার সূচনা করেন। আহসান হাবীব তাঁর কবিতায় মনস্তাপ, দুঃখ কাতরতা, আনন্দ, উল্লাস প্রেমের পঙ্ক্তির মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ করেছেন। প্রেম মানুষের চিরসুখের প্রসঙ্গ। প্রেমের সফল পরিণতি মানুষকে সুখি করে। মানুষ প্রেম বিচ্ছিন্ন নয়। প্রেমে বিরহ বেদনা ও ব্যর্থতাও থাকে। এ সব কিছুর মিলিত অনুভূতি আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। তিনি ভালবাসার এবং ঘৃণার মিলিত বাণী উচ্চারণ করেন-

একবার বলেছি, তােমাকে আমি ভালবাসি

একবার বলেছি, তােমাকে আমি, তােমাকেই ভালবাসি

বলাে এখন সে কথা আমি ফেরাবাে কেমনে।

আমি একবার বলেছি তােমাকে…

এখন তােমাকে আমি ঘৃণা করি।

এখন তােমার দৃষ্টির কবরে এলে

ক্ষতস্থান জ্বলে জ্বলে ওঠে।

তােমার সান্নিধ্যে এলে তুমি ইষণ নাভিমূল থেকে

বাতাসে ছড়াও তীব্র সাপিণীর তরল নিঃশ্বাস।

আমি যতবার ছুটতে চাই তােমার দৃষ্টির বাইরে

যেতে চাই তুমি দু’চোখে কি ইন্দ্রজাল মেলে রাখাে

আমি ছুটতেও পারি না।

আমি ফেরাতে পারি না কথা।

ভালােবাসার মােহন শব্দের উল্টোদিকে ঘৃণার অবস্থান থাকে। গভীর ভালবাসা প্রেমের বন্ধনকে দৃঢ় করে। ঘৃণার আগ্রাসী রূপ হাল্কা ভালবাসাকে তছনছ করতে পারে। কিন্তু প্রবল প্রেমের প্রবাহকে রুখতে পারে না কখনাে। আহসান হাবীব তাঁর কবিতায় এ ধরনের কথা

প্রকাশ করেছেন নানা ভঙ্গিতে। কবিতার কাছে নতজানু হয়ে। আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতা রচনায় অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। শৈশবে তাঁর লেখালেখির সুত্রপাত হয় স্কুল ম্যাগাজিনে ধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে। দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নের সময় লেখেন, মায়ের কবর পাড়ে কিশাের শীর্ষক একটি কবিতা। বিরলপ্রজ কবি আহসান হাবীব মেঘনা

পাড়ের ছেলেসহ অসংখ্য কবিতায় শৈশব ও কৈশােরের নানা ঘটনা ও অনেক চরিত্র চিত্রিত করেন। আহসান হাবীবের উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ: ‘রাত্রিশেষ’ ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কমরেড পাবলিশার্স গ্রন্থটি প্রকাশ করে। শিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর উৎসাহে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ তে প্রকাশিত হয় ‘ছায়া হরিণ’ কাব্যগ্রন্থ। ১৯৬৪ তে প্রকাশিত হয় ‘সারা দুপুর’ কাব্যগ্রন্থ। আনন্দ প্রকাশনা প্রকাশ করে তাঁর প্রেমের কবিতা প্রেমের কবিতা বিনির্মাণে তারুণ্যের স্পন্দন প্রেমের নানা অনুভূতি বিচিত্র ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি উচ্চারণ করেন-

তুমি ভালাে না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোেবাসা আছে

তুমি ভালাে না বাসলেই, আলােবাসা জীবনের নাম

ভালােবাসা ভালােবাসা বলে

দাঁড়ালে দু’হাত পেতে

ফিরিয়ে দিলেই

বুঝতে পারি ভালােবাসা আছে

না না বলে ফিরালেই

বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায় না কখনাে।

না না বলে ফিরিয়ে দিলেই

ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়।

প্রেমের প্রবল প্রবাহ স্বপ্ন বিন্দুতে পৌঁছানাের দায়িত্ব আহসান হাবীব তাঁর কবিতায় পালন করেছেন সফলভাবে। প্রেমিক প্রেমিকার পারস্পরিক গন্তব্যে ছুটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবপ্রাণের প্রেমের চিরাচরিত স্পন্দন আহসান হাবীবের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। তরুণ তরুণীদের প্রেম প্রকাশের অবলম্বন হিসেবে তাঁর কবিতা চিহ্নিত। আহসান হাবীবের কবিতার উচ্চারণ দিয়ে প্রেমের অভিব্যক্তি তরুণদের প্রকাশ প্রবণতা লক্ষণীয়। তাঁর কবিতায ভালােবাসা ও জীবনের অর্থময়তা ফুটে ওঠে জীবনের অমােঘতা, ভালােবাসার মানুষদের এক অপরের প্রতি আকর্ষণ, গন্তব্যের উল্লেখ

তাঁর কবিতায় অপূর্ব অপরূপে উঠে আসে-

আমার একটাই গন্তব্য ছিল তুমি

তােমারও গন্তব্য আছে তাই

বারবার তােমাকে হারাই

ভুল পথে ক্লান্ত হই, নিজের অজ্ঞাতে বারবার

নিজের দরােজায় এসে দাঁড়াই, এবং

আমার একটাই গন্তব্য থাকে তুমি।

আহসান হাবীব দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি অনেক লেখক তৈরী করেছেন। তাঁর নিপুণ সম্পাদনায় উজ্জ্বল হয়েছে দৈনিক বাংলার সাহিত্য বিভাগ। প্রেমের কবিতায় অনন্য আহসান হাবীব পেমের পরিণতিহীনতা ব্যর্থতায় নিরাসক্ত জীবনের বিষাদ বেদনা এবং সফল প্রেমের আনন্দ বিলাসিতা সুখানুভূতি একই সাথে সন্নিবেশিত করেছেন। তিনি প্রেমের কবিতায় অভিনব রীতি সৃচিত করেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ক্ষমতা এবং গভীর পর্যবেক্ষণশক্তি দিয়ে মানুষের অনুভূতির জায়গাগুলাে তিনি স্পর্শ করেছেন। তিনি মানবপ্রাণে প্রেমের অস্তিত্ব আবিস্কার করেছেন নানাভাবে। প্রেমশূন্য মানুষ হয় না। প্রেমের কারণে মানুষ আবেগতাড়িত হয়। প্রেমাবেগ মানুষকে কখনাে ভুল পথে নিয়ে যায়। আবার কখনাে ভুল শুধরে নেয়ার প্রেরণা দেয়।

মন্তব্য: