উষ্ণতার কাব্য, কাব্যের উষ্ণতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মনিরুল মনির

তাপদাহ। পুড়ছে। সব পুড়ে যাচ্ছে, শুষে নিচ্ছে জল-হাওয়া। সাহস পাচ্ছি না। ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছে করছে না। এই বৈশাখ, এই চরম গরম। এই গ্রীষ্মকাল, প্রচণ্ড উষ্ণতা। অথচ শ্রমজীবী মানুষ এই পোড়া বাতাস, জল খেয়ে বেঁচে উঠছে। বাঁচা, শুধু বেঁচে থাকা। আশায় বেঁচে থাকা। ভাবছিলাম আশা নিয়েই রোদে নেমে পড়ি। যদি কিছু পাই এই জল-হাওয়ার দুর্ভেদ্য আয়োজনে। এখানে ভালোবাসা বড়ই একা। একা হয়ে পড়ি। পুড়ি;- কখনো বিষাদে, কখনো রোদে। পুড়তে পুড়তে আমরা কেবল নিখাদ হতে থাকি। হয়তো এখন আমাদের মধ্যে মায়া কমে গেছে, কমে গেছে দিগন্ত বিস্তারী কোনো সুখ। সেই সুখের বিমুখে কতশত যন্ত্রণা। বদলে দিচ্ছে আমাদের। বদলে যাচ্ছি অনায়াস অসুস্থতায়।

বদলে গেছে পৃথিবীর হিসেব-নিকেষ। পৃথিবী এখন অসুস্থ। তার জল ও বাতাসের মধ্যে কেবলই বিরূপ-বিমুখের প্রতিক্রিয়া। ক্রমশ ধেয়ে আসছে বিপর্যয়। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের এই কালে তাপ যেমন বেড়েছে, তেমনি এর স্থায়ীত্বও বেড়েছে। নির্দিষ্ট কোনও কৌশলে সীমাবদ্ধ না থেকে এখন এই জলবায়ুর পরিবর্তনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। শুধুই উষ্ণতা, শুধুই নিয়ম নড়ে যাওয়ার ইতিহাস। আমরা যেমনটা ভেবেছি যে, ছয় ঋতুর প্রভাব আমাদের গৌরবান্বিত করবে। কিন্তু তেমনটা আর হচ্ছে না। এখন ঋতু বৈচিত্র্যেও এসেছে পরিবর্তন। শীতের স্থায়ীত্ব খুব কম, আবার যে ক’দিন শীত থাকে প্রচণ্ড শৈত্য প্রবাহে কাটে। ঐদিকে বৃষ্টি সময় না মেনে এলোমেলো করে আসে। ঠিক যখনটা হওয়ার প্রয়োজন, তখন হয় না। আবার বাতাসের গতি ঠিক থাকছে না, হয়তো বেড়ে যাচ্ছে নয়তো কমে যাচ্ছে। উষ্ণতা, বাতাসের সাথে বাড়ছে উষ্ণতা। যেন অবিরাম পরিবর্তন, অবিরাম চলনই তার উদ্ভাস।

উষ্ণ মন, উষ্ণ পৃথিবী

মন ভালো নেই। শরীর বেসামাল। মৌসুমী বায়ুর গতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময়ের পরিবর্তন হয়ে গেছে। বেড়ে গেছে তাপমাত্রা। উষ্ণায়নের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে ১৯৯৭ সালের পর থেকে ক্রমশ প্রতিবছর উষ্ণতা বেড়েছে। বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে, ২০১৪-১৫ সাল ছিল পৃথিবী উষ্ণতম বছর। এর আগে ২০১০ ছিল উষ্ণতম বছর।

পৃথিবী ক্রমেই উষ্ণ হচ্ছে। কেননা, গ্রিনহাউজ গ্যান নিঃসরণ হচ্ছে। অর্থাৎ বায়ুতে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অর্ধেকের চেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এখন সবুজ বিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যত বেশি সবুজ থাকবে, গাছ থাকবে; ততই কার্বণ গাছ শুষে নিবে। এখন গাছই তো নেই। সব কেটে উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের কথা বলি, এখানকার বনগুলো প্রতিবছর কমছে। সুন্দরবন, মধুপুর বনাঞ্চল, চকরিয়া সুন্দরবন, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল কমেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মানুষের অমানবিক শাসনের আঘাত প্রকৃতি সহ্য করতে না পেরে বিপর্যয়ের হুমকিতে পড়ে গেছে।

এদিকে বিজ্ঞানীরা বলছে, উষ্ণতায় উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে পানির উচ্চতা বাড়ছে। এই অবস্থা বেশ কিছুদিন ধরে অনবরত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে দীর্ঘ সময় থাকে। এর ফলে উষ্ণতার যে বৃদ্ধি ঘটে, তা বায়ুমণ্ডলেই থেকে যায়। একবার যদি তাপমাত্রা ভারসাম্যের বাইরে চলে যায়, সে প্রক্রিয়া আর সহজে থামে না। বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াসে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে গড়ে দুই মিটার।

ওদিকে নিম্নাঞ্চল তথা বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ পড়বে মহাবিপর্যয়ে। পানি বেড়ে গিয়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। ফলে লবন পানি আমাদের নদ-নদীকে প্লাবিত করবে। আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। দীর্ঘস্থায়ী প্লাবন দেখা দিবে। তখন কী হবে?

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের তথ্যে জেনেছি, আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুভূমির মতো দেখা দিতে পারে। উত্তরাঞ্চলে কিছু এলাকায় গাছ নেই বললে চলে। ফলে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি সংকট দেখা দিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে গেছে অধিক পানি সংগ্রহের কারণে। কৃষি জমি পড়েছে সংকটে। সেচের পানি পাচ্ছে না। নিয়মতান্ত্রিক পর্যায়ে এসে উৎপাদন সংকটে আছে দেশ। ওদিকে প্রতিবেশি দেশগুলোতে আমাদের নদীগুলোর উৎসস্থল হওয়াতে একতরফাভাবে পানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। নদীগুলো শুকিয়ে আছে। নদীগুলো কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। আর বর্ষা মৌসুমের পানিও বেশিদিন ধারণ করে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের এক জরিপে দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে ২০১০ সালে পানির স্তর নেমেছে ২২.৭৫ মিটার নিচে। যা ১৯৯৫ সালে ছিল ১১.৯৫ মিটার নিচে। এই কুড়ি বছরে আমূল পরিবর্তন। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এখানকার জলাশয়গুলো পানিশূন্য থাকে বছরের বেশিরভাগ সময়। এখন কী হবে? আমাদের সেই সুজলা দেশটির অবস্থা কী দাঁড়ালো!

এত কিছুর পর পৃথিবী কী ভালো থাকে। পৃথিবীময় লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছে। বন্যা, দুর্ভিক্ষের কারণে উদ্বাস্তু বেড়ে যাচ্ছে। নদী ভেঙে নিয়ে গেছে ঘর, গৃহহীন মানুষ। অভিবাসন করতে চাইছে অনেকে। এখন বিভিন্ন সময়ে দেখা যাচ্ছে একটা শ্রেণী বড় বা ধনী দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নানা রকম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ‘মানবপাচার’ নামে নতুন সংকটে পড়েছে অনেক ধনী দেশ। সামাল দিতে পারছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ে শিকার দেশগুলো থেকে উন্নত বা ধনী দেশগুলো বৈধ-অবৈধ পথে পাড়ি জমাচ্ছে অনেক লোক।

এই যে সংকট, এই অস্বাভাবিক অবস্থা এর জন্য দায়ী কে? ধনী দেশগুলো এই বিপর্যয়ের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। অথচ ধনী দেশগুলোই বায়ুর কার্বন বৃদ্ধি। নগরায়নে এরা পরিবেশ বিরুদ্ধ আচরণ করে গেছে দিনের পর দিন। পুঁজির উত্থান ছোট দেশগুলোর উপর চলছে ধনীদের শাসন। সেই শাসনে কড়া মাসুল গুনতে হবে সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে।

কার্বন বাণিজ্য

পৃথিবীর কোথাও আজ আর রক্ষা করার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতির উত্তরণের প্রচেষ্টা লক্ষ করছি না। এরপরও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ নিয়েছে কিয়োটো প্রটোকল। সেখানে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার, হেক্সা-ফ্লোরাইড, হাইড্রো ফ্লুয়ো কার্বন, কপার ফ্লুয়ো কার্বন স্যালিকে গ্রিন হাউস গ্যাস বলে বিধৃত করা হয়। সেখানে আরো বলা হয় কার্বন বাণিজ্যের। তার মানে বাণিজ্য করতে হবে। এই পুঁজির যুগে বাণিজ্যের এ-অন্যরকম চিন্তুা। কেমন তা? যে বাণিজ্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে চায়। চাওয়াটাকে অধিকারে পরিণত করতেই বাণিজ্যটি হচ্ছে। তা বিনে পয়সা কিংবা নিলামে ডেকে অর্থের বিনিময়। মূল কথা অধিকারটি কিনতে চায়। বড় বড় দেশ কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠান এই অধিকার নিতে চায়। এখন কথা হচ্ছে জোর করে অধিকার নিলে, তা হবে বিশ্বের জন্য হুমকি। আর আদালতে গিয়ে প্রচুর অর্থ খরচ করে অধিকার নিতে চায়। কেউ কেউ হয়তো এই বাণিজ্যের সাথে ‘অধিকার’ শব্দটি জুড়ে দিতে নারাজ। আমাদেরও কথা তাই, কিসের অধিকার? কেন এমন আত্মঘাতি অধিকার তাদের দিতে হবে। বরং কীভাবে এই ক্ষতি কমানো যায় সেই চেষ্টা করা যাক।

আর ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড চালু করেছেন যারা, তাদের মতে গ্রিনহাউস মুক্ত হবে পৃথিবী। ২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ১৮৩টি দেশ এই প্রটোকল সই করেছে, তা অনুমোদন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদন করে নি। জোর খাটিয়ে গেছে। এই চুক্তি অনুযায়ি জার্মানি ছাড়া অন্য দেশগুলো কার্বন নির্গমন কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।

এতো কিছু হচ্ছে, এরপরও বিশ্ব মানবতার টিকে থাকার দিকটি কারো আমলে মজবুতভাবে আসে নি। ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড চালু থাকলে সব দেশে কার্বন এর দর একই রকম থাকবে। তখন বৈষম্য দেখা দিবে। এই ট্রেডের অধীনে সে সব পণ্য উৎপাদিত হবে, তা চরম দাম দিয়ে ক্রয় করতে হবে। এই কুফলতা নিয়ে কী ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড হবে? বাজারে নেমে আসবে বিপর্যয়।

বিপন্ন পৃথিবী

মান্থলি রিভিউ সম্পাদক জন বেলামি ফস্টার আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে জলবায়ু সঙ্কট, প্রতিবন্ধকতা ও মানুষের দ্বারা বদলে যাওয়া পৃথিবী নিয়ে দি ভালনারেবল প্লানেট (বিপন্ন পৃথিবী) বইটি রচনা করেন। তখন সমালোচকরা বলতে থাকেন, পৃথিবী নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের বলা হচ্ছে। কিন্তু আজ সবক’টি বিষয় মিলে যাচ্ছে। মানুষ সৃষ্ট এই পরিবর্তন আজ পৃথিবীকে মহাসঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। ফস্টার বলেন, ‘মানুষের হাতে পৃথিবীর রূপান্তর এমনভাবে ঘটেছে যে, মাত্রা, হার ও পরিবেশ পরিবর্তনের দিক থেকে তা নজিরবিহীন। বিগত চারশ’ বছর ধরে চলতে থাকা অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহের ফল হচ্ছে এ অবস্থা। পৃথিবীর এ রূপান্তর এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা আমাদের সীমিত প্রতিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা পৃথিবীতে জীবনের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।’

আসলে এই অর্থনৈতিক বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য মানুষ পৃথিবীর প্রতিবেশকে ক্রমান্বয়ে শাসন করেছে। সেই রূপান্তরটি ফস্টার ব্যাখ্যা করছেন সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করে। পৃথিবীর প্রতি এমন অবিচার যে খুব বেশি সুষ্ঠু ছিল, তা-নয়। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিবেশ বিষয়ে সমীক্ষা বেয়োন্ড দি লিমিটসয়ে লেখক ডোনেলা মিডোজ, ডেনিস মিডোজ ও ইয়র্গেন র‌্যান্ডার্স গুরুত্বপূর্ণ শেষ সীমানা সংক্রান্ত ধারণাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্যাপারটি বোঝা সহজ হবে, যদি মনে করা হয় যে, উৎপাদন হচ্ছে, “মানুষের অর্থনীতির মাধ্যমে পৃথিবীর সম্পদরাজি ও ইন্ধনের উৎসসমূহ থেকে সৃষ্ট সামগ্রী, যা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আবর্জনা বা দূষণ ঘটানোর উপাদান হিসেবে ফেলা হয়।” এ ধারণা দাঁড় করানো হয়েছে তাপ-গতিবিদ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে। এই দুটি সূত্রে বলা হয়েছে যে, বস্তু ও শক্তি শেষ হয় না, রূপান্তর ঘটে; শক্তি এমন তাপে রূপান্তরিত হয়, যা ব্যবহার করা যায় না; এবং বিভিন্ন সামগ্রী একশ’ শতাংশ পুনঃব্যবহার করা যায় না। ব্যাপারটি আরো সহজভাবে বলা যায় : মানুষের সমাজকে টিকিয়ে রাখে ও উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয়, এমন অনেক ইন্ধন ও সামগ্রীর গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলো শেষ হয়ে আসছে আর আবর্জনা ও বিভিন্ন ব্যবহৃত উপাদান ফেলার স্থানগুলো কানায় কানায় ভরে গেছে। যেসব উৎস থেকে ইন্ধন বারবার পাওয়া যায়, সেই উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে আবাদযোগ্য জমি, পানি, বন এবং বিভিন্ন প্রজাতি। এগুলো এমন হারে ব্যবহার করা হচ্ছে যে, এসব টিকে থাকবে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’

এই রূপান্তরে ঘটে যাওয়া জমি, বন ও পানি বদলে গেলে মানুষের ধরন পাল্টে যাবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। মানুষের প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। বিরূপ-বিকৃতির মানুষ জন্মাতে দেখা যায়। এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বিস্ফোরণ। যা ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা। আজো সেখানে বিকলাঙ্গ মানুষ জন্মায়। আমরা আমাদের চারপাশেও দেখতে পাই। নানারকম দূষণের কারণে সমাজে বিরূপ মানুষ জন্মাচ্ছে। এর জন্য দায়ী কারা। সবকিছুর সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন লক্ষণীয়।

মারাত্মক স্মৃতি : ঊনত্রিশ এপ্রিল উনিশ’ একানব্বই

স্মৃতিতে এখনো আছে সেই বিস্ময়ের রাত। উনিশ’ একানব্বই সালের উনত্রিশ এপ্রিল। ভয়াবহ এক রাত। সাগর-নদী-জল-মানুষ-ঘরবাড়ি-গাছ-পশুপাখি সব একসাথে মিশে গেছে। ঘূর্ণিঝড়। সে এক মহাপ্রলংকর। তছনছ করে দিয়ে গেছে। মানুষের মন-ঘর উড়িয়ে নিয়ে গেছে। লাল বাতাস, আগুন বাতাস। যেদিক দিয়ে লাল কিংবা আগুন বাতাস যাচ্ছে, সেদিকে গাছ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আকাশে উড়ছে পাতা, গাছ, বন, পাখি, মানুষ, মানুষের ঘরের টিন। ভেঙ্গে পড়ছে গাছ, ঘর নিয়ে গেছে। পাহাড়ের গাছ ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। সাগরের জল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মানববসতী। হায়রে বিভীষিকা। মানুষ নেই শুধু লাশ। উপকূলবর্তী মানুষ জীবনের ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে। কোনো কোনো পরিবার একেবারে নিঃস্ব। হয়তো একজন ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। কোথাও একজনও নেই। কোথাও স্বজনদের মরতে দেখেছে নিজে বাঁচাতে পারে নি, নিজে মরে গেছে কাউকে বাঁচিয়ে স্মরণ হয়ে আছেন। এই যে বিষময় স্মৃতি।

প্রকৃতিকে মানুষ খুব শাসন করেছে। নদী শাসন, গাছ কেটে, বন উজাড় করে। প্রকৃতিও যে এমন রুদ্র, রুক্ষ, ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সেটি ছিল আমার জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তখন ছিল বৈশাখ মাস। সবেমাত্র চট্টগ্রাম শহরের বৈশাখ উদযাপন শেষ। লালদিঘির পাড়ে বৈশাখে মেলা চলছে। কোনো কিছুই রইল না। পরের দিন থেকে কয়েকদিন স্কুল বন্ধ। আমরা চলে গেছি সেই কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। একে একে লাল-কালো পানি ভেসে আসছে। দুর্গন্ধ। মানুষের শব, পশুর শব বোঝার কোনো উপায় নেই। মানুষের যে লাশটি ভাসছে তার শরীরে কোনো পোশাক নেই, পুরো শরীর পুড়ে গেছে। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, নোয়াখালী অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ। সমুদ্র উত্তাল হওয়ার কারণে কেউ যেতে পারছে না। একদিন পর সংবাদপত্রগুলোতে আসতে শুরু করলো ছবি- সেখানে দেখলাম শিশু, নারী-পুরুষের লাশ নদীতে ভাসছে, শুকনো গাছে ঝুলছে লাশ। কেউ কেউ বলছেন শত বছরের ইতিহাসে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

উষ্ণতার কবিতা

পরিবেশ ভাবনা মানুষের মধ্যে নতুন চিন্তা নয়। মানুষের বোধের সাথে সম্পর্কিত। সাধারণ অনুভূতি নিয়ে নাড়া দেয় যে সকল শব্দ, নিপাট উচ্চারণ, তা-ই কবিতা হয়ে ওঠে। তাপদাহের কবিতা। খরার কবিতা। শুরু করা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা দিয়ে : ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।/মুছে যাক সব গ্লানি। মুছে যাক জ্বরা/অগ্নিøানে দেহে-প্রাণে শুঁচি হোক ধরা।’ এই রূপকের ধার দিয়ে যায় মনে। মনের ময়লা মুছে নতুন দিনের সূচনা হোক। কিন্তু দুঃখ-যন্ত্রণাও মুছে নিতে আসে এই রুদ্র বৈশাখ। এই দাহ, এই সময়ের কবিতা। তারও আগে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন : ‘বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।/তরুতল নাহি মোর করিবে পসরা।/পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।/ফিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন।’ আহা কী গরম, আহা কী উষ্ণ হয়ে যাওয়া শরীর। যেন বসন খুলে নিতে চায়।

আবার কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের প্রতীক রূপে এই দহনকালকে উপস্থাপন করেছেন : ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর/প্রলয় নূতন সৃজন বেদন/আসছে নবীন জীবনধারা অসুন্দরে করতে ছেদন/তাই যে এমন কেশে-বেশে/মধুর হেসে/ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর…।’ জীবনানন্দ দাশ বলে যাচ্ছেন : ‘ঘুমিয়ে পড়ব আমি একদিন/তোমাদের নক্ষত্রের রাতে/শিয়রে বৈশাখ মেঘ সাদা/যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়।’ চিরকালীন করে রেখেছেন এমন রুদ্র প্রকৃতিকে। বৈশাখ, রুদ্রকাল, তাপদাহের কবিতা লিখেছেন আরো অনেকেই… প্রকৃতির রূপ বর্ণনা ছাড়াও বৈশাখ নিয়ে উন্মাদনা রয়েছে প্রচুর। সেই তাপের মধ্যে আলো ঝলঝম কিংবা বিদ্রোহের গর্জন রয়ে গেছে। ঘটে গেছে বিপ্লব। ঘটে গেছে অগ্নিøান।

চাই পরিবেশগত বিপ্লব

এত উষ্ণতা আমাদের মধ্যে প্রশান্তির ছায়া নিয়ে আসে নি। আমরা ভাবছি, ভাবছি জীবনের মায়াহীন অস্তিত্বের কথা। পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে নানারকম জটিল রাজনীতির দিকে দৃষ্টি গেছে, কিন্তু সমাধান মিলে নি। বিজ্ঞানে আবিষ্কার করা গেছে, অপব্যবহারে সব তছনছ হয়ে গেছে। আসলে দূষণ একটা সামগ্রিক বিষয়। একে সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধনী দেশের রাজনীতির কারণে গরীব দেশেরও এই বিপর্যয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর জন্য চাই সামগ্রিক আন্দোলন। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দায়িত্ব ও নিজের ভেতরকার মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বাঁচবার জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো সঠিক পন্থায় এগিয়ে নিতে হবে। পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকে এড়িয়ে গিয়ে প্রযুক্তির যুক্তিযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। গবেষণা ও বিপর্যয় এড়াবার কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেনের কথা থেকে বলি, “পরিশেগত মূল্যায়নের নরম্যাটিভ ফ্রেমওয়ার্ক অনেক কিছু দাবি করে। এর মধ্যে উল্লেখ্য, মূল্যায়নধর্মী সাউন্ডনেস, জ্ঞাত প্রয়োগের সম্ভাবনা এবং যৌক্তিক সমষ্টিগত ব্যবহার। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় একটি নরম্যাটিভ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে গেলে অবশ্যই সেখানে রাজনীতি ও জনযুক্তি, বিজ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্ব এবং এথিক্সের মতো বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে।” প্রকৃতির প্রতি ন্যায্য আচরণই আমাদের প্রশান্তির দ্বার উন্মোচিত হতে পারে।

মন্তব্য: