কবিতার নেপথ্য কথা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মােহাম্মদ নূরুল হক

কবিতা সম্পর্কে এযাবত যত কথা বলা হয়েছে, তার সবই কবিতা লিখিত হবার পরের কথা। কিন্তু কবিতা লেখার পেছনে কী বিশেষ যন্ত্রণাবােধ কাজ করে, সে সম্পর্ক বিশদ কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। কবিতা সম্পর্কে প্লেটোর ‘Poetry is inspired madness’, R Matthew Arnold’a এর criticism of life’ কিংবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনেক রকম কোনও সংজ্ঞাই সার্বজনীন নয়। শিল্পের কোনও প্রকরণেরই সার্বজনীন কোনও সংজ্ঞা কিংবা ব্যাখ্যা দাঁড় করানাে সম্ভব নয়। কোনও প্রপঞ্চ সম্পর্কে যখন কোনও সার্বজনীন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়, কিংবা কোনও সর্বজন গ্রহণযােগ্য ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব হয় তাহলে সে প্রপঞ্চ শিল্পের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য। শিল্পে ধ্রুব সত্য বলে কোনও সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া যায় না। কারণ ধ্রুব সত্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বক্তব্য পেশ করতে গেলে ব্যক্তির চিন্তার মৌলিকত্ব প্রমাণ হয়তাে সম্ভব হয়, কিন্তু তাতে শিল্প তার মৌলিকত্ব হারায়। সঙ্গত কারণে শিল্পে ‘নানা মুনির নান মত’ কথাটি আপ্তবাক্যের মর্যাদা পেয়ে বসে। কবিতা কী? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার রুচিবােধ এসময়ের কাব্যপাঠকের আছে বলে মনে হয় না। যারা এ প্রশ্ন আজও করার আশা পােষণ করেন, তারা পরীক্ষার্থী অথবা পরীক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেন মাত্র। কবিতার রসােদ্ধার তাদের অসাধ্য। কারণ কবিতা একান্তই উপলব্ধি ও উপভােগের বিষয়। ভােগ করার মতাে স্পৃশ্য শরীর এর নেই। তাই ভােগের প্রশ্নে কবিতা অনঙ্গ। সে অনঙ্গ শিল্পের পথে একাকী রাতখচিত সময় কাটান কবি। কবির অনিদ্রা কবিতার সৃজন মুহূর্তের পূর্বাভাষও।

শিল্পকলার তুমুল দ্বন্দমুখর প্রপঞ্চের নাম কবিতা। কবিতা কেবল বিশেষ প্রকরণে আত্মপ্রকাশ করে না। সমকাল যে কবিকে স্বীকৃতি দেয় না, মহাকাল সে কবিকে আবিষ্কারের নেশায় মাতাল হয় না। যে কবিতা সমকালে পাঠকমনে দোলা দিতে অসমর্থ, সে কবিতা মহাকালের সিঁড়িতে উত্তরণের পথই খুঁজে পায় না। যুগে যুগে চর্যাপদ রচিত হয় না। বছরে বছরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন না। জন্মগ্রহণ করেন না বুদ্ধদেব বসুও। তার জন্য হাজার বছরের সাধনার প্রয়ােজন। যে কবি সমকালের উত্তাপকে আত্মস্থ করে, সমকালের প্রধান অসুখকে কবিতায় রূপান্তর করার সামর্থ রাখেন, তিনি সমকালে যেমন নমস্য, মহাকালেও পূজনীয়। কখন একটি কবিতা কবির মস্তিষ্কে ঘাই মারে? কবিতা অনেকটা ঐশী বাণীর মতাে যদিও কবিকে প্রকম্পিত করে তােলে, তবুও কবিতা কোনওমতেই ঐশিবাণী নয়। কারণ ঐশী বাণীর উদ্দেশ্য নীতিবােধ ও স্বর্গ-নরক, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্যবােধের জ্ঞান বিতরণ। কবিতায় নৈতিকতার প্রশ্ন অবান্তর। ধর্মের সঙ্গে এখানে কবিতার বিরােধ আপাতত দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। ধর্মের জ্ঞান অজ্ঞর জন্য,

কবিতার সৌন্দর্য রসপিপাসুর। সেখানে জ্ঞানের ভান নয়, রসের প্রস্রবনই কাম্য। সুতরাং ধর্মের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় নয়। কবিতায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ স্বাগত হতে বাধাও নেই। তাই কবিও ধর্মাবতারের মতাে দৈববাণী শােনাতে পারেন। সে বাণী ধর্মবাক্যের মতােই মাদকতাপূর্ণ। ধর্মবাক্য শুনে মানুষ যেমন বিগলিত হয়, কবিতার পঙক্তি শুনেও তার মনে এক ধরনের ভাবনার উদ্রেক হয়। যা তার মনের সমস্ত কালিমাকে খুয়ে মুছে শাদা করে দেয়। কবিতায় বলা সম্ভব, “তুমি মঙ্গল করাে, নির্মল করে মলিন মর্ম মুছায়ে

Shall I say, I have gone at dusk through narrow streets

And watched the smoke that rises from the pipes

Of lonely men in shirt-sleeves, leaning out of windows?

I should have been a pair of ragged claws

Scuttling across the floors of silent seas

(The Love Song of J. Alfred Prufrok: T S Eliot)

জরাজীর্ণ পথিবীর বয়স বেড়ে যায়। বয়স বেড়ে গেলে বার্ধক্য এসে যায়। তখন মানুষের যাপিত জীবনকেই মানুষের মনে হয় ক্লিশে। ফিকে হয়ে আসা জীবনের এ সংক্রমণে মান দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করে। কিন্তু চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাকে ঠেকাতে না পেরে মনােজগতেই সে আত্মহননের পথ বেছে নেন। কিন্তু সে পথ খুব সহজভাবে তার কাছে ধরা দেয় না। কেবলই অচরিতার্থ জীবনের জন্য হাহাকারে তার বুক ভরে ওঠে। সে হাহাকারের রূপ কবিতা হয়ে কবির মস্তিষ্কে অনুরণন তােলে। যে মর্মজ্বালা থেকে এলিয়ট The Love Song of J. Alfred Prufrok কবিতাটি লিখেছিলেন, সে অন্তর্জালা জীবনানন্দ দাশকেও প্রণােদিত করেছিল। তাই জীবনানন্দ দাশও লিখেছিলেন, ‘আট বছর আগের একদিন নামক কবিতাটি। যেটি অনেকটা এলিয়টের ভাবসূত্র বলেই মনে হয়। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের ওপর ইয়েটসের প্রভাব বেশী হওয়ার দরুণ এলিয়টের প্রভাবের বিষয়টি পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। প্রভাবের বিষয় উজিয়ে বলা যায়, অভিন্ন বেদনাবােধ থেকে ভিনভাষার দুই কবির দুটি কবিতার অন্তর্গত সুর এক ও অভিন্ন কী করে সম্ভব?

কোনােদিন জাগিবে না আর

জাগিবার গাড় বেদনার

অবিরাম-অবিরাম ভার

সহিবে না আর

এই কথা বলেছিলাে তারে

চাঁদ ডুবে চলে গেলে অভ্ভুত আঁধারে

যেন তার জানালার ধারে

উটের গ্রীবার মতাে কোনাে এক নিস্তব্ধতা এসে।

(আট বছর আগের একদিনঃ জীবনানন্দ দাশ)

মূলত হতাশা ও বিষণ্নতাবােধ এবং বিচ্যুতি থেকেই এ ধরনের মনােবিকাশের সৃষ্ট। যে ব্যাধির ফলে এলিয়ট এমন যুগান্তকারী কবিতা উপহার দিতে পেরেছেন, সে একই বিষয়কে উপজীব্য করে জীবনানন্দ দাশও ব্যক্তিমানুষের অব্যক্তেয় বিষয়কে বাঙ্ময় করে তুলেছেন। মানুষ অকারণ বেদনায়ও নীল হয়। এসব অনিকেত মানুষ রােদনবিলাসী এবং আপন অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন না হওয়ায় সাঁত্রের অস্তিত্বাদী চেতনা এধরনের মানুষের ঠাঁই পায় না। যে ধরনের জীবন-যাপনের ফলে একজন ইয়েটস, এলিয়ট, এজরাপাউন্ড, র্যাবো, বােদলেয়ার, টেডহিউজ কিংবা ভর্লেম কবিতাকে আপন ইচ্ছা চরিতার্থ করার স্মারক করে তুলেছেন, সে ধরনের জীবন যাপন জীবনানন্দ দাশ কিংবা অন্য কোনও বাঙালি কবির ভাগ্যে নেমে আসেনি। তাই তাদের মতাে করে বাঙালি কবির আত্মবিলাপ পাঠকের কানে কিছুটা কৃত্রিম শােনায়।

জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মানুষ যেমন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হতে শেখে, তেমনি কবিও প্রতিটি কবিতা সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তে এক অলৌকিক অভিজ্ঞতার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে থাকেন। সবাই সে সৃজনযন্ত্রণা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে না। যিনি পারেন তিনি কবি। বাকিরা তার উপগ্রহ। জীবনানন্দ দাশ যাদেরকে উপকবি বলেছিলেন, তারা কবিতার সৃজন বেদনা সম্পর্কে কোনও রকম ধারণাই লাভ করতে পারেন না। কারণ, তাদের সে সংবেদনশীল মন ও হৃদয় নেই। তারা শুধু ওপর চালাকি দিয়েই চমক সৃষ্টির মহড়া দিয়ে যান। তাদের সে মহড়া দেখে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাতে প্রকৃত কবিতার পাঠক্রিয়ায় কোনও প্রভাব পড়ে না।

প্রকত কবি ধর্মাবতারের মতাে অলৌকিক গুণসম্পন্ন বলে কোনও কোনও সময় তাৎক্ষণিক তাকে সমাজ চিনতে ভুল করে। সে ভুল দীর্ঘস্থায়ী হয় না কোনও কালে। অল্পদিনের ব্যবধানেই কেউ না কেউ এসে প্রকৃত কবিকে মূল্যায়নের ব্রত নিজ কাঁধে তুলে নেন। চর্যাপদ হাজার বছরের নেপালের রাজদরবারে পড়েছিল একথা সত্য। কিন্তু প্রকাশের সাথে সাথে যে, এ গীতিকাগুলাে পঠিত হয়নি, তার কি যৌক্তিক প্রমাণ আছে? সমকালে যদি নাই পঠিত, সমাদৃত হবে, তাহলে নেপালের রাজদরবারে কেন তার ঠাই হবে? কেন সে পাণ্ডুলিপি রাজকীয় মর্যাদায় হাজার ধরে সযত্নে রক্ষিত হবে? একথা সত্য যে, একজন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ছাড়া সে বৌদ্ধ দোঁহাগুলাে যথাযথ মর্যাদা হয়তাে কেউ দিতে পারতাে কিনা, এটাও বিরাট এক প্রশ্ন। উত্তররৈবিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে একজন জীবনানন্দ দাশ

সমকালে অপঠিত ছিলেন, এমনটা বলা যায় না। তার প্রচুর লেখা ট্রাংকভর্তি ছিল বলে, তিনি প্রকাশবিমুখ ছিলেন, এমন যুক্তিরহিত কথাও টেকে না। লিখেছেন অসংখ্য। সব লেখা তাৎক্ষণিক ছাপানাের প্রয়ােজন মনে করেননি বলেই হয়তাে প্রকাশ করেননি। যেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার সবগুলাে প্রশংসিত হয় নি। কিন্তু কিছু কিছু লেখা বুদ্ধদেব বসুকে মুগ্ধ করেছিল বলেই বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করেছিলেন।

কবিতা কবির দিনলিপিও। কবি যে জীবন যাপন করেন, তাকে কবিতাযাপনও বলা চলে। প্রকৃত কবি কবিতা অন্ত:প্রাণ; সার্বক্ষণিকও। একজন কবি খণ্ডকালীন কবি হতে পারেন না। প্রকৃত কবির যেমন কোনও ব্যস্ততা নেই, তেমনি অখণ্ড অবসরও নেই। তাই কবিকে হতে হয় নিরন্তর সৃষ্টিশীল। সৃষ্টিশীল ক্ষমতাই কবির অভিপ্রায়কে শিল্পিত মহিমায় মহিমাম্বিত করে তােলে। সৃষ্টির প্রাচুর্যের ভেতর অনেক সময় অপচয়ের পরিমাণও অসহনীয় হয়ে ওঠে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা শামসুর রাহমান প্রচুর লিখতে গিয়ে অনেক

অকিবতাও লিখেছেন। আপাতত যেসব কবিতাকে অকবিতা বলছি, সেসব কবিতারও কোনও কোনও পঙক্তি, কোনও না কোানও চিত্রকল্প এমন মৌলিক ও অভিনব যে, সে রকম একটিমাত্র পঙক্তি কিংবা চিত্রকল্পের জন্যও সে কবি মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী আসন লাভ করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রাচুর্যই তার সৃষ্টিকে বিচিত্রমুখী করে তুলেছে। ফলে জীবনের সমস্ত দিকচক্রবালের ছবিই তিনি এঁকেছেন ক্লান্তিহীন নৈপুণ্যে।

এত কথার পরও যে সত্য কবির শক্তিমত্তাকে সগৌরবে প্রচার করে, সেটি তার সৃজনক্ষমতা। ছাড়া আর কী? সৃজনীশক্তিই কবির মৌল অভিজ্ঞান। পদকর্তা বল্লভের মুখে যখন শুনি-

কত মধুযামিনী রঙ সে গোঁয়াইলু

না বুকল কৈছন কেল।

লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু

তৰ হিয়া জুড়ন না গেল।

তখন একটি ঘােরের ভেতর মানবমনের অনিয়ন্ত্রিত আবেগের একটি বহিপ্রকাশ মাত্র দেখি। সেখানে হৃদয়বৃত্তির চেয়ে বড় কোনও দর্শন কিংবা নীতিবােধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। কবির শক্তি উপলব্ধির চিহ্ন কী? কবিতায় বক্রোক্তি ও চিত্রকল্প কিংবা উপমার সুসামঞ্জস্যও অনেক সময় কবিতাকে কেবল বুদ্ধির স্মারক করে তােলে। সেখানে প্রাণচাঞ্চল্যের কোনও

প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে কবিতা পাঠকের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। কবি কোনও কোনও সময় কবিতার ভেতর আত্মপ্রকৃতিও এঁকে রাখেন। আত্মপ্রকৃতি আঁকার বাসনা থেকেই কবি দীর্ঘকাল যাবত একটি অখণ্ড কবিতাই লেখার সাধনা করে আসছেন। কিন্তু কোথাও তৃপ্ত হওয়ার অবসর নেই তার। তাই অতৃপ্ত মন সারাক্ষণ তৃষ্ণার জল খুঁজে ফেরে। তার সন্ধান সহজে মেলে না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কবি কবিতায় মনােলােগও বৈঠকী ঢংয়ের মর্যাদা পায়।

সেই কবি মাের মতে কল্পনা সুন্দরী

যার মনঃকমলেতে পাতেন আসন।

অন্তগামী-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি

ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।

এখন প্রশ্ন হলাে, এখানে কবির সৃজনবেদন কতটা প্রকাশ হয়েছে? কবি নামক একটি পরিচয়ের ব্যাখ্যা ছাড়া এখানে আর কী আছে? যা আছে তা বুঝতে হলে, যা থাকা দরকার তা হলাে রসজ্ঞ পাঠকের রসবিচারীমন। এর ব্যতিক্রমে উপর্যুক্ত পঙুক্তিগুলােতে কবির মর্মজালা কত গভীরভাবে প্রকাশিত তা উপলব্ধি সম্ভব নয়।

কবিতা শেষ পর্যন্ত ব্যাখ্যার অতীত প্রপঞ্চ হিসেবে চিহ্নিত। কবিতার সাধারণ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। কবি কবিতাকে চিত্তের এমন স্তরের বিষয় পরিণত করেন, যেখান থেকে কবিতাকে নিছক বুদ্ধির মারপ্যাচ দিয়ে বােঝার বিষয়ে পর্যবসিত করা যায় না। কবির কাছে তাইকবিতার ব্যাখ্যা চাওয়াও ধৃষ্টতার সামিল। জীবনানন্দ দাশ একবার কবিদের পরামর্শ দিয়েছিলেন নিজের কবিতার ভাষ্য লেখার। নিজের কবিতার ভাষ্য লেখার অর্থ হলাে, নিজের কবিতাকে বহুরৈখিকতা থেকে একরৈখিকতার দিকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া। কবির

ভাষ্যপড়ে কবিতা পাঠ করলে পাঠকের স্বাধীনচিন্তার পথ রুদ্ধ হয়ে আসে। একঅনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হতেই অব্যাখ্যেয় বাণী কবি শােনান। বিষ্ণুদে’র ‘সে কবে’ কবিতায় সেরকম অভিজ্ঞানই সত্য।

সে কবে গিয়েছি আমি তােমার কীর্তনে

কৃতার্থ দােহার।

পদাবলী ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে;

স্মৃতি আছে তার।

এর পেছনের কথা জানা নেই। কিন্তু পেছনের কথা জানার প্রয়ােজন সবার নেই। কারও কারও থাকতে পারে। তারা মূলত কবি অথবা নবীন কবিযশপ্রার্থী।

কবি যে দেশকালসীমার ভেতর বাস করেন, সে সীমার ভেতর রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অসাম্য ও সামাজিক বিকৃতি তার মনােভূমিকে ক্ষতবিক্ষত করে তােলে। অনিয়ম, শােষণ ও দারিদ্র কবিকে যন্ত্রণা দেয়। সে যন্ত্রণা সহ্য করার মতাে সহিষ্ণুতা সংবেদনশীল কবির নেই। তাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা কবির প্রধান কাজ। যেখানে সৌখিন কবিরা কেবল সৌন্দর্যের বর্ণনা করেন, সেখানে বাস্তবতার কঠিন নিস্পেষণে নিস্পেষিত কবি দেখেন দুঃখ, জ্বরামরাময় পৃথিবী মানুষের বাস অযােগ্য হয়ে উঠছে। তাই প্রচলিত সৌন্দর্যচেতনা তাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। বরং বিপুল সৌন্দর্যের ঝর্ণাধারায়ও অনন্ত দুঃখের সন্ধান পান। সফোক্লিস আমাদের দেখিয়েছেন, কিং ইডিপাসের রানী জোকাস্টা সত্য অন্বেষণের বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ সত্য তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। লােক জানাজানিতে যে বিষয়টি কলঙ্কের চিহ্ন হয়ে উঠবে, গােপনীয়তা রক্ষায় সে বিষয়টি হয়ে উঠবে মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন। কিন্তু কিং ইডিপাস সত্যের সন্ধানে এতই ব্যগ্র ছিলেন, নিজেকে শাস্তি দিতেও কুণ্ঠি হননি। দৈবের ভবিষ্যত বাণীকে কিং ইডিপাস নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে দৈববাণীরই জয় হয়েছিল। সফোক্লিসদের প্রথাবিরােধী অবস্থান নেওয়ার সুযােগ ছিল না তাই মানবজীবনের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের উৎস হিসাবে দৈববাণী ও দেবতার নির্দেশকেই পরম সত্য বলে জানতেন। এ জানা তার অন্তরের সততাকে প্রকাশ করত কি না সন্দেহ আছে। কিন্তু এসত্য প্রচারে সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত থাকতাে বলে, প্রচল সত্যকে উপেক্ষা করে, দেবদেবীর মাহাত্মকে ক্ষুণ্ন করে মানবমহিমার জয়গান গাওয়ার মতাে চিত্তের দার্ঢ্য তার

ছিল না। কিন্তু কিং ইডিপাসের ঘটনায় পিতৃহত্যার অপরাধের চেয়ে স্বনির্ধারিত শান্তি প্রয়ােগের কারণেই কিং ইডিপাসের প্রতি আমাদের সহানুভূতি জাগে ষোল আনাই। সে মর্মবেদনা থেকে সফোর্লিস কিং ইডিপাস যে লেখেননি তাতে তাই বা কী করে বলি?

কবিতা পরিকল্পনা করে লেখা যায় না। সমস্ত পরিকল্পনাকে ভেঙেচুরে কবিতা আপনস্বভাবেই ধরা দেয়। জাগরণে যে কবিতা হাতছানী দেয়, তন্দ্রায় সে কবিতা শয্যা রচনা করে। শরীরে উত্তাপ যার আছে সে কবিতাকে বিছানায় নিয়ে আসতে পারে। না হলে ধর্ষণের চেষ্টা চলে কেবল, সঙ্গমের অতৃপ্ত সুখ সে পায় না। শহীদ কাদরীর একটি ক্ষুদ্র কবিতা “প্রিয়তমাসু’। শব্দকে অভিজ্ঞতার যথার্থ স্মারক হিসেবে সম্মানিত করার চরম নিষ্ঠা দেখিয়েছে এ কবিতায়।

ভেবেছি তােমার খােপার জন্য

পাঠাবাে একটি সােনালি তারা,

-সে কেবল কথা হালকা, নীল ও

কুয়াশাময়।

বরং কিনেছি উজাড় পকেটে

সেন্টের শিশি স্বপ্নমাখা!

অতিসাধারণ শব্দসমবায়ে রচিত এ কবিতা। কোনও বাহুল্য নেই। নেই কঠিন শব্দের জবরদস্তিও। কিন্তু শব্দের এমন প্রয়ােগ সম্ভব করেছেন, যে পাঠক প্রথম পঙক্তি পাঠ শেষে অনিবার্য পরিণতির মতাে পরবর্তী পঙক্তিগুলাে উচ্চারণ করতে অনুপ্রাণিত হন মন্ত্রমুগ্ধের মতাে।

আবার রফিক আজাদের কথাই যদি ধরি। সেখানে দেখি একটি স্বতঃস্ফূর্ত ঝর্ণাধারার মতাে। তার কবিতার শব্দগুলাে প্রবহমান। কোথাও কোনও ক্লান্তির ছােয়া নেই। কোাথাও কোনও জড়তা নেই। নেই কোনও কষ্টকল্পনার স্বাক্ষরও। তার যদি ভালবাসা পাই কবিতা

এমনই প্রবহমানতা রয়েছে।

যদি ভালবাসা পাই     আবার শুধরে নেবাে

                জীবনের ভুলগুলি

যদি ভালবাসা পাই     শিল্প-দীর্ঘ পথে

                বয়ে যাবাে কাঁথাগুলি।

এধরনের কবিতা লেখা যায় না কেবল বুদ্ধির জোরে। এধরনের পঙক্তি রচনা করার জন্য কবির মনােভূমে দৈবশক্তির অস্তিত্ত্ব প্রয়াজন। তা হলে দেখা যাবে কষ্টকল্পনার স্থানে স্বতঃস্কুর্ততা এসে কবিতাকে মহিমান্বিত করে তুলবে। এ রকম স্বতঃস্কৃর্ত আবেগের ফল আবু হাসান শাহরিয়ারের মােহরপ্রার্থী কবিতাটিও। যেখানে আত্মনিবেদনের ভাষা হয়ে উঠেছে প্রতিদিনের ব্যবহৃত ভাষার অনুরূপ। প্রতিরূপ ভাষা তৈরির দক্ষতা শাহরিয়ারের স্বভাবজাত। কিন্তু প্রতিরূপ ভাষা নির্মাণ করতে গেলে কবিতাটি হয়ে উঠতাে বানানাে কথার

ফুলঝুরি। বিশ্বস্ত শব্দের সহবস্থানে শব্দগুলাে বাঙ্ময় হয়ে উঠতাে না।

ভিক্ষা যদি করিই, হব রাজভিখিরি

সােনার থালা ধরব মেলে

দিতে চাইলে মােহর দিও রাজকুমারী

মােহর দিও, মােহর দিও, মােহর দিও।

ভিক্ষুকের ভূমিকায় কবির অভিনয় আত্মসমর্পণের স্তর অতিক্রম করে, আত্মনিবেদনের স্মারক হয়ে উঠেছে। তাই কবিতাটি প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে।

উদ্ধৃত কবিতাংশগুলাের উল্লেখ এ জন্য করা যে, কবির কবিতা রচনার কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা থাকে না, সত্য। মানসিক প্রস্তুতিও কি থাকে না? মানসিক প্রস্তুতি ব্যতীত একটি কবিতার বীজ দীর্ঘদিন যাবত কী করে কবির মনােভূমিকে উপযুক্ত করে তােলে? কী সে দৃশ্যান্তরের গল্প? কী সে ইতিহাসের সারাংশ? এলিয়টের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন কবিতা ভেতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা, সে ইতিহাস চেতনা কি সব ধরনের কবিতায় থাকা সম্ভব? না কি যে ধরণের কবিতায় ঐতিহ্যগত পরম্পরা রয়েছে সে ধরনের কবিতায় ঐতিহাসিক ঘটনার রেশ থাকবে?

অবশ্য এলিয়ট কথিত ইতিহাসচেতনার সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক বােধও কবির জরুরি। নৃতাত্বিকবােধ কবিকে আত্মর্যাদাবােধের প্রশ্নে দৃঢ়চিত্ত করে তােলে। ফলে কবি যা রচনা করেন, তাতে নিজের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দিতে পারেন। অন্তত কিছুটা মিশিয়ে দেওয়ার পর স্বস্তি পান। কবিতার নেপথ্য সূত্রবীজ সম্ভবত এই। এর বাইরেও যে সূত্রবীজ নেই, কে বলবে?

মন্তব্য: