পাহাড়ি বৈচিত্র বিজুতে প্রাণ নাচে আমুদে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

লেবিসন স্কু

নববর্ষ প্রতিটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিতেই পালিত হয়ে থাকে। আর্থসামাজিক বাস্তবততার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভৌগলিক নানা বোধ-বিশ্বাসের সংমিশ্রণের পার্থক্যে দেখা দেয় ভিন্নার্থক নববর্ষ উৎসব। এদিক থেকে বাংলাদেশ খুবই বিচিত্র। বাঙালীর পাশাপাশি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাসই বৈচিত্রের মূল কারণ। এদের নিজস্ব ঐতিহ্য রীতি-নীতি, বিশ্বাস, আদর্শিক অনুযায়ী পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে সাদরে বরণ করে। ৪৫টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের ‘বৈসাবি’ উৎসবই জাকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। পার্বত্য অঞ্চলের এই জনগোষ্ঠী বাংলা সনের প্রথম দিনটি উদযাপন করার জন্য আয়োজন করে ‘বৈসাবি’। ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ বা ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’ এই তিনটি উৎসবের সমন্বিত নাম ‘বৈসাবি’। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটি চাকমা অধ্যুষিত এলাকা। নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর পেশায় জীবনজীবিকা নির্বাহ করে যুগ যুগ ধরে চাকমারা এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এরা প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।

বাংলা নববর্ষের সময় বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে চাকমাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। চাকমাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসব ‘বিজু’। এটি চাকমাদের বড় ও প্রধান সামাজিক উৎসব। এই উৎসবে আদিম সাম্যসমাজের অনেক উপাদানই প্রকাশ ঘটে যা বাধাহীন স্বতঃস্ফূর্ততায় সম্মিলিত হয়ে সমাজের সকলে উৎসব পালন করে এবং অভিন্ন আনন্দের অংশীদার হয়। নববর্ষকে ঘিরে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের এই উৎসব চাকমা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা নববর্ষের যোগসাজসে কবে থেকে বিজু উৎসব পালন করে আসছে তার আছে নানান অস্পষ্ট মত। কেউ কেউ মনে করেন, মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চাকমা রাজাদেরও তৎকালীন সময়ে বার্ষিক খাজনা দিতে হতো। চাকমা রাজারা মোঘল সম্রাটদের বার্ষিক কর হিসাবে কার্পাস তুলা দিতেন। এ কারণে পার্বত্য অঞ্চল এক সময় কার্পাসমহল নামেও পরিচিত ছিল। মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা নববর্ষের সূত্রপাতের ইতিহাস আছে। তাই মোঘল শাসকদের কর আদায়ের সূত্র ধরেই বাংলা সনের সাথে বিজু উৎসবের সময় মিল হতে পারে। চৈত্রের শেষ দু’দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন মোট তিনদিন বিজু উৎসব হয়। বিজু উৎসবের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘ফুল বিজু’, চৈত্রের শেষ দিনকে বলা হয় ‘মূল বিজু’। আর বৈশাখের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘গোজ্জ্যা পোজ্জ্যা’। চৈত্র মাসকে চাকমা ভাষায় বলা হয় ‘চৈইত মাজ’ আর বৈশাখ মাসকে বলা হয় ‘বোজেক মাজ’। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে চাকমা গ্রামে গ্রামে চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই ঘরে ঘরে সবাই ব্যস্ত হতে থাকে। বিশেষ করে ঘরের কর্ত্রীরা পরিস্কার-পরিচ্ছনতার কাজে তৎপর হয়ে ওঠেন। জামা-কাপড়, ঘর-দোর, উঠোন, বাড়ির চারপাশ পরিস্কার করেন। এছাড়া ঘরের আসবাবপত্র, থালা-বাসনসহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিজুর আগেই ধুয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন রাখেন গৃহকর্ত্রী বা মেয়েরা। 

এভাবেই বিজু চৈত্রের মাঝ থেকেই জানান দেয় চাকমা গ্রামে বা মহল্লায়। পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহি খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হয়। ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা, পোর খেলা, বলিখেলায় মেতে ওঠে চাকমাপড়া। এছাড়াও গান, নাচ ও কবিতা আবৃত্তি হয়। অতীতে গেংখুলিদের চাকমা গীতি কবির সুরে মুখর হয়ে উঠতো চাকমা গ্রামগুলো। উভগীতের সুরের ছন্দে টালমাটাল হয়ে উঠতো পাহাড়ী জনপদ। বিজু উৎসবের প্রথম দিনটি ‘ফুল বিজু’। এদিন শিশু-কিশার-কিশোরিরা ঘুম থেকে উঠে ফুল তুলতে যায় পাহাড় টিলা, বন-বাদাড় বা গ্রামে গ্রামে। ভাতজরা ফুল বা বেইফুল ছাড়া বিজু জমে ওঠে না। বিজুর সময় ফোটে বলে একে বিজু ফুলও বলা হয়। ফুল বিজুর দিন সবাই সকাল সকাল ¯œান সেরে পরিপাটি হয়ে নেয়। তারপর মালা গেঁথে ফুলে ফুলে ঘর সাজানো হয়। সকালে নদীতে কিংবা ছড়ায় ফুল ভাসানো হয়। নদীর দেবতাকে প্রণাম জানানো হয়। ঘরের দুয়ারে, উঠোনে, গোয়ালে ও নদীর ঘাটে জ্বালানো হয় সান্ধ্যপ্রদীপ। শুধু ফুল বিজুর দিন নয়, মূল বিজু ও গোজ্জ্যা পোজ্জ্যাতেও সান্ধ্যপ্রদীপ জ্বালানো হয়। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ বছরের শেষ দিনটি হলো মূল বিজু। এদিন হলো বর্ষবিদায়ের উৎসব। ঘরে ঘরে নানা খাবারের আয়োজন করা হয়। তবে পাজন তরকারি প্রতি ঘরে থাকবেই। নানা পদের সবজি দিয়ে পাজন রান্না করা হয়। হরেক রকম পিঠা তৈরি করা হয়। ছোট ছেলেমেয়েরা মূল বিজুর দিন খুব ভোরে নদীতে কিংবা ছড়ায় ডুব দিয়ে কাল্পনিক বিজুগুলো খুঁজতে থাকে। তারপর গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে মোরগ-মুরগীর জন্য উঠানে ধান ছিটিয়ে দিয়ে আসে।  এদিন গৃহস্থরা অতিথিদের আপ্যায়ন করে। পাজন আর নানা প্রকার পিঠার সঙ্গে থাকে নানা প্রকার পানীয়। জগরা, কাঞ্জি ও দুচোয়ানি পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করে তারা। দলবেঁধে এপাড়া থেকে ওপাড়ায় ঘুরে ঘুরে বিজু খাওয়া হয়। দিন শেষে মাঝরাত অবধি চলে তরুণ-তরুণীদের ক্লান্তিহীন নাচ-গান ও রেঙওচাক (উল্লাসধ্বনি) মাতিয়ে রাখে চাকমা জনপদ। পহেলা বৈশাখ হলো গড়িয়ে গড়িয়ে থাকার দিন। মূল বিজুর দিন খাওয়া-দাওয়া আনন্দ করার পর শেষ দিনটি হলো গড়াগড়ি খাওয়ার দিন। এদিন গুরুজনদেরকে প্রণাম করে ছোটরা আশীর্বাদ নেয়। নদী, ছড়া বা কুয়ো থেকে পানি তুলে প্রবীনদের ¯œান করানো হয়। কেউ কেউ আধ্যাতিœক সাধনার জন্য বিকেলে কিয়াংএ চলে যান। এ সময় চাকমাদের বিজু উৎবকে কেন্দ্র করে নানা কবিতা, গান ও নাটক করা হয়। এই উৎসবে যারা ঢাকা শহর কিংবা অন্য কোন স্থানে পড়াশোনা বা পেশার জন্য অবস্থান করেন তারাও চলে আসেন নিজ গ্রামে। সার্বজনীনভাবে এই উৎসবটি পলিত হয়। পাহাড়ি বাঙালিরা একসঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করেন এমন আদিম বৈচিত্রের আমুদে আয়োজন।  

মন্তব্য: