চট্টগ্রামের বৈশাখী উৎসব

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শেখর দেব

পহেলা বৈশাখ সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসব আর আনন্দের সাথে পালিত হয়। এটি বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি সমাজ এই উৎসব পালন করে প্রাণের তাড়নায়। পুরনো বছরের দুঃখ-গ্লনি ভুলে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে। সবার কামনা একটাই নতুন বছর যেন কাটে সুন্দর ও সুখময়তায়। বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর এই দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হিসেবে পালন করা হয়। ভোরের রঙিন সূর্যের সাথে সাথে রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালির আনন্দ ও সুখ। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট নিমেষে ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের জনসাধারণ অংশ নেয় এ প্রাণের মেলায়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত এই দিনে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সর্বস্তরের জনসাধারণ বিশেষত তরুণ সমাজ নেমে আসে রাস্তায় বাহারি পোশাকে। সনাতন সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরালা, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়– এবং ত্রিপুরায় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হতো এই নববর্ষ। বর্তমান সময়ে যেমন নতুন বছরের সূচনার জন্য পালিত একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে নববর্ষ। এক সময় শুধু ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো নববর্ষ। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো। ভারতবর্ষে মুঘল সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর স¤্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ের সুষ্ঠুতা প্রণয়নের জন্য মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশ অনুসারে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানি ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। প্রথমে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময় হতেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এ পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময়ে এ দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিন দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিন দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ণ করে থাকে। এই প্রথাটি এখনো অনেকাংশে প্রচলিত আছে বিশেষ করে স্বর্ণের দোকানে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র ডিসি হিল পার্ক বা নজরুল স্কয়ার। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এখানে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দু’দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি  চত্বরে বসে নানান গ্রামীণ পণ্যের পসরা। থাকে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ব্যবস্থা। চট্টগ্রামে সম্মিলিতভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগে ১৯৭৩-১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায় ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৭৮ সালে এই উৎসব এখনকার ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেয়া হয়। ১৯৭৮ সালে এ উদ্যোগের সাথে জড়িত ছিলেন ওয়াহিদুল হক, নির্মল মিত্র, মিহির নন্দী, অরুণ দাশ গুপ্ত, আবুল মোমেন, সুভাষ দে প্রমুখ। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদাভাবে গান পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর এ অনুষ্ঠানে নাটকও যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে কয়েক বছর ধরে সিআরবি এলাকায় আরেকটি পহেলা বৈশাখ উৎসব আয়োজন করা হচ্ছে বেশ জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মঞ্চে শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন-

‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো

তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

বৎসরের অবর্জনা দূর হয়ে যাক,

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি

অশ্রু বাষ্পে সুদূরে মিলাক’

নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ সুসজ্জিত পোশাকে নেমে আসে রাস্তায়, উদ্দেশ্য ডিসি হিল পার্ক অথবা সিআরবি। বছরের শুরুতে রঙিন জামাটি গায়ে দিয়ে বাহারি মুখোশ ও ফেস্টুন হাতে সমেবত হয় প্রাণের টানে। চেরাগী পাহাড় হতে নন্দনকাননের বোস ব্রাদার্স পর্যন্ত বন্ধ থাকে যান চলাচল। পার্কের ভেতরে একটু ঘুরে আসার জন্য মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে বিশাল লাইনে। প্রধান আকর্ষণ ভেতরে রকমারি অনুষ্ঠান ও মনকাড়া গ্রামীণ পিঠা পুলির প্রদর্শনী ও বিক্রয়।  দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্য দেখা ও চেখে দেখা। যেন এক  মেলার শহর। তরুণ-তরুণীরাই মেলার প্রধান আকর্ষণ, বাহারি রঙের শাড়ি পরে মনের মতো গ্রামীণ সাজ নিয়ে দল বেঁধে আসেন তারা। তরুণরাও উচ্ছলতার সর্বোচ্চ মাত্রা নিয়ে চষে বেড়ান সমস্ত পার্ক। মুখে মুখে দল বেঁধে চলে মজার মাজার গান আর তুমুল আড্ডা। শিশু, কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের মুখে আঁকে গ্রামীণ বিভিন্ন জিনিস যেমন: তালপাতার পাখা, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদির ছবি।

চট্টগ্রামের গ্রামীণ জনপদে খুব উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয় এই দিনটি। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত বাঙালিরা বিশেষ ধর্মীয় মর্যাদায় পালন করে এই দিনটি। এদের সাথে যুক্ত হয় নানা বর্ণের ও ধর্মের লোক। সনাতনি সমাজে পহেলা বৈশাখ আয়োজন শুরু হয় পুরো চৈত্র মাস জুড়ে। চৈত্র মাসের শেষ দিনের পূর্বেই  ঘরদোর লেপা, ঘরের বিভিন্ন তৈজসপত্র  ধোয়া মোছার কাজ শেষ করা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিনটি হলো চৈত্র সংক্রান্তি। এই দিন সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলের বাড়িতে রান্না হয় এক বিশেষ ধরণের সবজি যেখানে মিশেল ঘটে অজস্র আইটেমের তরকারি। তরকারিটা রান্না হয় তিতা ব্যঞ্জনে। বছরের শেষ দিন তিতা খাওয়ার মাধ্যমে জীবন থেকে সকল ধরনের তিক্ততা ও অম্লতা দূর হয়ে যায় এরকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে। নিয়ম আছে পরদিন অর্থ্যাৎ পহেলা বৈশাখ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে। বাড়ির বয়স্ক মহিলারা অবশ্য আগেভাগেই বাড়ির উঠোনে জ্বালিয়ে দেয় আগুন। আগুন যাতে ধোঁয়া সৃষ্টি করে এ জন্য আগুনে ফেলে দেয় তরতাজা এক ধরণের বিশেষ উদ্ভিদ যা আগে সংগ্রহ করে রাখা হয়। বাড়ির সবাই মিলে সেই ধোঁয়া গায়ে মাখে আগুনের চারদিকে প্রদক্ষিণ করার মাধ্যমে এবং বিশেষ সুরে গান ধরা হয়-

জাগ্ জাগ্ জাগ্

পৃথিবীর যতো বিদ্যাবুদ্ধি আঁর ঘরত্ জাগ্

জাগ্ জাগ্ জাগ্

পৃথিবীর যতো ধনসম্পত্তি আঁর ঘরত্ জাগ্

জাগ্ জাগ্ জাগ্

পৃথিবীর যতো সুন্দর সব আঁর ঘরত্ জাগ্

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এভাবে তারা পৃথিবীর সব ভালো কিছু তাঁদের বাড়ির জন্য প্রার্থনা করে আদায় করে নিবে। আজই তা আদায়ের মোক্ষম দিন। বাড়ির ছোট বড় সবাই তা খুব আনন্দের সাথে নেয়। কারণ আজকেই তো সেই কাক্সিক্ষত পহেলা বৈশাখ। আস্তে আস্তে পুরো আকাশ ফর্সা হয়ে ওঠে, এবার চলে স্নান পর্ব। আজকের স্নানটা একটু অন্যরকম। আগে থেকে সংগ্রহ করা থাকে নিমপাতা ও হলুদ। নিমপাতা ও হলুদ বেটে পেস্ট করা হয়। এরপর সবার গায়ে মুখে ভালো করে সাবানের মতো মাখানো হয় এ পেস্ট। উদ্দেশ্য গায়ের রঙ একটু ফর্সা করা। ¯œান সারা হলে যার যার নতুন পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ে বয়স্কদের প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ নেয়ার জন্য। এরপর বাড়ির সবাই একসাথে বসে অংশগ্রহণ করে মিষ্টান্ন ও পিঠাপুলি ভোজন পর্বে। আগে থেকেই বাড়ির মহিলারা সুস্বাদু খাবার রান্না করে রাখে। এলাকার মাঠে বা খোলা প্রান্তরে বসে বৈশাখি মেলা। একটি বৈশাখি মেলা নতুন বছরের উৎসবের সাথে বাঙালির কৃষ্টি ও কালচারের সাথে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করে। নতুন জামাকাপড় পড়ে সবাই ছুটে চলে বৈশাখি মেলায়। মেলায় থাকে নানা রকমের কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর পসরা, থাকে নানান ধরণের পিঠা-পুলির আয়োজন। এই দিনের একটা পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি। মেলার বিভিন্ন ধরনের দোকানে সাজানো বিভিন্ন ধরনের পসরা সবাইকে আকর্ষণ করে। কাঁচের চুড়ি, আলতা, লাল ফিতা থেকে শুরু করে বিন্নি ধানের খই, বাতাসা, চিনিসাজ মোয়া, বিভিন্ন দেশীয় খাবার, খেলনা, গৃহস্থালী সামগ্রী, তৈজসপত্র কুটির শিল্প, দা, কাঁচি, লোহার কড়াই, পুতুলসহ রাঙালি ঘরানার হরেক রকমের পণ্যের পসরা নিয়ে বসে দোকানিরা। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিনটি বাঙালির আনন্দ উৎসবের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

মন্তব্য: