সজল আহমেদ
আবহমান গ্রাম-বাংলার কবি ছিলেন জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কথা যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। পল্লীর প্রকৃতির সৌন্দর্য তাঁর কবিতার আরও একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ‘পল্লীকবি’ খ্যাত এই কবি যে সকল কালের সকল বঞ্চিত মানুষের কবি তা আমরা অনেকে ভুলতে বসেছি। কারণ আমরা জসীমউদ্দীন বললেই বুঝি পল্লীকবি। কিন্তু এই দেশ যে গ্রামীণজীবনের সংস্কৃতিকে লালন করে গড়ে উঠেছে সেটা কেউ স্মরণ করতে চাই না। কারণ আজ আমরা নিজেদেরকে নাগরিক মানুষ ভাবতে বেশি পছন্দ করি।
জসীমউদ্দীন মূলত: শুধু পল্লীকেন্দ্রিক কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন জীবনকেন্দ্রিক, জীবন-সংকটকেন্দ্রিক ও আদর্শ জীবনসংবেদনশীল কবি। ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ূন আজাদের মতে-
‘পল্লীকে বিষয় হিসেবে নিলেই কেউ কবি হিসেবে আধুনিক বা পল্লীকবি হয়ে ওঠেন না; ওই বিষয়বস্তু নিয়েও হওয়া সম্ভব আধুনিক, যদি কবির থাকে আধুনিক সংবেদনশীলতা, চেতনা ও প্রকাশরীতি।’
জসীমউদ্দীন তার কবিতায় আধুনিক সংবেদনশীলতা আনতে পেরেছেন। তিনি বাঙালিজাতির চিরচেনা প্রকৃতি ও সময়ের কথা শুধু বলতে চেয়েছেন কবিতার ভাষায় শৈল্পিক ভঙ্গিতে। তাঁর কবিতার ক্যানভাস ছিল সবসময় জীবনঘনিষ্ট। তিনি সমাজ-সংসারের কথা লিখতে চেয়েছেন। তিনি ছিলেন আধুনিক এবং সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের কবি।
বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন হলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ। সেই ভয়াবহ একাত্তর স্মরণ করিয়ে দেয় কবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ নামক কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। এই কাব্যগ্রন্থটি মূলত: তৎকালীন যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতিকে কেন্দ্র করে রচিত। আঠারোটি কবিতা নিয়ে রচিত এই কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে জুলাই পযর্ন্ত। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘তুজম্বর আলি’ ছদ্মনামে এই কবিতাগুলো রচনা করেন। তৎকালীন সময়ে কবিতাগুলো আমেরিকা, ভারত ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল, যাতে বিশ্ববাসী বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি সমর্থন দেয়। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তখন আমাদের আন্তর্জাতিক সমর্থন এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিশ্ববাসীরা শোন,
মোদের কাহিনী শুনিয়া কাঁদিবে নাই কি দরদী কোন?
সীমান্ত পার হয়ে যারা গেছে হয়ত বেঁচেছে যবে,
এখানে যাহারা রয়েছি জানিনে কিবা পরিণাম হবে।
প্রতিদিন শুনি ভীষণ হইতে খবর ভীষণতর,
শিহরিয়া উঠি থাপড়াই বুক জীয়ন্তে মরমর,
রাত্র দিনের দু-খানি পাখায় লিখি অসহ্য গাথা,
চোখের সামনে দোলায় দেশের নিষ্ঠুর শাসন-দাতা।
… … …
… … …
আজিও যাহারা বাঁচিয়া রয়েছি, আছি এই আশ্বাসে,
মানবধর্মী ভাইরা আসিয়া দাঁড়াবে কখনো পাশে।
(কবির নিবেদন : ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে)
কবি জসীমউদ্দীন ছিলেন একজন অসা¤প্রদায়িক মানুষ। তিনি মানুষকে ভালোবাসতে। তিনি সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকে পছন্দ করতেন না। মানব ধর্মই তার কাছে বেশি প্রাধান্য পেত। ধর্মকে আশ্রয় করে যারা মানুষে-মানুষে সংঘাত সৃষ্টি করে তিনি তাদের ঘৃণা করতেন। তিনি সমাজের মানুষের মধ্যে কোন শ্রেণীবিভাজন পছন্দ করতেন না। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন সাধারণ কৃষক-মজুদদের জীবনের কথা। তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের কথা লিখতে চেয়েছেন। হিন্দু ও মুসলমান কৃষক যে ভাই ভাই তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন :
নর-হন্তারা আজিকে হোয়েছে শ্রেষ্ঠ ইমানদার,
লুণ্ঠনকারী জালিম নিয়েছে দেশের শাসনভার।
নগরের পর নগর পুড়িছে বাজার বিপণী আর।
দগ্ধ পলী রয়ে রয়ে করে অগ্নির উদ্গার।
দেশবিভাগ বাঙালি জাতির একটি আজন্মক্ষত। ধর্মকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানের যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিলো তার ফলে অনেক হিন্দুপরিবার দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাবার যে কষ্ট তা কবি জসীমউদ্দীন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন-এর স্মৃতি-লিখন এর মাধ্যমে তার কিছুটা আমরা বুঝতে পারি।
একদিন রেবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বত্র সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। অবশেষে সেজ’দা এই পুকুরের জলে ডুবে তুলল রেবাকে। জীবনে এই প্রথম আমি মৃত্যু দেখি। রেবার বয়স ছিল পাঁচ। আমাদের বাড়িতে এসে সাধু’দা (জসীমউদ্দীন) খুব কাঁদলেন। মাকে বললেন, আমাকে একটা পাটি দিন, আমি পুকুর পারে বসবো। কেউ যেন ডিসটার্ব না করে। মাঝখানে আমি একবার সাধু’দা-র কাছে গেলে তিনি আমাকে ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। সারাদিন বিষণ্নমুখে পুকুর পাড়ে বসে রইলেন সাধু’দা। সন্ধ্যের সময় মায়ের হাতে কয়েক পাতার একটা কবিত দিয়ে বললেন, কবিতাটি রেবাকে নিয়ে লেখা, যত্ন করে রাখবেন। এখন কবিতাটি আর নেই। আমি দাদাদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি তাদের কাছেও কবিতাটি নেই। অনেক খুঁজেও পাইনি। আমার জানতে ইচ্ছে করে, কবি জসীমউদ্দীন আমার বোনকে নিয়ে কি লিখেছিলেন।
মৃণাল সেনের মতো আমাদের জানতে ইচ্ছে করে কবির সেই ব্যথারকাহিনী। তবে পরে তিনি এই বিষয়ে আরো কিছু অসাধারণ কবিতা লিখেছেন। নিম্নে কিছু লাইন উদ্বৃতি দিচ্ছি :
১. গীতারা চলিয়া যাবে ছাড়িয়া পাকিস্তান,
সেই গীতা যার অঙ্গ ঝলকে ঝলমল-মল,
করিত সবার প্রাণ।
গীতারা চলিয়া যাবে-
কেন যাবে তারা?
(গীতারা চলিয়া যাবে : ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে)
২. গীতারা কোথায় যাবে?
কোথায় মমতা, কোথা স্নেহ আর মায়া,
কাহারা আজিকে এদেশ হইতে মুছিয়া ফেলিছে
সকল শীতল ছায়া।
(গীতারা কোথায় যাবে : ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে)
৩. গীতারা কোথায় গেলো,
আহা সেই পুতুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়ে।
দেখলে তাহারে মায়া মমতার ধারা বয়ে যায়
সারা বুকখানি ছেয়ে,
আদরি তাহারে কথা না ফুরায়
কথার কুসুম আকাশে বাতাসে উঠে বেয়ে,
… … ….
ওদের গ্রামের চারিদিকে বেড়ি ঘিরেছে দস্যুদল,
ঘরে ঘরে তারা আগুন জ্বালায়ে ফুকারে অগ্নিকল।
সেই কচি মেয়ে কোলে তুলে নিতে কোল যে জুড়িয়ে যেত,
কে মারিল তারে? মানুষ কি পারে নিষ্ঠুর হতে এত।
অফুট কুসুম কে দলেছে পায়ে? কথার সে বুলবুলি,
কোন নিষ্ঠুর বধেছে তাহারের গলায় আঙ্গুল তুলি?
(গীতারা কোথায় গেল : ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে)
কবি জসীমউদ্দীন-এর কবিতায় শুধু পল্লী জীবনকে পাওয়া না বরং বঞ্চিত মানুষের হৃদয়ের দু:খ-ক্ষোভ প্রকাশ পায়। কবির গভীরে যে দ্রোহচেতনা রয়েছে তারও আত্মপ্রকাশ ঘটে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ছবির মত সাজানো গ্রাম আগুনে দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে ছিলো পাক-বাহিনী। এই করুণ চিত্র কবির কোমল হৃদয়কে দগ্ধ করেছিলো। তারই দ্রোহে জন্ম নিল ‘দগ্ধগ্রাম’ কবিতাটি।
এইখানে ছিলো কালো গ্রামখানি, আম কাঁঠালের ছায়া
টানিয়া আনিত শীতল বাতাস কত যেন করি মায়া।
তাহারি তলায় ঘরগুলি ভরে মমতা মুরতী হয়ে,
ছিল যে তাহারা ভাই-বোন আর বউ ছেলেমেয়ে লয়ে।
সুখের স্বপন জড়ায়ে ঘুড়ায়ে ছিল যে তাদের বেড়ে,
আকাশ হইতে আসিত আশীষ দেবের ভবন ছেড়ে।
… … ….
কি যে কি হইল, পশ্চিম হতে নর-ঘাতকেরা আসি,
সারা গাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান,
পিতার সামনে মেয়েকে কাটিয়া করিল রক্ত-স্নান।
কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায়; যুপকাষ্ঠের গায়,
শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়গ ধায়।
(দগ্ধগ্রাম : ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে)
যে গ্রাম ছিলো মানুষের মমতা দিয়ে তৈরি তাকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করেছিলো পাক-বাহিনীরা। কবি সেই ভয়াবহ নির্মম বাস্তবকে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। তিনি ছিলেন নির্ভীক সত্যান্বেষণ কবি। তাঁর বাকরীতিতে বঞ্চিতমানুষের হাহাকার ও দ্রোহ প্রকাশ পায় স্পষ্টভাবে। জাতীয় সংকটের সময় তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম এবং বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন বাঙালিদের দুখ-কষ্টের কথা।
পল্লীজীবনের রূপকার ছিলেন কবি জসীমউদ্দীন। কিন্তু তার ভিতরে বাস করতো বিদ্রোহী কবি মানস সত্ত¡া। তিনি শুধু আবহমান গ্রাম-বাংলার চিত্রই এঁকে যাননি, তার সাথে দগ্ধগ্রাম ও বঞ্চিত মানুষের ছবিও এঁকেছেন শৈল্পিকভাবে।
তথ্যনির্দেশ:
১. ভয়াবহ সেইসব দিনগুলিতে : জসীমউদ্দীন, নওরোজ কিতাববিস্তান, ঢাকা।
২. শিল্পকলার বিমানবিকীরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ : হুমায়ূন আজাদ, ইউ পি এল, ঢাকা।
৩. জসীমউদ্দীন : সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, ঢাকা।
৪. মৃণাল সেন : সাধু’দা, শতবর্ষে জসীমউদ্দীন, নাসির আলী মামুন সম্পাদিত, জানুয়ারি ২০০৩, ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ, ফরিদপুর।
৫. সুচয়নী : জসীমউদ্দীন, পলাশ প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০০২, ঢাকা।