সমুদ্র হক
বছর কুড়ি আগেও ইংরেজি এবং বাংলা তারিখের পর যথাক্রমে সাল ও সন লেখা হতো। শুধু আরবি তারিখের পর হিজরী শব্দটি বসতো। সাল কথাটি ফার্সি, সন কথাটি আরবি। বাংলা মাসের তারিখের পর আমরা আরবি শব্দটি (সন) নিয়েই বাংলা নববর্ষ বরণ করেছি। অথচ বেশি দূর অতীতে নয় মুঘলের দ্বিতীয় সম্রাট আকবর তারিখ ই ইলাহী নামে ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করে বাংলা দিন পঞ্জিতে বঙ্গাব্দ শব্দ ব্যবহার করেন। সম্রাট আকবর লুনার ক্যালেন্ডারে (চন্দ্রমাস) বিশ্বাস করতেন না। তিনি সোলার ক্যালেন্ডার অর্থাৎ প্রতিদিন সূর্য উদিত হয়ে অস্ত যাওয়াকে দিন ধরে বছরের হিসাব কষেছেন। এই সূর্যালোকের ধারায় খ্রিষ্টিয় বর্ষ যা ইংরেজি মাসে খ্রিষ্টাব্দ এবং বঙ্গীয় বর্ষ যা বাংলা মাসে বঙ্গাব্দ কথা শব্দে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে বঙ্গাব্দ ও খ্রিষ্টাব্দ লেখা শুরু হয় গেল শতকের ৯০’র দশকের প্রথমে। ৪৭’র দেশ বিভাগের আগেও এই উপমহাদশের বঙ্গদেশে নববর্ষ ছিল না। তবে চৈত্রসংক্রান্তি ছিল। অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে উৎসবের আয়োজন ছিল সার্বজনীন। গ্রামের গৃহস্থ ও কিষাণবাড়ির আঙিনা পরিস্কার করে মাটি পানিতে গলিয়ে কাপড়ের টুকরো অথবা কিছু খড় দিয়ে লেপে দেয়া হতো। ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে গাঁয়ের বধূরা গীত গেয়ে নেচে পুরুষরা বড় নৌকা করে মাঝ নদীতে গিয়ে চাঁদের আলোয় উৎসবে মেতে উঠতো। ইংরেজ শাসনে গ্রেগেরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখের উৎসব দেখে বাঙালীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। চৈত্রসংক্রান্তির সঙ্গে কি করে পরের দিন বৈশাখের প্রথম দিনে বঙ্গাব্দের উৎসবের সূচনা করা যায় তা ভাবতে শুরু করে। প্রতিবাদের এই মাঠে এগিয়ে এলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু রাজ নারায়ন বসু। তিনি ছিলেন কলকাতার একটি স্কুলের হেড মাস্টার। তার স্কুলে তিনি বৈশাখের প্রথম দিনের প্রভাতে সকল শিক্ষার্থী অভিভাবক ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সঙ্গীত, নৃত্যগীত এবং মেলা বসিয়ে দিনভর উৎসবের আয়োজন করেন। বর্ষবরণ ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। তখন সময়কাল ১৩২৫ বঙ্গাব্দ। এরপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি নিকেতনে নববর্ষ পালনের সূচনা করেন। তারপর কালের পরিক্রমায় নববর্ষ উদযাপন উৎসবে মুখরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে গত শতকের ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই দেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে দেয়া হয় নি। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের রক্তচক্ষু ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের রোষানলে পড়ে বাঙালীর পরিচিতি হারিয়ে গিয়েছিল। তথ্য-উপাত্ত ঘেটে যতটা জানা যায় ১৯৬৪ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকায় কবি জাহানারা আরজুর বাড়িতে সেদিনের তরুণ কবি হাসান হাফিজুর রহমান বৈশাখ নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করে খুবই স্বল্প পরিসরের ঘরোয়া পরিবেশে বৈশাখ বরণের পালা শুরু করেন। পরের বছরই বীরের জাতি বাঙালী রমনার বটমূলে স্রোতের মতো নেমে আসে। এরপর আর বৈশাখকে ফিরে তাকাতে হয় নি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ আমরা যে সম্প্রীতির বন্ধনের কথা বলি তার সবই আছে বাংলা নববর্ষে। একমাত্র বৈশাখের প্রথম দিন দেশের প্রতিটি কোণায় সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষ মিলিত হয়ে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। বৈশাখী মেলার আয়োজনে বাঙালীর সংস্কৃতির সকল অনুসঙ্গই খুঁজে পাওয়া যায়। বৈশাখ মাস এলেই বাঙালীর সংস্কৃতির একেবারে গভীরের রূপটি অপরূপ হয়ে ওঠে। দ্বিজেন্দ্র লাল রায় এর গানের কথাগুলো যেন চোখের সামনে বাংলাদেশকে মেলে ধরে ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লী জননী…’। আমরা গর্ব করে বলতে পারি সম্প্রীতির বাঁধনে আমরাই আপন করে নিয়েছি সকল মানুষকে দেশে দেশে। যে সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দের সূচনা করেছেন তিনিই দেখিয়েছেন সেক্যুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষতার পথ। ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে- অনেকে বলেন সেক্যুলার হতে গেলে ধর্ম বাদ দিতে হবে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সেটা করলে চলবে না বরং প্রত্যেক রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গী যেন থাকে ধর্মনিরপেক্ষ। যা মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে এঁটে দেবে। নববর্ষ সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে যুগে যুগে। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায় কিভাবে নববর্ষ আমাদের গর্বিত করে তুলেছে। যত উৎসবই হোক বৈশাখ শুরু হলেই নানা আয়োজনে মনে হয় বাংলাদেশকে খুব কাছে থেকে দেখছি। শিশু ও কিশোরবেলা গ্রামের সেই পথঘাট, বটতলার সেই বাঁশির সুর, ঢাকের বাদ্য, মাটির থালায় (সানকি) পান্তা ভাত, জিলাপি, খই-মুড়ি, খাগরাই, শিশুদের পুতুলখেলার মাটির হাড়িপাতিল, কবিগান, পালাগানের সঙ্গে হেলেদুলে নাচ… শেকড় থেকে উঠে আসা কত যে আয়োজন…। উৎসবের আনন্দে কোনটি নাচ কোনটি গান তা খুঁজে পাওয়া যেন আরেক আনন্দে রূপ নেয়। কথা বলছে, নাচছে, আবার গাইছে। নাচ-গান-সংলাপের এই অদ্বৈত রূপকে ইতিহাসের পাতায় কেউ বলেছেন ‘কথার ত্রয়ী’। সংস্কৃতির আদি রূপে যখন যাত্রার প্রচলন হলো তখন বিশেষ সুরে টানা সংলাপনির্ভর যাত্রাকে লোকজন বলতো গান। এখনও অনেক অঞ্চলে যাত্রাপালা দেখতে যাওয়ার সময় বলা হয় ‘যাত্রাগান শোনা।’ চর্যাপদে বাঙালীর প্রাচীন সমৃদ্ধ যে ধারণা মেলে সেখানে বাঙালীর আবেগ প্রকাশের বাহন হয়েছিল গান। চর্যাপদের শীর্ষে রাগ রাগিনীর প্রয়োগে প্রাচীন ভারতীয় ধ্রপদী সঙ্গীতের সঙ্গে বাঙালীর নিবিড় পরিচয় ছিল। এর আগে বাঙালী সঙ্গীতের তাল-লয়-সুর অথবা রাগ-রাগিনী সম্পর্কে তেমনটি জানা যায় না। চর্যার কাল হতে একাদশ শতক পর্যন্ত বাঙালীর সঙ্গীতভাবনায় আর্য প্রভাবের সঙ্গে কৌম বাঙালীর লোকায়ত সঙ্গীত চিন্তার মিশ্রন ঘটেছে। চর্যাপদের শীর্ষে রাগ-রাগিনী ভাবধারা থাকলেও কবিতা ও সাহিত্যের বিষয়ে ধারণা করা যায় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে। ওই সময়েই বাঙালীর নিজস্ব সুরেরও মিশ্রন ঘটেছিল। যার প্রভাবে বাঙালীর কীর্তন ঝুমুর বাউলগানে আমাদের লোকায়ত সঙ্গীত ভাবনার প্রতিফলন ঘটে। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় তাই দেখা যায়। শান্তিনিকেতনের নববর্ষ উদযাপনের এক বক্তৃতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলগান এবং কীর্তনকে বাঙালীর নিজস্ব পরিচয়জ্ঞাপক সঙ্গীত বলে উল্লেখ করেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে বাউলের প্রভাব দেখা যায়। যেমন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে… গানটি একটি ক্ষ্যাপা বাউলের সুর ‘হরি নাম নিয়ে জগৎ মাতালে তুই একলা নিতাই রে…’। নববর্ষে গ্রামীণজীবনের আনন্দে কীর্তন ও বাউলের এক সুন্দর মিশ্রন ফুটে ওঠে। বাঙালীর এই শিল্পের আখ্যানে নাট্যকলা বা নাটক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যিনি একক বা সম্মিলিতভাবে কীর্তনের সুরের বর্ণনা দেন তখন আপনা-আপনি সংলাপের সূত্রে গেঁথে যায়। সঙ্গে আপন গতিতেই অভিনয়শৈলী চলে আসে। এভাবেই হাজার বছরের ধারায় তৈরি হয়ে আছে আমাদের নিজস্ব কাব্য নিজস্ব সাহিত্য। যে সাহিত্যরস সুধায় নববর্ষের বৈশাখ হয়েছে মহিমান্বিত। বর্তমান কালে যেমন নাটকের জন্য মঞ্চ থিয়েটার হলো অপিরহার্য তেমনই হাজার বছরের বাঙালীর ত্রয়ী (ইতোপূর্বে বলা হয়েছে) আখ্যান নববর্ষকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। যার শাখা-প্রশাখাতেই রচিত হয়েছে নানা উপাখ্যান। কাব্য গীত লোকসঙ্গীত লোকনাট্য গীতিনাট্য নৃত্যনাট্য তো আছেই, এর সঙ্গে অনু উপাখ্যানও রচিত হয়েছে। সবই এক সুতায় গাঁথা মালা। যা আমাদের বৃহত্তর জনজীবনের প্রেক্ষাপটে উচ্চকিত হয়েছে বার বার, হয়ে আছে চিরন্তন। আমাদরে জারি সারি ভাটিয়ালি ভাবগান নৌকা বাইচের গান মুর্শিদী আলকাপ (এই আলকাপ থেকেই গম্ভীরার সূচনা) যোগীগান মনসার গান লীলা রামায়নী পালাগান গম্ভীরা পটগানের সঙ্গে আদিম ধারার সঙ্গীত নাচের যে বলয় তৈরি হয়ে আছে তা নববর্ষেই নানা রূপে নান বর্ণে বাঙালী জীবনের কোন না কোন ধারায় পাখনা মেলে জানান দেয় শেকড়ের গভীরতা কত! বাংলা সাহিত্যের ধারায় রাধাকৃষ্ণের মিথকে যেভাবে আনা হয়েছে তার সঙ্গে প্রকৃতির এতটাই নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা গিযেছে যা অন্য কোন কাব্যে মিষ্টি মধুর ধারায় খুঁজে পাওয়া যায় না। নববর্ষ শুরুর সঙ্গেই ঋতু বৈচিত্রের পালা শুরু হয়ে যায়। নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখকে ঘিরে কাব্য সাহিত্যে ঝড়ের বর্ণনা আছে। বৈশাখকে স্বাগত জানাবার গানে রবীন্দ্রনাথ ‘এসো হে বৈশাখ…’ গানে বছরের সকল আবর্জনা ধুয়ে মুছে নতুন করে সজীব হতে বলেছেন। নববর্ষের বৈশাখেই প্রকৃতি ডেকে আনে ঝড়। আবার গ্রীষ্মের দাবদাহে অতিষ্ঠ হওয়া মানুষের সামনেই থাকে বর্ষা। নববর্ষের কাব্যসাহিত্যে সেই প্রাচীন কালেই রাধাকৃষ্ণকে টেনে আনা হয়েছে। এখানেও রবীন্দ্রনাথ কাব্যে সুরে মিলিয়েছেন ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে এসো কর ¯œান নবধারা জলে…’। সুরের বর্ণনায় মানসপটে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা হলো- কদমের (নীপ) বনে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার ছুটে যাওয়া। আবার প্রকৃতির উপাদানে বর্ষার ফুলের পরিচিতি ঘটেছে কদমকে দিয়েই। বর্ষামঙ্গল কাব্যের সূচনা ঘটে নববর্ষে। বাংলার এমন কোন রূপ নেই যা বয়ে আনে না নববর্ষ। চর্যাপদ সূচনাকৃত আলেখ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়, নববর্ষকে ঘিরেই বাঙালীর সকল আখ্যান উপাখ্যান অনুউপাখ্যান নিজস্ব পরিমন্ডলে নিজস্ব বলয়ে সৃষ্টি হয়েছে। যাকে বাঙালীর ভূগোলও বলেছেন কেউ কেউ। তর্কে এর পক্ষে বেশি যুক্তি এসেছে। যেমন নদী পরাপাররত সুরের একটি কথা “ভব নই গহন গম্ভীর বেগে বাহি/দু আন্তে চিখিল মাঝে না থাই” (যার অর্থ- ভব নদী গহন ও গম্ভীর বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, দুই ধারে কর্দম মাঝে ঠাঁই পাওয়া যায় না)। যে কথাগুলো প্রমাণ করে দেয় বঙ্গীয় উপকূলের নদী হাওড় বাওড় বিল কোমল কাদামাটি। এভাবেই বাঙালীর ঋতু নিয়ে কাব্যে গল্প কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। মনসামঙ্গলে বেহুলা লক্ষিন্দরের পৌরাণিক ধারার সঙ্গে করুণ উপাখ্যান, দিনাজপুরের বিষহরির গান, বরিশালের বয়ানিগান, রাজশাহীর পুঠিয়ার মনসার গান, মানিকগঞ্জের বেহুলার হাস্তন, ভাসান যাত্রা ইত্যাদি। ওইসব আলেখ্যে পালাগানে নাট্যচরিত্রের সংলাপে কখনও একক কণ্ঠে কখনও স্বতন্ত্রভাবে পরিবেশিত হলেও মূল আখ্যানে বাংলা নববর্ষের ভাবধারায় অক্ষুন্ন রয়ে যায়। এই সকল পরিবেশনা হাজার বছরের বাংলা নাট্যগীতের ত্রয়ী ও ধ্রুপদীর সহস্র আঙ্গিকের বহু শাখা প্রশাখার ভিন্ন ভিন্ন ধারা। যা দূর অতীতে নিয়ে গিয়ে বলে দেয় চর্যাপদের অনুআখ্যান গীতে। যেখানে পৌরাণিক থেকে প্রকৃতি ও বাস্তবতার মিশ্রনে মাটির গভীরতা থেকে উৎসারিত হয়েছে বাঙালী সংস্কৃতির শেকড়। বাঙালী সংস্কৃতিতেই সৃষ্টি হয়েছে মানবিক প্রেমের আখ্যান যা সম্প্রীতির স্রােতধারায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চিরন্তন হয়ে। মানবপ্রেমের এমন শক্ত বাঁধন বাংলার নববর্ষেই বার বার চোখ মেলে ধরে। বর্তমানে নিত্য বছর বাংলা নববর্ষ ঢাকার বটমূল থেকে দেশের প্রতিটি প্রান্তে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তা শেকড়কেই টেনে আনে। এই নববর্ষ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক অপার সম্প্রীতির ভুবন গড়ে দেয়, যে ভুবন চিরদিনের বাঙালীর…