চর্যাপদকালের দর্পণে কৃত উচ্চারণ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সানাউল্লাহ সাগর

চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া সিঞ্জা বাহক রচিত সাধন সঙ্গীত এর ভাষা। অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য। ফলে চর্যার কাব্যরস গ্রহণে অসুবিধে হয়। চর্যার ভাষাকে এজন্য অনেকে সন্ধ্যা ভাষা বলেছেন। চর্যাগুলাে মূলত প্রচারধর্মী। স্বজ্ঞান কাব্যরস সৃষ্টির কোন চেষ্টা এতে নেই। তবুও এর সাহিত্যিক মূল্য একেবারে উপেক্ষনীয় নয়।

বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। চব্বিশজন পদকর্তা ৫১টি পদ রচনা করেন। চর্যাপদগুলাে সবই গান। আর সব গানই কবিতা। চর্যাকারগন কবিতায় লােকায়ত জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। রূপক সৃষ্টিতে তারা লােকায়ত জীবনের দৈনন্দীন কাজকর্মকে অবলম্বন করেছেন। স্বল্প অবয়বে তারা যে কবিতা নির্মাণ করেছেন সে কবিতাগুলােতে সমকালীন ছবি আছে। দৈনন্দীন কাজ-কর্মের ফিরিস্তি আছে। মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা আছে। এ থেকে বােঝা যায়, চর্যাকারগণ জীবন থেকে দূরে ছিলেন না। তারা যে চিত্র এঁকেছেন সে চিত্র সঙ্গীতময়তার ভেতর দিয়ে ভাবকে পরিস্ফুট করে তুলেছে। সাধন কবিতা তখনই হয়ে ওঠে যখন চিত্র ধর্মের সাথে সঙ্গীতধর্ম কোন কবিতায় স্থান পায়।

নগর বাহির ডােমি তােহােরি কুড়ি আ।

ছুঁই ছুঁই জাসি ডােম্বি সাক্ষন নাড়িয়া।

আলাে ডােম্বি, তাে এ সম করিব মাে সাঙ্গ।

নিঘিন কাহ্ন কাপালি জোইলাঙ্গ।”

অর্থাৎ লােকালয়ের বাইরে একটি কুড়ের মধ্যে ডােম্বি একাকী বাস করে। সে অস্পৃশ্যা রমনী, তাই লােকালয়ে তার স্থান নেই। কিন্তু তাকে বিয়ে করার জন্য কাপালিক সেজেছে। এই যে চিত্রতা আমাদের চেতনার মধ্যে একটি ছবি রােপণ করে দেয় আর তৎকালীন জীবনের ছবি পদকর্তাগনের ধ্যানমগ্নতার স্পর্শে বহু স্থানে সজীব হয়ে উঠেছে।

প্রণয়িনী যেখানে সমাজে অস্পৃশ্যা, প্রেমিক সেখানে কাপালিক না সেজে আর করবে কি! প্রিয়ার জন্য গলায় হাড়ের মালা পরে সমাজ ত্যাগ করেছে সে। ওলাে তুই যেমন ডােম্বি, আমিও তেমনি কাপালিক তাের জন্যই গলায় হাড়ের মালা ধারন করেছি। প্রেম নিবেদনের এই ভাষা অপূর্ব। আর একটি চর্যায় আছে-

উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহি বসই সবরী বালী।

মােরাঙ্গ পিচ্ছ পরিহান সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।

উঁচু উঁচু পর্বত, তার উপরে বাস করে শবর বালিকা। শিখীপুচ্ছ খােপায় গুজে গুঞ্জার মালা পরে সে ঘুরে বেড়ায়, লবর তার জন্য উন্মত্ত। শবরীকে যে পরিবেশ চিত্রিত করা হয়েছে সেই পরিবেশটিও মনােরম-

নানা তরুবর মৌলিল রে গঅনত লাগেলী ডালী।

একেলা শবরী এ বন হিত্তই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী।”

ফুলে ফুলে ভরে গেছে সারা বন, সেই বনের ফুলে ভরা ডাল যেন স্পর্শ করেছে আকাশকে। কানে কুণ্ডল পরে একাকিনী শবরী বনে ঘুরে বেড়ায়। অরণ্যচারী মানুষের সহজ স্বাভাবিক জীবনের চিত্রটি এখানে অতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন আর একটি উদাহরণ-

হেরি মাের তইলা বাড়ী খসমে সমতুল্য।

যুবক এবেরে কপাসু ফুটিলা।

তইলা বাড়ীর পাশেরে জোহা বাড়ী তাএলা।

ফিটোলি আঙ্গারী রে আবাস ফুলিলা।”

অরণ্যের মধ্যে উচু টিলার বাড়ী আকাশের গায়ে যেন ছবির মত ভাসছে। সে বাড়ীর পাশে কার্পাস ফুল ফোটে তখন মনে হয় যেখানে জোন্সার আবাসস্থল কে যেন নির্মাণ করে দিয়েছে। পাহাড়ের উপর ফুটে থাকা কার্পাস ফুল দেখে মনে হয় যেন সমস্ত আকাশ জু়ড়ে তা ফুটে আছে। ফুলগুলি এতই সাদা যে তাতে আঁধার যেন দূর হয়ে যায়। ঠিক তেমনি এক চমৎকার মধুময় আকর্ষণীয় পরিবেশ শবর বালিকা বাস করে। এসব চিত্রময়তা চর্যাপদকে দিয়েছে কাব্য ধর্মের অতুল গৌরব-

চর্যাগীতি সীমিত পরিধির মধ্যে রচিত কবিরা অল্প কথায় ব্যঞ্জনাধর্মী প্রকাশে চর্যাগুলােকে কবিত্বরসপূর্ণ করে তুলেছেন। উপমা রূপক ব্যবহার করে কাব্য করেছেন সমৃদ্ধ। কাব্যসৃষ্টির প্রেরণা হয়তাে তাদের ছিল না কিন্তু তাদের জীবন ভাবনায় প্রত্যক্ষ যে যে অনুভূতি

কাজ করেছে তাই কবিতাগুলােকে কাব্যগুন সমৃদ্ধ করে তুলেছে। চর্যাগুলােতে জীবনের কথা আছে, ছবি আছে, যা গানের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাতে যে জীবন চিত্রিত তা ঐশ্বর্যশালী রাজ রাজড়ার নয় সাধারণ দারিদ্র পীড়িত সমাজের। এই সমাজ ভাবনা এসেছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। সেকালের মানুষের জীবন ও জীবন আচরণ এবং জীবন সংগ্রামের বহু কথা চর্যায় বসেছে উপমা, রূপকের আবরণে। চর্যাগীতিকাগুলােতে অতি সুকৌশলে প্রবাদ বচন জুড়ে দিয়েছেন পদকর্তাগণ। যেমন-

* আপনা মাংশে হরিণা বৈরী (৬)

* হাথেরে কাঙ্কন মা লােউ দাপন (৩২)

* আন চাহস্তে বিনবা (৪৪)

চর্যাপদগুলাের প্রকাশভঙ্গিতে পরিমিতিবােধ আছে। এই পরিমিতিবােধ প্রকাশ ভঙ্গ শ্রেষ্ঠ শিল্পীরই লক্ষণ। চর্যাকারগণ মিতভাসনে অতি চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ জিনিসের ছবি তুলে ধরেছেন।

তব নই গ্রহন গম্ভীর বেগে বাহী।

দু’আন্তে চিখিল মাবােন থাহী।

ধামার্থে চাটিল মাঙ্কম গাঢ়ই।

চর্যাপদে প্রেম ও বেদনার কথাও আছে। বহু চর্যাতে শৃঙ্গার রসাত্মক রূপক লক্ষ্য করা যায়,

দিনের বেলা বউটি কাকের ডাকে ভয় পায় অথচ রাতের বেলায় কামবাসন চরিতার্থ করার জন্য অভিসারে যেতে তার মনে কোন ভয় নেই।

এখানে কবি একটি সামাজিক বাস্তব সত্যকে সঙ্গীত মাধু্র্যে প্রকাশ করেছেন। প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনরসসমৃদ্ধ পদও চর্যায় আছে। নারীর প্রেম মানুষকে ঘর ছাড়া করে উতলা করে। নারী ও প্রেমিকের জন্য গভীর রাতে অভিসারে যায়। প্রেম সম্পর্কীয় পদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য-

জোইনি তই বিনু খনহিন জীবমি।

তো মুহ চুম্বি কমলরস পীবমি।

প্রেমিকের গভীর আগ্রহ এবং অনুভব পদ দু’টিতে মূর্ত হয়েছে। অন্যত্র এক পদে দুন্দভ বাজিয়ে বিয়ে করতে যাবার কথা আছে। বিয়ে করে সেই সময় যৌতুক পাওয়া যেত, বিয়ের পর রতিসুখে দিন কাটাত ডােম্বী যােগিনীর প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে একত্রে রাত কাটাত এবং একবার তাকে কাছে পেলে ক্ষণিকের জন্য ছাড়তে রাজী ছিল না। আদিরসকথাপূর্ণ চর্যাপদগুলােতে আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বুকে ধরেও রসময় কাব্যে পরিণতি পেয়েছে।

টিলার উপরে একখানি ঘর। তার পাশে কোন প্রতিবেশী নেই। কিন্তু এই করুণ দারিদ্রের মধ্যেও অতিথি শুধু উদরপূর্তির জন্যই আসে না, দেহের ক্ষুধা মেটাতেও আসে। সর্বহারা মানুষের চিত্র এখানে বাস্তব আলেখ্য অতি করুণভাবে ফুটে উঠেছে। চর্যাপদে বেদনার কথা আছে। ডঃ অরবিন্দ পােদ্দার বলেন, “চর্যাগীতির মধ্যে ইতস্তত যে খন্ড ও পরিপূর্ণ চিত্র ছড়ানাে রয়েছে তার আলােচনা করলে একটা গভীর শূন্যতাবাধ এবং দারিদ্রের চিত্রই ফুটে উঠেছে। আর এই চিত্র ফুটিয়ে তুলতে কবিরা যে রূপক উপমা বা শব্দ ব্যবহার করেছেন তা সঙ্গীতমাধুর্যে পাঠকহৃদয়কে পরিতৃপ্তি দান করে।”

চর্যাকারগণ উপমা রূপক সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশের অতি পরিচিত পরিবেশ ও সাধারণ জীবন থেকে। নদী ও নৌকা, তীর ও সাকো ঘাট, পাটনী, সােনা, রূপা কুটীর, থালা, বাসন, কার্পাস ফুল, তুলা এসব দ্রব্য চর্যাগীতিতে উপমা রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

চর্যায় অনুভূতিপ্রবণ মনের যে ছোঁয়া আছে তার চাইতে অলংকার কোন অংশেই কম নেই। চর্যার রূপ, রস রীতি কাব্যময় কি না তা অলংকার বিচার করে দেখা যেতে পারে। শাস্ত্ৰমতে, অলংকার দু’প্রকার- শব্দালংকার, অর্থালংকার। শব্দালংকারের মধ্যে প্রথম জিনিষ অনুপ্রাস। চর্যাপদে অনুপ্রাস অলংকারের অভাব নেই। যেমন-

বাহতু ডােম্বী বাহলাে ডােম্বী বাটত ভইল উছারা। অথবা কিন্তো মন্তে তন্তে কিন্তোরে জান বাখানেত। এই দুটো পদ অনুপ্রাস এক ধ্বনিময় অনুভবকে জাগিয়ে তুলেছে। তাছাড়া চর্যাপদে অন্ত্যানুপ্রাস অর্থাৎ ধ্বনি মিলের উদাহরণের অভাব নেই। যেমন-

জিম জিম করিনা করিনিরে রিস অ,

তিম তিম তথতা ম অগল বরিস অ

এখানে আদ্য শব্দ জিম জিমের সঙ্গে পরবর্তী শব্দ তিম তিমের অনুপ্রাস এক চমৎকার ধ্বনিময়তার জন্য দিয়েছে। অর্থালংকারের ব্যবহার চর্যায় আছে। একটি শব্দ একবার ব্যবহার করে দুটি অর্থ সৃষ্টি করার কৌশলকে বলা হয় শ্লেষ অলংকার। যেমন-

সোনে ভরিলী বারুনা নাবী

রূপা থোই নাহিক ডাবী

এখানে সােনা অর্থে স্বর্ণ ও শূন্যতা উতয়কেই বােঝায়। সমামােসক্তির ব্যবহার অর্থাৎ অচেতন বস্তুর উপর চেতনা বস্তুর ব্যবহারের উদাহরণ চর্যায় আছে। যেমন-

ভর ণই গহন গম্ভীর বেগে বাহী অর্থাৎ-ভবরূপ নদী গহন গম্ভীর বেগে ধেয়ে চলেছে। নদী অচেতন বস্তু হলেও তার চলা গতিময়। অথবা “ ফিটোলি আন্ধরিরে আকাশ ফলি আ- আকাশ কুসুমের মতাে ছুটে পালালাে। এখানে অন্ধকার অচেতন বস্তু, সে ছুটে পালাচ্ছে। এ পদে চেতন বস্তুর স্বভাব অচেতন বস্তুতে আরােপিত হয়েছে।

স্বভাবােক্তি অলংকারের উদাহরণ চর্যায় আছে। যেমন: উঁচা উঁচা পাবত তহি বসই সবরী বালী।”

রস সৃষ্টিতেও সিদ্ধাচার্যগন সজাগ ছিলেন। রস সৃষ্টির বিচারেও চর্যাপদ সাহিত্যগুন গুনান্বিত। চর্যাপদে না পাওয়ার বেদনা ধ্বনিত হয়েছে, আবার অন্তর দিয়ে যে যাকে পেতে চেয়েছে তাকে পাওয়ার আনন্দও প্রকাশ পেয়েছে। চর্যাপদে বেদনার হাহাকার আছে পাওয়ার আনন্দ আছে। শান্তিপাদ, কাহ্নপাদ এবং ভুসুকুপাদের চর্যাগুলাে, বিরহ বেদনা ও না পাওয়ার যন্ত্রণাকে অবলম্বন করে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে।

শব্দ ব্যবহারে চর্যাকারগন সফল হয়েছেন, তারা ভাব অনুযায়ী শব্দ ব্যবহার করে ধানি মাধুর্যের সৃষ্টি করেছেন। চাটিলপাদ যখন বলেন- ভব নই গহন গম্ভীর বেগে বাহী। তখনই এই গহন গম্ভীর বেগে বাহী শব্দগুলাে সুষম ব্যবহারে যে ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্ট করে তা সত্যিই অতুলনীয়। বাংলা পয়ার ছন্দের প্রাথমিক যাত্রা চর্যাপদ থেকেই শুরু হয়। চর্যাকারগন পয়ার- দীর্ঘ পয়ার লঘু পয়ার, দু’রকম পয়ারই চর্যাপদে ব্যবহার করেছেন। যেমন-

“অহনিসি সুর অ পসাঙ্গ জাই।

জোইনি জালে রঅনি পােহাই।”

অতীন্দ্র মজুমদার বলেন-

চর্যাপদকে সুষ্ঠ সুন্দর কাব্য বলে স্বীকার করতে দ্বিধা করি না এই কারণে যে, চর্যাপদে আছে সুগভীর মানবতা বােধের নির্মল অনুভূতিপ্রবণ নির্ঝর এবং প্রেমভক্তির সমন্বয়েই তার সাহিত্যমূল্য। বাংলা কাব্যের আদিলগ্লে এই অপূর্ব সমন্বয়ের সূচনাই বাংলা গীতি কবিতার মুক্তির দূত। সেদিক দিয়ে চর্যাপদ একটি অমূল্য সৃষ্টি।

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ সান্ধ্যভাষা হিসেবে অবহেলার কিছু নেই। চর্যাপদগুলােতে শুধু তত্ত্বের কথা হিসেবেই নয়-সাহিত্যরসমন্ডিত কবিতা হিসেবেও অতুলনীয়।

মন্তব্য: